চূর্ণ প্রতিমা/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 বাসায় গিয়া পুতুল দুইটী নিজের শোবার ঘরে রাখিলাম। যেখানে থাকিলে প্রাতে শয্যা হইতে উঠিবার সময় প্রতিমাগুলিকে দেখিতে পাওয়া যাইবে, শ্যামা ও শিবমূর্ত্তিকে ঘরের সেইখানেই রাখা হইল। বাড়ীর সকলে সে প্রতিমা দুখানি দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়াছিল।

 বেলা দুইটার পর আমি আফিসে যাইলাম। সেখানে সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করিলাম। দীর্ঘ শ্মশ্রু, সুদীর্ঘ জটা, খালি গা, গায়ে ভস্মরাশি, হাতে ও গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

 এইরূপে ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া ঠিক, সন্ধ্যার পর আমি সিকদার পাড়ায় হাজির হইলাম। গলিতে প্রবেশ করিয়া তিন চারিখানি বাড়ী পার হইয়া, একখানি মুদির দোকান দেখিতে পাইলাম। হিন্দুস্থানী ভাষায় কথাবার্ত্তা কহা আমার খুব অভ্যাস আছে। আমি মুদীর সম্মুখে হিন্দীতে নানা রকম অনেক দেব-দেবীর নাম উচ্চারণ করিয়া, কবিতা পাঠ করিয়া তাহার মন আকর্ষণ করিলাম। মুদী ভক্তি করিয়া আমায় একটা পয়সা দিতে আসিল, আমি উহা লইলাম না—কহিলাম, আমি কাহারও দান গ্রহণ করি না। এই কথায় আমার উপর মুদীর আরও ভক্তি হইল। কিছুক্ষণ পরে সে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুরজী! আমায় হাঁপানির একটা ওষুধ দিতে পারেন?”

 আমি বলিলাম, “হাঁপানি এক রকম নয়। অনেক রকমের হাঁপানি আছে। সকল রকম হাঁপানির ঔধধ আমার কাছে নাই। এক রকম ঔষধ আছে মাত্র।”

 মু। আমাকে সেই ঔষধই দিন। আমার অদষ্টে যাহা হয় হউক। আর একটা কথা আছে।

 আ। কি কথা বল?

 মু। আপনার কাছে পাগলের ওবুধ আছে?

 আ। খুব ভাল রকম ঔধধ আছে। কেন বল দেখি?

 মু। আমাদের পাড়ার একটা লোক হঠাৎ পাগল হইয়া গিয়াছে। বেচারা একদিনের মধ্যে উন্মাদ পাগল। বাপকে দাঁত ও নখ দিয়া ক্ষত বিক্ষত করিয়াছে। যদি আপনার কাছে ওষুধ থাকে, দয়া করিয়া একবার তাহাদের বাড়ীতে যাইবেন কি?

 আ। সে তোমার কে?

 মু। বন্ধু। ছেলেবেলা হইতে এক জায়গায় বাস। তা ছাড়া, জহরের মত লোক আজকাল দেখা যায় না।

 আ। তবে চল। তোমার বন্ধুর নাম তবে জহর?

 মু। আজ্ঞে হাঁ।

 এই বলিয়া দোকানে একটা লোককে বসাইয়া মুদী আমার আগে আগে চলিল। আমি তাহার অনুসরণ করিলাম। কিছুদূর যাইবার পর মুদী একখানি ক্ষুদ্র একতলা বাড়ীতে প্রবেশ করিল, এবং অতি যত্নের সহিত আমাকে ভিতরে লইয়া গেল। সন্ন্যাসীর বেশ দেখিয়া পথে কেহ কোন কথা কহিল না।

 বাড়ীর ভিতর গিয়া দেখিলাম, একজন বৃদ্ধ একখানি ঘরের দরজায় বসিয়া তামাক সেবন করিতেছে। একতলা হইলেও বাড়ীখানি বেশ উঁচু। বাড়ীর ভিতরে তিনখানি ঘর, বাহিরেও তিনখানি ঘর। ভিতরে একখানি রান্নাঘর, অপর দুইখানি শোবার ঘর। শুনিলাম, সে দুইখানি ঘরে জহর ও তাহার ভাই পান্না থাকে। বৃদ্ধকে বাহিরে থাকিতে হয়। তাহার অনেক দিন পূর্ব্বে স্ত্রী-বিয়োগ হইয়াছে। দুইটী পুত্রবধূ তাহার সংসারের আকল কাজই করিয়া থাকে।

 বৃদ্ধ আমাকে দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিত হইল। বলিল, “কি ঠাকুর, একেবারে অন্দরে যে? ব্যাপার কি?”

