ছিন্নমুকুল/চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ
চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ
মৃত্যু-শয্যা
ক্রমে দিন যাইতে লাগিল। সুশীলার আরােগ্য লাভের স্থিরতা নাই। তাঁহার পীড়া দু দিন হয়তো বা বাড়িয়া উঠে আবার দু’দিন যেন বেশ সারিয়া যায়। প্রমােদ আর কত দিন কলেজ কামাই করিবেন, সম্মুখেই তাঁহার পরীক্ষা। কিছু দিন দেখিয়া দেখিয়া তিনিও কলিকাতা যাত্রা করিলেন। প্রমােদ কলিকাতায় যাইবার তিন চার দিন পরে সুশীলার জ্বব বাড়িয়া উঠিল। ক্রমে বিকার হইয়া দাঁড়াইল। সুশীলা ক্রমাগত তাঁহার সম্মুখে বিগত বর্ষারজনীর সেই মূর্ত্তিটী দেখিতে লাগিলেন, সেদিনকার সেই গীতটী তাঁহার কাণে বাজিতে লাগিল, ক্রমাগত যেন শুনিতে লাগিলেন,
বুঝি গো সে এল না,
চির দিন চির নিশি জাগরণে গেছে মিশি
যাহার বিরহ মাঝে ধরিয়া আশার কণা।
কাছে কনক বসিয়াছিল, তাহাকে বলিলেন, “কনক, কি সুন্দর গান। আহা ঐ গানটী তিনি গাইতেন, আমি গানটী জানি।” বলিতে বলিতে সুশীলার অশ্রু বহিতে লাগিল। থাকিয়া থাকিয়া তিনি আবার বলিলেন “আহা ঐ গানটী এক দিন আমাকে গাওয়াবার জন্য তিনি কতই সাধ্যসাধনা করেছিলেন। আজ কনক ও গানটা কে গাচ্চে, ও গলা কার?”
সুশীল সেই স্বর চিনিবার জন্য মনোযোগ পূর্ব্বক কিছুক্ষণ মৌন হইয়া রহিলেন, পরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন—
“না—না চিনতে পারলুম না। তাঁকে চিনেছি, কিন্তু কনক ও গান কে গাচ্ছে? তাকে ত চিনতে পারছি নে?”
কনক সুশীলার কথায় কাঁদিতেছিল, অশ্রুজল মুছিয়া বলিল “আমি কই কিছুই শুনতে পাচ্ছিনে ত?”
সু। শুনতে পাচ্ছিস নে? ভাল করে শোন্। কনক কি সুন্দর গলা!
এই সময় চিকিৎসক আসিলেন। সমস্ত লক্ষণ দেখিয়া অত্যন্ত বিমর্ষ হইলেন, বুঝিলেন আশা বড়ই কম। সত্বর ঔষধ ব্যবস্থা করিতে তিনি বাহিরে গেলেন। চিকিৎসক চলিয়া গেলে সুশীলা বিস্ময় দৃষ্টিতে কনককে জিজ্ঞাসা করিলেন “ও কে? কেন এসেছে?” কনক উত্তর না দিতে দিতে সুশীলা আবার বলিতেন “কনক, ঐ শোন ঐ শোন।”
আর ত রহে না আঁখি, মুদে আসে পাতা,
আসিছে অনন্ত নিদ্রা এখনো সে কোথা?
এখনো এল না সখি, সেই কোলে মাথা রাখি
এ জীবনে তবে আর ঘুমান হলো না,
কাঁদিতে কাঁদিতে ওরে চলিনু জন্মের তরে
অভাগীর শেষ দিনে শেষ সাধও পূরিল না!
আমারি মনের মত গান, ঐ শোন ঐ শোন!”
এই সময় সহসা এক জন এই কক্ষে প্রবেশ করিয়া সুশীলার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তখন অপরাহ্ণ কাল। বাতায়ন পথে লোহিত বর্ণের পুঞ্জীভূত আলোক গৃহে প্রবেশ করিয়া শয্যার একপ্রান্ত উজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছিল। প্রবেশকারীর মূর্ত্তি সেই আলোকে সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ সুশীলা চক্ষু মুদ্রিত করিলেন, অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। আবার যখন চক্ষু খুলিলেন, তখন তাঁহার যেন কিছু জ্ঞান হইয়াছে, আর সে বিকারের ঘোর নাই, তিনি সেই দিকে চাহিয়া বলিলেন “মৃত্যুকালে এখন আমাকে দেখা দিলে?”
“প্রাণেশ্বরি, সুশীলা কোন্ মুখে আর তোমার কাছে আসি।” বলিয়া সন্ন্যাসী সুশীলার হস্ত আপন হস্তে লইয়া কঁদিতে লাগিলেন। স্বামীর দিকে চাহিয়া স্বামীর হস্তে হস্ত রাখিয়া সুশীলা প্রাণত্যাগ করিলেন।