ছিন্নমুকুল/ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

মনের কথা

 অন্তঃপুরে প্রমােদের শয়নকক্ষে বসিয়া, কনক নীরজার চুল বাঁধিয়া দিতেছিল। এ বড় সাধের চুল বাঁধা, প্রমােদের মনে ধরান চাই, কিন্তু প্রমােদের মনে ধরিবে কি না সে তো পরের কথা, কনকের এখন মনে ধরিলে হয়। কতবার যে কনক চুল খুলিয়া বাঁধিল তাহার ঠিক নাই, তথাপি কনকের মনে ধরিল না, বাঁধাও শেষ হইল না, বেচারী নীরজাও আর সে চুল বাঁধা হইতে ত্রাণ পাইল না। এ বন্ধনের অন্ত নাই দেখিয়া নীরজা বলিল—

 “নে ভাই, তোর কি আর হবে না? রাত হয়ে গেল যে!” কনক তাহার হেলিত মস্তক সমান করিয়া লইয়া বলিল—

 “তুই, ভাই, সেই অবধি যে নড়ছিস্ তা কি করে হবে? নইলে এতক্ষণ হয়ে যেত। কতবার যে বাঁকা হয়ে গেল তাই খুল্‌তে হোলো। তুই, ভাই, বনে থেকে থেকে বনের হরিণের মত চঞ্চল হয়ে পোড়েছিস্‌।”

 নী। আহা বনের হরিণ হওয়ায় যে কি সুখ তা ভাই, তুই কি করে জানবি? না, ভাই—বনের এলো হরিণ হওয়ায় চেয়ে পোষা হরিণ হওয়াই ভাল।

 ক। তুই সেই জন্যই বুঝি সাধ করে ব্যাধের হাতে ধরা দিলি?

 নী। না, ভাই, আমি সাধ করে ধরা দিইনি।

 ক। আমার দাদা তো পাখী শীকারে গেছলেন, তা তুই ধরা দিলি কেন?

 নী। তা, ভাই সাধ করে কি ধরা দিলেম?

 ধরা পড়লেম ফাঁদে,
 নইলে কোথা হরিণবালা ব্যাধের লাগি কাঁদে?

 ত, যাক, এখন তোর পায়ে পড়ি ভাই, শীঘ্র বেঁধে দে, হাজার বাঁকা হলেও এবার যেন খুলিস নে।

 কেন, এর মধ্যেই তোর সাধ ফুরুলো? এই যে বাঁধবার সময় বল্লি, “সে দিনকার বাঁধাটা উনি প্রশংসা করেছিলেন, সেই রকম করে বেঁধে দেও।”

 নী। তা, ভাই কি করব? আমার মাথা ব্যথা হয়ে গেছে আর পারিনে, ভাই। তুই এতক্ষণে বাঁধতে পারলি নে আমি কি করব?

 কনক সোহাগভরে চুল বাঁধা রাখিয়া একটু অভিমান করিয়া বলিল—

 তবে এই রইল, আমি আর বাঁধব না, আমার মনের মত বাঁধতে দিবিনে তবে তোর যেমন করে ইচ্ছা বাঁধ্‌গে।”

 নী। রাগ! আচ্ছা আর বাপু বলব না, তুই যত ইচ্ছা দেরি কর, সেই কাল সকাল বেলা উঠিস্, আমার কি?

 ক। অমনি আর কি? তোর ঐ এক কথায় বুঝি আমার রাগ যাবে? আজ তোকে পায়ে ধরে সাধাব তবে হবে। তুই যে বড় কথায় কথায় অভিমান করে দাদাকে সাধাস, আমার বুঝি তাতে রাগ হয় না? আমি আজ তার শোধ তুলব?

 নী। আচ্ছা তাই সই, কিন্তু ভাই সাধতে গেলেই গান গাইতে হয়, একটা সাধবার গান তুই আমাকে শিখিয়ে দে, আমি ভাই বুনোমানুষ ওসব গানের তো আমার বিদ্যে নেই। কনক এই কথায় ঠাট্টা ছাড়িয়া বলিল—

 “আমার তো অদৃষ্টে কখনো অভিমানের পর আদর ঘটেনি, চিরকাল অভিমান করে মনে মনেই কষ্ট সহ্য করে আসছি। কষ্টের গান ছাড়া তো আর আমি কিছুই শিখিনি যে তোকে শেখাব।”

