চূর্ণ প্রতিমা/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 ইন্‌স্পেক্টার বাবু জহরলালকে লইয়া যাইবার পর, আমি হরিশ বাবুকে বলিলাম “মহাশয়। কিছুদিন পূর্ব্বে নফয়ের দোকানে পূর্ব্ববঙ্গের এক জমীদার পুত্রকন্যা লইয়া পুতুল কিনিতে গিয়াছিল। কিছুক্ষণ দোকানে থাকিবার পর জমীদার মহাশয়ের কন্যার গলার হারের একখানি ধুক্‌ধুকি হারাইয়া যায়। ধুক্‌ধুকিখানি সোণার ছিল কিন্তু তাহাতে একখানি খুব দামী হীরা বসান ছিল। সম্ভবতঃ হীরাখানি ভাল করিয়া বসান ছিল না। অনেক অনুসন্ধানের পর ধুক্‌ধুকিখানি পাওয়া গেল বটে, কিন্তু হীরাখানি পাওয়া গেল না।

 জমীদার মহাশয় তখন থানায় খবর দিলেন। যথাসময়ে পুলিস আসিল। চারিদিক অন্বেষণ করা হইল, কিন্তু হীরাখানি কোথাও পাওয়া গেল না। কাজেই নফর ও তাহার কারিগর গুলিকে থানায় চালান দেওয়া হইল। সেখানে সকলের কাপড়- চোপড় বেশ করিয়া খোঁজা হইল, কিন্তু হীরাখানি কাহারও নিকট হইতে বাহির হইল না।

 অনেক অনুসন্ধানের পরও যখন হীরা পাওয়া গেল না, তখন লোকগুলিকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। নফর ও তাহার আর আর কারিগর থানা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আগেকার মত কাজ করিতে লাগিল, কেবল এই জহরলাল বাড়ী ফিরিয়া আসিয়া একেবারে উন্মাদ হইয়া গেল।

 হরিশবাবু আমার কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঐ লোকটা কি নফরের কারিগর?”  আ। হাঁ।

 হ। হঠাৎ পাগল হইবার কারণ কি?

 আ। আমি প্রথমে মনে করিয়াছিলাম যে, জহরলাল আর কখনও থানায় যায় নাই। ভয়ে ও লজ্জায় হয়ত সে পাগল হইয়া গিয়াছে,—লোকটা ভাবিয়া ভাবিয়া পাগলের মত হইয়া গিয়াছে। নতুবা সে একেবারে উন্মাদ পাগল হয় নাই।

 ই। এমন কি দুশ্চিন্তা যে, তাহাতে একজন সুস্থ লোককে অতি সামান্য সময়ের মধ্যে পাগল করিয়া ফেলিল?

 আ। সে কথা এখনও সাহস করিয়া বলিতে পারি না। যদি প্রমাণ করিতে পারি, তবেই একথা জানিতে পারিবেন। এখন আপনি যদি থানায় যাইতে ইচ্ছা করেন, আমার সহিত আসিতে পারেন।

 হ। আপনি কি এখনই থানায় যাইবেন?

 আ। আগে একবার বাড়ী যাইব। সেখান হইতে আমার পুতুলটা লইয়া থানায় যাইব।

 হ। পুতুল লইয়া যাইবার কারণ কি?

 আ। থানায় গিয়া সকলের সমক্ষে উহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিব।

 হ। কেন?

 আ। সে কথা এখন বলিব না। যদি আমার সঙ্গে যান, তাহা হইলে স্বচক্ষে দেখিতে পাইবেন।

 হরিশ বাবু আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া একখানি গাড়ী তৈয়ার করিতে হুকুম দিলেন। গাড়ী দরজায় আসিলে আমরা তাহাতে উঠিলাম।

 আমার বাড়ীর দরজায় গাড়ী থামিলে, আমি গাড়ী হইতে নামিয়া বাড়ীর ভিতর গমন করিলাম, হরিশ বাবু গাড়ীর ভিতর বসিয়া রহিলেন।

 পুতুলটী আমার শোবার ঘরে রাখিয়াছিলাম। সেখানে গিয়া দেখিলাম, পাড়ায় জন কতক লোক সেই প্রতিমাখানি দেখিতে আসিয়াছে। আমায় দেখিয়া সকলেই সরিয়া গেল। আমিও প্রতিমা লইয়া সেখান হইতে বাহির হইলাম।

 প্রায় আধ ঘণ্টার পর আমরা পুলিসে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, ইন্‌স্পেক্টর বাবু জহরলালকে হাজত-ঘরে রাখিয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছেন। আমাদিগকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “আমি ভাবিয়াছিলাম, আজ রাতে আর আপনারা কষ্ট করিয়া এখানে আসিবেন না।”

