ছিন্নমুকুল/চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

চতুস্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

মেঘে বিজলি

 হিরণকুমারের চারি দিন ফুরাইয়া আসিয়াছে, কাল তাঁহাকে এলাহাবাদ ছাড়িতে হইবে। তিনি মধ্যাহ্নে অন্যান্য চিঠিপত্র শেষ করিয়া কনককে একখানি চিঠি লিখিতে বসিয়াছেন। কতবার লিখিলেন কতবার ছিঁড়িলেন,—অবশেষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া একখানি চিঠি শেষ করিয়া নীরবে অশ্রুজল মুছিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে সে অশ্রু শুকাইল, মুখে দৃঢ়তাব্যঞ্জক ভাব প্রকটিত হইল, তিনি উঠিয়া চিঠিখানি নিজে ডাকে দিয়া বাটী ফিরিলেন। গঙ্গাতীরের একটী সরকারী বাড়ীতে আপাততঃ তিনি বাস করিতেছিলেন।—যখন গৃহে ফিরিলেন তখনও সন্ধ্যা হয় নাই, উজ্জল আকাশ প্রান্তে সবে মাত্র দুই একটি তারকা ফুটিয়া উঠিয়াছে, তিনি বারান্দার একখানি ইজিচেয়ারে শুইয়া আকাশের সেই অস্তমান্ শেষ উজ্জ্বলতার দিকে কিছুক্ষণ নির্ণিমেষ নেত্রে চাহিয়া চাহিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। সন্ধ্যা হইল, হিরণকুমার উঠিলেন না, ভৃত্য নীরবে দেয়ালের ধারে লিখিবার টেবিলে একটি আলো রাখিয়া গেল। রাত্রি হইল, আটটা বাঞ্জিল, হিরণকুমার উঠিলেন না, থাবার আনিতেও হুকুম দিলেন না,—বেগতিক দেখিয়া একজন ভৃত্য খবর দিল, খাদ্য প্রস্তুত। ভৃত্যের নিকট ইহা আজ নূতন ব্যাপার নহে। কয়েক দিন হইতে আহার সম্বন্ধে প্রভুর সে এইরূপ বীতরাগ দেখিতেছে। এতক্ষণ হিরণকুমার ঘুমাইতেছিলেন কি না জানিনা, কিন্তু ভৃত্যের কথায় চোখ খুলিয়া একবার তাহার দিকে চাহিলেন। তাঁহার সেই যন্ত্রণা-প্রকটিত পাংশুবর্ণ মুখ, তাঁহার সেই কোন ভয়ানক দৃঢ়সঙ্কল্পবিশিষ্ট অথচ অন্তিমকালের ন্যায় অসরল দৃষ্টি দেখিয়া ভৃত্য চমকিয়া উঠিল, আশ্চর্য্য হইয়া মৌনে তাঁহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আর একবার বলিল, “খাবার ঠিক।”

 হিরণকুমার বিরক্তভাবে বলিলেন, “আমার ক্ষিদে নেই, আজ খাব না।” ভৃত্য দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া চলিয়া গেল, আর কথা কহিতে সাহস করিল না। হিরণকুমার তখন উঠিলেন, উঠিয়া টেবিলের সম্মুখে চৌকিতে বসিয়া কয়েকখানি পত্র লিখিতে লাগিলেন— এই সময় একজন ভৃত্য আসিয়া একটী পিস্তল দেখাইয়া বলিল, “জিনিষপত্র সবই প্রায় গোছান হয়ে গেছে, নৌকায় তুল্লেই হয়, এটা বন্দুকের বাক্সে ধরলো না, কাপড়ের বাক্সেই রাখি?”