 আমি কোন উত্তর করিবার আগেই মুদী বৃদ্ধকে বাধা দিয়া বলিল, “ও কি করেন জ্যেঠা মশায়! আমি এঁকে ডাকিয়া আনিয়াছি। ইহাঁর নিকট পাগলের খুব ভাল ওষুধ আছে, জহরকে দেখাইতে আনিয়াছি।”

 মুদীর কথা শুনিয়া বৃদ্ধের মুখ মলিন হইয়া গেল। সে ভাবিল, আমি বুঝি সত্য সত্যই দেবতা—তাহার পুত্ত্রকে আরোগ্য করিবার জনা তাহার বাড়ীতে আসিয়াছি। সে আগে অতি বিনীতভাবে ভূমিষ্ট হইয়া আমায় প্রণাম করিল, পরে বলিল, “ঠাকুর, আমি না জানিয়া আপনাকে রূঢ় কথা বলিয়াছি। আমার অপরাধ মার্জ্জনা করুন। আমার ছেলেটী হঠাৎ পাগল হইয়া গিয়াছে, তাহাকে আরোগ্য করিয়া দিন। আমার এই দুই পুত্র ছাড়া আর কেহ নাই, দেখিবেন, এই বৃদ্ধবয়সে যেন পুত্রশোক পাইতে না হয়।”

 এই কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ কাঁদিয়া ফেলিল। বৃদ্ধের অবস্থা দেখিয়া আমার দয়া হইল। বলিলাম, “তুমি কাঁদিতেছ কেন? তোমার পুত্ত্র আরোগ্য লাভ করিবে। আমি আজই একটা ঔষধ দিয়া যাইতেছি। চল, তোমার পুত্ত্র কোথায় আছে দেখিয়া আসি।”

 বৃদ্ধ আমাকে লইয়া যে ঘরে তাহার পুত্ত্র ছিল, সেই ঘরের দ্বারে আসিল। বলিল, আমি আর ভিতরে যাইব না। আপনি ঘরের ভিতরে যান্‌।”

 বৃদ্ধের কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমিও কেন আমার সঙ্গে চল না?”

 বৃ। না মহাশয়! আমায় দেখিলে জহর আরও ক্ষেপিয়া উঠে। কি জানি, আমার উপর তাহার এত আক্রোশ কেন হইল।

 আ। আমার সঙ্গে আইস। আমি কাছে থাকিলে তোমায় কিছু বলিবে না। জহর কি কেবল তোমায় দেখিলেই রাগান্বিত হয়?

 বৃ। আজ্ঞে হাঁ। আরও অনেক লোক জহরকে দেখিতে আসিয়াছিল; কিন্তু জহর তাহাদিগের উপর কোনরূপ অত্যাচার করে নাই; বরং তাহাদের সহিত ভাল রকমে কথাবার্ত্তা কহিয়াছিল।

 আ। তুমি কি জহরকে কোন কথা বলিয়াছিলে?

 বৃ। যেদিন জহর থানা হইতে মুক্তি পাইয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিল, সেই দিন আমি তাহার নিকট হইতে সংসার-খরচের টাকা চাহিয়াছিলাম। এই আমার অপরাধ।

 আ। জহর ত নফরের দোকানে চাকরি করে; কত টাকা বেতন পায়?

 বৃ। বেতন কিছুই নাই। যত কাজ করে যেই মত টাকা পায়।

 আ। কেবল জহরের টাকাতেই কি তোমার সংসার চলিতেছে?

