ছিন্নমুকুল/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

মোহ-মুগ্ধ

 যুবকেরা বাড়ী ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু অন্য দিনের ন্যায় সে দিন পরস্পরে কথোপকথন চলিল না। দু’জনেই আপন মনে থাকিয়া প্রায় নিস্তব্ধ ভাবেই দিন কাটাইলেন। আশ্চর্য্য! পূর্ব্বদিনকার ঘটনার কথা লইয়া কোথায় দু’জনের গল্প থামিবে না, না দু’জনেই আজ নিস্তব্ধ, দুজনেই চিন্তামগ্ন। কিন্তু কেহ মনোনিবেশ পূর্ব্বক উভয়কে দেখিলে বুঝিতেন যে তাঁহাদের সেই নিস্তব্ধ মুখমণ্ডল পরস্পর কেমন ভিন্ন-ভাবব্যঞ্জক। প্রমোদ গম্ভীর, প্রশান্ত, যেন বহির্জগতের সহিত তাঁর কোন সম্পর্কই নাই, তাঁহার দৃষ্টি লক্ষ্যশূন্য, মুখে প্রফুল্লতা নাই; আর যামিনীনাথের অধীর ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাসে যেন অনল বহিতেছে, কখনও কখনও কিসের ভাবে কে জানে তাঁহার ওষ্ঠাধর আহ্লাদে কাঁপিয়া উঠিতেছে, আবার কখনও যেন আপনাআপনি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হইয়া পড়িতেছে। উভয়ের মনে মনে চিন্তাস্রোত বহিয়া যাইতেছে, কিন্তু কেহই কাহারও নিকট আপন মনোভাব প্রকাশ করিতেছেন না, একজন ভাব-প্রকাশ বিষয়ে যেন সম্পূর্ণ উদাসীন, আর একজন সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক।

 এইরূপেই প্রায় সে দিনটি কাটিল। দু’একটি সামান্য কথা ছাড়া তাঁহাদের কোন কথাই আর হইল না। দু’জনের কেহই পূর্ব্বদিনকার কথা তুলিলেন না। অপরাহ্নে যামিনীনাথ বাহিরে গেলেন। আগামী কল্যই তাঁহাদের কানপুর ছাড়িবার কথা— তাহার আগে কানপুরের আলাপী বন্ধুদিগের সহিত একবার দেখা সাক্ষাৎ করা উচিত; কিন্তু প্রমোদকে আজ ইহাতে নিতান্ত অনিচ্ছুক দেখিয়া অবশেষে যামিনীনাথ একাকীই গমন করিলেন। প্রমোদ নিঃসঙ্গ হইয়া ক্ষণকাল পাঠে মন দিতে চেষ্টা করিলেন; কিন্তু তাহাতেও অকৃতকার্য্য হইয়া—চিন্তাভারাক্রান্ত মনকে শান্তি দান করিতেই যেন, সুদৃশ্য ভাগীরথীর তীরে আগমন করিলেন। সেখানে আসিয়া দেখিলেন— পরপারেই সেই অরণ্য। সেই বনদেবীর বাসস্থান। পূর্ব্বদিনের স্মৃতি জ্বলন্তভাবে তাঁহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিল। ভাবিতে ভাবিতে তিনি যে পুনরায় সেই অরণ্যের দিকেই চলিতেছেন—তাহা নিজেই বুঝিতে পারিলেন না। অজ্ঞাত তাড়িতশক্তির প্রভাবেই যেন পদে পদে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অরণ্যে আসিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল,—কিন্তু তখন আর ফিরিয়া যাইতে পা উঠিল না—ভাবিলেন সন্ন্যাসীর সহিত একবার দেখা করিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া আসিলে হয় না। পূর্ব্বরাত্রে যে পথ দিয়া মন্দিরে গিয়াছিলেন, প্রবল ইচ্ছার বশবর্ত্তী হইয়া সেই পথ ধরিলেন। কিন্তু দূর হইতে মন্দিরচুড়া যখন নজরে পড়িল তখন সহসা কেমন একটা লজ্জার ভাবে, সঙ্কোচের ভাবে, তিনি সেইখানেই বন্ধপদ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। একবার মনে করিলেন, ফিরিয়া যাই— আবার ভাবিলেন, “এতদূর আসিয়া সন্ন্যাসীকে একবার না দেখিয়া ফিরিয়া যাইব তাহাই বা কিরূপে হয়।”

 সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে, ধরণী ধূসরবর্ণ আবরণে আচ্ছন্ন। মন্দিরচূড়া ক্রমশঃ প্রমোদের দৃষ্টি হইতে অন্তর্ধান হইল। প্রমোদ হতাশচিত্তে শূন্যমনে কাননের চতুর্দ্দিক অবলোকন করিলেন।—সেদিনের মত কোন দেবী প্রতিমা কি তাঁহার নেত্রগোচর হইবে না?— সেইরূপ মধুর সঙ্গীতধ্বনিতেও কি একবার তাঁহার তৃষিত কর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করিবে না? সহসা প্রমোদের হৃদয়তন্ত্রী বাজিয়া উঠিল,—আজও বনদেবী গাহিতে গাহিতে ক্রমে তাঁহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রমোদকে দেখিয়া সবিস্ময়ে বলিল— “একি আজও!”

 প্রমোদ কি উত্তর দিবেন! আসিয়াছেন বলিয়া মনে মনে অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন। বালিকা সরলভাবে আবার বলিল— “আজও কি পথ হারিয়েছেন? মন্দির ত কাছেই—বিশ্রাম করবেন?”

 প্রমোদ লজ্জিতভাবে বলিলেন “না আজ আমার কোন পরিশ্রম হয়নি আমি শুধু বেড়াতে এসেছি—এখনি ফিরে যাব।”

 বা। না, তা হবে না; একবার মন্দিরে আসুন না—বাবার সঙ্গে দেখা হবে।”

 প্রমোদ বলিলেন—“মন্দিরে? হ্যাঁ তা আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করব বলেই এসেছি— কিন্তু অন্ধকার হয়ে পড়েছে—আজ ফিরে যাই, আপনিও এইবেলা যান্।”

 বালিকা হাসিয়া বলিল— “অন্ধকার হয়ে পড়েছে, এখনি চাঁদ উঠবে এখন,—এমন কত অন্ধকার রাতে আমি একলা এখানে বেড়াই।”

 প্র। অন্ধকারে ভয় করে না! বলেন ত আপনাকে মন্দির পর্য্যন্ত পৌঁছে আসি।

 নী। ভয় কিসের? ছেলাবেলা থেকে এই বনে আছি—অমাবস্যার রাতেও একলা বেড়াতে আমার ভয় করে না। বাবা অনেক গান গেয়ে গেয়ে ঘুরে সময় কুটীরে শাস্ত্র পাঠ করেন, আমি বনে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াই—তিনি ডাকলে তখন ঘরে ফিরি। আমার মনে হয় তমসা মুরলা আমার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াচ্ছেন।”

 প্রমোদ উত্তররামচরিত পড়েন নাই,— তমসা মুরলার উল্লেখ বুঝিলেন না,—বলিলেন—“তমসা মুরলা! তাঁরা কে?”

 বা। তাঁরা বনদেবী, সীতাদেবীর সখী; আমারো সখী।”

 প্র। আপনি ত নিজেই বনদেবী, শকুন্তলা পড়েছেন? আপনাকে দেখলে আমার সেই তাপসীকন্যাকে মনে পড়ে।”

 বা। আমার দুষ্মন্তকে মোটেই ভাল লাগে না, তিনি কি সত্যিই শকুন্তলাকে ঋষির শাপে ভুলে গিয়েছিলেন? আমার তা কিছুতেই বিশ্বাস হয় না।

 প্র। আপনি দেখছি খুব সংস্কৃত জানেন। বাঙ্গ্‌লা পড়েছেন কি?

