চিদ্বিলাস/মীমাংসা দর্শন

উইকিসংকলন থেকে
মীমাংসা দর্শন।

 মহর্ষি জৈমিনি কর্ম্মকেই সর্ব্বপ্রধান বলিয়া স্বীকার করেন। অপরাপর দার্শনিকের মতে কর্ম্ম কর্ত্তার অধীন; কিন্তু জৈমিনি তাহা স্বীকার করেন না। কারণ ব্যতীত কোন কার্য্য হয় না; অতএব কর্ত্তৃত্বেরও কারণ আছে। যাহা একের কর্ত্তা তাহা আবার আর একটির কর্ম্ম। এইরূপে ধারাবাহিকরূপে একটি কর্ম্মস্রোত চলিতেছে। জৈমিনির মতে কর্ত্তৃত্ব কর্ম্মস্রোতের একটি অংশ বা অবস্থা বিশেষ।

 কর্ম্ম হইতেই সকলের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় হয়; কিন্তু সংসারের বিনাশ নাই, ইহা এই ভাবেই চলিয়া আসিতেছে এবং এই ভাবেই চলিয়া যাইবে। প্রতিক্ষণেই নদীর জলের পরিবর্ত্তন হইতেছে কিন্তু নদী যেমন চির দিনই বহিতেছে, সেইরূপ প্রতিক্ষণে এক কর্ম্মের উৎপত্তি, স্থিতি ও লয় ও অপর কর্ম্মের উৎপত্তি হইতেছে; এই কর্ম্মধারার বিরাম নাই বা শেষ নাই। কর্ম্ম হইতেই সুখ, দুঃখ, ভয়, উন্নতি, অবনতি, বদ্ধতা, মুক্তি, গুরুত্ব, ঈশ্বরত্ব প্রভৃতি উৎপন্ন হইতেছে; বস্তুতঃ এ সমস্তই কর্ম্মের রূপান্তর মাত্র।

 মহর্ষি জৈমিনি শব্দ প্রমাণ বা বেদকেই সর্ব্বপ্রধান প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করেন। প্রত্যক্ষ প্রমাণকে তন্নিম্ন স্থান দান করেন, এবং অনুমান ও উপমানকে প্রত্যক্ষের অধীন বলিয়া থাকেন। ইনি বলেন যে আমাদিগের ইন্দ্রিয় দ্বারা সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান লাভ হয় না; আবার যাহা কিছু অণুমান করিব তাহা সমস্তই প্রত্যক্ষের অপেক্ষা রাখে, এবং উপমার প্রত্যক্ষ না হইলে উপমান হয় না। অতএব শব্দই শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।

 জৈমিনির বেদের প্রাধান্য স্বীকারের মধ্যে একটু বিশেষত্ব আছে। ইনি বলেন বেদ যে সকল কর্ম্ম অনুষ্ঠান করিতে বলিতেছেন আমাদিগের তাহা অবশ্য কর্ত্তব্য, এবং বেদে যে সমস্ত মন্ত্র আছে তাহা আমাদিগের সাধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু মন্ত্রাদিতে বর্ণিত কোনও ঈশ্বর বা দেবতা বা পিতৃপুরুষ আমাদিগের কর্ম্মফলদাতা বলিয়া কল্পনা করা উচিত নহে, কারণ সে কল্পনা আমাদিগের মানসিক ব্যাপার মাত্র, তাহা বেদবিহিত নহে। ইনি বলেন মন্ত্রের নিমিত্তই মন্ত্র এবং যজ্ঞাদি কর্ম্মের নিমিত্তই যজ্ঞ; ঐ মন্ত্র ও যজ্ঞই কর্ম্মীকে শুভাশুভ ফল দান করিয়া থাকে। ইনি বলেন বেদ-কথিত বর্ণাশ্রম ধর্ম্মপালনই কর্ত্তব্য, তদ্বিপরীতাচরণে প্রত্যবায় হয়।

 অপরাপর দার্শনিকগণ যেরূপ অপবর্গ বা মুক্তি সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন মহর্ষি জৈমিনি সেরূপ কিছুই করেন নাই। অপরাপর দার্শনিক কর্ম্মের শেষ স্বীকার করেন কিন্তু ইনি তাহা করেন না। এই স্থলেই ইহাঁর মতের সহিত অপরাপর দর্শনের মতের পার্থক্য রহিয়াছে।

ওঁ তৎ সৎ ওঁ