 হিরণের মনে পড়িল, একদিন একজন চোরের নিকট হইতে পিস্তলটি কাড়িয়া লইয়াছিলেন; এবং ইহা পুলিশে দেখাইয়া চোরের সন্ধান করিবার অভিপ্রায়ে সাবধানে রাখিতে বলিয়াছিলেন। পরে নানারকম কাজের ভিড়ে এতদিন পর্য্যন্ত ও কথাটা মনেই পড়ে নাই। হিরণ পিস্তলটি হস্তে লইলেন, এদিক ওদিক করিয়া দেখিতে লাগিলেন; ভাবিলেন ইহার একটি গুলিতেই তো আজ তাঁহার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হইতে পারে। লোভ অসম্বরণীয় দেখিয়া ত্রস্তে তাহা টেবিলে রাখিলেন। কিন্তু মনে হইল তাঁহার ভয় বৃথা, উহাতে গুলি নাই। ভাবিতে ভাবিতে আবার তাহা হস্তে লইলেন, সর্প যেমন তুণ্ডিকের বংশীধ্বনি হইতে ফিরিতে অক্ষম, হিরণকুমার তেমনই সেই পিস্তল হইতে দৃষ্টি উঠাইতে অক্ষম হইলেন। এই সময় একজন অপরিচিত লোকের সহিত একজন চাপরাশি এই গৃহে আসিয়া হিরণকে বলিল,

 “কদিন থেকে এই লোকটি চাকরীর উমেদারীতে আসছে আমাদেরও তো আর একজন চাপরাশির দরকার, এ’কে কি রাখবেন? বন্দুক চালাতে পারে, লাঠি খেলতে পারে, জমিদারের সর্দ্দার ছিল, লায়েক লোক।”

 হিরণকুমার এ কথায় কর্ণপাত করিলেন না, তিনি তখন পিস্তল দেখিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেখিতে দেখিতে পিস্তলের এক প্রান্তে কয়েকটি অক্ষর মুদ্রিত দেখিলেন, পড়িয়া তাঁহার মুখ বিস্ময়-পূর্ণ হইল; দেখিলেন ইংরাজি অক্ষরে লেখা “যামিনীনাথ রায়।” তিনি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলেন, ‘যামিনীর পিস্তল!' নবাগত উমেদার উত্তর অপেক্ষায় সেই স্থানে দাঁড়াইয়া ঐ সকল দেখিতেছিল। হিরণের মুখনির্গত বিস্ময়-প্রসূত ঐ কথাটী শুনিয়া সে আস্তে আস্তে তাঁহার একটু কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; বিশেষ লক্ষ্যের সহিত দেখিয়া দেখিয়া বলিল, “হ্যা বাবুর পিস্তল বলেই মনে হচ্ছে, আমাকে একবার দেখতে দেবেন?”

 হিরণ বিস্মিত ভাবে উমেদারের হস্তে পিস্তলটী দিয়া বলিলেন, তুমি কি যামিনীবাবুর চাকর ছিলে?”

 সে বেসুরে উত্তর করিল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

 বলিয়া পিস্তলটী লইয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া বিশেষ রূপে দেখিতে লাগিল। সেই মুদ্রাঙ্কিত অক্ষরগুলি দেখিয়া তাহার মুখ চক্ষু আরক্তিম হইল, ক্রুদ্ধস্বরে বলিল, এ পিস্তল আমি চিনি, এ বাবুরই পিস্তল বটে।” হিরণ তাহার ভাবে, কথায় অবাক হইয়া বলিলেন, পিস্তল তবে চোরের হাতে গেল কি করে?”

 “চোর! না—”, বলিয়াই সে থামিল; কি একটী কথা বলিতে যেন সে ভয় পাইতেছিল। শেষে যখন তাহার কথায় অন্য সকল ভৃত্যকে প্রস্থান করিতে আদেশ করিয়া হিরণ কথা দিলেন যে বলিলে তাহার কোন হানি হইবে না, তখন সে বলিল, “মহাশয়, সে চোর না, যামিনীবাবুর দরোয়ান—”

 হি। যামিনীর চাকর! সে কি পিস্তল চুরি করেছিল?

