বিষয়বস্তুতে চলুন

চিত্রা/সিন্ধু পারে

উইকিসংকলন থেকে

সিন্ধু পারে।

পউষ প্রখর শীতে জর্জ্জর, ঝিল্লি-মুখর রাতি;
নিদ্রিত পুরী, নির্জ্জন ঘর, নির্ব্বাণ দীপ-বাতি।
অকাতর দেহে আছিনু মগন সুখ নিদ্রার ঘোরে-
তপ্ত শষ্যা প্রিয়ার মতন সোহগে ঘিরেছে মোরে।
হেনকালে হায় বাহির হইতে কে ডাকিল মোর নাম,—
নিদ্রা টুটিয়া সহসা চকিতে চমকিয়া বসিলাম।


তীক্ষ্ণ শাণিত তীরের মতন মর্ম্মে বাজিল স্বর,—
ঘর্ম্ম বহিল ললাট বাহিয়া রোমাঞ্চ কলেবর।
ফেলি আবরণ, ত্যজিয়া শয়ন, বিরল-বসন বেশে
দুরু দুরু বুকে খুলিয়া দুয়ার বাহিরে দাঁড়ানু এসে।
দূর নদীপারে শুন্য শ্মশানে শৃগাল উঠিল ডাকি,
মাথার উপরে কেঁদে উড়ে গেল কোন্ নিশাচর পাখী।
দেখিনু দুয়ারে রমণীমুরতি অবগুণ্ঠনে ঢাকা,—
কৃষ্ণ অশ্বে বসিয়া রয়েছে, চিত্রে যেন সে আঁকা।
আরেক অশ্ব দাঁড়ায়ে রয়েছে পুচ্ছ ভুতল চুমে,
ধূম্রবরণ, যেন দেহ তার গঠিত শ্মশান ধূমে।
নড়িল না কিছু আমারে কেবল হেরিল আঁখির পাশে,
শিহরি শিহরি সর্ব্ব শরীর কঁপিয়া উঠিল ত্রাসে।
পাণ্ডু আকাশে খণ্ড চন্দ্র হিমানীর গ্লানি মাখা;
পল্লবহীন বৃদ্ধ অশথ শিহরে নগ্ন শাখা।
নীরব রমণী অঙ্গুলি তুলি দিল ইঙ্গিত করি’-
মন্ত্রমুগ্ধ অচেতন সম চড়িনু অশ্ব’ পরি।
বিদ্যুৎবেগে ছুটে যায় ঘোড়া,বারেক চাহিনু পিছে,
ঘরদ্বার মোর বাষ্প সমান, মনে হল সব মিছে।
কাতর রোদন জাগিয়া উঠিল সকল হৃদয় ব্যেপে,
কণ্ঠের কাছে সুকঠিন বলে কে তারে ধরিল চেপে।


পথের দুধারে রুদ্ধ দুয়ারে দাঁড়ায়ে সৌধ সারি,
ঘরে ঘরে হায় সুখ শয্যায় ঘুমাইছে নরনারী।
নির্জ্জন পথ চিত্রিতবৎ, সাড়া নাই সারা দেশে।
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে।
শুধু থেকে থেকে ডাকিছে কুকুর সুদুর পথের মাঝে,—
গম্ভীর স্বরে প্রাসাদ শিখরে প্রহর ঘণ্টা বাজে।


অফুরান পথ, অফুরান রাতি, অজানা নূতন ঠাঁই,
অপরূপ এক স্বপ্ন সমান, অর্থ কিছুই নাই।
কি যে দেখেছিনু মনে নাহি পড়ে, ছিল নাকো আগা গোড়া,—
লক্ষ্যবিহীন তীরের মতন ছুটিয়া চলেছে ঘোড়া।
চরণে তাদের শব্দ বাজে না, উড়ে নাকো ধূলিরেখা,
কঠিন ভূতল নাই যেন কোথা, সকলি বাষ্পে লেখা।
মাঝে মাঝে যেন চেনা চেনা মত মনে হয় থেকে থেকে,—
নিমেষ ফেলিতে দেখিতে না পাই কোথা পথ যায় বেঁকে।
মনে হল মেঘ, মনে হল পাখী, মনে হল কিশলয়,
ভাল করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে এ কি প্রাসাদের সারি? অথবা তরুর মূল?
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারি মনের ভুল?

মাঝে মাঝে চেয়ে দেখি রমণীর অবগুণ্ঠিত মুখে,—
নীরব নিদয় বসিয়া রয়েছে, প্রাণ কেঁপে ওঠে বুকে!
ভয়ে ভুলে যাই দেবতার নাম, মুখে কথা নাহি ফুটে;
হুহু রবে বায়ু বাজে দুই কানে ঘোড়া চলে যায় ছুটে’!


চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি,
পূর্ব্বদিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি।
জনহীন এক সিন্ধু পুলিনে অশ্ব খামিল আসি,—
সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি’।
সাগরে না শুনি জল কলরব না গাহে উষার পাখী,
বহিল না মৃদু প্রভাত পবন বনের গন্ধ মাখি।
অশ্ব হইতে নামিল রমণী, আমিও নানি নীচে,
আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে।
ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তস্ত পরে,
কনক শিকলে সোনার প্রদীপ জ্বলিতেছে থরে থরে।
ভিত্তির কায়ে পাষাণ মূর্ত্তি চিত্রিত আছে কত
অপরূপ পাখী, অপরূপ নারী, লতাপাতা নানা মত।
মাঝখানে আছে চাঁদোয়া খাটানো, মুলা ঝালরে গাঁথা,—
তারিতলে মণি-পালঙ্ক পরে অমল শয়ন পাতা।

তারি দুই ধারে ধূপধার হতে উঠিছে গন্ধধুপ,
সিংহবাহিনী নারীর প্রতিমা দুই পাশে অপরূপ।
নাহি কোনো লোক, নাহিক প্রহরী, নাহি হেরি দাস দাসী।
গুহাগৃহতলে তিলেক শব্দ হয়ে উঠে রাশি রাশি।
নীরবে রমণী আবৃত বদনে বসিলা শয্যাপরে,
অঙ্গুলি তুলি ইঙ্গিত করি’ পাশে বসাইল মোরে।
হিম হয়ে এল সর্ব্ব শরীর শিহরি উঠিল প্রাণ;—
শোণিত প্রবাহে ধ্বনিতে লাগিল ভয়ের ভীষণ তান।


সহসা বাজিয়া বাজিয়া উঠিল দশ দিকে বীণা বেণু,
মাথার উপরে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িল পুষ্প রেণু।
দ্বিগুণ আভায় জ্বলিয়া উঠিল দীপের আলোক রাশি,—
ঘোমটা ভিতরে হাসিল রমণী মধুর উচ্চ হাসি।
সে হাসি ধ্বনিয়া ধ্বনিয়া উঠিল বিজন বিপুল ঘরে,—
শুনিয়া চমকি ব্যাকুল হৃদয়ে কহিলাম যোড় করে,—
“আমি যে বিদেশী অতিথি, আমায় ব্যথিয়ো না পরিহাসে,
কে তুমি নিদয় নীরব ললনা কোথায় আনিলে দাসে”!


অমনি রমণী কনক দণ্ড আঘাত করিল ভূমে,
আঁধার হইয়া গেল সে ভবন রাশি রাশি ধূপ ধূমে।

বাজিয়া উঠিল শতেক শঙ্খ হুলু কলরব সাথে,—
প্রবেশ করিল বৃদ্ধ বিপ্র ধান্য দুর্ব্বা হাতে।
পশ্চাতে তার বাঁধি দুই সার কিরাত নারীর দল
কেহ বহে মালা, কেহবা চামর, কেহ বা তীর্থ জল।
নীরবে সকলে দাঁড়ায়ে রহিল,—বৃদ্ধ আসনে বসি
নীরবে গণনা করিতে লাগিল গৃহতলে থড়ি কসি’।
আঁকিতে লাগিল কত না চক্র, কত না রেখার জাল,
গণনার শেষে কহিল, “এখন হয়েছে লগ্ন কাল!”
শয়ন ছাড়িয়া উঠিলা রমণী বদন করিয়া নত,
আমিও উঠিয়া দাঁড়াইনু পাশে মন্ত্র-চালিত মত!
নারীগণ সবে ঘেরিয়া দাঁড়াল একটি কথা না বলি,
দোঁহাকার মাথে ফুলদল সাথে বরষি লাজাঞ্জলি।
পুরোহিত শুধু মন্ত্র পড়িল আশিষ করিয়া দোঁহে,—
কি ভাষা কি কথা কিছু না বুঝি, দাড়ায়ে রহিনু মোহে।
অজানিত বধু নীরবে সঁপিল–শিহরিয়া কলেবর–
হিমের মতন মোর করে, তার তপ্ত কোমল কর।
চলি গেল ধীরে বৃদ্ধ বিপ্র;—পশ্চাতে বাঁধি সার
গেল নারীদল মাথায় কক্ষে মঙ্গল-উপচার।
শুধু এক সখী দেখাইল পথ হাতে লয়ে দীপখানি,—
মোরা দোঁহে পিছে চলিনু তাহার, কারো মুখে নাহি বাণী!

কত না দীর্ঘ আঁধার কক্ষ সভয়ে হইয়া পার
সহসা দেখিনু সমুখে কোথায় খুলে গেল এক দ্বার।
কি দেখিনু ঘরে কেমনে কহিব হয়ে যায় মনোভুল,
নানা বরণের আলোক সেথায়, নানা বরণের ফুল।
কনকে রজতে রতনে জড়িত বসন বিছানো কত!
মণি বেদিকায় কুসুম শয়ন স্বপ্ন-রচিত মত।
পাদপীঠ পরে চরণ প্রসারি’ শয়নে বসিলা বধূ–
আমি কহিলাম–“সব দেখিলাম, তোমারে দেখিনি শুধু”!


চারিদিক হতে বাজিয়া উঠিল শত কৌতুক হাসি!
শত ফোয়ারায় উছসিল যেন পরিহাস রাশি রাশি।
সুধীরে রমণী দুবাহু তুলিয়া,–অবগুণ্ঠন খানি
উঠায়ে ধরিয়া মধুর হাসিল মুখে না কহিয়া বাণী।
চকিত নয়ানে হেরি মুখপানে পড়িনু চরণ তলে–
“এখানেও তুমি জীবন দেবতা”! কহিনু নয়ন জলে!
সেই মধুমুখ, সেই মৃদুহাসি সেই সুধাভরা আঁখি–
চির দিন মোরে হাসল কাঁদাল, চির দিন দিল ফাঁকি!
খেলা করিয়াছে নিশি দিন মোর সব সুখে সব দুখে,
এ অজানাপুরে দেখা দিল পুন সেই পরিচিত মুখে!

অমল কোমল চরণ কমলে চুমিনু বেদনাভরে–
বাঁধা না মানিয়া ব্যাকুল অশ্রু পড়িতে লাগিল ঝরে’;–
অপরূপ তানে ব্যথা দিয়ে প্রাণে বাজিতে লাগিল বাঁশি।
বিজন বিপুল ভবনে রমণী হাসিতে লাগিল হাসি।
২০ শে ফাল্গুন,
১৩০২।

সম্পূর্ণ।