ছন্দ/ছন্দের মাত্রা

উইকিসংকলন থেকে

ছন্দের মাত্রা

 বহুকাল পূর্বে একটি গান রচনা করেছিলেম। ‘সবুজপত্রে’ সেটি উদ্ধৃত হয়েছিল।[১]

আঁধার রজনী পোহাল,
জগৎ পুরিল পুলকে,
বিমল প্রভাত-কিরণে
মিলিল দ্যুলোক ভূলোকে।

তাছাড়া এই ছন্দে পরবর্তী কালে দুই-একটি শ্লোক লিখেছিলুম। যথা—

গোড়াতেই ঢাক বাজনা,
কাজ করা তার কাজ না।

আরেকটি—

শকতিহীনের দাপনি
আপনারে মারে আপনি।

বলা বাহুল্য এগুলি নয় মাত্রার চালে লেখা।

 ‘সবুজপত্রে’র প্রবন্ধে[২] তার পরে দেখিয়েছিলুম ধ্বনিসংখ্যার কতরকম হেরফের করে এই ছন্দের বৈচিত্র্য ঘটতে পারে, অর্থাৎ তার চলন কত ভঙ্গির হয়। তাতে যে-দৃষ্টান্ত রচনা করেছিলেম তার পুনরুক্তি না করে নতুন বাণী প্রয়োগ করা যাক।

 এইখানে বলে রাখা ভালো এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত উদাহরণগুলিতে প্রত্যেক ভাগে তাল দিলে ছন্দের পার্থক্য ধরা সহজ হয়।

 উপরের ছন্দে ৩+৩+৩-এর লয়। নিচের ছন্দে ৩+২+৪-এর লয়।

আসন | দিলে | অনাহূতে
ভাষণ | দিলে | বীণাতানে,
বুঝি গো | তুমি | মেঘদূতে
পাঠায়ে | ছিলে | মোর পানে।
বাদল রাতি এল যবে
বসিয়াছিনু একা-একা,
গভীর গুরু-গুরু রবে
কী ছবি মনে দিল দেখা।
পথের কথা পুবে হাওয়া
কহিল মোরে থেকে থেকে;
উদাস হয়ে চলে যাওয়া,
খ্যাপামি সেই রোধিবে কে।
আমার তুমি অচেনা যে,
সে কথা নাহি মানে হিয়া,
তোমারে কবে মনোমাঝে
জেনেছি আমি না জানিয়া।
ফুলের ডালি কোলে দিনু,
বসিয়াছিলে একাকিনী,
তখনি ডেকে বলেছিনু,
তোমার চিনি, ওগো চিনি।

তার পরে ৪+৩+২:

বলেছিনু | বসিতে | কাছে,
দেবে কিছু | ছিল না | আশা,
দেব বলে | যেজন | যাচে
বুঝিলে না | তাহারো | ভাষা।

শুকতারা চাঁদের সাথী
বলে, “প্রভু, বেসেছি ভালো,
নিয়ে যেয়ো আমার বাতি
যেথা যাবে তোমার আলো।”
ফুল বলে, “দখিন হাওয়া,
বাঁধিব না বাহুর ডোরে,
ক্ষণতরে তোমারে পাওয়া
চিরতরে দেওয়া যে মোরে।”

তার পরে ৩+৬:

বিজুলি | কোথা হতে এলে,
তোমারে | কে রাখিবে বেঁধে।
মেঘের | বুক চিরি গেলে
অভাগা | মরে কেঁদে কেঁদে।
আগুনে গাঁথা মণিহারে
ক্ষণেক সাজায়েছ যারে,
প্রভাতে মরে হাহাকারে
বিফল রজনীর খেদে।

দেখা যাক ৪+৫:

মোর বনে | ওগো গরবী,
এলে যদি | পথ ভুলিয়া,
তবে মোর | রাঙা করবী
নিজ হাতে | নিয়ো তুলিয়া।

আরেকটা:

জলে ভরা | নয়নপাতে
বাজিতেছে | মেঘরাগিণী,
কী লাগিয়া | বিজনরাতে
উড়ে হিয়া, | হে বিবাগিনী।

ম্লানমুখে | মিলাল হাসি
গলে দোলে | নবমালিকা।
ধরাতলে | কী ভুলে আসি
সুর ভোলে | সুরবালিকা।

তার পরে ৪+৪+১। বলে রাখা ভালো এই ছন্দটি পড়বার সময় সবশেষ ধ্বনিটিকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।

বারে বারে | যায় চলি- | য়া,
ভাসায় ন- | য়ননীরে | সে,
বিরহের | ছলে ছলি- | য়া
মিলনের | লাগি ফিরে | সে।
যায় নয়নের আড়া-লে,
আসে হৃদয়ের মাঝে গো।
বাঁশিটিরে পায়ে মাড়া-লে
বুকে তার সুর বাজে গো
ফুলমালা গেল শুকা-য়ে,
দীপ নিবে গেল বাতা-সে,
মোর ব্যথাখানি লুকা-য়ে
মনে তার রহে গাঁথা সে।
যাবার বেলায় দুয়া-রে
তালা ভেঙে নেয় ছিনি-য়ে,
ফিরিবার পথ উহা-রে
ভাঙা দ্বার দেয় চিনি-য়ে

 ৩+২+৪-এর লয় পূর্বে দেখানো হয়েছে। ৫+৪-এর লয় এখানে দেওয়া গেল।

আলো এল যে | দ্বারে তব
ওগো মাধবী | বনছায়া।
দোঁহে মিলিয়া | নবনব
তূণে বিছায়ে | গাঁথ মায়া

চাঁপা, তোমার আঙিনাতে
ফেরে বাতাস কাছে কাছে;
আজি ফাগুনে  একসাথে
দোলা লাগিয়ো  নাচে নাচে।
বধু, তোমার দেহলিতে
বর আসিছে দেখিছ কি।
আজি তাহার বাঁশরিতে
হিয়া মিলায়ে দিয়ো সখি ৷

৬+৩-এর ঠাটেও নয় মাত্রাকে সাজানো চলে। যেমন—

সেতারের তারে | ধানশী
মিড়ে মিড়ে উঠে | বাজিয়া।
গোধূলির রাগে | মানসী
সুরে যেন এল | সাজিয়া।

আরেকটা:

তৃতীয়ার চাঁদ | বাঁকা সে,
আপনারে দেখে | ফাঁকা সে।
তারাদের পানে | তাকিয়ে
কার নাম যায় | ডাকিয়ে
সাথী নাহি পায় | আকাশে।