 ভৃ। না, যামিনীবাবুর হুকুমে প্রমোদবাবুকে মারতে গিয়েছিল।

 “যামিনী বাবুর হুকুমে প্রমোদকে মারতে গিয়েছিল!” সহসা হিরণকুমারের মলিন বিষাদ-গম্ভীর মুখকান্তি জ্যোতিষ্মান্ হইল, তাঁহার নিকটে যেন একটি রুদ্ধ-দ্বার খুলিয়া গেল। তিনি কনকের কাছে শুনিয়াছিলেন প্রমোদের বিশ্বাস, হিরণ তাহাকে হত্যা করিতে গিয়াছিলেন, আজ সহসা তাহার কারণ বুঝিতে পারিলেন। হিরণ জানিতেন, যামিনী নীরজাকে বিবাহের অভিপ্রায়ে সন্ন্যাসীর নিকট প্রমোদকে দোষী সাব্যস্ত করিতে গিয়াছিল। ভৃত্যের কথায় এখন তাঁহার মনে হইল যে তাহার মত মন্দ লোকের পক্ষে স্বাভিপ্রায় সিদ্ধির জন্য এরূপ জঘন্য ভয়ঙ্কর উপায় অবলম্বনও অসম্ভব নহে। পরে আপন দোষ যামিনী হিরণের উপর অর্পণ করিয়াছে তাহাতেও সন্দেহ নাই। হিরণ ভাবিলেন, যদি যথার্থই যামিনী দোষী হয় এবং তিনি তাহা প্রমাণ করিতে পারেন, তাহা হইলে প্রমোদের ভ্রম ঘুচিতে পারে; হিরণ আবার সুখী হইতে পারেন। হিরণকুমার ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন,

 “যামিনী প্রমোদকে মারতে পাঠান কেন?”

 ভৃত্য। আমাকে কি আর সে কথা তিনি বলেছেন? কিন্তু আমি তা বলতে পারি। প্রমোদ বাবুর সহিত নীরজার পাছে বিয়ে হয়, সেই ভয়ে—

 হি। তিনিই যে মারতে পাঠিয়েছিলেন তা তুমি কি করে জানলে?

 ভৃত্য। আমাকেই প্রথমে মারতে বলেন, কিন্তু আমি নারাজ হই। শেষে পাঠান্ বেটা রাজি হয়েছিল। হোক, টাকা যত পেয়েছে, তা আমি জানি!

 হি। রাজি হয়েছিল কি ক'রে জানলে?

 এই কথার উত্তর দিতে উমেদার ভীত হইল। যাহা বলিবে তাহাতে তাহার আত্মীয় এক ব্যক্তির কোন হানি হইবে না, এই শপথ করাইয়া লইয়া অবশেষে বলিল “বাবুর দরোয়ানের সঙ্গে আমার মামাত ভাই হরিও ঐ কাজের মধ্যে ছিল; তার কাছেই শুনেছি।”

 হি। মকদ্দমা হ'লে তুমি যামিনীর বিপক্ষে সব কথা বলতে রাজি আছ? দোষ প্রমাণ করতে পারবে?

 উমেদার সহর্ষে বলিল “তা আর পারব না? যে আমার সর্বনাশ করেছে তার বিপক্ষে সাক্ষী দিয়ে শোধ তুলব না! কিন্তু হরেটার জন্যই ভয়, নইলে কি আর আমি এতদিনই চুপ করে থাকি!”

 হি। না না তার জন্যে কোন ভয় নেই। তার সাক্ষ্যই বিশেষ দরকারী। তুমি কেবল তার কাছে শুনেছ বই ত নয়। হরি যদি সব খুলে বলে তো তাকে মহারাণীর সাক্ষী (Queen's evidence) দাঁড় করিয়ে খালাস দেওয়ান যাবে। তুমি যে শোধ তোলবার কথা বলছ যামিনী বাবু তোমার কি করেছেন?