 কনক এই বলিয়া যেন কিছু বিষণ্ণ হইল, পূর্ব্বের আমোদের ভাব ছাড়িয়া আপন মনে গুন গুন করিয়া গাহিতে লাগিল—

“কে আছে রে অভাগিনী, আমার মতন?
জানিনে কখনো কি বা সোহাগ যতন।
জনম দুঃখিনী, হায়! আপনারি ভাবি যায়
ছুঁতে যাই, অমনি সে হয় অদর্শন।

পরিমলে মাখামাখি একটী গোলাপ দেখি
আপনা ভুলিয়ে, আহা! মোহময় হরষে,
ভুলিতে গিয়াছি যে, প্রফুল্ল কুসুম সেই
অমনি শুকায়ে গেছে এ হাতের পরশে।
একটী পুষেছি পাখী যদি ভাল বাসিয়ে,
দুদিনে খাঁচাটি ভেঙ্গে গিয়েছে সে পালিয়ে,
কাঁদিয়ে জনম গেল, কেহ তো বাসেনি ভাল,
অনন্ত এ অশ্রুধারা করেনি কেহ মোচন।”

 গানটি খানিকক্ষণ শুনিয়া নীরজা বলিল—

 “এই এতক্ষণ ভাই তুই কেমন ছিলি, কেন আমি মরতে গানের কথা পাড়লুম। তোর এই রকম ভাব দেখলে আমার বড় ভয় হয়, জানি যে তাহলে সমস্ত দিনটাই তোর এইভাবে কাটবে।”

 ক। তা কাটলোই বা? তাতে কার কি এল গেল, ভাই?

 নী। তা বইকি? আমার সঙ্গে যে তা হ’লে সমস্ত দিন কথা কইবিনে? আমার যে একলাটি চুপ করে থেকে গুমরে মর্‌তে হবে।”

 ক। তা আমি নাইবা কথা কইলুম, তুই দাদার গল্প করিস, আমি শুন্‌ব এখন, তা হলেই তো তোর হ’ল?

 নী। শুধু ওরূপ করে শুনিয়ে কি তেমন মজা হয়?

 ক। তবে আবার কি চাই?

 নী। হেসে গল্প করে না শুনলে আমি তোকে বলব না ত।

 ক। তুই দেখিস দেখি, আমি হেসেই শুনব। তোর সুখের কথায় কি ভাই, আমার আমোদ হয় না?

 নী। আচ্ছা তা যেন তোর হয়, কিন্তু তুই ভাই মাঝে মাঝে অমন বিষণ্ণ হোস্‌ কেন?

 ক। কি করে তা বলব?

 নী। আপনার মনের কথা আর আপনি বলতে পারবি নে! তবে কি তোর দাদাকে ও কথা জিজ্ঞাসা করব নাকি?

 ক। তা বইকি! আচ্ছা তুই বল দেখি সে দিন কাঁদ্‌লি কেন?

 নী। সত্যি কথা বলব? তোর দাদার উপর অভিমান হয়েছিল।

 ক। কেন গো?

 নীরজা একটু হাসিয়া বলিল “ভাই, ও কথা জিজ্ঞাসা করিসনে। অভিমানের কারণ কিছুই নেই, শুধু শুধু।”

 ক। আমারো ভাই তবে এরূপ ভাবের কারণ কিছুই নেই, তোকে আর কি বলব।

 নী। দূব ভাই, তুই দেখছি ছাড়্‌বিনে। সে পাগলামীর কথা বলতে বড় লজ্জা করে, কিন্তু নিতান্তই শুনবি?

 ক। যদি বলিস্।

 নী। দেখ্ ভাই আমি নতুন তোর কাছে পান সাজতে শিখে, নিজে এক পান সেজে বাইরে তাঁকে পাঠিয়ে দিই, রাত্রে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করলুম—খেয়েছিলে? তিনি বল্লেন, সেখানে একজন ভদ্রলোক থাকায় পানটি তাঁকে দিতে হয়েছিল। এতেই ভাই, আমার বড় দুঃখ হল।

 তাহার অভিমানের কারণ শুনিয়া কনক একটু হাসিয়া বলিল “তোর, ভাই এত অল্পে অভিমান হয়?”