এতক্ষণ এই যে নয় মাত্রার ছন্দটাকে নিয়ে নয়-ছয় করছিলুম সেটা বাহাদুরি করবার জন্যে নয়, প্রমাণ করবার জন্যে যে এতে বিশেষ বাহাদুরি নেই। ইংরেজি ছন্দে এক্‌সেন্‌টের প্রভাব; সংস্কৃত ছন্দে দীর্ঘহ্রস্বের সুনির্দিষ্ট ভাগ। বাংলায় তা নেই, এইজন্যে লয়ের দাবিরক্ষা ছাড়া বাংলা ছন্দে মাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে চলার আর কোনো বাধা নেই। ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে আরম্ভ করে পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ মাত্রা পর্যন্ত বাংলা ছন্দে আমরা দেখি। এই সুযোগে কেউ বলতে পারেন এগার মাত্রার ছন্দ বানিয়ে নতুন কীর্তি স্থাপন করব। আমি বলি তা কর কিন্তু পুলকিত হোয়ো না, কেননা কাজটা নিতান্তই সহজ। দশ মাত্রার পরে আর একটা মাত্রা যোগ করা একেবারেই দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। যেমন—

চামেলির ঘনছায়া-বিতানে
বনবীণা বেজে ওঠে কী তানে।
স্বপনে মগন সেথা মালিনী
কুসুমমালায় গাঁথা শিথানে।

অন্যরকমের মাত্রাভাগ করতে চাও সেও কঠিন নয়।যেমন—

মিলন-সুলগনে | কেন বল্
নয়ন করে তোর | ছল্‌ছল।
বিদায়দিনে যবে | ফাটে বুক,
সেদিনো দেখেছি তো | হাসিমুখ।

তারপরে তের মাত্রার প্রস্তাবটা শুনতে লাগে খাপছাড়া এবং নতুন, কিন্তু পয়ার থেকে একমাত্রা হরণ করতে দুঃসাহসের দরকার হয় না। সে কাজ অনেকবার করেছি, তা নিয়ে নালিশ ওঠেনি। যথা—

গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা।

এক মাত্রা যোগ করে পয়ারের জ্ঞাতিবৃদ্ধি করাও খুবই সহজ। যথা—

হে বীর, জীবন দিয়ে মরণেরে জিনিলে,
নিজেরে নিঃস্ব করি বিশ্বেরে কিনিলে।

ষোল মাত্রার ছন্দ দুর্লভ নয়। অতএব দেখা যাক সতর মাত্রা:

নদীতীরে দুই | কূলে কূলে |
কাশবন দুলি- | ছে।
পূর্ণিমা তারি | ফুলে ফুলে |
আপনারে ভুলি- | ছে।

আঠার মাত্রার ছন্দ সুপরিচিত। তার পরে উনিশ:

ঘন মেঘভার গগনতলে,
বনে বনে ছায়া তারি,
একাকিনী বসি নয়নজলে
কোন্ বিরহিনী নারী।

তারপরে কুড়ি মাত্রার ছন্দ সুপ্রচলিত। একুশ মাত্রা। যথা—

বিচলিত কেন মাধবীশাখা,
মঞ্জরি কাঁপে থরথর।
কোন্ কথা তার পাতায় ঢাকা
চুপি চুপি করে মরমর।

তারপরে,—আর কাজ নেই। বোধ হয় যথেষ্ট প্রমাণ করতে পেরেছি যে, বাংলায় নতুন ছন্দ তৈরি করতে অসাধারণ নৈপুণ্যের দরকার করে না।

 সংস্কৃত ভাষায় নূতন ছন্দ বানানো সহজ নয়, পুরানো ছন্দ রক্ষা করাও কঠিন। যথানিয়মে দীর্ঘহ্রস্ব স্বরের পর্যায় বেঁধে তার সংগীত। বাংলায় সেই দীর্ঘধ্বনিগুলিকে দুইমাত্রায় বিশ্লিষ্ট করে একটা ছন্দ দাঁড় করানো যেতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে মূলের মর্যাদা থাকবে না। মন্দাক্রান্তার[৩] বাংলা রূপান্তর দেখলেই তা বোঝা যাবে।

যক্ষ সে কোনো জনা আছিল আনমনা, সেবার অপরাধে প্রভুশাপে
হয়েছে বিলয়গত মহিমা ছিল যত, বরষকাল যাপে দুখতাপে।
নির্জন রামগিরি-শিখরে মরে ফিরি একাকী দূরবাসী প্রিয়াহারা
যেথায় শীতল ছায় ঝরনা বহি যায় সীতার স্নানপূত জলধারা।
মাস পরে কাটে মাস, প্রবাসে করে বাস প্রেয়সী-বিচ্ছেদে বিমলিন;
কনকবলয়-খসা বাহুর ক্ষীণদশা, বিরহদুখে হল বলহীন।
একদা আষাঢ় মাসে প্রথম দিন আসে, যক্ষ নিরখিল গিরিপর
ঘনঘোর মেঘ এসে লেগেছে সানুদেশে, দন্ত হানে যেন করিবর।

 পরিচয়—১৩৩৯ কার্তিক

 উপরের প্রবন্ধে লিখেছি ‘আঁধার রজনী পোহাল’ গানটি নয়মাত্রার ছন্দে রচিত। ছন্দতত্ত্বে প্রবীণ অমূল্যবাবু ওর নয়-মাত্রিকতার দাবি একেবারে নামঞ্জুর করে দিলেন।[৪] আর কারো হাত থেকে এ রায় এলে তাকে আপিল করবার যোগ্য বলেও গণ্য করতুম না, এ-ক্ষেত্রে ধাঁধা লাগিয়ে দিলে। রাস্তার লোক এসে যদি আমাকে বলে তোমার হাতে পাঁচটা আঙুল নেই তাহলে মনে উদ্‌বেগের কোনো কারণ ঘটে না। কিন্তু শারীরতত্ত্ববিদ এসে যদি এই সংবাদটা জানিয়ে যান তাহলে দশবার করে নিজের আঙুল গুনে দেখি, মনে ভয় হয় অঙ্ক বুঝি ভুলে গেছি। অবশেষে নিতান্ত হতাশ হয়ে স্থির করি, যে-কটাকে এতদিন আঙুল বলে নিশ্চিন্ত ছিলুম বৈজ্ঞানিক মতে তার সব-কটা আঙুলই নয়; হয়তো শাস্ত্রবিচারে জানা যাবে যে, আমার আঙুল আছে মাত্র তিনটি, বাকি দুটো বুড়ো আঙুল আর কড়ে আঙুল, তারা হরিজনশ্রেণীয়।