 বৃ। আজ্ঞে না। আমার ছোটছেলেও প্রেসে কাজ করে। তাহার বেতন কুড়ি টাকা। সেও সমস্ত টাকা আমার হাতে দেয়।

 আ। তোমার নিজের কোন আয় আছে?

 বৃ। এই বৃদ্ধবয়সে কোথায় চাকরী করিব বলুন, আর কেই বা আমায় এ বয়সে চাকরি দিবে?

 আ। এ বাড়ীখানি কার?

 বৃ। আজ্ঞা আমার।

 আ। তোমার কেনা বাড়ী?

 বৃ। আজ্ঞা না; আমার পৈতৃক বাড়ী।

 আ। কতদিন এখানে বাস করিতেছ?

 বৃ। তিনপুরুষ।

 বৃদ্ধকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। বৃদ্ধও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল।

 ঘরে গিয়া দেখিলাম, এক যুবক একস্থানে বসিয়া গম্ভীরভাবে কি ভাবিতেছে। যুবকের বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাহাকে দেখিতে শ্যামবর্ণ ও শীর্ণ। তাহার চক্ষু কোটরগ্রস্ত, দেখিলেই বোধ হয়, লোকটা নেশাখোর। তাহার পরিধানে একখানি ময়লা কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল ন॥ তাহার হাত পা লৌহশিকলে আবদ্ধ।

 আমাকে দেখিয়াই সে দাঁড়াইয়া উঠিল এবং আমার নিকট আসিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু পদদ্বয় শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকায় সহজে আসিতে পারিল না। আমি অনেক পাগল দেখিয়ছি, পাগলের মেজাজ আমার বেশ জানা আছে। তাহাদের সহিত রূঢ় ব্যবহার না করিলে তাহারা বশীভূত হয় না। আমি জহরকে নিকটে আসিতে চেষ্টা করিতে দেখিয়া, অতি কর্কশভাবে বলিলাম, “যেখানে আছ, সেইথানেই থাক; আমার কাছে আসিবার চেষ্ট। করিও না। আমি সংসারী নহি যে, তোমায় দেখিয়া ভয় পাইব। আমি তোমার মত অনেক পাগল আরাম করিয়াছি। যদি আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দাও, তাহা হইলে তুমিও শীঘ্র আরোগ্য হইবে।”

 আমার কথা শুনিয়া জহর আবার বাসয়া পড়িল; কোন কথা কহিল না। সে আপন মনে কখন হাসিতে, কখন কাঁদিতে লাগিল। আমার কিম্বা তাহার পিতার দিকে দৃকপাতও করিল না।

 আমি তখন জহরকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “জহরলাল! আমি তোমার গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।”

 জহর কথা কহিল না; ঘাড় নাড়িয়া উত্তর দিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি হঠাৎ এমন উন্মাদ পাগল হইলে কিসে?”

 এবার জহরের মুখ ফুটিল। সে বলিল, “সেকথা আমি কি করিয়া বলি।”

 একটী উত্তর পাইয়া আমার আনন্দ হইল। ভাবিলাম, যখন একটী কথার উত্তর পাইয়াছি, তখন আর ভাবনা কি? পুনরার জিজ্ঞাসা করিলাম, “অধিক মাদক সেবন করিয়াছ কি?”

 জহর বোধ হয় আমার কথা বুঝিতে পারিল না, আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার মনোগত ভাব বুঝতে পারিলাম। বলিলাম, “অতিরিক্ত নেশা করিয়াছিলে?”

 এবর জহর আমার কথা বুঝিল। বলিল, “না মহাশয়, ভাতের খরচ যোগাইতে পারি না, নেশা করিবার পয়সা কোথায় পাইব?”

