চোখের বালি/৫২

উইকিসংকলন থেকে

৫২

সমস্ত রাত্রি মহেন্দ্র ঘুমায় নাই—ক্লান্তশরীরে ভোরের দিকে তাহার ঘুম আসিল। বেলা আটটা-নয়টার সময় জাগিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল। গত রাত্রির একটা কোন্ অসমাপ্ত বেদনা ঘুমের ভিতরে ভিতরে যেন প্রবাহিত হইতেছিল। সচেতন হইবা মাত্র মহেন্দ্র তাহার ব্যথা অনুভব করিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ পরেই রাত্রির সমস্ত ঘটনাটা মনে স্পষ্ট জাগিয়া উঠিল। সকালবেলাকার সেই রৌদ্রে, অতৃপ্ত নিদ্রার ক্লান্তিতে সমস্ত জগৎটা এবং জীবনটা অত্যন্ত বিরস বোধ হইল। সংসার-ত্যাগের গ্লানি, ধর্মত্যাগের গভীর পরিতাপ এবং এই উদ্‌ভ্রান্ত জীবনের সমস্ত অশান্তিভার মহেন্দ্র কিসের জন্য বহন করিতেছে। এই মোহাবেশ-শূন্য প্রভাতরৌদ্রে মহেন্দ্রের মনে হইল, সে বিনোদিনীকে ভালোবাসে না। রাস্তার দিকে সে চাহিয়া দেখিল, সমস্ত জাগ্রত পৃথিবী ব্যস্ত হইয়া কাজে ছুটিয়াছে। সমস্ত আত্মগৌরব পঙ্কের মধ্যে বিসর্জন দিয়া একটি বিমুখ স্ত্রীলোকের পদপ্রান্তে অকর্মণ্য জীবনকে প্রতিদিন আবদ্ধ করিয়া রাখিবার যে মূঢ়তা, তাহা মহেন্দ্রের কাছে সুস্পষ্ট হইল। একটা প্রবল আবেগের উচ্ছ্বাসের পর হৃদয়ে অবসাদ উপস্থিত হয়; ক্লান্ত হৃদয় তখন আপন অনুভূতির বিষয়কে কিছুকালের জন্য দূরে ঠেলিয়া রাখিতে চায়। সেইভাবের ভাঁটার সময় তলের সমস্ত প্রচ্ছন্ন পঙ্ক বাহির হইয়া পড়ে, যাহা মোহ আনিয়াছিল তাহাতে বিতৃষ্ণা জন্মে। মহেন্দ্র যে কিসের জন্য নিজেকে এমন করিয়া অপমানিত করিতেছে, তাহা সে আজ বুঝিতে পারিল না। সে বলিল, ‘আমি সর্বাংশেই বিনোদিনীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তবু আজ আমি সর্বপ্রকার হীনতা ও লাঞ্ছনা স্বীকার করিয়া ঘৃণিত ভিক্ষুকের মতো তাহার পশ্চাতে অহোরাত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছি; এমনতরো অদ্ভুত পাগলামি কোন্ শয়তান আমার মাথার মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দিয়াছে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের কাছে আজ একটি স্ত্রীলোকমাত্র, আর কিছুই নহে; তাহার চারি দিকে সমস্ত পৃথিবীর সৌন্দর্য হইতে, সমস্ত কাব্য হইতে, কাহিনী হইতে, যে-একটি লাবণ্যজ্যোতি আকৃষ্ট হইয়াছিল, তাহা আজ মায়ামরীচিকার মতো অন্তর্ধান করিতেই একটি সামান্য নারীমাত্র অবশিষ্ট রহিল―তাহার কোনো অপূর্বত্ব রহিল না।

