ছবি/অষ্টম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টম পরিচ্ছেদ।

 সমস্ত কথা শুনিয়া বিদ্যুৎপ্রকাশ দীর্ঘনিশ্বাআ ত্যাগ করিলেন। বলিলেন, “মহাশয়! কি বলিব, সেই অভিনেত্রীকে বিবাহ করিতে পারিলাম না, যদি সে উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করিত, যদি তাহাকে বিবাহ করিলে আমার মর্য্যাদার হানি না হইত, তাহা হইলে সেকি আজ অপরের হইতে পারে? এমন রমণী আমি ইতিপূর্ব্বে আর কোথাও দেখি নাই। আপনি স্বয়ং তাহাকে দেখিয়াছেন, সুতরাং সে যে অতি রূপসী, তাহা আমাকে আর নূতন করিয়া বলিতে হইবে না। আপনি যখন তাহার সহিত কথা কহিয়াছেন, যখন তাহার বুদ্ধিতে আশ্চর্য্য হইয়াছেন, তখন সে যে কিরূপ বুদ্ধিমতী, তাহাও আপনাকে বলিবার কোন প্রয়োজন দেখি না। বলুন দেখি, সে যদি আজ আমার স্ত্রী হইত এবং ভবি- যাতে রাণী পদবাচ্য হইত, তাহা হইলে তাহা দ্বার আমার কত উপকার হইত?”

 আমি বিদ্যুতের কথা স্বীকার করিলাম। বলিলাম, “আপনি যাহা বলিয়াছেন, তাহা সত্য। যে রমণী বুদ্ধিতে আমাকে পরাস্ত করিতে পারে, সে সামান্যা রমণী নহে। এপর্য্যন্ত অতি অল্প লোকেই আমাকে পরাজিত করিয়াছে, কিন্তু তাহার মধ্যে কেহ রমণী ছিল না। সেই অভিনেত্রী যে সর্ব্বাপেক্ষা বুদ্ধিমতী, ইহাই তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ।”

 বিদ্যুৎকাশ আমার কথায় সন্তুষ্ট হইলেন; বলিলেন, “তবে আর আমাদের বিলম্বের প্রয়োজন কি?”

 আ। কিছুই নয়। আমি প্রস্তত।

 বি। তবে আপনার ভৃত্যকে আমার গাড়ী আনিতে বলুন।

 আ। আপনার গাড়ী কোথায়? আমি যখন বাড়ীতে প্রবেশ করি, তখন দরজায় কোন গাড়ী দেখি নাই।

 বি। আপনার ভৃত্য জানে।

 আ। সেকি!

 বি। আমিই তাহাকে গাড়ীখানি গোপনে রাখিতে বলিয়া ছিলাম।

 আ। কেন?

 বি। শুনিতেছি, দেশ হইতে আমার সন্ধানে লোক আসিয়াছে। যদি তাহারা আমার গাড়ী দেখিতে পায়, এই জন্যই গোপনে রাখিতে বলিয়াছিলাম।

 আমি সহাস্যমুখে বলিলাম, “তবে চলুন, আপনি কাল প্রাতেই যাহাতে দেশে যাইতে পারেন, তাহার উপায় করা যাউক। বুঝিয়াছি, আপনার বিবাহের দিন নিকটবর্ততী হইয়া আসিতেছে।”

 এই বলিয়া ভৃত্যকে গাড়ী আনিতে বলিলাম। কিছুক্ষণ পরেই ভৃত্য গাড়ী লইয়া আসিল। আমরা উভয়ে উহাতে আরোহণ করিলাম এবং সত্বর সেই অভিনেত্রীর বাড়ীর দ্বারে উপস্থিত হইলাম।

 বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র দ্বারবান হাস্য করিয়া সুদীর্ঘ সেলাম করিল। তাহার ভাবগতিক দেধিয়া আমি আশ্চর্য্য হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমাদের প্রভু কোথায়? হাসিতেছ কেন? ব্যাপার কি?”

