ছিন্নমুকুল/উপসংহার

উইকিসংকলন থেকে

উপসংহার

 আরও কয়েক বৎসর অতীত হইয়াছে। এই অল্পকালের মধ্যেই ধ্বংসশীল জগতের ক্ষতিগ্রস্ত ভাগ কত পূরিয়া উঠিয়াছে। কত মরু কত শ্মশান শ্যামলক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে, কত শুষ্ক নদনদী জলে ভরিয়া উঠিয়াছে। এই অল্পকালের মধ্যেই কত দরিদ্র ধনবান হইয়াছে, কত পলাতক রাজা আবার আপন রাজ্যে অধিবেশন করিয়াছেন। কত মাতার পুত্রশোক লাঘব হইয়া আসিয়াছে; কত বন্ধু বন্ধুর শোক ভুলিয়াছেন, কত পত্নীব্রতস্বামী যাঁহারা একদিন স্ত্রীর নিকট শপথ করিয়া বলিয়াছিলেন, স্ত্রীর মৃত্যু হইলে নিশ্চয়ই তাঁহাদেরও প্রাণবিয়োগ হইবে, তাঁহারা আবার দ্বিতীয়বার দারগ্রহণ করিয়া সুখে সংসার নির্ব্বাহ করিতেছেন। প্রমোদও এই অল্পকাল মধ্যে কনককে ভুলিয়াছেন, কেবল মাঝে মাঝে স্বপ্নের ন্যায় কখনও কখনও কনকের কথা তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত হয়। প্রমোদের এখন একটি কন্যা ও একটি পুত্র। তাহাদের দেখিয়া কোনও কোনও সময়ে প্রমোদের শৈশবকাল মনে পড়ে, একআধবার কনককে মনে পড়িয়া একটু কষ্ট হয়, কিন্তু আবার নীরজার মুখের দিকে চাহিলেই সকল ভুলিয়া যান।

 কনকের মৃত্যুর পর হইতে হিরণের উপর আর প্রমোদের বিদ্বেষ ভাব রহিল না; হিরণের তিনি বিশেষ বন্ধু হইয়া পড়িলেন, হৃদয়ের সহিত তাঁহার সমদুঃখী হইলেন। কিন্তু কিছুকাল পূর্ব্বে যে ব্যক্তির বিন্দুমাত্র দয়া পাইলেও হিরণ চিবসুখী হইতে পারিতেন, এখন তাঁহার নিকট হইতে সহস্র মমতা পাইয়াও তাঁহার দুঃখের ভার কিছুমাত্র কমিল না। অনেক ক্ষতি কালে পূরণ হয় বটে, কিন্তু সকলরূপ ক্ষতি কাল পূরণ করিতে পারে না, সকলরূপ যন্ত্রণা কাল নিবাইতে পারে না। কত মহা সমুদ্র লোপ হইয়াছে কালে তাহার চিহ্ন মাত্রও নাই, কত মহানগরী ধ্বংস হইয়াছে এখন তাহার নাম মাত্র অবশিষ্ট আছে; কত পর্ব্বতশৃঙ্গ চূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহা আর উঠে নাই, হিরণের ভগ্নহৃদয়ও আর জোড়া লাগিল না; তাঁহার হৃদয়ের আগুন আর নিবিল না!

 একদিন প্রমোদ প্রত্যূষে উদ্যানে বেড়াইতে বেড়াইতে নদী তীরে আসিয়া দেখিলেন, জলের অব্যবহিত উপরে, সোপানে এক ব্যক্তি শয়ান, মাঝে মাঝে সোপানপ্রতিহত জলরাশি উচ্ছ্বলিত হইয়া তাহার অঙ্গে ছড়াইয়া পড়িতেছে, সে ব্যক্তির তাহাতে চেতনা নাই যেন গভীর নিদ্রায় অভিভূত। প্রমোদ নিকটে আসিলেন, শোকবিহ্বলচিত্তে দেখিলেন, সে ব্যক্তি হিরণকুমার — দেখিলেন হিরণকুমার মুমুর্ষু, প্রমোদ নিকটে আসিয়া তাহাকে সোপান হইতে উঠাইতে চেষ্টা করিলেন, তখন হিরণকুমার ধীরে ধীরে একবার চক্ষু উন্মীলিত করিলেন, অশ্রুময় নেত্রে প্রমোদের চক্ষুতে চক্ষু সংলগ্ন করিয়া অন্তিমকালের যাতনাকম্পিত স্বরে বলিলেন, “আমায় উঠিও না—আমি এইখানেই মরব, এইখানেই শুনেছিলাম, কনক আমাকে ভালবাসেন।

 বলিতে বলিতে হিরণ অবসন্ন হইয়া পড়িলেন, তাঁহার প্রাণত্যাগ হইল; প্রমোদ বিষাদাকুলচিত্তে স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

 হিরণের এই শেষ কথা গুলি অনেকদিন পর্য্যন্ত তাঁহার মনে লাগিয়া ছিল।

সমাপ্ত