 তখন এই ধিক্‌কৃত মোহচক্র হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া বাড়ি ফিরিয়া যাইবার জন্য মহেন্দ্র ব্যগ্র হইল। যে শান্তি প্রেম এবং স্নেহ তাহার ছিল তাহাই তাহার কাছে দুর্লভতম অমৃত বলিয়া বোধ হইল। বিহারীর আশৈশব অটলনির্ভর বন্ধুত্ব তাহার কাছে মহামূল্য বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। মহেন্দ্র মনে মনে কহিল, ‘যাহা যথার্থ গভীর এবং স্থায়ী তাহার মধ্যে বিনা চেষ্টায়, বিনা বাধায় আপনাকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করিয়া রাখা যায় বলিয়া তাহার গৌরব আমরা বুঝিতে পারি না; যাহা চঞ্চল ছলনামাত্র, যাহার পরিতৃপ্তিতেও লেশমাত্র সুখ নাই, তাহা আমাদিগকে পশ্চাতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়দৌড় করাইয়া বেড়ায় বলিয়াই তাহাকেই চরম কামনার ধন বলিয়া মনে করি।’


 মহেন্দ্র কহিল, ‘আজই বাড়ি ফিরিয়া যাইব; বিনোদিনী যেখানেই থাকিতে চাহে সেইখানেই তাহাকে রাখিবার ব্যবস্থা করিয়া দিয়া আমি মুক্ত হইব’। ‘আমি মুক্ত হইব’ এই কথা দৃঢ় স্বরে উচ্চারণ করিতেই তাহার মনে একটি আনন্দের আবির্ভাব হইল; এতদিন যে অবিশ্রাম দ্বিধার ভার সে বহন করিয়া আসিতেছিল তাহা হালকা হইয়া আসিল। এতদিন, এই মুহূর্তে যাহা তাহার পরম অপ্রীতিকর ঠেকিতেছিল পরমুহূর্তেই তাহা সে পালন করিতে বাধ্য হইতেছিল; জোর করিয়া ‘না’ কি ‘হাঁ’ সে বলিতে পারিতেছিল না; তাহার অন্তঃকরণের মধ্যে যে আদেশ উত্থিত হইতেছিল বরাবর জোর করিয়া তাহার মুখ চাপা দিয়া সে অন্য পথে চলিতেছিল— এখন সে যেমনি সবেগে বলিল ‘আমি মুক্তিলাভ করিব’ অমনি তাহার দোলা-পীড়িত হৃদয় আশ্রয় পাইয়া তাহাকে অভিনন্দন করিল।

 মহেন্দ্র তখনই শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া মুখ ধুইয়া বিনোদিনীর সহিত দেখা করিতে গেল। গিয়া দেখিল, তাহার দ্বার বন্ধ। দ্বারে আঘাত দিয়া কহিল, “ঘুমাইতেছ কি?

 বিনোদিনী কহিল, “না। তুমি এখন যাও।”

 মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে; আমি বেশিক্ষণ থাকিব না।”

 বিনোদিনী কহিল, “কথা আর আমি শুনিতে পারি না— তুমি যাও, আমাকে আর বিরক্ত করিয়ো না, আমাকে একলা থাকিতে দাও।”

 অন্য কোনো সময় হইলে এই প্রত্যাখ্যানে মহেন্দ্রের আবেগ আরো বাড়িয়া উঠিত। কিন্তু আজ তাহার অত্যন্ত ঘৃণাবোধ হইল। সে ভাবিল, ‘এই সামান্য এক স্ত্রীলোকের কাছে আমি নিজেকে এতই হীন করিয়াছি যে, আমাকে যখন-তখন এমনতরো অবজ্ঞাভরে দূর করিয়া দিবার অধিকার ইহার জন্মিয়াছে। অধিকার ইহার স্বাভাবিক অধিকার নহে। আমিই তাহা ইহাকে দিয়া ইহার গর্ব এমন অন্যায়রূপে বাড়াইয়া দিয়াছি।’ এই লাঞ্ছনার পরে মহেন্দ্র নিজের মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করিবার চেষ্টা করিল। সে কহিল, ‘আমি জয়ী হইব; ইহার বন্ধন আমি ছেদন করিয়া দিয়া চলিয়া যাইব।’

