ছিন্নমুকুল/ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

ঝটিকাবসানে

 এদিকে প্রমোদ ও নীরজা ঝড়ের উপক্রম দেখিয়া তীবে বোট লাগাইতে কহিলেন। কিন্তু বোট না লাগাইতে লাগাইতেই প্রবল বেগে বাতাস বহিতে লাগিল, মাঝিরা অতিশয় যত্ন করিয়াও বোট শীঘ্র তীরে লাগাইতে পারিল না। ঝড়ের অপ্রতিহত প্রভাবে বোট ক্রমাগত উজানে তাঁহাদের বাটীর দিকেই যাইতে লাগিল; মাঝিরা ক্রমে হাল ছাড়িয়া দিবার উদ্যোগ করিল। চতুর্দ্দিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়া প্রবল বেগে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; মাঝে মাঝে এক একবার বিদ্যুতের আলোকে গঙ্গার রুদ্র মূর্ত্তি, ও ছোট ছোট নৌকাগুলির বায়ুতাড়িত অবস্থা বোটস্থিত লোকদিগের মনে দারুণ বিভীষিকা-তরঙ্গ তুলিতে লাগিল। নীরজা প্রমোদের ভয়বিহ্বল বক্ষে মস্তক রাখিয়া অজ্ঞানপ্রায় হইয়া পড়িল। প্রমোদ নিরাশার বলে বলিষ্ঠ হইয়া মাঝিদিগকে উচ্চৈঃস্বরে বোট বাহিতে আজ্ঞা দিতে লাগিলেন।

 এদিকে বোট বায়ুভৱে প্রধাবিত হইয়া কখনও উচ্চে, কখনও নীচে, কখনো যেন পর্ব্বতে, কখনও যেন পাতালে উঠিতে লাগিল। তাঁহাদের বাটী আর বহুদূর নাই, কিন্তু বোটও আর তিষ্ঠায় না। বাতাসের একটি প্রবল ঝল্কায় বোটের মাস্তুল ভাঙ্গিয়া কোথায় উড়িয়া গেল। পরে বোটখানিও তরঙ্গ প্রভাবে তীরে ধাক্কা খাইয়া বিচূর্ণ হইল।

 সুখের বিষয় এই যে, প্রমোদ নীরজাকে বক্ষে লইয়া কুলের নিকট স্বল্প জলে লাফাইয়া পড়িতে পারিয়াছিলেন। অজ্ঞান প্রায় নীরজাকে-বক্ষে ধারণ করিয়া তিনি কিনারায় কিনারায় বাটী অভিমুখে যাইতে লাগিলেন। কিন্তু একে সেই বৃষ্টিধারাযুক্ত বাতাসের প্রবল বেগ তাহাতে আবার উন্মূলিত বৃক্ষশাখা প্রভৃতি প্রতিপদে তাঁহার গমনে বাধা দিতে লাগিল। তিনি সত্বর অগ্রসর হইতে না পারিয়া মূর্চ্ছাপন্ন নীরজাকে লইয়া অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। সহসা কিছু দূরে বৃক্ষের অন্তরালে ক্ষীণদীপালোক দৃষ্ট হইল, আশার আশ্বাসে বৃক্ষ কণ্টকাদির আঘাতে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া, দ্রুতপদে তিনি সেই দিকে চলিতে লাগিলেন। কিছু দূর আসিলে সেই আলোটিও চক্ষুর অগোচর হইল; তাঁহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। নীরজাকে লইয়া তিনি কোথায় যান! বৃক্ষতলে দাঁড়াইবার যো নাই, প্রতিক্ষণে ঝড়ের বেগে শাখা ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে! তিনি নিরাশচিত্তে মুহূর্ত্তকাল কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় ভাবে দাঁড়াইয়া পড়িলেন, সহসা সেই ঝড় বৃষ্টি-গর্জ্জনের মধ্যে কোন মনুষ্যের কাতরচীৎকার তাহার কর্ণে প্রবিষ্ট হইল। সেই সময় বিদ্যুতালোকে তিনি দেখিলেন, এক জন মনুষ্য তাঁহার নিকট দিয়া অতি দ্রুতবেগে পলায়ন করিল। আর একবার বিদ্যুৎ হানিল, তিনি দেখিতে পাইলেন, তাঁহার সম্মুখে কিছু দূরে এক ধবলাকার পদার্থ। কোন ভগ্ন অটালিকা হইবে—এই আশা করিয়া সেই দিকে আসিলেন, কিন্তু সেখানে আসিয়া বিদ্যুতালোকে যাহা দেখিলেন, তাহাতে স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। দেখিলেন একজন মৃতপ্রায় মনুষ্য কষ্টব্যঞ্জক অস্ফুট আর্ত্তনাদ করিতেছে।