 নীরজা একটুখানি লজ্জার হাসি হাসিয়া বলিল “আমিতো এখন তোকে সব খুলে বল্লুম—এবার তুই বল দেখি তোর বিষণ্ণ ভাবের কারণ কি? কেন ভাই, তোর যখন এত অল্পে দাদার উপর অভিমান হয়, আমি দাদাকে এত ভালবাসি যখন ভাবি তিনি আমাকে ভালবাসেন না, তখন কি দুঃখ হয় না?

 এই কথা শুনিয়া নীরজার অতিশয় আহ্লাদ হইল। প্রমাদকে কেহ ভালবাসে শুনিতেও নীরজার ভাল লাগে। যদি কেহ নীরজার প্রিয়পাত্র হইতে ইচ্ছা করে তাহা হইলে প্রমোদের প্রশংসা করাই তাহার অভীষ্ট সিদ্ধির একটি সহজ ও অকাট্য উপায়।

 নীরজা কনকের কথায় আহ্লাদে হাসিয়া বলিল—“আচ্ছা ভাই, সত্যি তুই তোর দাদাকে খুব ভালবাসিস? তোর দাদাও তোকে খুব ভালবাসেন, আর দুঃখ করতে হবে না?”

 ক। তোমার আর আমাকে প্রবোধ দিতে হবে না।

 নী। আচ্ছা, তা দিচ্ছিনে কিন্তু বল্ দেখি, দাদাকে সত্যিই খুব ভালবাসিস?

 ক। কেন? তাতে তোর রাগ হয় নাকি? সেজন্য যেন আবার দাদার উপর অভিমান করে বসিনে। হ্যাঁ, খুব ভালবাসি, তোর চেয়েও ভাল বাসি।

 এই কথায় আহ্লাদে ঢলঢল ভাবে নীরজা বলিল—“তোর দাদাটি যে মিষ্টি তা আর বাস্‌বিনে। কিন্তু ভাই, দেখিস আমাকে ফাঁকি দিস্‌নে?”

 ক। নে ভাই, তোর ঐ এক পচা, পুরাণ, জঘন্য ঠাট্টা রেখে দে, আর বুঝি ঠাট্টা জানিস্‌নে?

 নী। আমি ঐ ঠাট্টাটি নতুন যে ভাই শিখেছি, তা তোর আজ এখন মন ভাল নেই, এখন যে কি রকম ঠাট্টা তোর ভাল লাগবে, তাতো জানিনে। তোর দাদার মত করে ঠাট্টা করব?

 বলিয়া নীরজা কনকের দিকে মুখ ফিরাইয়া তাহার চিবুক ধরিয়া গাহিল—

আয়লো, সরলে, প্রাণের প্রতিমা,
আয়লো, হৃদয়ে রাখি,
কতদিন হতে রয়েছি আশায়,
কি বলিব বল সখি?

আয়, আয়, ভাই, তেমনি করিয়ে
গা না লো মধুর গান,
কি মোহিনী গুণ আছে ঐ গানে
পাই যেন নব প্রাণ;
পেয়েছি তােরে লো হাসিব এখনি
ভুলিব প্রাণের জ্বালা,
ও হাসি হেরিলে আঁধার এ হৃদে
জোছনা ভাতিবে, বালা।
স’রে আয়, সখি ভাল করে দেখি,
আজি এ কেমন বেশ!
নয়ন কমল, জলে ঢল ঢল,
এলানাে ছড়ান শে।
পারিনে, পারিনে, দেখিতে পারিনে
ও মুখ তোমার ম্লান,
মরমের শিকে কি যে বেঁধে শেল
ফেটে উঠে যেন প্রাণ।
সরলে আমার, সর্ব্বস্ব ধন,
আয়লো, হৃদয়ে আয়,
ভাঙ্গা চোরা এই হৃদয় আমার
চিরদিন তোরি, হায়!
তোমারি কারণ জীবন ধারণ,
আমি যে তােমারি, সখি,—
প্রমােদ-মাখানো প্রাণের প্রতিমা,
আয় তােরে হৃদে রাখি।

ভাই, তাের দাদার কাছে গানটি শিখেছি।

 কনক নীরজার দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া চাহিয়া তাহার গানটি শেষ হইলে একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল—

 “দাদার কাছে শিখেছিস্, বেশ করেছিস্, এখন এদিকে মুখ ফিরিয়ে আমার যে কাজ বাড়ালি, তার কি বল্ দেখি? তুই ভাই, আজ দেখছি কোন মতে ভাল করে চুল বাঁধতে দিবিনে।”