 সে বলিল, “তিনি এখানে নাই। বোধ হয় আর আসিবেন না। যখন তিনি এ বাটী ত্যাগ করেন, তখন বলিয়া যান যে, আপনি এখানে আসিবেন। তাঁহার কথা এখন সত্য হইল দেখিয়া, হাসিয়াছিলাম।”

 “তিনি কেন বলিয়াছিলেন, বলিতে পার?” আমিও হাসিয়া এই কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।

 সে বলিল, “পারি। শুনিয়াছি, আপনার কি একখানি ছবি দরকার। সেই ছবির জন্য আপনাকে এখানে আসিতেই হইবে আপনি সহরের একজন নামজাদা লোক, আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনার ন্যায় লোকের চরণ দর্শন করিতে পাইলাম।”

 আমি বলিলাম, “না হে বাপু, অতটা ভাল নয়। ‘অতি ভাল চোরের লক্ষণ’ হইয়া পড়িবে। এখন আমরা তোমার প্রভুর ঘরগুলি পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করি। তোমার কোন আপত্তি নাই ত?”

দ্বা। আজ্ঞা না।

 আ। তবে তুমি আমাদের সঙ্গে চল।

 দ্বা। আমাকে আর কেন জড়ান মহাশয়! গরিবকে মাপ করুন। আপনি ত সকলই জানেন।

 আমি দ্বারবানের কথায় হাস্য করিলাম। পরে বিদ্যুৎপ্রকাশকে সঙ্গে লইয়া অভিনেত্রীর বৈঠকখানায় প্রবেশ করিলাম; যেখানে ছবিখানি লুক্কায়িত ছিল, সেই আলমারির ভিতর একখানি সামান্য আয়নার কাচ ও কাষ্ঠের মধ্যস্থল হইতে তাহা বাহির করিয়া ফেলিলাম।

 আয়নাখানি এরূপে নির্ম্মিত যে, উহার কাচ ও কাষ্ঠের মধ্যে সামান্য় পরিমাণ স্থান ব্যবধান ছিল। অথচ এরূপভাবে গঠিত যে, সহজে কেহ তাহা জানিতে পারিবে না। ঐ ব্যবধানের মধ্যেই ছবিখানি লুক্কায়িত ছিল। আমি অভিনেত্রীকে ঐ স্থান হইতেই ছবিখানিকে অর্দ্ধেক বাহির করিতে দেখিয়াছিলাম।

 যাহা বাহির করিলাম, তাহা প্রথমতঃ দেখিলে ছবি বলিয়া বোধ হইল না। দেখিলাম, একটী কাগজের মোড়ক। শশব্যস্তে মোড়কটী খুলিয়া ফেলিলাম। দুইখানি ছবি ও একখানি পত্র বাহির হইল। পত্রখানি আমারই উদ্দেশে লেখা, পত্রের উপরে আমার নাম পরিষ্কাররূপে লিখিত ছিল।

 ছবি দুইখানির মধ্যে একখানিতে বিদ্যুৎপ্রকাশ ও অভিনেত্রী একত্রে, অপরখানিতে অভিনেত্রী স্বয়ং একাকিনী বিরাজমানা। প্রথমখানি দেখিবামাত্র বিদ্যুৎপ্রকাশ চকিতের মত তুলিয়া লইলেন। দ্বিতীয়খানি পড়িয়া রহিল। বিদ্যুৎপ্রকাশ মনে করিয়াছিলেন, সেখানি পত্রের মর্ম্ম জানিয়া পরে লইবেন।

 পত্র পাঠ করিবার জন্য আমারও কৌতুহল জন্মিল। আমি পাঠ করিলাম,—

 “মহাশয়!

