ছিন্নমুকুল/তৃতীয় পরিচ্ছেদ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
বিজন কুটীর
অরণ্যপ্রান্তে নদীর অনতিদূরে অনুচ্চ বিজন মন্দির। মন্দিরসংলগ্ন দীর্ঘ দালান যাত্রীনিবাস। যুবতী পথিকদিগকে লইয়া এইখানে সমাগত হইল! দালানের নিভৃত একটি কোলঙ্গায় দ্বিসলিতা প্রদীপ জ্বলিতেছিল; সেই দাপালোকবিভাসিত প্রফুল্ল কুসুমসদৃশ সহাস্য রমণীমূর্ত্তি দেখিয়া, তাঁহারা দ্বিতীয়বার যেন মোহমুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। দীপালোকে বালিকার রূপকান্তি অধিকতর সুস্পষ্টভাবে তাঁহাদের নয়নে প্রতিভাত হইল! বালিকা যথার্থই বনবালা, সে মুখে যুবতীস্বভাবসুলভ লজ্জা নাই, সে মুখে বিলাসময় ভাবভঙ্গী কিছু মাত্র নাই; তাহা বালিকার উপযুক্ত ঈষৎ সরল হাস্যে মাত্র প্রফুল্ল।—তাঁহারা নীরবে বিস্মিতনেত্রে সেই বিজন মন্দিরবাসিনী বনদেবীর প্রতি চাহিয়া রহিলেন।
মন্দিরে অন্য কোন যাত্রী সে দিন ছিলনা। দুইজন ভৃত্য দালানে বসিয়া ছিল,—বালিকাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল, এবং তাহার আজ্ঞাক্রমে একজন তাঁহাদের মুখহাত ধুইবার জল আনিতে গেল— অন্যজন মন্দিরব্রাহ্মণ,—তিনি পথিকদিগের আহারের আয়োজন করিতে গেলেন। —দাস জল আনিলে বালিকা পথিকদিগকে বলিল,— “আপনারা অস্ত্র শস্ত্র রেখে মুখ হাত ধুন, আমি খাবার আনি।” বলিয়া সে মন্দির পার্শ্বস্থ রন্ধনগৃহে প্রবেশ করিল,—এবং অনতিবিলম্বে ব্রাহ্মণের সহিত খাদ্যাদি আনিয়া পরিবেশনতৎপর হইল। ভৃত্য পূর্ব্বেই আসন ও ভোজনপাত্রাদি দালানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। পথিক দুইজন ভোজনে বসিলেন। যামিনী তৃপ্তি পূর্ব্বক মন্দিরভোগ উপভোগে প্রবৃত্ত হইলেন।—প্রমোদ প্রায় কিছুই থাইলেন না,—যদিও কিছু পূর্ব্বে তিনি ক্ষুধা তৃষ্ণায় যামিনীর মতনই অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছিলেন। ঘোর বিস্ময়ে পড়িয়া তাঁহার হৃদয় এত প্রকার ভাবে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল যে তখন ক্ষুধাতৃষ্ণা সকলই বিস্মৃত হইয়াছিলেন।
পরিবেশন শেষ করিয়া বনবালা তাঁহাদের নিকট বসিয়া নিতান্ত সরলভাবে কত গল্প করিতে লাগিল। তাঁহারা শুনিলেন, বালিকার নাম নীরজা, তাঁহার পিতা নৈমিষারণ্যে মানৎরক্ষা করিতে গিয়াছেন, রাত্রেই আসিবার কথা আছে। বালিকা কিছু পরে বলিল “বাবা যতক্ষণ না আসেন আমি ঘুমাব না। কিন্তু এখন আমি আমার কুটীরে যাই, আপনারা শ্রান্ত হয়েছেন এবার বিশ্রাম করুন।”
