চোখের বালি/৭

উইকিসংকলন থেকে

রাজলক্ষ্মী জন্মভূমিতে পৌঁছিলেন। বিহারী তাঁহাকে পৌঁছাইয়া চলিয়া আসিবে এরূপ কথা ছিল, কিন্তু সেখানকার অবস্থা দেখিয়া সে ফিরিল না।

 রাজলক্ষ্মীর পৈতৃক বাটীতে দুই-একটি অতিবৃদ্ধ বিধবা বাঁচিয়া ছিলেন মাত্র। চারি দিকে ঘন জঙ্গল ও বাঁশবন, পুষ্করিণীর জল সবুজবর্ণ, দিনে দুপুরে শেয়ালের ডাকে রাজলক্ষ্মীর চিত্ত উদ্ভ্রান্ত হইয়া উঠে।

 বিহারী কহিল, “মা, জন্মভূমি বটে, কিন্তু ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ কোনোমতেই বলিতে পারি না। কলিকাতায় চলো। এখানে তোমাকে পরিত্যাগ করিয়া গেলে আমার অধর্ম হইবে।”

 রাজলক্ষ্মীরও প্রাণ হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময়ে বিনোদিনী আসিয়া তাঁহাকে আশ্রয় দিল এবং আশ্রিয় করিল।

 বিনোদিনীর পরিচয় প্রথমেই দেওয়া হইয়াছে। এক সময়ে মহেন্দ্র এবং তদ্ভাবে বিহারীর সহিত তাহার বিবাহের প্রস্তাব হইয়াছিল। বিধিনির্বন্ধে যাহার সহিত তাহার শুভ বিবাহ হয়, সে লোকটির সমস্ত অন্তরিন্দ্রিয়ের মধ্যে প্লীহাই ছিল সর্বাপেক্ষা প্রবল। প্লীহার অতিভারেই সে দীর্ঘকাল জীবনধারণ করিতে পারিল না।

 তাহার মৃত্যুর পর হইতে বিনোদিনী, জঙ্গলের মধ্যে একটিমাত্র উদ্যানলতার মতে, নিরানন্দ পল্লীর মধ্যে মুহ্যমান ভাবে জীবনযাপন করিতেছিল। অদ্য সেই অনাথা আসিয়া তাহার রাজলক্ষ্মৗ-পিস্‌শাশ-ঠাকরুনকে ভক্তিভরে প্রণাম করিল এবং তাঁহার সেবায় আত্মসমর্পণ করিয়া দিল।

 সেবা ইহাকেই বলে! মুহূর্তের জন্য আলস্য নাই। কেমন পরিপাটি কাজ, কেমন সুন্দর রান্না, কেমন মুমিষ্ট কথাবার্তা।

 রাজলক্ষ্মী বলেন, “বেলা হইল মা, তুমি দুটি খাও গে যাও।”

 সে কি শোনে। পাখা করিয়া পিসিমাকে ঘুম না পাড়াইয়া সে উঠে না।

 রাজলক্ষ্মী বলেন, “এমন করিলে যে তোমার অসুখ করিবে, মা।”

 বিনোদিনী নিজের প্রতি নিরতিশয় তাচ্ছিল্য প্রকাশ করিয়া বলে, “আমাদের দুঃখের শরীরে অসুখ করে না পিসিমা। আহা, কতদিন পরে জন্মভূমিতে আসিয়াছ! এখানে কী আছে, কী দিয়া তোমাকে আদর করিব।”

 বিহারী দুইদিনে পাড়ার কর্তা হইয়া উঠিল। কেহ তাহার কাছে রোগের ঔষধ, কেহ-বা মোকদ্দমার পরামর্শ লইতে আসে; কেহ-বা নিজের ছেলেকে বড়ো আপিসে কাজ জুটাইয়া দিবার জন্য তাহাকে ধরে, কেহ-বা তাহার কাছে দরখাস্ত লিখাইয়া লয়। বৃদ্ধদের তাসপাশার বৈঠক হইতে বাগ্দিদের তাড়িপানসভা পর্যন্ত সর্বত্র সে তাহার সকৌতুক কৌতূহল এবং স্বাভাবিক হৃদ্যতা লইয়া যাতায়াত করিত— কেহ তাহাকে দূর মনে করিত না, অথচ সকলেই তাহাকে সম্মান করিত।