 বর্তমান তর্কে আমার মনে সেইরকম উদ্‌বেগ জন্মেছে। ‘আঁধার রজনী পোহাল’ চরণের মাত্রাসংখ্যা যেদিক্ থেকে যেমন করে গনে দেখি নয়মাত্রায় গিয়ে ঠেকে। অমূল্যবাবু বললেন এটা তো নয়মাত্রার ছন্দ নয়ই, বাংলাভাষায় আজো নয়মাত্রার উদ্ভব হয়নি, হয়তো নিরবধিকালে কোনো এক সময়ে হতেও পারে। তিনি বলেন বাংলা ছন্দ দশমাত্রাকে মেনেছে, নয়মাত্রাকে মানেনি। এ-কথায় আরো আমার ধাঁধা লাগল।

 অমুল্যবাবু পরীক্ষা করে বলছেন এ ছন্দে জোড়ের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ‘আঁধার রজনী’ পর্যন্ত এক পর্ব, এইখানে একটা ফাঁক, তারপরে ‘পোহাল’ শব্দে তিনমাত্রার একটা পঙ্গু পর্বাঙ্গ, তার পরে পুরো যতি। অর্থাৎ এ-ছন্দে ছয়মাত্রারই প্রাধান্য। এর ধড়টা ছয়মাত্রার, ল্যাজটা তিনমাত্রার। চোখ দিয়ে এক পংক্তিতে নয়মাত্রা দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু অমূল্যবাবুর মতে কান দিয়ে দেখলে ওর দুটো অসমান ভাগ বেরিয়ে পড়ে।

 এর থেকে বোঝা যাচ্ছে আমার অঙ্কবিদ্যায় আমি যে-সংখ্যাকে ‘নয়’ বলি অমূল্যবাবুর অঙ্কশাস্ত্রেও তাকেই ‘নয়’ বলে বটে, কিন্তু ছন্দের মাত্রানির্ণয় সম্বন্ধে তাঁর পদ্ধতির সঙ্গে আমার পদ্ধতির মূলেই প্রভেদ আছে। কথাটা পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো।

 পৃথিবী চলছে, তার একটা ছন্দ আছে। অর্থাৎ তার গতিকে মাত্রাসংখ্যায় ভাগ করা যায়। এই ছন্দের পূর্ণায়তনকে নির্ণয় করব কোন্ লক্ষণ মতে। পৃথিবী নিয়মিতকালে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। আমাদের পঞ্জিকা অনুসারে পয়লা বৈশাখ থেকে আরম্ভ করে চৈত্রসংক্রান্তিতে তার আবর্তনের এক পর্যায় শেষ হয়, তার পরে আবার সেই পরিমিতকালে পয়লা বৈশাখ থেকে পুনর্বার তার আবর্তন শুরু হয়। এই পুনরাবর্তনের দিকে লক্ষ্য করে আমরা বলতে পারি পৃথিবীর সূর্যপ্রদক্ষিণের মাত্রাসংখ্যা ৩৬৫ দিন।

মহাভারতের কথা অমৃতসমান
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান্।

এই ছন্দের মাত্রাপথে পুনরাবর্তন আরম্ভ হয়েছে কোথায় সে তো জানা কথা। সেই অনুসারে সর্বজনে বলে থাকে এর মাত্রাসংখ্যা চোদ্দ। বলা বাহুল্য এই চোদ্দমাত্রা একটা অখণ্ড নিরেট পদার্থ নয়। এর মধ্যে জোড় দেখা যায়, সেই জোড় আটমাত্রার অবসানে, অর্থাৎ ‘মহাভারতের কথা’ একটুখানি দাঁড়িয়েছে যেখানে এসে। পয়ারে এই দাঁড়াবার আড্ডা দু-জায়গায়, প্রথম আট ধ্বনিমাত্রার পরে ও শেষার্ধের ছয় ধ্বনিমাত্রা ও দুই যতিমাত্রার শেষে। পৃথিবীর প্রদক্ষিণ-ছন্দের মধ্যেও দুইভাগ আছে, উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন। যতিসমেত ষোলমাত্রা পয়ারেও তেমনি আছে ঊত্তরভাগ ও দক্ষিণভাগ, কিন্তু সেই দুটিভাগ সমগ্রেরই অন্তর্গত।

মহাভারতের বাণী
অমৃতসমান মানি,
কাশীরাম দাস ভনে
শোনে তাহা সর্বজনে।

যদিও পয়ারের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ তবু একে অন্য ছন্দ বলব, কারণ এর পুনরাবর্তন আটমাত্রায়, ষোলমাত্রায় নয়।

আঁধার রজনী পোহাল,
জগৎ পুরিল পুলকে।

এই ছন্দের আবর্তন ছয়মাত্রার পর্যায়ে ঘটে না, তার কক্ষপথ সম্পূর্ণ হয়েছে নয়মাত্রায়। নয়মাত্রায় তার প্রদক্ষিণ নিজেকে বারে বারে বহুগুণিত করছে। এই নয়মাত্রায় মাঝে মাঝে সমভাগে জোড়ের বিচ্ছেদ আছে। সেই জোড় ছয় মাত্রায় না, তিন মাত্রায়।

 এই ছন্দের লক্ষণ কী। প্রশ্নের উত্তর এই যে, এর পূর্ণভাগ নয়মাত্রা নিয়ে, আংশিক ভাগ তিন, এবং সেই প্রত্যেক ভাগের মাত্রাসংখ্যা তিন। কোনো পাঠক যদি ছয়মাত্রার পরে এসে হাঁফ ছাড়েন, তাঁকে বাধা দেবার কোনো দণ্ডবিধি নেই; সুতরাং সেটা তিনি নিজের স্বচ্ছন্দেই করবেন, আমার ছন্দে করবেন না। আমার ছন্দের লক্ষণ এই— প্রত্যেক পদে তিন কলা,[৫] প্রত্যেক কলায় তিনমাত্রা, অতএব সমগ্র পদের মাত্রাসমষ্টি নয়। অমুল্যবাবু এটিকে নিয়ে যে ছন্দ জানিয়েছেন তার প্রত্যেক পদে দুই কলা। প্রথম কলার মাত্রা সংখ্যা ছয়, দ্বিতীয় কলার তিন, অতএব সমগ্র পদের মাত্রাসমষ্টি নয়। দুটি ছন্দেরই মোট আয়তন একই হবে, কানে শোনাবে ভিন্নরকম।