 “আমি ভাল লেখাপড়া জানি না। ভুলভ্রান্তি মাপ কর্‌বেন। কি খেলাই আজ খেলেছেন। প্রথমে আমি সত্যই মনে করেছিলাম, শেষে আপনার মুখ ভাল করে দেখে আমার সন্দেহ হয়।

 “আপনি যখন চলে যান, আপনার পশ্চাতে দরোয়ান পাঠাই। সে আমায় আপনার সন্ধান এনে দেয়। আমি আপনার মৎলব বুঝ্‌তে পারি। ঐ দিনেই আমার স্বামীর দেশে যাবার কথা ছিল। কিন্ত ইচ্ছা আছে, আপনার সঙ্গে শেষ দেখা না ক’রে যাব না।

 “ইচ্ছা ছিল, ছবিখানি নিয়ে যাই। কিন্ত, শেষে মনে কর্‌লাম—না। যার জন্য কলিকাতার বিখ্যাত গোয়েন্দা আমার পাছু নিয়েছে, সেটা রেখে যাওয়াই উচিত। কিন্ত মনে কর্‌লে আপনাকে হতাশ কর্‌তে পার্‌তাম।

 “আর এককথা। এ ছবিতে আর আমার কোন প্রয়োজন নাই। ও পাপ আমার গৃহে না থাকাই ভাল। যে আমায় ভালবাসে, আমি যাকে প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসি, এখন তার রূপ চিন্তা কর্‌তেই সময় কুলাইবে না;—অন্য ছবি লইয়া কি করিব? আমার নিজের একখানি ছবি রাখিয়া যাইতেছি। যদি কুমার বিদ্যুৎপ্রকাশ ইচ্ছা করেন, গ্রহণ করিবেন, নচেৎ আগুনে পুড়াইয়া ফেলিবেন। ইতি—

 আশীর্ব্বাদীকা
  শ্রীমতী—
 পরের মর্ম্ম অবগত হইয়া কুমার বিদ্যুৎপ্রকাশ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “যাহাই হউক, আপনারই জিত মহাশয়! আপনিই আজ আমায় বিপদ হইতে উদ্ধার করিলেন।”

 আ। আমার একটা অনুরোধ আছে।

 শশব্যস্তে বিদ্যুৎপ্রকাশ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলুন?”

 আমি হাসিয়া বলিলাম, “ঐ ছবিখানি।”

 বি। আপনার চাই?

 আ|। আজ্ঞা হাঁ।

 বি। কেন?

 আ। যে রমণী বুদ্ধিতে আমায় পরাজিত করিয়াছে, তাহার চিত্র আমার নিকট রাখিতে চাই।

 “বেশ কথা, এই নিন।” এই বলিয়া বিদ্যুৎপ্রকাশ উহা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পরে গাড়ী করিয়া আমায় বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।

 বাসায় আসিয়া বিশ্রামের চেষ্টা করিলাম, কিন্ত আমার মন তখন এত অস্থির ছিল যে, অনেক চেষ্টা করিয়াও ঘুম আসিল না। পরদিন প্রাতে ডাক্তারের বাড়ী গেলাম। ডাক্তার তখন গৃহাগত রোগীর ব্যবস্থা দিতে ছিলেন; আমাকে দেখিয়া হাসিয়া বসিতে বলিলেন। আমি তাঁহার নিকট একখানি চেয়ারে বসিলাম।

 রোগী দেখা শেষ হইলে ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছবিখানি আদায় হইয়াছে?”

 আমি বলিলাম, “তা না হইলে আর নিশ্চিন্তভাবে তোমার নিকট বসিয়া আছি।”

 এই বলিয়া ডাক্তারকে সমস্ত কথা বলিলাম। সকল কথা শুনিয়া ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন,—“এ ছবি লইয়া তুমি কি করিবে?”

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “ইনি আমার শিক্ষাদাত্রী। ইহাঁর নিকট হইতে আমার যথেষ্ট শিক্ষা লাভ হইয়াছে। ছবিখানি এক একবার দেখিলে ষড়রিপুর মধ্যে একটীর হাত হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইবে।”

 বলা বাহুল্য, এই ছবিখানি উদ্ধার করিতে যাহা কিছু খরচ হইয়াছিল, তাহার সমস্তই ও উপযুক্তরূপ পারিতোধিক বিদ্যুৎপ্রকাশ পরিশেষে প্রদান করিয়াছিলেন।

সমাপ্ত।


পৌষ মাসের সংখ্যা।

“খুনী কে?”

যন্ত্রস্থ।