 আহারান্তে মহেন্দ্র টাকা উঠাইয়া আনিবার জন্য ব্যাঙ্কে চলিয়া গেল। টাকা উঠাইয়া আশার জন্য ও মার জন্য কিছু ভালো নূতন জিনিস কিনিবে বলিয়া সে এলাহাবাদের দোকানে ঘুরিতে লাগিল।

 আবার একবার বিনোদিনীর দ্বারে আঘাত পড়িল। প্রথমে সে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর করিল না; তাহার পরে আবার বারবার আঘাত করিতেই বিনোদিনী জ্বলন্ত রোষে সবলে দ্বার খুলিয়া কহিল, “কেন তুমি আমাকে বারবার বিরক্ত করিতে আসিতেছ।”

 কথা শেষ না হইতেই বিনোদিনী দেখিল, বিহারী দাঁড়াইয়া আছে।

 ঘরের মধ্যে মহেন্দ্র আছে কি না, দেখিবার জন্য বিহারী একবার ভিতরে চাহিয়া দেখিল। দেখিল, শয়নঘরে শুষ্ক ফুল এবং ছিন্ন মালা ছড়ানো। তাহার মন নিমেষের মধ্যেই প্রবলবেগে বিমুখ হইয়া গেল। বিহারী যখন দূরে ছিল তখন বিনোদিনীর জীবনযাত্রা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহজনক চিত্র যে তাহার মনে উদয় হয় নাই তাহা নহে, কিন্তু কল্পনার লীলা সে চিত্রকে ঢাকিয়াও একটি উজ্জ্বল মোহিনীচ্ছবি দাঁড় করাইয়াছিল। বিহারী যখন বাগানে প্রবেশ করিতেছিল তখন তাহার হৃৎকম্প হইতেছিল— পাছে কল্পনাপ্রতিমায় অকস্মাৎ আঘাত লাগে এইজন্য তাহার চিত্ত সংকুচিত হইতেছিল। বিহারী বিনোদিনীর শয়নগৃহের দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইবা মাত্র সেই আঘাতটাই লাগিল।

 দূরে থাকিয়া বিহারী এক সময় মনে করিয়াছিল, সে আপনার প্রেমাভিষেকে বিনোদিনীর জীবনের সমস্ত পঙ্কিলতা অনায়াসে ধৌত করিয়া লইতে পারিবে। কাছে আসিয়া দেখিল, তাহা সহজ নহে; মনের মধ্যে করুণার বেদনা আসিল কই। হঠাৎ ঘৃণার তরঙ্গ উঠিয়া তাহাকে অভিভূত করিয়া দিল। বিনোদিনীকে বিহারী অত্যন্ত মলিন দেখিল।

 এক মুহূর্তেই বিহারী ফিরিয়া দাঁড়াইয়া “মহেন্দ্র” “মহেন্দ্র” করিয়া ডাকিল।

 এই অপমান পাইয়া বিনোদিনী নম্র মৃদু স্বরে কহিল, “মহেন্দ্র নাই, মহেন্দ্র শহরে গেছে।”

 বিহারী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তোমার পায়ে ধরি, একটুখানি বসিতে হইবে।”

 বিহারী কোনো মিনতি শুনিবে না মনে করিয়াছিল, একেবারে এই ঘৃণার দৃশ্য হইতে এখনই নিজেকে দূরে লইয়া যাইবে স্থির করিয়াছিল, কিন্তু বিনোদিনীর করুণ অনুনয়স্বর শুনিবা মাত্র ক্ষণকালের জন্য তাহার পা যেন আর উঠিল না।

 বিননাদিনী কহিল, “আজ যদি তুমি বিমুখ হইয়া এমন করিয়া চলিয়া যাও, তবে আমি তোমারই শপথ করিয়া বলিতেছি, আমি মরিব।”