 বা। পড়ি বইকি? বাবা আমার জন্যে কত বই আনেন। আমার রামায়ণ আছে, মহাভারত আছে, সীতার বনবাস আছে, সাধকসঙ্গীত আছে, আরো কত সঙ্গীত আছে,—আর দুর্গেশনন্দিনী বলে একখানি বই আছে—সেখানা কিন্তু আমার যেমন ভাল লাগে এমন কোন বই না। বাবা আমাকে যখন গীতার মানে বলে দেন—আমার তখন তিলোত্তমার কথা মনে পড়ে। শাস্ত্র পড়তে আমার মোটে ভাল লাগে না। উত্তররামচরিত, শকুন্তলা, রত্নাবলী আগে খুব ভালবাসতুম, এখন দুর্গেশনন্দিনী সব চেয়ে ভালবাসি। আসুন আমার সব গাছগুলি আপনাকে দেখিয়ে আনি। ঐ যে শিরীষ ফুলের গাছ দেখছেন,—ওর তলায় দাঁড়ালে ধ্রুব তারাটি ঠিক চোখের সামনে পড়ে, দেখছেন?

 প্র। ঐ ধ্রুবতারা! আপনি সব নক্ষত্রের নাম জানেন?

 নী। আপনি জানেন না? ঐ দেখুন সপ্তর্ষি। চলুন এখন আপনাকে আর একটি জিনিষ দেখাই। ঐ ঝুমকো লতামণ্ডপের মধ্যে একটি খাঁচায় পাতার বিছানা করে একটি বউকথাকওকে শুইয়ে রেখেছি দেখিয়ে আনি।”

 প্র। বউকথাকওটি খুব পোষ মেনেছে?

 নী। না, এটি পোষা নয়। আহা, আজ সকালে ঐ ছানাটি গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল, তাই তাকে অমন যত্নে রেখেছি। পাখী খাঁচায় ধরে রাখতে আমার মায়া করে,—ছানাগুলি কুড়িয়ে মানুষ করি, বড় হলে উড়িয়ে দেই। স্বাধীনভাবে তারা কত সুখী।

 প্র। চলুন, কিন্তু ভয় হয় পাছে আপনার পিতা ডাকলে শুনতে না পান।

 প্রমোদ নীরজার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন, নীরজা সেই নিস্তব্ধ নৈশ-গগন চমকিত করিয়া গান গাহিতে গাহিতে পথ দেখাইয়া চলিল—

নিঃঝুম নিঃঝুম গম্ভীর রাতে,
কম্পত পল্লব দক্ষিণ বাতে,
পেখল সজনি সতিমির রজনী,
অম্বরে চন্দ্র ন তারকা ভাতে,
ঝিল্লি-ধ্বনি-কৃত, বন পরিপূরিত,
কলয়ত জাহ্নবী মৃদুল প্রপাতে।

 বালিকা থামিয়া বলিল “আমি বাঙ্গলা গান শিখতে বড় ভালবাসি, বাঙ্গালী যাত্রী এলেই আমি গান শিখি। আপনি গাইতে পারেন না?”

 প্রমোদ সে কথায় উত্তর না করিয়া বলিলেন “আপনি যে গানটি এখন গাইলেন ওকি কোনও যাত্রীর কাছে শিখেছেন?

 বা। না ওটি আমি তৈরি করেছি। আমি যাত্রীদের কাছে গান শিখি—বাবার কাছে শিখি—কেতাবের গানের সুর জানিনে, কিন্তু যেটা ভাল লাগে একটা যে কোন সুর তাতে বসিয়ে নিই, আর নিজে কথা তৈরি করে তাতে সুর দিয়ে গাই—সব চেয়ে সেই গান গাইতে আমার বেশী আনন্দ হয়।

 প্র। আপনি নিজে গান রচনা করেন? যে গানটি গাইলেন ওকি আপনার রচনা? আর একবার গাবেন কি?