 নীরজা অপ্রস্তুত হইয়া হাসিয়া বলিল “তোর দাদার কথায় আমার ভাই জ্ঞান থাকে না; না, ভাই, আর করব না, এবার বেঁধে দে।”

 নীরজার অসাবধানতার অর্দ্ধবিনায়িত একটি বিনুনী যে কনকের হস্তচ্যুত হইয়া অল্প খুলিয়া গিয়াছিল, সেইটি কনক আবার হস্তে তুলিয়া বিনাইতে বিনাইতে বলিল—“গানটি ভাই কিন্তু বেশ। গানটি গেয়ে বুঝি দাদা তোর অভিমান ভাঙ্গিয়েছিলেন? অত অভিমান করিস্ কেন, ভাই?”

 নী। তুই অত দুঃখ করিস্ কেন ভাই।

 ক। নে, ভাই, তুই আবার আমার অত দুঃখ পেলি কোথা?

 নী। পাব আর কোথা? দেখতে পাই। ছিঃ! ভাই দাদার উপর কি মিছে দুঃখ কর্‌তে আছে? তাঁর হোল কনকগত প্রাণ।

 ক। অল্পেতেই কথায় কথায় তোর যে অভিমান, কনকগত প্রাণ হলে কি আর রক্ষা থাকত।

 নী। না, ভাই, তাতে কি অভিমান করি? এখন বাসেন না তাই, দেখা যেত, বাসলে কর্‌তিস্ কি না।

 নীরজা বলিল “আমার সোনার চাঁদ কনক, তোকে পেয়েছি কত ভাগ্যি, তোকে ভালবাসলে কি রাগ করতুম? আমার ভাই ভাগ্যি যে তুই জলে ডুবে মরিসনি, তা হলে এমন করে বসে কার সঙ্গে গল্প করতুম? আচ্ছা, ভাই কনক, তোকে তীরে দেখে যখন হিরণকুমার বোটে তুলে নিয়ে গেল, তখন তোর কি একটুও জ্ঞান ছিল না?”

 ক। আবার সেই জলে ডোবার গল্প? কত বার ঐ এক গল্প করব? এই নে ভাই, চুল বাঁধা এবার শেষ হোলো।

 তখন নিস্তার পাইয়া কনকের দিকে ফিরিয়া বসিয়া নীরজা বলিল—

 “তা ক্র্লিই বা, এক গল্প কি আর দু’বার করতে নেই নাকি? আচ্ছা ভাই, বাড়ীর লোকেরা তোকে কেউ পেলে না কেন? ভাল করে খুঁজলে কি আর পেতো না?”

 ক। বাড়ীতে আর কে ছিল বল্? শুধু চাকর দাসী? তা তারা মায়ের দাহ কার্য্যেই ব্যস্ত। তারপর তারা বোধ হয় এক দিকে খুঁজতে খুঁজতে হিরণকুমার অন্য দিক থেকে ততক্ষণে আমাকে বোটে তুলে নিয়েছেন।

 নীরজা বলিল “ভাগ্যে হিরণকুমার তোকে দেখতে পেয়েছিল!”

 কনক আর কিছুই উত্তর করিল না, এই জলমগ্নের কথায় কনক আরো বিষণ্ণ হইয়া পড়িল। দেখিয়া নীরজা বলিল—

 “কথায় কথায় তবু তোর বিষণ্ণতা ঘুচে এসেছিল, আবার ভাই, সেভাব কেন বল দেখি? তুই ভাই, বাস্তরিক কি একটি আমার কাছে ঢাকিস্। তুই আমাকে তোর দুঃখের যে কারণ বলিস্ তা ছাড়া আর একটা কি নিশ্চয়ই তোর মনে আছে।”

 কনক এই কথাটি শুনিয়া আর থাকিতে পারিল না, তাহার চক্ষু হইতে দুই এক বিন্দু অশ্রু ধীরে ধীরে ভূমিতে পতিত হইল। নীরজা বুঝিল, তাহার অনুমান ঠিক না হইয়া যায় না। ব্যথিত হৃদয়ে বলিল “বলনা ভাই, তুই আমার কাছে কি কথা ঢাক্‌ছিস? কনক আমি তো ভাই, তোর কাছে কিছু ঢাকি নে।”