 ছান্দসিক যাই বলুন এখানে ছন্দরচয়িতা হিসাবে আমার আবেদন আছে। ছন্দের তত্ত্ব সম্বন্ধে আমি যা বলি সেটা আমার অশিক্ষিত বলা, সুতরাং তাতে দোষ স্পর্শ করতে পারে; কিন্তু ছন্দের রস সম্বন্ধে আমি যদি কিছু আলোচনা করি, সংকোচ করব না, কেননা ছন্দসৃষ্টিতে অশিক্ষিতপটুত্বের মূল্য উপেক্ষা করবার নয়। ‘আঁধার রজনী পোহাল’ রচনাকালে আমার কান যে আনন্দ পেয়েছিল সেটা অন্যছন্দোজনিত আনন্দ থেকে বিশেষভাবে স্বতন্ত্র। কারণটা বলি।

 অন্যত্র বলেছি দুই মাত্রায় স্থৈর্য আছে, কিন্তু বেজোড় বলেই তিনমাত্রা অস্থির।[৬] ত্রৈমাত্রিক ছন্দে সেই অস্থিরতার বেগটাকে বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়।

বিংশতি কোটি মানবের বাস
এ ভারতভূমি যবনের দাস
রয়েছে পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা।

এ-ছন্দে শব্দগুলি পরস্পরকে অস্থিরভাবে ঠেলা দিচ্ছে। একে জোড়মাত্রার ছন্দে রূপান্তরিত করা যাক।

যেথায় বিংশতি কোটি মানবের বাস
সেই তো ভারতবর্ষ যবনের দাস
শৃঙ্খলেতে বাঁধা পড়ে আছে।

এর চালটা শান্ত। [কবিতায় ত্রৈমাত্রিক ছন্দে সাধারণত অশান্ত বেজোড় মাত্রার দৌড়কে পরিণামে জোড়মাত্রার সীমায় লাগাম টেনে সংযত করা হয়। প্রায়ই সংগীতের একতালাজাতীয় তালের নিয়মে বারমাত্রায় তার চরমগতি, সেই তীর্থে এসে তবে সে খাড়া হয়ে থাকে। ঐ ‘বার’ সংখ্যাটা যেন বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি, দুইয়ের সঙ্গেও তার যেমন কুটুম্বিতা তিনের সঙ্গেও তেমনি। তাই তিনমাত্রার ঝোঁকটা বারমাত্রায় এসে ঠাণ্ডা হবার সুযোগ পায়। ‘বিংশতি কোটি মানবের বাস’ পদটি বারমাত্রায় স্থির হয়েছে।]

 আলোচ্য নয়মাত্রার ছন্দে ‘তিন’ সংখ্যার অস্থিরতা শেষপর্যন্তই রয়ে গেছে। সেটা উচিত নয়, ছয়মাত্রার পরে থামবার একটুখানি অবকাশ দেওয়া ভালো, এমন তর্ক তোলা যেতে পারে। কিন্তু ছন্দের সিদ্ধান্ত তর্কে হয় না, ওটার মীমাংসা কানে। সৌভাগ্যক্রমে এ-সভায় সুযোগ পেয়েছি কানের দরবারে আরজি পেশ করবার। নয়মাত্রার চঞ্চল ভঙ্গিতে কান সায় দিচ্ছে না, এ-কথা যদি সুধীজন বলেন তাহলে অগত্যা চুপ করে যাব, কিন্তু তবুও নিজের কানের স্বীকৃতিকে অশ্রদ্ধা করতে পারব না।

 ‘আঁধার রজনী পোহাল’ কবিতাটি গানরূপে রচিত। সংগীতাচার্য ভীমরাও শাস্ত্রী[৭] মৃদঙ্গের বোলে একে যে তালের রূপ দিয়েছিলেন তাতে দুটি আঘাত এবং একটি ফাঁক। যথা—

  
আঁধার | রজনী | পোহাল।

এ কথা সকলেরই জানা আছে যে, ফাঁকটা তালের শেষ ঝোঁক, তারপরে পুনরাবর্তন। এই গানের স্বাভাবিক ঝোঁক প্রত্যেক তিনমাত্রায় এবং এর তালের অর্থাৎ ছন্দের সম্পূর্ণতা তিনমাত্রাঘটিত তিন ভাগে। অমুল্যবাবু বা শৈলেন্দ্রবাবু[৮] যদি অন্য কোনো রকমের ভাগ ইচ্ছা করেন তবে রচয়িতার ইচ্ছার সঙ্গে তার ঐক্য হবে না, এর বেশি আমার আর কিছু বলবার নাই।

উত্তর দিগন্ত ব্যাপি দেবতাত্মা হিমাদ্রি বিরাজে,
দুই প্রান্তে দুই সিন্ধু, মানদণ্ড যেন তারি মাঝে।

এই ছন্দকে আঠারমাত্রা যখন বলি তখন সমগ্র পদের মাত্রাসংখ্যা গণনা করেই বলে থাকি। আট মাত্রার পরে এর একটা সুস্পষ্ট বিরাম আছে বলেই এর আঠার মাত্রার সীমানার বিরূদ্ধে নালিশ চলে না।

 আমাদের হাতে তিন পর্ব আছে। মণিবন্ধ পর্যন্ত এক, এটি ছোটো পর্ব, কনুই পর্যন্ত দুই, কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত তিন; যাকে আমরা সমগ্র বাহু বলি সে এই তিনি পর্ব মিলিয়ে। আমাদের দেহে এক বাহু অন্য বাহুর অবিকল পুনরাবৃত্তি। প্রত্যেক ছন্দেরই এমনিতরো একটি সম্পূর্ণ রূপকল্প অর্থাৎ প্যাটার্‌ন্ আছে। ছন্দোবদ্ধ কাব্যে সেই প্যাটার্‌ন্‌কেই পুনঃপুনিত করে। সেই প্যাটার্‌নের সম্পূর্ণ সীমার মধ্যেই তার নানা পর্ব পর্বাঙ্গ প্রভৃতি যা-কিছু। সেই সমগ্র প্যাটার্‌নের মাত্রাই সেই ছন্দের মাত্রা। ‘আঁধার রজনী পোহাল’ গানটিকে এইজন্যেই নয়মাত্রার বলেছি। যেহেতু প্রত্যেক নয়মাত্রাকে নিয়েই তার পুনঃপুনঃ আবর্তন।