 বিহারী তখন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “বিনোদিনী, তোমার জীবনের সঙ্গে আমাকে তুমি জড়াইবার চেষ্টা করিতেছ কেন। আমি তোমার কী করিয়াছি। আমি তো কখনো তোমার পথে দাঁড়াই নাই, তোমার সুখদুঃখে হস্তক্ষেপ করি নাই।”

 বিনোদিনী কহিল, “তুমি আমার কতখানি অধিকার করিয়াছ তাহা একবার তোমাকে জানাইয়াছি তুমি বিশ্বাস কর নাই। তবু আজ আবার তোমার বিরাগের মুখে সেই কথাই জানাইতেছি। তুমি তো আমাকে না বলিয়া জানাইবার, লজ্জা করিয়া জানাইবার, সময় দাও নাই। তুমি আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়াছ, তবু আমি তোমার পা ধরিয়া বলিতেছি, আমি তোমাকে―”

 বিহারী বাধা দিয়া বলিল, “সে কথা আর বলিয়ো না, মুখে আনিয়ো না। কথা বিশ্বাস করিবার জো নাই।”

 বিনোদিনী। সে কথা ইতর লোকে বিশ্বাস করিতে পারে না, কিন্তু তুমি করিবে। সেইজন্য একবার আমি তোমাকে বসিতে বলিতেছি।

 বিহারী। আমি বিশ্বাস করি বা না করি, তাতে কী আসে যায়। তোমার জীবন যেমন চলিতেছে তেমনি চলিবে তো।

 বিননাদিনী। আমি জানি তোমার ইহাতে কিছুই আসিবে-যাইবে না। আমার ভাগ্য এমন যে, তোমার সম্মান রক্ষা করিয়া তোমার পাশে দাঁড়াইবার আমার কোনো উপায় নাই। চিরকাল তোমা হইতে আমাকে দুরেই থাকিতে হইবে। আমার মন তোমার কাছে এই দাবিটুকু কেবল ছাড়িতে পারে না যে, আমি যেখানে থাকি আমাকে তুমি একটুকু মাধুর্যের সঙ্গে ভাবিবে। আমি জানি, আমার উপরে তোমার অল্প একটু শ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল, সেইটুকু আমার একমাত্র সম্বল করিয়া রাখিব। সেইজন্য আমার সব কথা তোমাকে শুনিতে হইবে। আমি হাতজোড় করিয়া বলিতেছি ঠাকুরপো, একটুখানি বোসো।

 “আচ্ছা চলো” বলিয়া বিহারী এখান হইতে অন্যত্র কোথাও যাইতে উদ্যত হইল।

 বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, যাহা মনে করিছে তাহা নহে। এ ঘরে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করে নাই। তুমি এই ঘরে একদিন শয়ন করিয়াছিলে―এ ঘর তোমার জন্যই উৎসর্গ করিয়া রাখিয়াছি, ঐ ফুলগুলা তোমারই পূজা করিয়া আজ শুকাইয়া পড়িয়া আছে। এই ঘরেই তোমাকে বসিতে হইবে।”

 শুনিয়া বিহারীর চিত্তে পুলকের সঞ্চার হইল। ঘরের মধ্যে সে প্রবেশ করিল। বিনোদিনী দুই হাত দিয়া তাহাকে খাট দেখাইয়া দিল। বিহারী খাটে গিয়া বসিল, বিনোদিনী ভূমিতলে তাহার পায়ের কাছে উপবেশন করিল। বিহারী ব্যস্ত হইয়া উঠিতেই বিনোদিনী কহিল, “ঠাকুরপো, তুমি বোসো। আমার মাথা খাও, উঠিয়ো না। আমি তোমার পায়ের কাছে বসিবারও যোগ্য নই, তুমি দয়া করিয়াই সেখানে স্থান দিয়াছ। দূরে থাকিলেও এই অধিকারটুকু আমি রাখিব।”

 এই বলিয়া বিনোদিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “তোমার খাওয়া হইয়াছে ঠাকুরপো?”

