চোখের বালি/৯

উইকিসংকলন থেকে

 এমন সময় দোতলা হইতে “মহিনদা মহিনদা” রব উঠিল। “আরে কে হে, এসো এসো” বলিয়া মহেন্দ্র জবাব দিল। বিহারীর সাড়া পাইয়া মহেন্দ্রের চিত্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। বিবাহের পর বিহারী মাঝে মাঝে তাহাদের সুখের বাধাস্বরূপ আসিয়াছে— আজ সেই বাধাই সুখের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হইল।

 আশাও বিহারীর আগমনে আরাম বোধ করিল। মাথায় কাপড় দিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল দেখিয়া মহেন্দ্র কহিল, “যাও কোথায়। আর তো কেহ নয়, বিহারী আসিতেছে।”

 আশা কহিল, “ঠাকুরপোর জলখাবারের বন্দোবস্ত করিয়া দিই গে।”

 একটা-কিছু কর্ম করিবার উপলক্ষ আসিয়া উপস্থিত হওয়াতে আশার অবসাদ কতকটা লঘু হইয়া গেল।

 আশা শাশুড়ির সংবাদ জানিবার জন্য মাথায় কাপড় দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বিহারীর সহিত এখনো সে কথা কয় না।

 বিহারী প্রবেশ করিয়াই কহিল, “আ সর্বনাশ! কী কবিত্বের মাঝখানেই পা ফেলিলাম। ভয় নাই বৌঠান, তুমি বোসো, আমি পালাই।”

 আশা মহেন্দ্রের মুখে চাহিল। মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী, মার কী খবর।”

 বিহারী কহিল, “মা-খুড়ির কথা আজ কেন ভাই। সে ঢের সময় আছে। Such a night was not made for sleep, nor for mothers and aunts!”

 বলিয়া বিহারী ফিরিতে উদ্যত হইলে মহেন্দ্র তাহাকে জোর করিয়া টানিয়া আনিয়া বসাইল। বিহারী কহিল, “বৌঠান, দেখো, আমার অপরাধ নাই— আমাকে জোর করিয়া আনিল— পাপ করিল মহিনদা, তাহার অভিশাপটা আমার উপরে যেন না পড়ে।”

 কোনো জবাব দিতে পারে না বলিয়াই এই-সব কথায় আশা অত্যন্ত বিরক্ত হয়; বিহারী ইচ্ছা করিয়া তাহাকে জ্বালাতন করে।

 বিহারী কহিল, “বাড়ির শ্রী তো দেখিতেছি— মাকে এখনো আনাইবার কি সময় হয় নাই।”

 মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ! আমরা তো তার জন্যই অপেক্ষা করিয়া আছি।”

 বিহারী কহিল, “সেই কথাটি তাঁহাকে জানাইয়া পত্র লিখিতে তোমার অল্পই সময় লাগিবে, কিন্তু তাঁহার সুখের সীমা থাকিবে না। বোঠান, মহিনদাকে সেই দু-মিনিট ছুটি দিতে হইবে, তোমার কাছে আমার এই আবেদন!”

 আশা রাগিয়া চলিয়া গেল— তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

 মহেন্দ্র কহিল, “কী শুভক্ষণেই যে তোমাদের দেখা হইয়াছিল। কিছুতেই সন্ধি হইল না— কেবলই ঠুকঠাক চলিতেছে।”

 বিহারী কহিল, “তোমাকে তোমার মা তো নষ্ট করিয়াছেন, আবার স্ত্রীও নষ্ট করিতে বসিয়াছে। সেইটে দেখিতে পারি না বলিয়াই সময় পাইলে দুই-এক কথা বলি।”

 মহেন্দ্র। তাহাতে ফল কী হয়।

 বিহারী। ফল তোমার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই হয় না, আমার সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ হয়।