 বিনোদিনী এই অস্থানে-পতিত কলিকাতার ছেলেটির নির্বাসনদণ্ড যথাসাধ্য লঘু করিবার জন্য অন্তঃপুরের অন্তরাল হইতে চেষ্টা করিত। বিহারী প্রত্যেক বার পাড়া পর্যটন করিয়া আসিয়া দেখিত, কে তাহার ঘরটিকে প্রত্যেক বার পরিপাটি পরিচ্ছন্ন করিয়াছে, একটি কাঁসার গ্লাসে দু-চারটি ফুল এবং পাতার তোড়া সাজাইয়াছে এবং তাহার গদির এক ধারে বঙ্কিম ও দীনবন্ধুর গ্রন্থাবলী গুছাইয়া রাখিয়াছে। গ্রন্থের ভিতরের মলাটে মেয়েলি অথচ পাকা অক্ষরে বিনোদিনীর নাম লেখা।

 পল্লীগ্রামের প্রচলিত আতিথ্যের সহিত ইহার একটু প্রভেদ ছিল। বিহারী তাহারই উল্লেখ করিয়া প্রশংসাবাদ করিলে রাজলক্ষ্মী কহিতেন, “এই মেয়েকে কিনা তোরা অগ্রাহ্য করিলি!”

 বিহারী হাসিয়া কহিত, “ভালো করি নাই মা, ঠকিয়াছি। কিন্তু বিবাহ না করিয়া ঠকা ভালো, বিবাহ করিয়া ঠকিলেই মুশকিল।”

 রাজলক্ষ্মী কেবলই মনে করিতে লাগিলেন, ‘আহা, এই মেয়েই তো আমার বধু হইতে পারিত। কেন হইল না।’

 রাজলক্ষ্মী কলিকাতায় ফিরিবার প্রসঙ্গমাত্র উত্থাপন করিলে বিনোদিনীর চোখ ছল্ ছল্ করিয়া উঠিত। সে বলিত, “পিসিমা, তুমি দুদিনের জন্যে কেন এলে। যখন তোমাকে জানিতাম না, দিন তো একরকম করিয়া কাটিত। এখন তোমাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব।”

 রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলিয়া ফেলিতেন, “ম, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।”

 সে কথা শুনিয়া বিনোদিনী কোনো ছুতায় লজ্জায় সেখান হইতে উঠিয়া যাইত।

 রাজলক্ষ্মী কলিকাতা হইতে একটা কাতর অনুনয়পত্রের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁহার মহিন জন্মাবধি কখনো এতদিন মাকে ছাড়িয়া থাকে নাই, নিশ্চয় এতদিনে মার বিচ্ছেদ তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। রাজলক্ষ্মী তাঁহার ছেলের অভিমান এবং আবদারের সেই চিঠিখানির জন্য তৃষিত হইয়া ছিলেন।

 বিহারী মহেন্দ্রের চিঠি পাইল। মহেন্দ্র লিখিয়াছে, ‘মা বোধ হয় অনেক দিন পরে জন্মভূমিতে গিয়া বেশ সুখে আছেন।’

 রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, ‘আহা, মহেন্দ্র অভিমান করিয়া লিখিয়াছে। সুখে আছেন! হতভাগিনী মা নাকি মহেন্দ্রকে ছাড়িয়া কোথাও সুখে থাকিতে পারে।’

 “ও বিহারী, তার পর মহিন কী লিখিয়াছে, পড়িয়া শুনা-না বাছা।”

 বিহারী কহিল, “তার পরে কিছুই না, মা।”