 বিহারী কহিল, “স্টেশন হইতে খাইয়া আসিয়াছি।”

 বিনোদিনী। আমি গ্রাম হইতে তোমাকে যে চিঠিখানি লিখিয়াছিলাম, তাহা খুলিয়া, কোনো জবাব না দিয়া, মহেন্দ্রের হাত দিয়া আমাকে ফিরাইয়া পাঠাইলে কেন।

 বিহারী। সে চিঠি তো আমি পাই নাই।

 বিনোদিনী। এবারে মহেন্দ্রের সঙ্গে কলিকাতায় কি তোমার দেখা হইয়াছিল।

 বিহারী। তোমাকে গ্রামে পৌঁছাইয়া দিবার পরদিন মহেন্দ্রের সঙ্গে দেখা হইয়াছিল, তাহার পরেই আমি পশ্চিমে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলাম, তাহার সঙ্গে আর দেখা হয় নাই।

 বিনোদিনী। তাহার পূর্বে আর-এক দিন আমার চিঠি পড়িয়া উত্তর না দিয়া ফিরাইয়া পাঠাইয়াছিলে?

 বিহারী। না, এমন কখনোই হয় নাই।

 বিননাদিনী স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “সমস্ত বুঝিলাম। এখন আমার সব কথা তোমাকে বলি। যদি বিশ্বাস কর তো ভাগ্য মানিব, যদি না কর তো তোমাকে দোষ দিব না; আমাকে বিশ্বাস করা কঠিন।”

 বিহারীর হৃদয় তখন আর্দ্র হইয়া গেছে। এই ভক্তিভারনম্রা বিনোদিনীর পূজাকে সে কোনোমতেই অপমান করিতে পারিল না। সে কহিল, “বোঠান, তোমাকে কোনো কথাই বলিতে হইবে না, কিছু না শুনিয়া আমি তোমাকে বিশ্বাস করিতেছি। আমি তোমায় ঘৃণা করিতে পারি না। তুমি আর-একটি কথাও বলিয়ো না।”

 শুনিয়া বিনোদিনীর চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল, সে বিহারীর পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল। কহিল, “সব কথা না বলিলে আমি বাঁচিব না। একটু ধৈর্য ধরিয়া শুনিতে হইবে― তুমি আমাকে যে আদেশ করিয়াছিলে, তাহাই আমি শিরোধার্য করিয়া লইলাম। যদিও তুমি আমাকে পত্রটুকুও লেখ নাই, তবু আমি আমার সেই গ্রামে লোকের উপহাস ও নিন্দা সহ্য করিয়া জীবন কাটাইয়া দিতাম, তোমার স্নেহের পরিবর্তে তোমার শাসনই আমি গ্রহণ করিতাম― কিন্তু বিধাতা তাহাতেও বিমুখ হইলেন। আমি যে পাপ জাগাইয়া তুলিয়াছি তাহা আমাকে নির্বাসনেও টিঁকিতে দিল না। মহেন্দ্র গ্রামে আসিয়া, আমার ঘরের দ্বারে আসিয়া, আমাকে সকলের সম্মুখে লাঞ্ছিত করিল। সে গ্রামে আর আমার স্থান হইল না। দ্বিতীয় বার তোমার আদেশের জন্য তোমাকে অনেক খুঁজিলাম, কোনোমতেই তোমাকে পাইলাম না; মহেন্দ্র আমার খোলা চিঠি তোমার ঘর হইতে ফিরাইয়া লইয়া আমাকে প্রতারণা করিল। বুঝিলাম, তুমি আমাকে একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছ। ইহার পরে আমি একেবারেই নষ্ট হইতে পারিতাম― কিন্তু তোমার কী গুণ আছে, তুমি দূরে থাকিয়াও রক্ষা করিতে পার― তোমাকে মনে স্থান দিয়াছি বলিয়াই আমি পবিত্র হইয়াছি― একদিন তুমি আমাকে দুর করিয়া দিয়া নিজের যে পরিচয় দিয়াছ তোমার সেই কঠিন পরিচয়, কঠিন সোনার মতো,কঠিন মানিকের মতো, আমার মনের মধ্যে রহিয়াছে, আমাকে মহামূল্য করিয়াছে। দেব, এই তোমার চরণ ধুইয়া বলিতেছি সে মূল্য নষ্ট হয় নাই।”