 কথা শুনিয়া আমি চমকিত হইলাম। ভাবিলাম, লোকটা যখন এমন কথা বলিতেছে, তখন তাহাকে পাগল বলা যায় না। বৃদ্ধকে বলিলাম, “তোমার পুত্ত্র শীঘ্রই আরোগ্য হইবে। জহর যেরূপভাবে আমার কথার জবাব দিয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, সে পাগল হয় নাই। মস্তিষ্কের কোন রকম গোলযোগ হইয়াছে। তোমার কোন চিন্তা নাই, জহর শীঘ্রই আরোগ্য লাভ করিবে। এখন আমি জহরকে আর গোটাকতক কথ জিজ্ঞামা করিতে চাই। তুমি কাছে থাকিলে সে হয়ত কোন উত্তর দিবে না। তুমি এখন এখান হইতে চলিয়া যাও।”

 বৃদ্ধ প্রস্থান করিলে পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি কাজ কর কোথায় বাপু?”

 অতি শান্তভাবে জহর উত্তর করিল, “আমি নফরের দোকানে কাজ করিতাম।”

 আ। সেখানে আর যাও না কেন?

 জ। আমায় যাইতে দেয় না।

 আ। কে তোমায় যাইতে দেয় না।

 জ। বাড়ীর লোকে।

 আ। কে বাড়ীর লোক? তোমার পিতা?

 জ। না, আর সকলে।

 আ। তোমার ভাই?

 জ। না, আর সকলে।

 আ। তবে আর সকল কে?

 জহর কোন উত্তর করিল না, মুখ টিপিয়া হাসিতে লাগিল। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার স্ত্রী?”

 এক গাল হাসি হাসিয়া জহর উত্তর করিল, “হাঁ।”

 আ। তুমি এখন সেই রকম কাজ করিতে পারিবে?

 জ। বোধ হয় না।

 আ। কেন?

 জ। মাখার ভিতর কেমন একট! গোলযোগ হইয়াছে, কি করিতেছি, কি বলিতেছি, কিছুই আমার মনে নাই। আমার হাত পা সদাই যেন কাঁপিতেছে। হাত ঠিক না হইলে, পুতুল-গড়া হয়না।

 আ। লোকে তোমায় পাগল বলিতেছে, কিন্তু আমার সঙ্গে তুমি যে রকম ভাবে কথা কহিতেছ, তাহাতে আমি পাগলের কোন লক্ষণই দেখিতে পাইতেছি না। মধ্যে মধ্যে ক্ষেপিয়া উঠ কেন?

 জ। কেন বলিতে পারি না। বোধ হয়, আমায় যেন কে মারিতেছে, কে যেন আমায় ধমকাইতেছে, কে যেন আমায় তাড়া করিতেছে। তখন আমি কি করি, কি বলি,আমার জ্ঞান থাকে না।

 আ। তোমার বাপকে যে সেদিন মারিয়া প্রায় খুন করিয়া ফেলিয়াছ। তাহার গায়ের দাগ এখনও তেমনই রহিয়াছে।

 জহরলাল হাসিয়া উঠিল। সে হাসির যেন শেষ নাই; ক্রমাগত এক কোয়াটার ধরিয়া জহরলাল হাসিল। পরে বলিল, “এও কি কখন হয়? ছেলে হইয়া বাপকে মারিবে? না মহাশয়? আপনি আমাকে উপহাস করিবেন না। আপনারা দেবতা—জ্ঞানী পুরুষ হইয়া আমার সঙ্গে তামাসা করিবেন না|”

 আমি আর সেকথা তুলিলাম না। জহরের মন তখন স্থির আছে দেখিয়া, আমি নফরের দোকানের কথা পাড়িবার মতলর করিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি নফরের নিকট হইতে কত টাকা করিয়া বেতন পাইতে?”

 জহর আমার কথায় রাগিয়া গেল। বলিল, “আমি কাহারও মাহিনার চাকর নহি। আমি মাহিনা লইয়া কাজ করিতাম না।”

 আমি বলিলাম, “আমি সে রকম মাহিনার কথা বলি নাই। তুমি মাসে কত টাকা উপায় করিতে এই আমার জিজ্ঞাস্য।”

 জহর উত্তর করিল, “নফর বাবু যদি আমায় যথার্থ উচিতমত মুল্য দিতেন, তাহা হইলে আমার আয় যথেষ্ট হইত। কিন্তু তিনিই আমার ঐ কার্য্যের গুরু, আমি তাঁহারই নিকট হইতে শিক্ষালাভ করিয়াছি। সুতরাং প্রায় অর্দ্ধ মূল্যেই আমায় কার্য্য করিতে হয়। অন্য কোথাও যাইলে আমি দ্বিগুণ উপায় করিতে পারি, কিন্ত বোধ হয়, আমি আর কার্য্য করিতে পারিব না।”

 আ। কত টাকা উপায় কর বলিলে না?