 বলিয়া চিঠিখানা মুঠার মধ্যে দলিত করিয়া একটা বহির মধ্যে পুরিয়া ঘরের এক কোণে ধপ্ করিয়া ফেলিয়া দিল।

 রাজলক্ষ্মী কি আর স্থির থাকিতে পারেন। নিশ্চয়ই মহিন মার উপর এমন রাগ করিয়া লিখিয়াছে যে, বিহারী তাঁহাকে পড়িয়া শোনাইল না।

 বাছুর যেমন গাভীর স্তনে আঘাত করিয়া দুগ্ধ এবং বাৎসল্যের সঞ্চার করে, মহেন্দ্রের রাগ তেমনি রাজলক্ষ্মীকে আঘাত করিয়া তাঁহার অবরুদ্ধ বাৎসল্যকে উৎসারিত করিয়া দিল। তিনি মহেন্দ্রকে ক্ষমা করিলেন। কহিলেন, ‘আহা, বউ লইয়া মহিন সুখে আছে, সুখে থাক্—যেমন করিয়া হোক সে সুখী হোক। বউকে লইয়া আমি তাহাকে আর কোনো কষ্ট দিব না। আহা, যে মা কখনো তাহাকে এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না, সেই মা চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া মহিন মার ’পরে রাগ করিয়াছে!’

 বারবার তাঁর চোখ দিয়া জল উছলিয়া উঠিতে লাগিল।

 সে দিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে বারবার আসিয়া বলিলেন, “যাও বাবা, তুমি স্নান করো গে যাও। এখানে তোমার বড়ো অনিয়ম হইতেছে।”

 বিহারীরও সে দিন স্নানাহারে যেন প্রবৃত্তি ছিল না, সে কহিল, “মা, আমার মতন লক্ষ্মীছাড়ারা অনিয়মেই ভালো থাকে।”

 রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি স্নান করিতে যাও।”

 বিহারী সহস্রবার অনুরুদ্ধ হইয়া নাহিতে গেল। সে ঘরের বাহির হইবা মাত্রই রাজলক্ষ্মী বহির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি সেই কুঞ্চিত দলিত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইলেন।

 বিনোদিনীর হাতে চিঠি দিয়া কহিলেন, “দেখো তো মা, মহিন বিহারীকে কী লিখিয়াছে।”

 বিনোদিনী পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। মহেন্দ্র প্রথমটা মার কথা লিখিয়াছে; কিন্তু সে অতি অল্পই, বিহার যতটুকু শুনাইয়াছিল তাহার অধিক নহে।

 তার পরেই আশার কথা। মহেন্দ্র রঙ্গে রহস্যে আনন্দে যেন মাতাল হইয়া লিখিয়াছে।

 বিনোদিনী একটুখানি পড়িয়া শুনাইয়াই লজ্জিত হইয়া থামিয়া কহিল, “পিসিমা, ও আর কী শুনিবে।”

 রাজলক্ষ্মীর স্নেহব্যগ্র মুখের ভাব এক মূহূর্তের মধ্যেই পাথরের মতো শক্ত হইয়া যেন জমিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী একটুখানি চুপ করিয়া রহিলেন; তার পরে বলিলেন, “থাক্।”

 বলিয়া চিঠি ফেরত না লইয়াই চলিয়া গেলেন।

 বিনোদিনী সেই চিঠিখানা লইয়া ঘরে ঢুকিল। ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িতে লাগিল।

 চিঠির মধ্যে বিনোদিনী কী রস পাইল, তাহা বিনোদিনীই জানে। কিন্তু তাহা কৌতুকরস নহে। বারবার করিয়া পড়িতে পড়িতে তাহার দুই চক্ষু মধ্যাহ্নের বালুকার মতো জলিতে লাগিল, তাহার নিশ্বাস মরুভূমির বাতাসের মতো উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।

 মহেন্দ্র কেমন, আশা কেমন, মহেন্দ্র-আশার প্রণয় কেমন, ইহাই তাহার মনের মধ্যে কেবলই পাক খাইতে লাগিল। চিঠিখানা কোলের উপর চাপিয়া ধরিয়া, পা ছড়াইয়া, দেয়ালের উপর হেলান দিয়া, অনেকক্ষণ সম্মুখে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

 মহেন্দ্রের সে চিঠি বিহারী আর খুঁজিয়া পাইল না।

 সেদিন মধ্যাহ্নে হঠাৎ অন্নপূর্ণা আসিয়া উপস্থিত। দুঃসংবাদের আশঙ্কা করিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল; কোনো প্রশ্ন করিতে তিনি সাহস করিলেন না, অন্নপূর্ণার দিকে পাংশুবর্ণমুখে চাহিয়া রহিলেন।

 অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদি, কলিকাতার খবর সব ভালো।”

 রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তবে এখানে যে!”

 অন্নপূর্ণ কহিলেন, “দিদি, তোমার ঘরকন্নার ভার তুমি লও’সে। আমার আর সংসারে মন নাই। আমি কাশী যাইব বলিয়া যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছি। তাই তোমাকে প্রণাম করিতে আসিলাম। জ্ঞানে অজ্ঞানে অনেক অপরাধ করিয়াছি, মাপ করিয়ো। আর তোমার বউ—” (বলিতে বলিতে চোখ ভরিয়া উঠিয়া জল পড়িতে লাগিল) “সে ছেলেমানুষ, তার মা নাই, সে দোষী হোক নির্দোষী হোক, সে তোমার।”

আর বলিতে পারিলেন না।

 রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া তাঁহার স্নানাহারের ব্যবস্থা করিতে গেলেন। বিহারী খবর পাইয়া গদাই ঘোষের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে ছুটিয়া আসিল। অন্নপূর্ণাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, সে কি হয়। আমাদের তুমি নির্মম হইয়া ফেলিয়া যাইবে?”

 অন্নপূর্ণা অশ্রু দমন করিয়া কহিলেন, “আমাকে আর ফিরাইবার চেষ্টা করিস নে, বেহারি— তোরা সব সুখে থাক্, আমার জন্যে কিছুই আটকাইবে না।”

 বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তার পরে কহিল, “মহেন্দ্রের ভাগ্য মন্দ, তোমাকে সে বিদায় করিয়া দিল।”

 অন্নপূর্ণা চকিত হইয়া কহিলেন, “অমন কথা বলিস নে। আমি মহিনের উপর কিছুই রাগ করি নাই। আমি না গেলে সংসারে মঙ্গল হইবে না।”

 বিহারী দূরের দিকে চাহিয়া নীরবে বসিয়া রহিল। অন্নপূর্ণা অঞ্চল হইতে এক জোড়া মোটা সোনার বালা খুলিয়া কহিলেন, “বাবা, এই বালাজোড়া তুমি রাখো— বউমা যখন আসিবেন, আমার আশীৰ্বাদ দিয়া তাঁহাকে পরাইয়া দিয়ো।”

 বিহারী বালাজোড়া মাথায় ঠেকাইয়া অশ্রু সম্বরণ করিতে পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

 বিদায়কালে অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বেহারি, আমার মহিনকে আর আমার আশাকে দেখিস।”

 রাজলক্ষ্মীর হস্তে একখানি কাগজ দিয়া বলিলেন, “শ্বশুরের সম্পত্তিতে আমার যে অংশ আছে, তাহা এই দানপত্রে মহেন্দ্রকে লিখিয়া দিলাম। আমাকে কেবল মাসে মাসে পনেরোটি করিয়া টাকা পাঠাইয়া দিয়ো।”

 বলিয়া ভূতলে পড়িয়া রাজলক্ষ্মীর পদধূলি মাথায় তুলিয়া লইলেন এবং বিদায় হইয়া তীর্থোদ্দেশে যাত্রা করিলেন।