 নীরজার স্নেহবাক্যে কনকের অশ্রু আরও উথলিয়া উঠিল। নীরজার আর সন্দেহ মাত্র রহিল না! কনকের হৃদয় যে একটি লুকানো ব্যথা জাগিতেছে এবং ব্যথাটা যে কিছু গুরুতর রকমের, মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া লইয়া সে ভাবিল “কিন্তু কেন? কনকের কথা বিশ্বাস করতে গেলে এর কোন কারণই নেই। তাও নাকি হয়? কনক কি কাউকে ভালবেসেছে নাকি? আমি যখন প্রমোদকে ভালবেসেছিলুম তখন প্রমোদের নাম শুনলেই, প্রমোদের কথা মনে এলেই, এমন কি তাঁর সঙ্গে যে ফুলটি পর্য্যন্ত একত্রে দেখেছি সে ফুলটি দেখলেও মনটা কি ভয়ানক ব্যাকুল হয়ে পড়ত, আপনা হতেই কেমন চোক বিয়ে জল আসত। এতো তাই নয়? কিন্তু কনক ভালই বা কাকে বাসবে? প্রণয়ের পাত্র কই?” নীরজার মনে হইল “অনেক দিন কনক হিরণের সহিত একত্রে বাস করেছিল, হিরণই তাকে বাঁচিয়েছে; হিরণকে তো সে ভালবাসে নি? নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই তাই।” নীরজা কনকের হাতটি ধরিয়া সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিল “কনক তুই কি কাউকে ভালবেসেছিস? বল্‌না ভাই? তুই কি হিরণকে ভালবাসিস্?”

 হিরণের নাম শুনিয়া কনকের মুখটী একটু আরক্তিম হইল, ক্রমে আবার নেই আবক্তিম বিষণ্ণ মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া আসিল, কনকের অধর প্রান্তে একটু যেন সলজ্জ হাসির রেখা পড়িল। তাহাকে নিরুত্তব এবং তাহার ভাব দেখিয়া নীরজা বুঝিল কনক যথার্থ ই হিরণকে ভালবাসে। বুঝিয়া কিন্তু নীরজা মনে মনে দুঃখিত হইল। প্রমোদের নিকট হিরণের কথা নীরজা যেরূপ শুনিয়াছিল, তাহাতে সে তাহাকে স্বামীর শত্রু ও নিতান্ত মন্দ লোক বলিয়াই জানিত। যে তাহাদের শত্রু, মন্দ লোক বলিয়া যাহাকে তাহারা ঘৃণা করে তাহাকে কনক ভালবাসিবে এ কথা মনে করিতেও তাহার কষ্ট হইল। যদি কোন মতে কনকের মন হইতে সে ভালবাসা ঘুচাইতে পারে এই চেষ্টায় বলিল,

 “কেন ভাই, তাকে তুই ভালবাসলি? সে ভারী খারাপ লোক, যে তোর ভাইকে খুন করতে গিয়েছিল, তাকে ভাই তুই ভালবাসলি? তাকে ভালবেসে তুইত সুখী হবিনে।”

 নীরজা বালিকা জানে না যে, প্রণয়ের মূল উৎপাটন করিতে গেলেই আরো দৃঢ় হইয়া বসে। নীরজার কথায় কনকের বিষণ্ন মুখমণ্ডল যেন সহসা জ্বলিয়া উঠিগ, অশ্রুবারি শুকাইয়া গেল, কনক ধীর-গম্ভীর ভাবে বলিল—

 “হিরণ খারাপ লোক নন, হিরণ কখনও খুন করতে যান নি, এ কথা যে তোমাদের বলেছে সে মিথ্যাবাদী, তাঁকে না জেনে কেন দোষ দাও? তাঁর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক না থাকলেও একজন সত্যিকার ভাল লোকের মিথ্যা নিন্দা আমি কেমন ক'রে শুনব?”

 তখন নীরজা কেবল ঈবং ঘৃণা-ব্যঞ্জক-স্বরে বলিল—“ওঃ এত দূর?”

 এই স্থানে তাহাদের কথোপকথন বন্ধ হইল, দুজনের মনের ভাব দুজনে বুঝিয়া দুজনেই নিস্তব্ধ হইয়া গেল। কনক ভাবিয়াছিল, একদিন তাহার মনের কথা মীরজাকে বলিয়া সে একজন ব্যথার ব্যথী পাইবে। কিন্তু আজ বুঝিল সে আশা বৃথা।