 বিহারী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বিনোদিনীও আর কোনো কথা কহিল না। অপরাহ্ণের আলোেক প্রতি ক্ষণে ম্লান হইয়া আসিতে লাগিল। মহেন্দ্র ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া বিহারীকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। বিনোদিনীর প্রতি তাহার যে-একটা ঔদাসীন্য জন্মিতেছিল ঈর্ষায় তাড়নায় তাহা দূর হইবার উপক্রম হইল। বিনোদিনী বিহারীর পায়ের কাছে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছে দেখিয়া, প্রত্যাখ্যাত মহেন্দ্রের গর্বে আঘাত লাগিল। বিনোদিনীর সহিত বিহারীর চিঠিপত্র দ্বারা এই মিলন ঘটিয়াছে, ইহাতে তাহার আর সন্দেহ রহিল না। এতদিন বিহারী বিমুখ হইয়া ছিল, এখন সে যদি নিজে আসিয়া ধরা দেয় তবে বিনোদিনীকে ঠেকাইবে কে। মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ত্যাগ করিতে পারে, কিন্তু আর-কাহারো এমন সময় হাতে ত্যাগ করিতে পারে না তাহা আজ বিহারীকে দেখিয়া বুঝিতে পাঝিল।

 ব্যর্থরোষে তীব্র বিদ্রুপের স্বরে মহেন্দ্র বিনোদিনীকে কহিল, “এখন তবে বঙ্গভূমিতে মহেন্দ্রের প্রস্থান, বিহারীর প্রবেশ। দৃশ্যটি সুন্দর― হাততালি দিতে ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু আশা করি, এই শেষ অঙ্ক, ইহার পরে আর-কিছুই ভালো লাগিবে না।”

 বিনোদিনীর মুখ রক্তিম হইয়া উঠিল। মহেন্দ্রের আশ্রয় লইতে যখন তাহাকে বাধ্য হইতে হইয়াছে, তখন এ অপমানের উত্তর তাহার আর কিছুই নাই―ব্যাকুল বৃষ্টিতে সে কেবল একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিল।

 বিহারী খাট হইতে উঠিল; অগ্রসর হইয়া কহিল, “মহেন্দ্র, তুমি বিনোদিনীকে কাপুরুষের মতো অপমান করিয়ো না― তোমার ভদ্রতা যদি তোমাকে নিষেধ না করে, তোমাকে নিষেধ করিবার অধিকার আমার আছে।”

 মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ইহারই মধ্যে অধিকার সাব্যস্ত হইয়া গেছে? আজ তোমার নূতন নামকরণ করা যাক― বিনোদবিহারী।”

 বিহারী অপমানের মাত্রা চড়িতে দেখিয়া মহেন্দ্রের হাত চাপিয়া ধরিল। কহিল, “মহেন্দ্র, বিনোদিনীকে আমি বিবাহ করিব, তোমাকে জানাইলাম; অতএব এখন হইতে সংযতভাবে কথা কও।”

 শুনিয়া মহেন্দ্র বিস্ময়ে নিস্তব্ধ হইয়া গেল, এবং বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল— বুকের মধ্যে তাহার সমস্ত রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল।

 বিহারী কহিল, “তোমাকে আর-একটি খবর দিবার আছে― তোমার মা মৃত্যুশয্যায় শয়ান, তাঁহার বাঁচিবার কোনো আশা নাই। আমি আজ রাত্রের গাড়িতেই যাইব― বিনোদিনীও আমার সঙ্গে ফিরিবে।”

 বিনোদিনী চমকিয়া উঠিল; কহিল, “পিসিমার অসুখ?”