বলিয়া বালিকা বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক মন্দির হইতে কিছুদূরে প্রাঙ্গণস্থ স্বতন্ত্র কুটীরে গমন করিল। বলা বাহুল্য, নিদ্রার নাম গন্ধও এখন তাঁহাদের ছিলনা, কিন্তু রমণীর কথায় অগত্যা তাঁহারা দালানে নির্দ্দিষ্ট খাটিয়ার আশ্রয় লইলেন।
যামিনী শীঘ্রই নিদ্রামগ্ন হইলেন, কিন্তু প্রমোদের মন অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত চিন্তাতরঙ্গে আন্দোলিত হইতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন “এমন বিজনে এ রমণী কে? উদ্যানের কুসুম বনে কেমন করিয়া ফুটিল? পৃথিবীর দুর্লভ রত্ন এই কুটিরে কেন? এইরূপ চিন্তাতে অনেক রাত্রি অতিবাহিত করিয়া রাত্রিশেষে তিনি নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন। যামিনীনাথ প্রত্যূষে কখন শয্যা ত্যাগ করিয়া গেলেন তিনি তাহা জানিতেও পারিলেন না।
এদিকে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইল, তথাপি নীরজার পিতা তীর্থ হইতে ফিরিলেন না। নীরজা কখনও শুইয়া, কখনও বসিয়া, কখনও উত্থানে গাহিতে গাহিতে বেড়াইয়া রাত্রি কাটাইল। প্রত্যূষে মধুময় সঙ্গীধ্বনিতে যামিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি বাহিরে আসিয়া দেখিলেন তখনও ঘোর ঘোর আছে, পশ্চিমগগনে চন্দ্রমা হাসিতেছে, শীতল মৃদু মৃদু বায়ু বহিতেছে, সেই সঙ্গীতধ্বনিবাহী, মধুরবায়ুহিল্লোলিত হইয়া প্রাতস্ফুট কুসুমনিকরের সুরভি সুগন্ধতর হইয়া বহিতেছে। যামিনী দেখিলেন, কৃষ্ণমেঘময় আকাশস্থিত একটি তারকার ন্যায় এই ম্লানাভ উদ্যান উজ্জ্বল করিয়া রমণী গাহিয়া বেড়াইতেছে। তাহাকে দেখিয়া যামিনী নিকটে আসিলেন। বালিকা জিজ্ঞাসা করিল “কেমন ঘুমাইলেন?”
যুবা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া কিছুক্ষণ মৌনভাবে থাকিয়া বলিলেন “তা আর কি বলব?
রমণী ভুবনমুগ্ধকর সরল হাসি হাসিয়া বলিল “বুঝি ভাল ঘুম হয়নি?”
যামিনীনাথ মুগ্ধ হইয়া বলিলেন “কেমন করে হবে?”
বালিকা। “আমি আরো মনে করেছিলুম—সমস্ত দিনের শ্রান্তির পর সহজেই ঘুম আসবে!
যুব। আর একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন “ঘুম! Nor poppy nor mandragora can give me that sweet sleep which"—
বালিকা সবিস্ময়ে বলিল, “কি রলছেন, আমি ত ও ভাষা জানিনে।”
যামিনী একটু হাসিয়া বলিলেন “বলছি ঘুম কি আর হয়! যা দেখছি যে আলো চোখের সামনে—তাতে কি আর ঘুম আসে!”