 প্রমোদ বুঝিলেন, কিছুক্ষণ পূর্ব্বে তাহারই চীৎকার তিনি শুনিতে পাইয়াছিলেন। এবং যে ব্যক্তিকে তাহার নিকট দিয়া পলায়ন করিতে দেখিলেন, ভাবিলেন, সেই ইহাকে আহত করিয়া গিয়াছে।

 মূর্চ্ছাপন্ন নীরজা তাঁহার বক্ষে, আর আহত মুমূর্ষ ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে হয়তো যত্ন করিলে সে এখনো বাঁচিতে পারে, প্রমোদ যে কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। এই সময় আর এক ব্যক্তি তাঁহার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল, সে আসিয়া প্রমোদকে এবং ভূপতিত ব্যক্তিকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়, আপনারা বিপদে পড়েছেন আমি চীৎকার শুনেই দৌড়ে এসেছি, কাছেই এই গাছের আড়ালে আমার কুটির, সেইখানে চলুন। আমি এ লোকটিকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

 তাহাকে দেখিয়া প্রমোদ যেন প্রাণ পাইয়া তাহার সহিত একত্রে কুটিরে আসিয়া পৌঁছিলেন। কুটিরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, গৃহ পার্শ্বে একটি অগ্নিপাত্র। তিনি তাহার নিকট একখানি মাদুরে নীরজাকে শয়ন করাইয়া উত্তাপ দিতে দিতে ক্রমে তাহার জ্ঞান সঞ্চার হইতে লাগিল।

 এদিকে অপর ব্যক্তি সেই আহত ব্যক্তিকে মাটীতে ফেলিয়া দেখিল, একটি পিস্তলের গুলি তাহার স্কন্ধ দিয়া চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু বুঝিল তাহা সাংঘাতিক নহে অল্প যত্নেই সে আরোগ্যলাভ করিবে। সে ক্ষতস্থান বন্ধনে যত্নপর হইল। ইহার মধ্যে নীরজাও সজ্ঞান হইয়া উঠিয়া বসিল। তখন প্রমোদ সুস্থির হইয়া আহত ব্যক্তির দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। নীরজাও বসিয়া তাহার দিকে চাহিয়া দেখিল, দেখিবামাত্র সহসা চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, প্রমোদও সন্ন্যাসীকে চিনিতে পারিলেন। চিনিয়া নীরজা পিতার নিকট আসিয়া ব্যাকুলভাবে তাঁহার সেবা করিতে লাগিল। ক্রমে তাঁহাদের যত্নে সন্ন্যাসী অনেকটা শান্তিলাভ করিলেন, তাঁহার কথা কহিবার সামর্থ্য জন্মিল। তখন তিনি বাগ্রতা সহকারে বলিয়া উঠিলেন,

 “তোমরা একজন কেহ এখনি পুলিষে যাও। নহিলে আজ এখনি হত্যাকাণ্ড হবে।”