 কোন্ ছত্র কী রকম ভাগ করে পড়তে হবে, এ নিয়ে মতান্তর হওয়া অসম্ভব নয়। পুরাতন ছন্দগুলির নাম অনুসারে সংজ্ঞা আছে। নতুন ছন্দের নামকরণ হয়নি। এইজন্যে তার আবৃত্তির কোনো নিশ্চিত নির্দেশ নেই। কবির কল্পনা এবং পাঠকের রুচিতে যদি অনৈক্য হয় তবে কোনো আইন নেই যা নিয়ে নালিশ চলতে পারে। বর্তমান প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য এই যে, আমি যখন স্পষ্টতই আমার কোনো কাব্যের ছন্দকে নয়মাত্রার বলছি তখন সেটা অনুসরণ করাই বিহিত। হতে পারে তাতে কানের তৃপ্তি হবে না। না যদি হয় তবে সে দায় কবির। কবিকে নিন্দা করবার অধিকার সকলেরই আছে, তার রচনাকে সংশোধন করবার অধিকার কারো নেই।

 এই উপলক্ষ্যে একটা গল্প মনে পড়ছে। গল্পট। বানানো নয়। পার্লামেন্‌টে দর্শকদের বসবার আসনে দুটি শ্রেণীভাগ আছে। সম্মুখভাগের আসনে বসেন যাঁরা খ্যাতনামা, পশ্চাতের ভাগে বসেন অপর-সাধারণ। দুই বিভাগের মাঝখানে কেবল একটিমাত্র দড়ি বাঁধা। একজন ভারতীয় দর্শক সেই সামনের দিক্ নির্দেশ করে প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “Can I go over there?” প্রহরী উত্তর করেছিল, “Yes, sir, you can, but you mayn’t।” ছন্দেও যতিবিভাগ সম্বন্ধে কোনো কোনো ক্ষেত্রে canএর নিষেধ বলবান্ নয়, কিন্তু তবু mayর নিষেধ স্বীকার্য। একটা দৃষ্টান্ত দেখা যাক। পাঠকমহলে স্বনামখ্যাত পয়ার ছন্দের একটা পাকা পরিচয় আছে, এইজন্যে তার পদে কোথায় আধা যতি কোথায় পুরো যতি তা নিয়ে বচসার আশঙ্কা নেই। নিম্নলিখিত কবিতার চেহারা অবিকল পয়ারের। সেই চোখের দলিলের জোরে তার সঙ্গে পয়ারের চালে ব্যবহার অবৈধ হয় না।

মাথা তুলে তুমি যবে চল তব রথে
তাকাও না কোথা আমি ফিরি পথে পথে,
অবসাদজাল মোরে ঘেরে পায় পায়।
মনে পড়ে এই হাতে নিয়েছিলে সেবা,
তবু হায় আজ মোরে চিনিবে সে কেবা,
তোমারি চাকার ধুলা মোরে ঢেকে যায়।

কিন্তু যদি পয়ার নাম বদলিয়ে এর নাম দেওয়া যায় ‘ষড়ঙ্গী’ এবং এর যথোচিত সংজ্ঞা নির্দেশ করি তাহলে বিনা প্রতিবাদে নিম্নলিখিত ভাগেই একে পড়া উচিত হবে।

তাকাও না কোথা
আমি ফিরি পথে
পথে,
অবসাদজাল
ঘেরে মোরে পায়
পায়।
মনে পড়ে এই
হাতে নিয়েছিলে
সেবা,
তবু হায় আজ
মোরে চিনিবে সে
কেবা,
তোমারি চাকার
ধুলা মোরে ঢেকে
যায়।

এর প্রত্যেক পদে চোদ্দ মাত্রা, তিন কলা, সেই কলার মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ছয় ছয় দুই।

 অমূল্যবাবুর মতে বাংলায় নয়মাত্রার ছন্দ নেই, আছে দশমাত্রার, কিন্তু দশমাত্রার ঊর্ধ্বে আর ছন্দ চলে না। আমি অনেক চিন্তা করেও তাঁর এই মতের তাৎপর্য বুঝতে পারিনি। একাদিক্রমে মাত্রাগণনা গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে সহজ কাজ, তাতেও যদি তিনি বাধা দেন তাহলে বুঝতে হবে তাঁর মতে গণনার বাইরে আরো কিছু গণ্য করবার আছে। হয়তো মোট মাত্রার ভাগগুলো নিয়ে তর্ক। ভাগ সকল ছন্দেই আছে। দশমাত্রার ছন্দ। যথা—

প্রাণে মোর আছে তার বাণী,
তার বেশি তারে নাহি জানি।

এর সহজ ভাগ এই—

প্রাণে মোর
আছে তার
বাণী।

একে অন্যরকমেও ভাগ করা চলে। যথা—

প্রাণে মোর আছে
তার বাণী।

অথবা ‘প্রাণে’ শব্দটাকে একটু আড় করে রেখে—

প্রাণে মোর আছে তার
বাণী।

এই তিনটেই দশমাত্রার ছন্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাহলেই দেখা যাচ্ছে ছন্দকে চিনতে হলে প্রথম দেখা চাই তার পদের মোট মাত্রা, তারপরে তার কলাসংখ্যা, তারপরে প্রত্যেক কলার মাত্রা।

   8
সকল বেলা | কাটিয়া গেল | বিকাল নাহি | যায়

এই ছন্দের প্রত্যেক পদে সতর মাত্রা। এর চার কলা। অন্ত্য কলাটিতে দুই ও অন্য তিনটি কলায় পাঁচ পাঁচ মাত্রা। এই সতর মাত্রা বজায় রেখে অন্যজাতীয় ছন্দ রচনা চলে কলাবৈচিত্র্যের দ্বারা। যথা—

  
মন চায় | চলে আসে | কাছে,
 
তবুও পা | চলে না।
বলিবার | কত কথা | আছে,
তবু কথা | বলে না।

এ-ছন্দে পদের মাত্রা সতর, কলার সংখ্যা পাঁচ, তার মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ৪|৪|২|৪|৩। আঠারমাত্রার দীর্ঘপয়ারে প্রথম আট মাত্রার পরে যেমন স্পষ্ট যতি আছে, এই ছন্দের প্রথম দশ মাত্রার পরে তেমনি।