 আমি বলিলাম, “আমরা সাহেবের বাড়ী যাইতেছি। আপনার সহিত এখানে দেখা করিব বলিয়াছিলাম, সেইজন্যই এখানে আসিয়াছি, এখন চলিলাম।”

 এই বলিয়া পুলিস হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময়ে ইন্‌স্পেক্টার বাবু বলিলেন, “আমি আপনাদের সঙ্গে যাইতে ইচ্ছা করি।”

 আমি সম্মত হইলাম, এবং তিনিজনে সেই প্রতিমাখানি লইয়া সাহেবের নিকট গমন করিলাম। সাহেবের তখন আহারাটি শেষ হইয়া গিয়াছে। তিনি একটা প্রকাণ্ড দালানে একখানি আরাম চৌকির উপর শুইয়া চুরুট সেবন করিতেছিলেন। সেই রাত্রে আমাদের তিনজনকে দেখিয়া তিনি প্রথমত আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন, পরে সহাস্যমুখে বসিতে বলিলেন।

 আমি তাঁহার নিকট বসিয়া প্রথমে আমার সঙ্গী দুইজনের পরিচয় দিলাম, এবং তাঁহাদিগকে সেখানে লইয়া যাইবার উদ্দেশ্যও প্রকাশ করিলাম। পরে বলিলাম, “কিছুদিন পূর্ব্বে আপনি পার্ব্বতীচরণ নামে পূর্ব্ববঙ্গের এক জমীদারের একখানি দামী হীরার সন্ধানে নিযুক্ত করিয়াছিলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমি তাহার সন্ধান পাইয়াছি।”

 সাহেব প্রথমে আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। পরে হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায়?”

 আমি কালী প্রতিমাখানি দেখাইয়া উত্তর করিলাম, “ইহারই মধ্যে।”

 সাহেব আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন। আগ্রহের সহিত বলিলেন, “কই? বাহির কর দেখি?”

আমি তখন মনে মনে কালীমাতার নাম স্মরণ করিয়া প্রতিমাখানি চুর্ণ করিয়া ফেলিলাম। সেই চূর্ণগুলি একখানি শিলার উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে গুঁড়াইতে লাগিলাম। তখনই হীরাখানি বাহির হইয়া পড়িল। আমি তুলিয়া লইয়া ভাল করিয়া পরিষ্কার জলে ধুইয়া ফেলিলাম। দেখিলাম, পাথরখানি দামী বটে। পার্ব্বতীচরণ যে দর বলিয়াছিল, আমার বিবেচনায় তদপেক্ষা অধিক।

 দেখিয়া সাহেব, হরিশ বাবু ও ইন স্পেক্টর বাবু স্তম্ভিত হইলেন। কিছুক্ষণ তাঁহাদের কাহারও মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না।

 কিছুক্ষণ পরে সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোন সূত্র ধরিয়া আপনি এ রহস্য ভেদ করিলেন?”

 আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “সেই কথাবলিবার জন্যই এত রাত্রে আপনার নিকট আসিয়াছি। জহরলাল যে কি ভয়ানক লোক, তাহা আপনারা শুনিলে আশ্চর্য্যান্বিত হইবেন। জহরলালই হীয়াখানি কুড়াইয়া পাইয়াছিল। ধুকধুকিখানা যখন গলা হইতে মাটীতে পড়িয়া যায়, তখন হীরাখানি খুলিয়া নিশ্চয়ই জহরলালের টুলের পায়ার নিকট গড়াইয়া গিয়াছিল। জহরলাল সকলের অলক্ষ্যে সেখানি কুড়াইয়া লইয়া, সে যে মাটী দিয়া পুতুল গড়িতে ছিল, সেই মাটির ভিতর লুকাইয়া ফেলিল। সেই হীরা সমেত পুতুর গড়িয়াছিল।” সুতরাং দোকান-ঘর খুঁজিয়া তোলপাড় করিলেও হীরা পাওয়া যায় নাই। সৌভাগ্যক্রমে আমি এই প্রতিমাখানি কিনিয়াছিলাম। সেই জন্য ইহা প্রাপ্ত হইতে বিশেষ কষ্ট করিতে হইল না।”

 সাহেব বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেমন করিয়া জানিলেন যে, জহরলাল এ কাজ করিয়াছে?”

 আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “জহরলাল যেদিন প্রথম থানা হইতে মুক্তি পায়, সেই দিন বাড়ীতে ফিরিয়াই পাগল হইয়া যায়। যখন তাহাকে দেখিতে যাই, তখন আমি কৌশলে হীরার কথা ফেলিয়াছিলাম। কিন্তু হীরার নাম শুনিবামাত্র সে অজ্ঞান হইয়া পড়ে। আমি প্রথমে তাহাকে পাগল মনে করিয়াছিলাম, কিন্তু যখন দেখিলাম যে, সে তাহার প্রস্তুত শেষ ছয়খানি কালীমূর্ত্তি ভাঙ্গিবার জন্ম এইরূপ পাগলাম করিয়া বেড়াইতেছে, তখনই আমার সন্দেহ হইল যে, সে নিশ্চয়ই হীরাখানি কুড়াইয়া পাইয়া ছিল এবং এই পুতুলের মাটির সঙ্গে রাখিয়াছিল। সকল পুতুলই এক প্রকার, সুতরাং কোনটি সেই হীরা সমেত মাটি দিয়া গঠিত, তাহা জানিতে না পারিয়া, একে একে সকলগুলিই ভাঙ্গিতে লাগিল।

 সা। যেগুলি বিক্রয় হইয়াছিল, তাহার সন্ধান পাইলে কিরূপে?

 আ। পাঁচখানি প্রতিমার বায়না দেওয়া ছিল। সকলেই অগ্রিম দাম দিয়াছিল। যে খাতায় সেই সকল লোকের নাম ধাম লেখা আছে, তা জহরলাল জানিত, এর মধ্যে মধ্যে সেও উহাতে লিখিয়া থাকিত।

 স। কয়খানি প্রতিমা প্রস্তুত হইয়াছিল?

 আ। ছয়খানি। তাহার মধ্যে পাঁচখানির মূল্য আগেই দেওয়া হইয়াছিল, অবশিষ্ট একখানি আমি কিনিয়া লইলাম।

 সা। আপনার পুতুলের মধ্যেই যে হীরা আছে, তাহা কি করিয়া জানিলেন?

 আ। যখন জহরলাল পাঁচখানি ভাঙ্গিয়া পায় নাই, তখন নিশ্চয়ই বুঝিলাম, ইহার মধ্যে আছে।

 স। অপরগুলিতে পায় নাই, আপনি কি রকমে জানিতে পারিলেন।

 আ। যখন সে হরিশ বাবুর বাড়ীর পুতুলটি ভাঙ্গিতে আসে, তখন যে সে অপর চারিখানিতে পায় নাই, তাহা নিশ্চয়।

 সা। ঠিক কথা। জহরলাল বড় চতুর লোক। পাগলের ভাণ করিয়া অনেকবার অব্যাহতি পাইয়াছে।

 আ। পাগলের ভাণ বলা যায় না। কারণ সময়ে সময়ে সত্য সত্যই উহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া যায়। তখন ও কি করে, কি বলে, কিছুই জ্ঞান থাকে না। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সে ভাল থাকে। পাগলের মন ঠিক থাকে না, জহরলাল মন ঠিক করিয়া স্বহস্ত-নির্ম্মিত শেষ পুতুল ছয়টি ভাঙ্গিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া ছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি ও ছাড়া পায়, তাহা হইলে কোন না কোন দিন এই প্রতিমা ভাঙ্গিবার জন্য আমার বাড়ীতে যাইত। যদিও আমি নগদ মূল্য দিয়া কিনিয়াছি, সুতরাং আমার নাম ধাম কোনস্থানে লেখা নাই, তবুও জহরলাল কোন না কোন কৌশলে আমার সন্ধান বাহির করিত। দোকানের দুই একজন লোক ও নফর নিজে আমার নাম এখন বেশ জানে।

 লাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্ত্তা হইবার পর, আমরা সেই স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম।

 এবারে জহরকে আর পরিত্রাণ দেওয়া হইল না। মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট তাহাকে বিচারার্থ প্রেরণ করা হইল। ফলে প্রমাণ-প্রয়োগ গ্রহণ করিয়া ও আমার নিকট সমস্ত কথা শুনিয়া, এখন জহরলাল প্রকৃত পাগলে পরিণত হইয়াছে কি না, তাহা জানিবার নিমিত্ত, উহাকে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে রাখিলেন। প্রায় ১৫ দিবস পয়ে ডাক্তার সাহেব উহাকে পাগল বলিয়া স্থির করিলেন। সুতরাং জহরলাল পাগলা গারদে গমন করিল। পার্ব্বতী বাবু তাঁহার হীরা পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন। আমার কথাও শেষ হইল।


বৈশাখ মাসের সংখ্যা

“মদের গেলাস”

বা

“অদ্ভূত হত্যা-রহস্য”

যন্ত্রস্থ।