 সকলে আশ্চর্য্য ভাবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, যেন তাঁহার কথার অর্থ বুঝিতে অক্ষম। পিতাকে কথা কহিতে দেখিয়া আহ্লাদে নীরজা তাঁহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে লাগিল। সন্ন্যাসীও আহ্লাদে অভিভূত হইয়া পড়িলেন। সন্ন্যাসীকে ঈষৎ সুস্থ দেখিয়া শুশ্রূষাকারী বলিল “মশায়, আর ভয় কি, রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে। ভাগ্যিস্ গুলি হাড়ে লাগিনি শুধু মাংসের উপর দিয়েই চলে গেছে, নইলে কি আর রক্ষা থাকত? এখন ত আরামই হয়ে গেছেন বল্লে হয়। এখন বলুন দেখি কি ক'রে এ রকমটা হোলো?

 তাহার প্রতি এবার প্রমোদের দৃষ্টি পড়িল, তিনি দেখিলেন সে যামিনীর পূর্ব্ব ভৃত্য। যখন তাঁহারা কানপুরে বেড়াইতে যান সে তাঁহাদের সঙ্গে গিয়াছিল। নীরজাও তাহাকে চিনিয়া আশ্চর্য্যবিস্ফারিত-নেত্রে বলিয়া উঠিল, “আমি কি ঠিক দেখছি? তুমি কি সেই নৌকান্ দয়াবান দাঁড়ি নও? তুমিই কি আমাকে অসীম বিপদে প্রথমে আশ্বাস দাও নি?”

 রামধন সন্ন্যাসীর মুখে পানীয় দিতে দিতে বলিল, “হ্য। আমিই সেই দাঁড়ি। তা সেই এক বিপদ আর এই এক বিপদ; কি করে এমনটা হোল মশায়?”

 সন্ন্যাসী আরও কিছু সামর্থ্য পাইয়া বলিলেন, “রেণীঘাট থেকে পার্ব্বতী মন্দিরে যাচ্ছিলেম—ঝড় বৃদ্ধি দেখে পথে একটী ভগ্ন দেবালয়ের মধ্যে আশ্রয় নিলেম। অনেকক্ষণ হল, ঝড় থামল না, কি করব ভাবছি, এমন সময় বিদ্যুতের আলোতে দেখলেম তিন চার জন লোক সেই দেবালয়ের দিকে আসছে। তারা এল, কিন্তু ঘরে না ঢুকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি কথা বার্ত্তা কইতে লাগল—”

 সকলেই উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, কি কথা!”

 স। আমি সকল কথা শুনিতে পাই নি। কিন্তু মাঝে মাঝে দুই একটা যা’ শুনলেম তাতে এইটে বুঝলেম যে তাদের অভিসন্ধি ভাল নয়।

 ব্যগ্রভাবে সকলে জিজ্ঞাসা করিল, “কি রকম?”

 স। হিরণকুমার ব’লে একজনকে খুন করতে যাবার আগে তারা কজন মিলে আর একজন সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেক ক্ষণ অপেক্ষার পর একজন বল্লে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব, চল, যাওয়া যাক!”

 অন্য সকলে। তারপর?

 স। তার পর, তারা গিয়েছে ভেবে আমি ঐ অভিসন্ধির কথা প্রকাশের অভিপ্রায়ে তাড়াতাড়ি মন্দির থেকে বাইরে এসে দেখি, দস্যুদের মধ্যে তখনো একজন যায় নি, কেবলমাত্র সেই যাবার উদ্যোগ করছে। আমাকে দেখে সে বুঝলে আমি তাদের সকল কথা শুনেছি, অমনি আমাকে লক্ষ্য করে পিস্তল ছুঁড়লে, আমি পড়ে গেলেম। পরে কি হল আর জানি না। যা হোক্ এখনি এ অভিসন্ধির কথা পুলিসে জানান দরকার।”

 প্রমোদ বলিলেন, “নিশ্চয়ই।”

 রামধন তখন সেই ঝড়বৃষ্টি ভ্রুক্ষেপ না করিয়া পুলিসে সংবাদ দিতে চলিল।