নয়নে | নিঠুর | চাহনি |
হৃদয়ে | করুণা | ঢাকা।
গভীর | প্রেমের | কাহিনী |
গোপন | করিয়া | রাখা।

এরও পদের মাত্রা সতর, কলার সংখ্যা ছয়, শেষ কলাটি ছাড়া প্রত্যেক কলার মাত্রা তিন।

   8
অন্তর তার | কী বলিতে চায় | চঞ্চল চর- | ণে
কণ্ঠের হার | নয়ন ডুবায় | চম্পক বর- | নে।

এরও সমগ্র পদের মাত্রা সতর। এর চারটি কলা। প্রথম তিনটি কলায় মাত্রাসংখ্যা ছয়, চতুর্থ কলায় এক। সতরমাত্রার ছন্দকে কলাবৈচিত্র্যের দ্বারা আরো নবনব রূপ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সাক্ষী আর বাড়াবার দরকার নেই।

 শেষের যে দৃষ্টান্ত দেওয়া গেছে তাতে মাত্রাসংখ্যাগণনা উপলক্ষ্যে ‘চরণে’ শব্দকে ভাগ করে দিয়ে একমাত্রার ‘ণে’ ধ্বনিকে স্বতন্ত্র কলায় বসিয়েছি। ওটা যে স্বতন্ত্রকলাভুক্ত তার প্রমাণ এই ছন্দের তাল দেবার সময় ঐ ‘ণে’ ধ্বনিটির উপর তাল পড়ে।

 ইতিপূর্বে অন্যত্র একটি নয়মাত্রার ছন্দের দৃষ্টান্ত দেবার সময় নিম্নলিখিত শ্লোকটি ব্যবহার করেছি।[৯] তাল দেবার রীতি বদল করে একে দুরকম করে পড়া যায়, দুটোই পৃথক্‌ ছন্দ।

বারে বারে যায় | চলিয়া
ভাসায় গো আঁখি-| নীরে সে।
বিরহের ছলে | ছলিয়া
মিলনের লাগি | ফিরে সে।

এটা নয়মাত্রার শ্রেণীর ছন্দ; এর দুই কলা এবং কলাগুলি ত্রৈমাত্রিক। এর পদকে তিন কলায় ভাগ করে কলাগুলিকে দুই মাত্রার ছাঁদ দিলে এই একই ছড়া সম্পূর্ণ নূতন ছন্দে গিয়ে পৌঁছাবে। যথা—

  
বারে বারে | যায় চলি- | য়া
ভাসায় গো | আঁখিনীরে | সে।
বিরহের | ছলে ছলি- | য়া
মিলনের | লাগি ফিরে | সে।
সারাদিন | দহে তিয়া- | ষা,
বারেক না| দেখি উহা- | রে।
অসময়ে | লয়ে কী আ- | শা
অকারণে | আসে দুয়া- | রে।

অমূল্যবাবু বলেন এর প্রথম দুই কলায় চার চার আট এবং শেষেক কলায় একমাত্রার ছন্দ কৃত্রিম শুনতে হয়। বোধ হয় অখণ্ড শব্দকে খণ্ডিত করা হচ্ছে বলে তাঁর কাছে এটা কৃত্রিম ঠেকছে। কিন্তু ছন্দের ঝোঁকে অখণ্ড শব্দকে দুভাগ করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এরকম তর্কে বিশুদ্ধ হাঁ এবং না-এর দ্বন্দ্ব, কোনো পক্ষে কোনো যুক্তিপ্রয়োগের ফাঁক নেই। আমি বলছি কৃত্রিম শোনায় না, তিনি বলছেন শোনায়। আমি এখনো বলি, এই রকম কলাভাগে এই ছন্দে একটি নূতন নৃত্যভঙ্গি জেগে ওঠে, তার একটা রস আছে।

 দশের বেশি মাত্রাভার বাংলা ছন্দ বহন করতে অক্ষম একথা মানতে পারব না। নিম্নে বারমাত্রার একটি শ্লোক দেওয়া গেল।

মেঘ ডাকে গম্ভীর গরজনে
ছায়া নামে তমালের বনে বনে
ঝিল্লি ঝনকে নীপ-বীথিকায়।

সরোবর উচ্ছল কূলে কূলে,
তটে তারি বেণুশাখা দুলে দুলে
মেতে ওঠে বর্ষণ-গীতিকার।

শ্রোতারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আবৃত্তিকালে পদান্তের পূর্বে কোনো যতিই দিইনি, অর্থাৎ বারমাত্রা একটি ঘনিষ্ঠ গুচ্ছের মতোই হয়েছে। এই পদগুলিকে বারমাত্রার পদ বলবার কোনো বাধা আছে বলে আমি কল্পনা করতে পারিনে। উল্লিখিত শ্লোকের ছন্দে বারমাত্রা, প্রত্যেক পদে তিন কলা, প্রত্যেক কলায় চার মাত্রা। বারমাত্রার পদকে চার কলায় বিভক্ত করে ত্রৈমাত্রিক করলে আরেক ছন্দ দেখা দেবে। যথা—

শ্রাবণ-গগন, ঘোর ঘনঘটা,
তাপসী যামিনী এলায়েছে জটা,
দামিনী ঝলকে রহিয়া রহিয়া।

এ ছন্দ বাংলাভাষায় সুপরিচিত।

তমালবনে ঝরিছে বারিধারা,
তড়িৎ ছুটে আঁধারে দিশাহারা।
ছিঁড়িয়া ফেলে কিরণ-কিঙ্কিনী
আত্মঘাতী যেন সে পাগলিনী।

পঞ্চমাত্রাঘটিত এই বারমাত্রাকেও কেন যে বারমাত্রা বলে স্বীকার করব না, আমি বুঝতেই পারিনে।

 কেবল নয়মাত্রার পদ বলার দ্বারা ছন্দের একটা সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয়, সে পরিচয় বিশেষভাবে সম্পূর্ণ হয় না। আমার সাধারণ পরিচয় আমি ভারতীয়, বিশেষ পরিচয় আমি বাঙালি, আরও বিশেষ পরিচয় আমি বিশেষ পরিবারের বিশেষ নামধারী মানুষ। নয়মাত্রার পদবিশিষ্ট ছন্দ সাধারণভাবে অনেক হতে পারে।