 উ। কি করেছেন! তাঁর জন্যই স্ত্রী পুত্র পরিবার ছেড়ে বিদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। নিমকহারামের জন্য কি না করেছি! মশায় বলব কি, বাবু যখন আমাদের দিয়ে নীরজাকে চুরী করিয়ে আবার ফন্দি ক’রে নিজেকেই সাধু দাঁড় করাবার মতলব করেন তখন আমিই ত দাঁড়ি সেজে সব ঠিকঠাক করি। প্রমোদ বাবুম যেদিন কানপুরের বনে নীরজার সঙ্গে দেখা করতে যান, সেদিন আমিই ত তাঁর পিছনে লুকিয়ে গিয়ে জেনে আসি যে সন্ন্যাসী নৈমিষারণ্যে যাবেন; তাতেই ত পরের দিন চুরী হয়।

 হি। তাই বটে! এখন

 উ। তা মোশাই জাতটাই বোঝা যাচ্ছে! শুধু খোয়ালাম, পেটটাও তাতে ভরবো না। মনে ছিল বক্সিসটা কিছু এমন মারবো যে এর পর যাবজ্জীবন বসে খেতে পারব, আর চাকরী করতে হবে না। ওমা তাতেও বাবু নমো নমো ক’রে সারলে। আবার বলে কিনা খুন কর! আমি বেটা ফাঁসিতে ঝুলি আর উনি পায়ের উপর পা রেখে গুড়ুক ফুঁকুন! এমন চাকরীর পায়ে গড়! জানলেন মশায় তাই রাগের মাথায় দুট বেফাঁস কথা কয়ে ফেলেছিলুম! তার জন্যে এমন গোঁ! বলব কি মশায়, বেটার শরীরে ধর্ম্মজ্ঞান এক ফোঁটা নেই! তা আমিও এবার ছাড়ছি নে!

 বলিতে বলিতে প্রতিশোধ স্পৃহায় সে জ্বলিয়া উঠিল। হিরণ বলিলেন, “কিন্তু বাবু তোমার কি শাস্তিটা করেছেন?”

 উ। সে কথা আর কন্ কেন? মিথ্যা চুরির দাবিতে আমাকে জেলে দেবার ফন্দি। কি করি প্রাণের দায়ে মাসির কাছে এসে লুকিয়ে আছি। মেসো আমার ছিল ভাল, বাবুদের দোকানে জুতোর কাজ করে দিব্যি দু’ পয়সা রোজগার করত; এখন মেসো মরেছে, মাসী পৈরাগবাসী হয়েছে। ছেলেপিলে নেই দু’ দশ পয়সা যা আছে আমিই পাব। এখন এ দায়টা থেকে ছাড়ান পেলেই বাঁচি।

 ভৃত্যের কথায় হিরণকুমারের সম্পূর্ণ বিশ্বাস জন্মিল। তাঁহার সহসা নূতন আশার সঞ্চার হইল। তিনি বলিলেন, আজ থেকে রামধন, তুমি আমার চাকর বাহাল হলে, তোমার শোধ তোলার ভার আমি হাতে নিলুম। এখনি আমার সঙ্গে কলকাতায় চল।”

 হিরণকুমার যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া লইয়া, ভৃত্যের সহিত একটা ঠিকা গাড়িতে উঠিয়া গাড়ী হাঁকাইয়া ষ্টেসনে লইয়া যাইতে হুকুম দিলেন। কাল তাঁহার কর্ম্ম স্থলে যাত্রা করিবার কথা কিন্তু এই জীবনমৃত্যু বিপাকে সে কর্ত্তব্য ভুলিয়া তাহার ত্রুটিতে যে ক্ষতি হইতে পারে, তাহাও গণনার মধ্যে না আনিয়া তিনি কলিকাতা যাত্রা করিতে অধীর হইয়া উঠিলেন। কিন্তু এত অধীরতা এত সত্বরতা সমস্তই বৃথা হইল। তাঁহারাও ষ্টেসনে পৌঁছিলেন, কলিকাতামুখা মেলগাড়ীও তাঁহাদের চোখের উপর দিয়া হুস হুস শব্দে চলিতে আরম্ভ করিল। হিরণকুমার হতাশচিত্তে স্তব্ধ ভাবে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াইয়া রহিলেন।