এ কথার মর্ম্ম বালিকা বুঝিতে পারিল না—কি আলোক যামিনীর চোখের উপর, তাহার সহিত নিদ্রার কি যোগ এই দুরূহ সমস্যায় পড়িয়াই বুঝি বালিকা নিস্তব্ধ হইয়া পড়িল। যামিনী সেই নিস্তব্ধতায় আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন “সুন্দরি, সব কি খুলে বলব— আমার হৃদয় আর আমার নেই—ঐ—”
তাহার কথা শেষ না হইতে হইতে বালিকা বলিয়া উঠিল, “সকাল হয়েছে, আপনার সঙ্গী এখনে। ওঠেন নি? দেখে আসি।” এই বলিয়া বালিকা মন্দিরাভিমুখে গমন করিল। যুবা স্তম্ভিতভাবে সেইখানে দাঁড়াইয়া গমনশীল বালিকার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। বালিকা দালানে আসিয়া সুষুপ্ত প্রমোদের শিয়রে আসিয়া দাঁড়াইল—দেখিল, প্রমোদের ওষ্ঠাধরে ঈষৎ হাসির রেখা, ঈষদ্ভিন্ন পল্লবযুক্ত নয়নদ্বয় ঈষৎ আবেশময়। বালিকা দেখিল প্রমোদ কোন সুখ-স্বপ্ন দেখিতেছেন। সত্যই প্রমোদ স্বপ্ন দেখিতেছিলেন—যেন আকাশ হইতে একটি জ্যোতির্ম্ময়ী রমণী নামিয়া তাঁহার শিয়রে দাঁড়াইলেন— তিনি আহ্লাদে উৎফুল্ল হইয়া তাহাকে ধরিতে হাত বাড়াইবা মাত্র সে মূর্ত্তি অন্তর্হিত হইল। প্রমোদ জাগিয়া দেখিলেন—সত্যই তাঁহার মস্তকের নিকট সেই দেবীমূর্ত্তি। দুজনে মুগ্ধ নয়নে দুজনের প্রতি চাহিয়া রহিলেন, যামিনীনাথ যে কখন গৃহে প্রবেশ করিলেন—জানিতেও পারিলেন না। যামিনী আসিয়া দেখিলেন, প্রমোদের প্রতি রমণীর সে দৃষ্টি কি স্নেহময়, কি মধুময়! যামিনীর হৃদয়ে ঈর্ষার অনল জ্বলিল। প্রমোদ যামিনীকে দেখিয়া চমকিতভাবে উঠিয়া বসিলেন। বালিকারও এতক্ষণে কথা ফুটিল।
সে বলিল “আপনারা কি নদীতে স্নান করবেন? কিন্তু আপনাদের মত কাপড় দিতে পারব না ত? বাবার গেরুয়া বস্ত্র আছে।”
তখন প্রমোদ শয্যা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া সবিনয়ে বলিলেন, “এখন সকাল হয়েছে, আমরা স্বচ্ছন্দে পথ চিনে বাড়ী যেতে পারব। আপনাকে কাল কত কষ্ট দিয়েছি, কিছু মনে করবেন না। আপনি আশ্রয় না দিলে আমাদের যে কাল কি দুর্দ্দশা হোত তার ঠিক নেই, চিরকাল আপনার আতিথ্য আমাদের মনে থাকবে।”
রমণী ঈষৎ লজ্জিতভাবে বলিল “অতিথি সৎকারে কষ্ট কি? পিতার সেবায় যেমন আনন্দ—অতিথি সৎকারেও তেমনি আনন্দ। আপনারা আহারাদি করে যান না?”
যামিনীনাথ বলিলেন—“তাতে আর আপত্তি কি?”
কিন্তু প্রমোদ সে কথা গ্রাহ্য না করিয়া বলিলেন, “আপনার পিতা তাহলে কাল আসেন নি? আপনাকে এই বিজন মন্দিরে একা রেখে তিনি কি ক’রে দূরে থাকেন?”
বা। না তিনি আমাকে ফেলে বেশী দিন কোথাও থাকেন না—এবার কেবল একটু দেরী হয়েছে—প্রায় দিন দশ হ’ল তিনি গেছেন।
প্র। আপনার ভয় হয় না? এমন নির্জ্জন স্থান?
বালিকা হাসিয়া বলিল “ভয় কিসের? এত লোকজন তবু আপনারা বলছেন নির্জ্জন।”
বা। কিন্তু এখানে ত কই আপনার সