চিদ্বিলাস/বেদান্তদর্শন

উইকিসংকলন থেকে
পরিভ্রমণে চলুন অনুসন্ধানে চলুন
বেদান্তদর্শন।

 মহর্ষি বেদব্যাস বেদান্তসূত্রের রচয়িতা। একমাত্র শ্রুতির উপরই বেদান্ত দর্শনের ভিত্তি সংস্থাপিত। প্রত্যক্ষ, অনুমান ও উপমান নিকৃষ্ট প্রমাণ বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে। মহর্ষি জৈমিনির কৃত দর্শনেরও মূল শ্রুতি। এই নিমিত্ত জৈমিনিদর্শনকে পূর্ব্ব মীমাংসা কহে, এবং বেদান্ত দর্শনকে উত্তর মীমাংসা কহে। জৈমিনি সমগ্র শ্রুতি হইতে কেবল কর্ম্মতত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু বেদব্যাস তাহা হইতে কেবল মাত্র অদ্বৈত ব্রহ্মতত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন। তিনি বলেন যে, সমস্ত শ্রুতি বলিতেছেন কেবল একমাত্র ব্রহ্মই আছেন তদতিরিক্ত অন্য কিছুই নাই—একমেবাদ্বিতীয়ং। সাংখ্যকার পুরুষ ও প্রকৃতি রূপ দুইটি তত্ত্ব দেখিয়াছেন, পতঞ্জলিও দ্বৈতবাদী, ন্যায় বৈশেষিকও দ্বৈতবাদী, জৈমিনিও দ্বৈতবাদী কারণ তিনি কার্য্য ও কারণ স্বীকার করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু বেদান্ত বলেন দুই নাই, ভেদ নাই; সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, সমস্তই ব্রহ্ম। বেদান্তের ন্যায় আর জ্ঞান নাই, ইহাই চরম জ্ঞান।

  এক্ষণে এই বেদান্ত সম্বন্ধে রামানুজ ও শঙ্করাচার্য্যের মত ভিন্নরূপে বর্ণিত হইতেছে।

রামানুজস্বামীর মত।
বিশিষ্টাদ্বৈত বাদ।

 রামনুজ বলেন যে ব্রহ্ম বিশেষণ যুক্ত; কিন্তু এই বিশেষণ ব্রহ্ম হইতে ভিন্ন নহে। গুণ কখনও গুণীকে ছাড়িয়া পৃথকভাবে থাকিতে পারে না, গুণ ও গুণীর নিত্য অভেদ। ব্রহ্মই ভোগ্য, ভোক্তা ও নিয়ামকরূপে বিদ্যমান রহিয়াছেন। ভোগ্যবস্তু জড় এবং ভোক্তা ও নিয়ামক চৈতন্য। কিন্তু জড়ের কোনও পৃথক্ সত্ত্বা নাই। জড়ত্ব ব্রহ্মের একটি বিশেষণ মাত্র—ব্রহ্ম জগৎ বিশিষ্ট।

 ব্রহ্মের গুণ বা বিশেষণ নিত্য। কিন্তু এই গুণের কখনও বা স্থূল প্রকাশ হয়, আবার কখনও বা গুণ সূক্ষ্ম সত্ত্বারূপে অবস্থিত থাকে। যখন এই গুণের স্থূল প্রকাশ হয় তখনই সৃষ্টি ও স্থিতি আবার যখন গুণ স্থূলভাব পরিহার পূর্ব্বক সূক্ষ্ম সত্ত্বারূপে পরিণত হয় তখনই জগতের লয়। একটি উপমা যেমন কূর্ম্ম ইচ্ছা করিলে তাহার সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রকাশিত করিতে পারে, আবার সঙ্কুচিত করিয়া দর্শকের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত ও করিতে পারে। গুণই ক্রিয়ার উৎপত্তি করে, গুণই তাহার স্থিতি ও পরিবর্ত্তন করে, এবং গুণই ক্রিয়াকে কারণে লয় করে। অতএব গুণ নিত্য।

 ইনি বলেন ব্রহ্মেতে বিশেষণ থাকিলে ব্রহ্ম দূষিত হয়েন না। যদিও বিশেষণের স্থূল প্রকাশ ও সূক্ষ্ম সত্ত্বা এই দুই অবস্থা-ভেদ হয়, কিন্তু তাহাতে ব্রহ্মের ভেদ হয়না। বস্তুর প্রকাশ-ভেদ হইলেই যে বস্তুর ভেদ হয় এরূপ বলা যায় না। আমি কার্য্য করি বা নিদ্রা যাই তাহাতে আমার কিছু মাত্র ভেদ হইল না, আমি যাহা তাহাই রহি। ব্রহ্ম যখন ইচ্ছা দ্বারা নিজেতেই জগৎ উৎপাদন করেন অথবা যখন ইচ্ছা দ্বারা নিজেতেই সেই জগতের লয় করেন ইহার কোন স্থলেই ব্রহ্মের ভেদ হইল না; ব্রহ্ম যাহা ছিলেন তাহাই রহিলেন। অনন্ত শক্তিধর যিনি, তিনি সেই শক্তি প্রকাশই করুন আর নাই করুন, তিনি বা শক্তি ইহার কখনও অভাব বা পার্থক্য ঘটবে না।

 শ্রুতিতে নির্গুণ, নির্ব্বিশেষ, প্রভৃতি যে সমস্ত বাক্য আছে, রামানুজ তাহার অন্য প্রকার ব্যাখ্যা করেন। নির্গুণ শব্দে গুণ নাই বা নির্ব্বিশেষ শব্দে তাঁহার বিশেষণ নাই এরূপ অর্থ করেন না। তিনি বলেন নির্গতো বিশেষঃ যম্মাৎ তৎ ইতি নির্গুণং, অর্থাং যাঁহা হইতে বিশেষণ নির্গত হইয়াছে ইত্যাদি। এরূপ অর্থ ব্যাকরণ বিরুদ্ধ নহে; বস্তুতঃ শ্রুতি কি ভাবে এই সকল বাক্য ব্যবহার করিয়াছেন তাহা ঠিক করিয়া কেহই বলিতে পারেন না। যাঁহার যেরূপ বোধ হয় তিনি সেইরূপই ব্যাখ্যা করেন।

 রামানুজ বলেন যে ব্রহ্মের বিশেষণ স্বীকার না করিলে সমস্ত জগৎ মিথ্যা হইয়া যায়, বেদ মিথ্যা হইয়া যায়, সমস্ত ধর্ম্ম ও কর্ম্ম মিথ্যা হইয়া যায়, মতামত সমস্তই ভাসিয়া যায়, অর্থাৎ এ সমস্ত কিছুই নাই এইরূপ হয়। যে ব্যক্তি ঘোরতর কুক্রিয়াসক্ত তাহার সহিত মহাজ্ঞানীরও কোন প্রভেদ থাকে না, কারণ উভয়ই মিথ্যা। ইহা অতি ভয়ানক ব্যাপার।

 দ্বিতীয়তঃ সমস্ত শাস্ত্রই বলেন এবং বেদান্তও বলেন যে ব্রহ্ম সাক্ষাৎকারই মুক্তি। কিন্তু যদি বিশেষণ না থাকে তবে কিসেরই বা ব্রহ্ম আর কিসেরই বা সাক্ষাৎকার হইবে?

 তৃতীয়তঃ ব্রহ্ম নির্ব্বিশেষ হইলে তাঁহাতে কোন প্রকার প্রমাণই ব্যবহৃত হইবে না; এবং তাহা হইলে ব্রহ্মতত্ত্ব থাকাও যাহা না থাকাও তাহা হইয়া উঠে।

 রামানুজ বলেন যে জীব যখন সাধন দ্বারা অনন্যাভক্তি লাভ করেন তখন তাঁহার মুক্তি লাভের দ্বারা উন্মুক্ত হয় এবং ঐ ভক্তিই তাহাকে মুক্তিদান করে।

শঙ্করাচার্য্যের মত।
বিশুদ্ধাদ্বৈত বাদ।

 শ্রীমচ্ছঙ্করাচার্য্য বলেন ব্রহ্মই সমস্ত; তাঁহার কোনও গুণ বা বিশেষণ নাই। উপনিষদে যে নির্গুণ, নিষ্কিয়, নিরাকার, নির্ব্বিশেষ প্রভৃতি বাক্য আছে ইনি সে সকলের এইরূপ অর্থ করেন যে নির্‌ নাস্তি গুণং যস্য তৎ নির্গুণং ইত্যাদি অর্থাৎ যাঁহার কোন গুণ নাই, রূপ নাই, বিশেষণ নাই ইত্যাদি।

 পক্ষান্তরে শ্রুতিতে অনেক স্থলে ব্রহ্মকে সগুণ, ক্রিয়াবান, সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের কর্ত্তা বলা হইয়াছে। শ্রীমৎশঙ্করাচার্য্য এই দুই ভিন্ন মতের সামঞ্জস্য করিয়া বলেন যে শ্রুতিতে যে যে স্থলে ব্রহ্মকে নির্গুণ, নির্ব্বিশেষ, নিরাকার, নির্ব্বিকার ইত্যাদি ভাবে ব্যক্ত করা হইয়াছে তাহাই যথার্থ-তত্ত্ব, তাহাই পারমার্থিক সত্য; এবং যে যে স্থানে তাহাকে সগুণ, ক্রিয়াবান ইত্যাদি বলা হইয়াছে তাহা যথার্থতত্ত্ব নহে, সেগুলি ব্যবহারিকভাবে বলা হইয়াছে। তিনি বলেন যে শ্রুতির পারমার্থিক অংশ নির্গুণ বিদ্যা এবং ব্যবহারিক অংশ সগুণ বিদ্যা। জ্ঞানীদিগের পক্ষে নির্গুণ বিদ্যা এবং অজ্ঞানী দিগের পক্ষে সগুণ বিদ্যা; অর্থাৎ যতক্ষণ অজ্ঞান থাকে ততক্ষণই সগুণ বিদ্যা থাকে যখনই অজ্ঞানের নাশ হয় তখনই নির্গুণ বিদ্যা। অজ্ঞানী নির্গুণ বিদ্যার অধিকারী নহে; তাঁহাকে সগুণ বিদ্যা অবলম্বন পূর্ব্বক জ্ঞানমার্গে আরোহন করিতে হইবে; এবং যখন তিনি জ্ঞানলাভ করিবেন তখন সূর্য্য উদয়ে অন্ধকারের ন্যায় নির্গুণ বিদ্যা তাঁহার নিকট হইতে দূরে চলিয়া যাইবে। জ্ঞান শব্দে ব্যবহারিক জ্ঞান বুঝায় না। ব্রহ্ম ব্যবহারিক জ্ঞানগম্য নহেন কারণ তিনি “অবাঙ্‌ মনসো গোচরং” বাক্য ও মন দ্বারা তাঁহার উপলব্ধি হয় না। “যতো বাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ,” “বিজ্ঞাতম্ অবিজানতাম্”, “অবিজ্ঞাতম্ বিজানতাম্” ইত্যাদি দ্বারা তিনি মন ও বুদ্ধির অতীত ইহা বলা হইতেছে; “নেতি নেতি” বলিয়া তাঁহাকে সমস্ত বিশেষণের অবর্ণনীয় বলা হইতেছে। অতএব আমরা যখন বাহ্য বা অন্তর্জগতের অস্তিত্বজ্ঞানশূন্য হইব তখনই ব্রহ্মের অপরোক্ষানুভূতি হইবে,—তিনি স্বপ্রকাশ।

 এস্থলে ভগবান বাহ্ব ও রাজা বাস্কলির উপাখ্যন বর্ণিত হইতেছে। একদিন রাজা বাস্কল ভগবান বাহ্বকে বারম্বার ব্রহ্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেন; কিন্তু বাহ্ব কিছুমাত্রও উত্তর করিলেন না। কিন্তু পুনঃ পুনঃ রাজা প্রশ্ন করার পর বাহ্ব বলিলেন “আমি উত্তর দিয়াছি, তুমি বুঝিতে পার নাই; শান্তোঽয়মাত্মা”। বস্তুতঃ বাক্য দ্বারা ব্রহ্মতত্ত্ব আলোচনা বাতুলের প্রয়াস মাত্র। এবং পরিচ্ছিন্ন বুদ্ধি দ্বারা ব্রহ্মকে জানিতে চেষ্টা করা মরীচিকাতে জলের প্রত্যাশা করার ন্যায় বিড়ম্বনা মাত্র। তবে সগুণ বিদ্যা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন নহে, ইহা দ্বারা সাধকের চিত্তশুদ্ধি হয়।

 সৃষ্টিতত্ত্ব—এক্ষণে শঙ্করাচার্য্য সৃষ্টি সম্বন্ধে কি বলেন তাহা বর্ণিত হইতেছে। শ্রুতিতে কোন স্থানে আছে “যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে যেন জাতানি জীবন্তি যৎ প্রযন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাস্য”। অর্থাৎ ব্রহ্ম হইতে জগৎ সৃষ্টি হইতেছে, ব্রহ্ম দ্বারাই জগতের স্থিতি হইতেছে, ব্রহ্মতেই সমস্ত লয় হইতেছে ইত্যাদি। আবার কোথায়ও আছে “সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” “একমেবাদ্বিতীয়ং” ইত্যাদি; অর্থাৎ সমস্তই ব্রহ্ম, ব্রহ্মাতিরিক্ত কিছুই নাই। এস্থলেও ব্যবহারিক ও পারমার্থিক ভেদ রহিয়াছে। যতদিন আমাদের অজ্ঞান থাকিবে ততদিন জগৎ থাকিবে এবং যখন অজ্ঞান দূরীভূত হইবে তখন জগতের সত্ত্বাও থাকিবেনা। যখন অজ্ঞানের অভাবে জগতের অভাব হয় তখন অজ্ঞান বা অবিদ্যাই জগতের কারণ। অবিদ্যা যে কখন আসিল তাহার সীমা নাই; অতএব অবিদ্যা অনাদি। আবার জ্ঞানের উদয় হইলে অবিদ্যার নাশ হয়, অতএব অবিদ্যা সান্ত। অবিদ্যার আবরণ ও বিক্ষেপ নামে দুইটি শক্তি আছে। আবরণ শক্তি সত্যকে আচ্ছন্ন করে এবং বিক্ষেপ শক্তি তাহাকে অন্য ভাবে প্রকাশ করে। রজ্জুতে যে সর্পভ্রম হয় তাহা এইরূপ;—অজ্ঞান প্রথমে আবরণ শক্তি দ্বারা আমাদের রজ্জুর বোধকে আচ্ছন্ন করে এবং পরে বিক্ষেপ শক্তি দ্বারা তাহাকে সর্পরূপে প্রকাশ করে। সেইরূপ অজ্ঞান প্রথমে ব্রহ্মকে বা আত্মাকে আবরণ করে ও পরে তাঁহাতেই প্রপঞ্চ জগতের বোধ করায়। এই অনাত্মাকে আত্মজ্ঞান অযথার্থকে যথার্থজ্ঞান, ব্রহ্মতে জগৎ জ্ঞান, আত্মাতে কর্ত্তৃত্ত্ব, ভোক্তৃত্ব ইত্যাদি জ্ঞানের নাম অধ্যাস। সুখ, দুখ, রাগ, দ্বেষ, কর্ম্মফল,জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি সমস্তই অধ্যাস বশতঃ ঘটিয়া থাকে। বস্তুতঃ আত্মজ্ঞান হইলে এ সমস্ত কিছুই থাকে না। ব্রাহ্মণত্ব, ক্ষত্রিয়ত্ব, শাস্ত্র, অশাস্ত্র, পাপ, পুণ্য, ভাল, মন্দ সমস্তরই অবসান হয়, কারণ সকলই অধ্যাসমূলক।

 এক্ষণে প্রশ্ন হইতে পারে যে সত্যেতে মিথ্যার ন্যায় আলোকেতে অন্ধকারের ন্যায় আত্মাতে কিরূপে অবিদ্যার সম্ভব হয়। তদুত্তরে শঙ্কর একটিমাত্র উপমা দিয়াছেন। দিবাভাগে প্রচণ্ড সূর্য্যালোক থাকে, তখন আলোকের কিছুমাত্র অভাব থাকে না, পরন্তু পেচক তখন দেখিতে পায় না। অতএব যেরূপ আলোকেতেও অন্ধকারের কার্য্য করে, সেইরূপ আত্মাতেও অবিদ্যার কার্য্য হয়। আবার প্রশ্ন হইতে পারে যে যখন অবিদ্যাই আমাদের মোহ ও সমস্ত অনর্থের কারণ তখন আত্মা কি জন্য অবিদ্যাকে আশ্রয় করেন? তাহার উত্তরও শঙ্কর কেবলমাত্র একটি উপমাদ্বারা দিয়াছেন; বালকগণ অনেক সময় তাহাদের নিজের হানিকর ব্যাপারে আসক্ত হয়, তাহারা এমন কি তাহাদিগের গুরুজন দিগের আদেশ ও উপদেশ পর্য্যন্ত লঙ্ঘন করে; আবার অনেকে স্বাস্থ্যহানি হইবার আশঙ্কা থাকিলেও নিমন্ত্রনে যাইয়া ভূরিপরিমাণ ভোজন করেন, রাত্রি জাগরণ ইত্যাদি করিয়া থাকেন; অতএব আমরা যে জানিয়া শুনিয়া নিজের অনিষ্টকর বিষয়ে আসক্ত হই ইহা সপ্রমাণ হইল। আবার প্রশ্ন হইতে পারে যখন “সর্ব্বং খল্বিদং ব্রহ্ম” তখন অবিদ্যা কাহার এবং কিরূপেই বা সম্ভবে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে শঙ্কর একটি মাত্র উত্তর দিতেছেন; তিনি বলেন এ সমস্ত আবার প্রশ্ন কি? ইহার আবার বিচার কি? যে বিষয় সহজে অনুভব হয় না তাহারই জন্য ত বিচার আবশ্যক; কিন্তু যখন কোন বিষয় সততই এবং স্বভাবতঃই বোধগম্য হয়, তখন আবার তাহার সম্বন্ধে বিচারের কি আবশ্যক! নিজের অনুভবকেই যদি বিশ্বাস না কর তবে আবার তর্ক কিসের জন্য? তর্কতো নিজের অনুভব সিদ্ধির জন্যই করা হয়? তবে অনুভবই প্রধান। তুমি নিজেই অনুভব করিতেছ যে তুমি অজ্ঞান, তুমি মোহাচ্ছন্ন; তবে অজ্ঞান কাহার, অজ্ঞান কিরূপে সম্ভব, কেন অজ্ঞানকে আশ্রয় করিলাম, ইত্যাদি প্রশ্ন কিজন্য করিতেছ? এরূপ অবস্থায় এ সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠিতেই পারে না। যদি বল সমস্ত সময়ে নিজে যাহা অনুভব করি তাহা ঠিক হয় না, অতএব তাহা সত্য কি অসত্য প্রমাণের জন্য তর্ক আবশ্যক; তাহার উত্তরে আমি বলি যে তোমার অনুভব যে ঠিক তাহা তুমি ঠিক বুঝিতেছ, ইহা তোমার বুদ্ধিতে পৌঁছিয়াছে, অতএব এ সম্বন্ধে তর্কের আবার কি প্রয়োজন? যখন অজ্ঞান আছে ইহা নিশ্চয় বুঝিলে তখন তাহার কারণ কি তাহা স্থির হউক বা না হউক তাহাতে কিছুই আসে যায় না। চৌর যখন চুরী করিয়া পলায়ন করে তখন সে চৌর কি না, তাহার উদ্দেশ্য কি, সে কেন চুরী করে ইত্যাদি বিচারের কিছুই আবশ্যকতা নাই। চুরী যে হইল তাই ঠিক, অতএব যাহাতে চুরী না হয় বা যাহাতে চৌর চুরী করিয়া পলাইতে না পারে সেইরূপই ব্যবস্থা করা উচিত। অজ্ঞান কি? অজ্ঞান কেন? অজ্ঞানের কি প্রকারে সম্ভব? এ সমস্ত প্রশ্ন পরিত্যাগ পূর্ব্বক যাহাতে অজ্ঞানের নাশ হয় তৎপ্রতিকার করাই সমীচিন। আর এ সম্বন্ধে অধিক কি বলিব যখন চৈতন্যে অজ্ঞানের অনুভব হইতেছে তখন বুঝিতে হইবে চৈতন্য ও অজ্ঞান পরস্পর বিরোধী নহে, কিন্তু যখন তত্ত্বজ্ঞান উদিত হইবে, তখন সেই জ্ঞান অজ্ঞানকে দূর করিবে। সেই তত্ত্বজ্ঞানই কেবল অজ্ঞানের বিরোধী।

 অবিদ্যা বা মায়া যে আছে তাহা আমরা যখন অজ্ঞান অবস্থায় থাকি তখনই বোধ করি; তখন ইহার আদি কোথায় তাহার বোধ হওয়াও অসম্ভব; অতএব অবিদ্যা বা মায়া আমাদিগের নিকট অনাদি বলিয়াই বিবেচিত হয়। কিন্তু জ্ঞান যেখানে আছে মায়া সেখানে নাই অতএব তত্ত্বদৃষ্টিতে মায়ার অস্তিত্ব নাই। যুক্তি দৃষ্টিতে বা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে অবিদ্যা সদসৎ অনির্বাচ্য, কিন্তু পরমার্থ দৃষ্টিতে মায়া মিথ্যা। যতক্ষণ মিথ্যাকে সত্য বলিয়া বোধ থাকিবে ততক্ষণই বন্ধন, আর যে মাত্র তত্ত্বদৃষ্টি দ্বারা মিথ্যাকে মিথ্যা বুঝিব তখনই মোক্ষ।
বেদান্ত দর্শন।
সাধন তত্ত্ব।

 বেদান্ত শাস্ত্র বলেন যে সাধক যে কোন মার্গই অবলম্বন করুন না কেন সকলেরই ফল চিত্তশুদ্ধি। সমস্ত শাস্ত্রই বলেন যে কর্ম্মফলই জন্ম মৃত্যুর কারণ এবং তাহারই নাম বন্ধন। জন্ম মৃত্যুর অতীত হইতে হইলে কর্ম্মের শেষ হওয়া আবশ্যক। কৃত কর্ম্মের ফল অবশ্যই আমাদিগকে ভোগ করিতে হইবে; অতএব তজ্জন্য নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্ত অনুষ্ঠান আবশ্যক। কিন্তু পুনর্ব্বার যাহাতে কর্ম্মফল উৎপন্ন না হয় এইজন্য সমস্ত কাম্যকর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে হইবে, এবং সমস্ত প্রকার নিষিদ্ধ কর্ম্মও ত্যাগ করিতে হইবে। কারণ যে সমস্ত কর্ম্মে শুভ বা অশুভ ফল হয় সে সমস্তই জন্মের কারণ। পরন্তু নিত্য, নৈমিত্তিক, ও প্রায়শ্চিত্তরূপ কর্ম্ম দ্বারা পূর্ব্ব সঞ্চিত ফলের নাশ হয়—তাহাতে নূতন ফল সঞ্চিত হয় না। অপরদিকে মনেতে যে কর্ম্মের বীজ থাকে তাহার ধ্বংসের জন্য উপাসনা করা আবশ্যক। শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনের দ্বারা চিত্ত স্থিরতা লাভ করে। চিত্ত স্থির না হইলে তাহাতে সত্য বস্তু প্রতিফলিত হয় না এবং চিত্ত স্থির না হইলে তাহাতে কর্ম্মের মূল বাসনা থাকিয়া যায়। অতএব উপাসনা অবশ্য কর্ত্তব্য। এইরূপে সাধন করিলে সাধক চারিটি অমূল্য রত্ন লাভ করিবেন যথা—আত্মানাত্ম বস্তুবিবেক, ইহামুত্রফলভোগবিরাগ, শম, দম, উপরতি, তিতিক্ষা, সমাধান ও শ্রদ্ধা এই ষট্‌ সম্পত্তি, এবং মুমুক্ষুত্ব।

 যখন কি সত্য এবং কি মিথ্যা, অর্থাৎ যখন আত্মার স্বরূপ বোধ হয় তখনই আত্মানাত্ম বস্তুবিবেক সিদ্ধ হয়। যখন সাধক ইহকালের সর্ব্বপ্রকার সুখ লাভের ইচ্ছা ত্যাগ করেন এবং যখন পরকালের স্বর্গ ইত্যাদি ভোগের বাসনা ত্যাগ করেন তখন তাঁহার ইহামুত্রফলভোগবিরাগ সিদ্ধ হয়। শম শব্দে শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ও তদনুকুল সমস্ত বিষয় ভিন্ন অপরাপর সমস্ত বিয়য় হইতে মনের নিবৃত্তি বুঝায়; অর্থাৎ সাধক যখন উপাসনা এবং তাহার জন্য যে সমস্ত বহিরঙ্গ সাধন আবশ্যক তদতিরিক্ত অপর কোন বিষয়কে মনেতে স্থান দেন না তখনই তাঁহার শম সিদ্ধ হয়। সাধনের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ বিষয় ব্যতীত অন্যান্য বিষয় হইতে সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রামকে সাধক যখন নিবৃত্ত করেন তখন তাঁহার দম সিদ্ধ হইল। সাধক যখন সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন পূর্ব্বক সমস্ত শাস্ত্রোক্ত কাম্য কর্ম্ম পরিত্যাগ করেন তখনই তাঁহার উপরতি সিদ্ধ হইল। সন্ন্যাস কাহাকে বলে তাহা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে ভালরূপে বুঝাইয়াছেন। তিনি বেশ ভাল করিয়া বলিয়াছেন যে অন্তরে সন্ন্যাস ভাব না আসিলে কেবল বাহিরে সন্ন্যাসী হইলে বিড়ম্বনা মাত্র—তাহা মিথ্যাচারমাত্র। অতএব সমস্ত প্রকার শাস্ত্রীয় কর্ম্মত্যাগের পূর্ব্বে সাধক যেন ভাল করিয়া দেখেন যে তাঁহার মনে কোন প্রকার বাসনা আছে কিনা? কারণ মনে মনে বাসনা করিলেই যথার্থরূপে কর্ম্ম বন্ধন হয়; মনই সমস্ত কর্ম্ম করে শরীর একটা উপাদান কারণমাত্র। যথার্থ সন্ন্যাস যখন মনেতে উপস্থিত হয় তখনই উপরতি সিদ্ধ হয়। যখন শীত, উষ্ণ, সুখ, দুঃখ, নিন্দা, স্তুতি, ভাল, মন্দ, মান, অপমান প্রভৃতি কিছুতেই সাধকের চিত্ত বিক্ষেপ উপস্থিত করিবে না তখনই তাঁহার তিতিক্ষা সিদ্ধ হইবে; তিতিক্ষা শব্দের অর্থ দ্বন্দ্ব-সহিষ্ণুতা। শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ও তদনুকূল বিষয়ে মনের একাগ্রতার নাম সমাধান। গুরুবাক্য ও শাস্ত্র (বেদান্ত) বাক্যে বিশ্বাস করার নাম শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা না থাকিলে কিছুই হয় না। শ্রদ্ধা প্রথম হইতেই আবশ্যক, ইহাই মুক্তির মূল। সাধক যখন শম দমাদি সিদ্ধ হইবেন তখন তাঁহার ষট্ সম্পত্তি লাভ হইবে। মুমুক্ষুত্ব শব্দে মোক্ষের ইচ্ছা বুঝায়। অল্পের মধ্যে বেদান্তোক্ত সাধন বিষয়ে কিছু কিছু বলা হইল। মোক্ষকাম ব্যক্তি গুরু ও শাস্ত্র আশ্রয় করিলেই সমস্ত রহস্য বুঝিতে পারিবেন। ওঁ তৎসৎ ওঁ