 বিহারী কহিল, “সারিবার অসুখ নহে। কখন কী হয় বলা যায় না।”

 মহেন্দ্র তখন আর-কোনো কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

 বিনোদিনী তখন বিহারীকে বলিল, “যে কথা তুমি বলিলে তাহা তোমার মুখ দিয়া কেমন করিয়া বাহির হইল। এ কি ঠাট্টা।”

 বিহারী কহিল, “না, আমি সত্যই বলিয়াছি, তোমাকে আমি বিবাহ করিব।”

 বিনোদিনী। এই পাপিষ্ঠাকে উদ্ধার করিবার জন্য?

 বিহারী। আমি তোমাকে ভালোবাসি বলিয়া, শ্রদ্ধা করি বলিয়া।

 বিনোদিনী। এই আমার শেষ পুরস্কার হইয়াছে। এই যেটুকু স্বীকার করিলে, ইহার বেশি আর আমি কিছুই চাই না। পাইলেও তাহা থাকিবে না, ধর্ম কখনো তাহা সহ্য করিবেন না।

 বিহারী। কেন করিবেন না।

 বিনোদিনী। ছি ছি, এ কথা মনে করিতে লজ্জা হয়। আমি বিধবা, আমি নিন্দিতা, সমস্ত সমাজের কাছে আমি তোমাকে লাঞ্ছিত করিব, এ কখনো হইতেই পারে না। ছি ছি, এ কথা তুমি মুখে আনিয়ো না।

 বিহারী। তুমি আমাকে ত্যাগ করিবে?

 বিনোদিনী। ত্যাগ করিবার অধিকার আমার নাই। তুমি গোপনে অনেকের অনেক ভালো কর― তোমার একটা-কোনো ব্রতের একটা কিছু ভার আমার উপর সমর্পণ করিয়ো, তাহাই বহন করিয়া আমি নিজেকে তোমার সেবিকা বলিয়া গণ্য করিব। কিন্তু ছি ছি, বিধবাকে তুমি বিবাহ করিবে! তোমার ঔদার্যে সব সম্ভব হইতে পারে, কিন্তু আমি যদি এ কাজ করি, তোমাকে সমাজে নষ্ট করি, তবে ইহজীবনে আমি আর মাথা তুলিতে পারিব না।

 বিহারী। কিন্তু বিনোদিনী, আমি তোমাকে ভালোবাসি।

 বিনোদিনী। সেই ভালোবাসার অধিকারে আমি আজ একটিমাত্র স্পর্ধা প্রকাশ করিব।

 বলিয়া বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া বিহারীর পদাঙ্গুলি চুম্বন করিল। কাছে বসিয়া কহিল, “পরজন্মে তোমাকে পাইবার জন্য আমি তপস্যা করিব― এ জন্মে আমার আর-কিছু আশা নাই, প্রাপ্য নাই। আমি অনেক দুঃখ দিয়াছি, অনেক দুঃখ পাইয়াছি, আমার অনেক শিক্ষা হইয়াছে। সে শিক্ষা যদি ভুলিতাম, তবে আমি তোমাকে হীন করিয়া আরো হীন হইতাম। কিন্তু তুমি উচ্চ আছ বলিয়াই আজ আমি আবার মাথা তুলিতে পারিয়াছি― এ আশ্রয় আমি ভুমিসাৎ করিব না।”

 বিহারী গম্ভীরমুখে চুপ করিয়া রহিল।

 বিনোদিনী হাতজোড় করিয়া কহিল, “ভুল করিয়ো না আমাকে বিবাহ করিলে তুমি সুখী হইবে না, তোমার গৌরব যাইবে― আমিও সমস্ত গৌরব হারাইব। তুমি চিরদিন নির্লিপ্ত, প্রসন্ন। আজও তুমি তাই থাকো― আমি দূরে থাকিয়া তোমার কর্ম করি। তুমি প্রসন্ন হও, তুমি সুখী হও।”