 জ। পঁচিশ ত্রিশ টাকার কম নহে।

 আ। নফরের দোকানে সেদিন কি হইয়াছিল?

 প্রশ্ন শুনিয়া জহর আমার দিকে কট্‌মট্‌ করিয়া চাহিয়া রহিল। সে শূন্য় দৃষ্টি পাগলেরই শোভা পায়। আমার মনে কেমন সন্দেহ হইল, আমিও জহরের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া রহিলাম।

 বোধ হয়, জহর আমার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়াছিল। সে একবার মুখ অবনত করিয়াই, হাসিতে হাসিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিল, “আপনি দেবতা। তাহা না হইলে কিছু হইয়াছিল কি না, কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন? যখন সমস্তই জানেন, তখন আর আমায় জিজ্ঞাসা করেন কেন?”

 আমি সে কথা চাপা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “শুনিলাম, তুমি নফরের সঙ্গে হাজতে গিয়াছিলে; মুক্তিলাভ করিয়া বাড়ী আসিয়াই পাগল হইয়াছ। এ কথা সত্য কি?”

 জ। আজ্ঞা হাঁ!। কিন্ত আপনি সকলই জানেন, মিথ্যা জিজ্ঞাসার দরকার কি?

 অ। হাজতে গিয়াছিলে কেন?

 জ। আর কেন আমায় কষ্ট দেন।

 আ। কষ্ট কি?

 জ। আপনি যখন সকলই জানেন, তখন কেন আমি বকিয়া মরি।

 আ। আমি সামান্য সন্ন্যাসী। বারবার আমার অত সুখ্যাতি করিও না। আমার মনোমধ্যে অহঙ্কার জন্মিতে পারে, যেমন শুনিয়াছি, তেমনই জানি। তুমি যেমন জান, তুমি যেমন বলিতে পারিবে, অপরে তোমার মুখ হইতে শুনিয়া তেমন বলিতে পরিবে না। সেই জন্য তোমার মুখ হইতে শুনিবার আমার এত ইচ্ছা। আছি শুনিয়াছি, একখানি দামী হীরা হারাইয়াছে।

 আমার শেষ কথা মুখ হইছে বাহির হইতে না হইতে জহর এক বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল। পরক্ষণেই সে কাঁপিতে কাঁপিতে শুইয়া পড়িল, সঙ্গে সঙ্গে তাহার জ্ঞানলোপ হইল।

 বৃদ্ধ দৌড়িয়া জহরের নিকট গেল, আমিও তাহার পার্শ্বে বসিয়া মূর্চ্ছা ভাঙ্গাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। একটী যুবতীও ঘোমটা দিয়া সেই ঘরে আসিল, এবং দূর হইভে জহরকে দেখিতে লাগিল।

 প্রায় আধ ঘণ্টার পর জহরের জ্ঞান হইল। সে চক্ষু উন্মীলন করিল। সম্মুখেই আমাকে দেখিতে পাইল। আমার দিকে চাহিয়াই অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিল। হাসি থামিলে সে চুপ করিয়া রহিল—কোন কথার উত্তর দিল না। অনেক লোভ দেখাইলাম, নানা রকম ভয় দেখাইলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। জহরলাল তখন সত্য সত্যই উন্মাদ পাগলের মত ব্যবহার করিতে লাগিল দেখিয়া, আমি বৃদ্ধের নিকট হইতে একটা মাদুলী লইয়া, তাহাতে ঔযধরূপে শুষ্ক বিল্বপত্র দিয়া বৃদ্ধকে ফিরাইয়া দিলাম। তাহার পর আর সেখানে বিলম্ব না করিয়া অফিসের দিকে আসিলাম। অফিসে ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া গৃহে ফিরিলাম।