 বালিকা পূর্ণকণ্ঠে গানটি আবার গাহিতে লাগিল।

 প্রমোদের শরীর হর্ষবিহ্বল ও রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল, প্রমোদ ভাবিলেন “এই অরণ্যটিই কেন সমস্ত পৃথিবী হইল না? এই দুইটি জীবন বই আর পৃথিবীতে জীবন রহিল কেন?” সহসা পশ্চাৎ দিকে কাহার পদশব্দে তাঁহার সে চিন্তা ভঙ্গ হইল, তিনি মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন—একজন সন্ন্যাসী। নীরজার তখন গান শেষ হইয়াছিল, সন্ন্যাসী ঈষৎ তীব্র স্বরে বলিলেন “নীরজা, তোমাকে কতক্ষণ ধরে ডাকছি? আহারের সময় হয়েছে, এস কুটীরে এস —?” প্রমোদ লজ্জায় জড়সড় হইয়া পড়িলেন, নীরজাও কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইল। কিন্তু নীরজা বনবালা, তাহার সে ভাব অধিকক্ষণ রহিল না, সরল ভাবে পিতাকে বলিল “কে জানে কেমন অন্যমনে ছিলাম—আপনার ডাক আজ শুনতেই পাইনি; অনেকক্ষণ ধরে ডাকছেন কি?” কন্যার কাতর ভাবে সন্ন্যাসী স্বাভাবিক নরম স্বরে বলিলেন “না, আমি বেশীক্ষণ ডাকি নাই; ও যুবাটি কে?”

 নীরজা বলিল “সেই যে সেদিন পথহারা হয়ে দুজন পথিক এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, যাঁদের কথা আমি আপনাকে বলেছিলুম, ইনি তাঁদেরি মধ্যে একজন। নাম প্রমোদ; আপনার সঙ্গে দেখা করতে ইনি মন্দিরে যাচ্ছেন।”

 তখন প্রমোদ বলিলেন “মহাশয়, ইনিই সেদিন বনদেবীরূপে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেজন্য আমরা চিরঋণী। এই জঙ্গল মধ্যে আমরা সেদিন কি বিপদেই পড়েছিলেম।

 সন্নাসী বলিলেন “নীরজা সন্ন্যাসীকন্যা, অতিথি সৎকারই উহার ধর্ম্ম। নীরজা কর্ত্তব্য কাজ করেছে, সেজন্য তোমরা কেন ঋণী হবে? সে যাই হ’ক, আজও কি শীকার অভিপ্রায়ে আসা হয়েছিল?”

 প্রমোদ একটু লজ্জিতভাবে ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন “না, আজ বেড়াতেই এসেছি।”

 স। আজও রাত হয়ে পড়েছে, কুটীরে থাকলে হয় না?

 এই কথায় নীরজা ব্যগ্রভাবে প্রমোদকে বলিল “চলুন তবে কুটীরেই চলুন, এত রাতে কি করে বাড়ী যাবেন?”

 কিন্তু প্রমোদ ইহাতে অসম্মত হইলেন, ভাবিলেন তাহা হইলে যামিনীনাথ বড়ই চিন্তিত হইবেন, সমস্ত রাত্রি তাঁহার অন্বেষণ করিবেন। সন্ন্যাসী বলিলেন “কিন্তু এত রাতে তোমাকে অনাহারে আমি ছেড়ে দিতে পারি না; তা’হলে আমার ব্রত ভঙ্গ হয়, অতিথি-সৎকারই আমার ব্রত।” এই কথায় তখন প্রমোদ আর কিছু না বলিয়া সন্ন্যাসীর সহিত মন্দিরাভিমুখে গমন করিলেন। নীরজা প্রফুল্লচিত্ত বিহঙ্গীর ন্যায় আগে আগে যাইতে যাইতে গান ধরিল—

আয় আয় আয়, কে আছিস তোরা,
মরমব্যথায় যার,
দিবস রজনী পড়িছে বিফলে
নয়ন-সলিল ধার;
কাতর হৃদয়ে কাঁদিছে যেজন
হারায়ে বিভব মান,

হতাশ প্রেমের হুতাশে সদাই,
জ্বলিছে যাহার প্রাণ।
কাঁদিতে হবে না, যাতনা রবে না,
রবে না ভাবনা-ভার,
আয় আয় আয়, কে আছিস তোরা,
খোলা এ কুটীর দ্বার।