[মোর বনে ওগো | গরবী
এলে যদি পথ | ভুলিয়া,
তবে মোর রাঙা | করবী
নিজ হাতে নিয়ো | তুলিয়া।

এর এই নয়মাত্রার পদকে যদি দুইভাগ করা যায় তবুও সমগ্র পদের দিকে তাকিয়ে একে নয়মাত্রার ছন্দই বলব। যথা—

মোর বনে | ওগো গরবী
এলে যদি | পথ ভুলিয়া।

এই উভয় ভাগের ছন্দকেই নয়মাত্রার ছন্দ বলছি, তার কারণ উভয়তই নয়মাত্রার পদে ছন্দের রূপকল্পটি সমাপ্ত, তার পরে পুনরাবর্তন। এই সব-কটি ছন্দেরই সাধারণ পরিচয়, এরা নয়মাত্রার ছন্দ।] আরও বিশেষ পরিচয় দাবি করলে এর কলাসংখ্যা এবং সেই কলার মাত্রাসংখ্যার হিসাব দিতে হয়।

 কোনো কোনো ছন্দে কলাবিভাগ করতে ভুল হবার আশঙ্কা আছে। যেমন— গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা। পয়ারের চোদ্দ মাত্রা থেকে এক মাত্রা হরণ করে এই তের মাত্রার ছন্দ গঠিত। অর্থাৎ ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরিষন’ এবং এই ছন্দটি বস্তুত এক, এমন মনে হতে পারে। আমি তা স্বীকার করিনে, তার সাক্ষী শুধু কান নয় তালও বটে। এই দুটি ছন্দে তালের ঘা পড়েছে কী রকম তা দেখা উচিত।

 
গগনে গরজে মেঘ | ঘন বরিষন।

সাধারণ পয়ারের নিয়মে এতে দুটি আঘাত।

  
গগনে গরজে মেঘ | ঘন বর- | ষা।

এতে তিনটি আঘাত। পদটি তিন অসমান ভাগে বিভক্ত। পদের শেষবর্ণে স্বতন্ত্র ঝোঁক দিলে তবেই এর ভঙ্গিটাকে রক্ষা করা হয়। ‘বরষা’ শব্দের শেষ আকার যদি হরণ করা যায় তাহলে ঝোঁক দেবার জায়গা পাওয়া যায় না, তাহলে অক্ষরসংখ্যা সমান হলেও ছন্দ কাত হয়ে পড়ে।

 ‘আঁধার রজনী পোহালো’ পদের অন্তবর্ণে দীর্ঘস্বর আছে, কিন্তু নয়মাত্রার ছন্দের পক্ষে সেটা অনিবার্য নয়। তারি একটি প্রমাণ নিচে দেওয়া গেল।

জ্বেলেছে পথের আলোক
সূর্যরথের চালক,
অরুণরক্ত গগন।
বক্ষে নাচিছে রুধির
কে রবে শান্ত সুধীর
কে রবে তন্দ্রামগন।
বাতাসে উঠিছে হিলোল
সাগর-ঊর্মি বিলোল,
এল মহেন্দ্রলগন,
কে রবে তন্দ্রামগন।

 এই তর্কক্ষেত্রে আর-একটি আমার কৈফিয়ত দেবার আছে। অমুল্যবাবুর নালিশ এই যে, ছন্দের দৃষ্টান্তে কোনো কোনো স্থলে দুই পংক্তিকে মিলিয়ে আমি কবিতার এক পদ বলে চালিয়েছি। আমার বক্তব্য এই, লেখার পংক্তি এবং ছন্দের পদ এক নয়। আমাদের হাঁটুর কাছে একটা জোড় আছে বলে আমরা প্রয়োজনমতো পা মুড়ে বসতে পারি, তৎসত্ত্বেও গণনায় ওটাকে এক পা বলেই স্বীকার করি এবং অনুভব করে থাকি। নইলে চতুষ্পদের কোঠায় পড়তে হয়। ছন্দেও ঠিক তাই।

সকল বেলা কাটিয়া গেল
বিকাল নাহি যায়।

অমূল্যবাবু একে দুই চরণ বলেন, আমি বলিনে। এই দুটি ভাগকে নিয়েই ছন্দের সম্পূর্ণতা। যদি এমন হত

সকল বেলা কাটিয়া গেল,
বকুলতলে আসন মেল।

তাহলে নিঃসংশয়ে একে দুই চরণ বলতুম।

 পুনর্বার বলি যে, যে-বিরামস্থলে পৌঁছিয়ে পদ্যছন্দ অনুরূপ ভাগে পুনরাবর্তন করে সেইপর্যন্ত এসে তবেই কোন্‌টা কোন্ ছন্দ এবং তার মাত্রার পরিমাণ কত তার নির্ণয় সম্ভব, মাঝখানে কোনো একটা জোড়ের মুখে গণনা শেষ করা অসংগত। সংস্কৃত বা প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রে এই নিয়মেরই অনুসরণ করা হয়। দৃষ্টান্ত—

পৈঙ্গল-ছন্দঃসূত্রাণি

ভংজিঅ মলঅচোলবই ণিবলিঅ
গংজিঅ গুজ্জরা।
মালবরাঅ মলঅগিরি লুক্কিঅ
পরিহরি কুংজরা।
খুরাসাণ খুহিঅ রণমহ মুহিঅ
লংঘিঅ সাঅরা।
হম্মীর চলিঅ হারব পলিঅ
রিউগণহ কাঅরা।[১০]

গ্রন্থকার, বলছেন ‘বিংশত্যক্ষরাণি’ এবং ‘পঞ্চবিংশতিমাত্রাঃ প্রতিপাদং দেয়াঃ’। এর পদে পদে কুড়িটি অক্ষর ও পঁচিশটা মাত্রা, ছন্দের এই পরিচয়।

পঢ়ম দহ দিজ্জিআ
পুণবি তহ কিজ্জিআ
পুণবি দহ সত্ত তহ বিরই জাআ।
এম পরি বিবিহু দল
মত্ত সততীস পল
এহু কহ ঝুল্লণা ণাঅরাআ।[১১]

ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা এই, “প্রথমং দশমাত্রা দীয়ন্তে। অর্থাৎ তত্র বিরতিঃ ক্রিয়তে। পুনরপি তথা কর্তব্যা। পুনরপি সপ্তদশমাত্রাসু বিরতির্জাতা চ। অনয়ৈব রীত্যা দলদ্বয়েপি মাত্রাঃ সপ্তত্রিংশৎ পতন্তি।” এমনি করে দলগুলিকে[১২] মিলিয়ে যে ছন্দের সাঁইত্রিশ মাত্রা “তামিমাং নাগরাজঃ পিঙ্গলো ঝুল্লণামিতি কথয়তি”। আমি যাকে ছন্দোবিশেষের রূপকল্প বা প্যাটার্‌ণ্[১৩] বলছি ‘ঝুল্লণা’ ছন্দে সেইটে সাঁইত্রিশ মাত্রায় সম্পূর্ণ, তারপরে তার অনুরূপ পুনরাবৃত্তি। অমূল্যবাবু হয়তো এর কলাগুলির প্রতি লক্ষ্য রেখে একে পাঁচ বা দশমাত্রার ছন্দ বলবেন, কিন্তু পাঁচ বা দশমাত্রায় এর পদের সম্পূর্ণতা নয়।

 যার ভাগগুলি অসমান এমন ছন্দ দেখা যাক।

কুংতঅরু ধণুদ্ধরু
হঅবর গঅবরু
ছক্কলু বিবি পা—
ইক্ক দলে।[১৪]

এই ছন্দ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ‘দ্বাত্রিংশন্মাত্রাঃ পাদে সুপ্রসিদ্ধাঃ’। এই ছন্দকে বাংলায় ভাঙতে গেলে এইরকম দাঁড়ায়।

কুঞ্জপথে জ্যোৎস্নারাতে
চলিয়াছে সখীসাথে
মল্লিকা-কলিকার
মাল্য হাতে।[১৫]

চার পংক্তিতে এই ছন্দের পূর্ণরূপ এবং সেই পূর্ণরূপের মাত্রাসংখ্যা বত্রিশ। ছন্দে মাত্রাগণনার এই ধারা আমি অনুসরণ করা কর্তব্য মনে করি। মনে নেই আমার কোনো পূর্বতম প্রবন্ধে অন্য মত[১৬] প্রকাশ করেছি কি না, যদি করে থাকি তবে ক্ষমা প্রার্থনা করি।

 সবশেষে পুনরায় বলি, ছন্দের স্বরূপনির্ণয় করতে হলে সমগ্রের মাত্রাসংখ্যা, তার কলাসংখ্যা ও কলাগুলির মাত্রাসংখ্যা জানা আবশ্যক। শুধু তাই নয়, যেখানে ছন্দের রূপকল্প একাধিক পদের দ্বারা সম্পূর্ণ হয় সেখানে পদসংখ্যাও বিচার্য। যথা—

বর্ষণশান্ত
পাণ্ডুর মেঘ যবে ক্লান্ত
বন ছাড়ি মনে এল নীপরেণুগন্ধ,
ভরি দিল কবিতার ছন্দ।

এখানে চারটি পদ এবং প্রত্যেক পদ নানা অসমান মাত্রায় রচিত, সমস্তটাকে নিয়ে ছন্দের রূপকল্প। বিশেষজাতীয় ছন্দে এইরূপ পদ ও মাত্রা গণনাতেও আমি পিঙ্গলাচার্যের[১৭] অনুবর্তী।

 উদয়ন—১৩৪১ জ্যৈষ্ঠ

  1. ২৫ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১২৯২ সালে ‘রবিচ্ছায়া’ গ্রন্থে।
  2. ২৩-২৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  3. ৪৬-৪৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  4. অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়— নয় মাত্রার ছন্দ: পরিচয়, ১৩৪০ কার্তিক।
  5. ‘উপপর্ব’ অর্থে ব্যবহৃত। সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রমতে ‘কলা’ শব্দের মানে ‘মাত্রা’, অর্থাৎ ‘কলা’ ও ‘মাত্রা’ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।
  6. ৩৯-৪০, ৪৩-৪৪, ৭১ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  7. বিশ্বভারতীর ভূতপূর্ব সংগীতশিক্ষক।
  8. শৈলেন্দ্রকুমার মল্লিক। তাঁর ‘ছন্দরণ’ প্রবন্ধ (বিচিত্রা, ১৩৩৯ শ্রাবণ) দ্রষ্টব্য।
  9. ৯০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  10. প্রাকৃতপৈঙ্গলম্, ১।১৫১। এই প্রাকৃত ছন্দটির নাম ‘গগনাঙ্গ’ (প্রাকৃতপৈঙ্গলম্ ১।১৪৯-৫০), মতান্তরে ‘গগনাঙ্গনা’।
  11. প্রাকৃতপৈঙ্গলম্ ১।১৫৬। এ-ছন্দের সঙ্গে জয়দেবের ‘বদসি যদি কিঞ্চিদপি’ ইত্যাদি বিখ্যাত রচনাটির ছন্দোগত সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
  12. ‘দল’ মানে ছন্দের বৃহত্তম বিভাগ বা ‘চরণ’। ঝুল্লণা ছন্দে দুই দল, প্রতিদলে সাঁইত্রিশ মাত্রা।
  13. ‘প্রাকৃতপৈঙ্গলম্’এর ভাষ্যকার এই রূপকল্প বা প্যাটার্‌ণ্ অর্থে ‘পরিপাটি’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। ঝুল্লণা ছন্দের প্রতিদলে সাঁইত্রিশ মাত্রা স্থাপনের পরিপাটি হচ্ছে ১০।১০।১০।৭।
  14. প্রাকৃতপৈঙ্গলম্ ১।১৭৯। প্রাকৃত-ছন্দশাস্ত্রমতে এ-ছন্দের নাম ‘দণ্ডকল’।
  15. সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রমতে পদের অন্তস্থিত লঘুধ্বনি অনেক সময় গুরু অর্থাৎ দ্বিমাত্রক বলে গণ্য হয়। সেই হিসাবে এখানে ‘হাতে’ শব্দের ‘তে’ ধ্বনিটিকে দ্বিমাত্রক বলে গণ্য করতে হবে।
  16. ৪১-৪৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
  17. বিখ্যাত ছন্দশাস্ত্রকার। এঁর নামে দুইখানি বই প্রচলিত আছে, একটি সংস্কৃত ও একটি প্রাকৃত। প্রথমটি (ছন্দঃসূত্রম্) খ্রীস্টের পূর্ববর্তী কালে এবং দ্বিতীয়টি (প্রাকৃতপৈঙ্গলম্) খ্রীস্টীয় চতুর্দশ শতকে রচিত বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন।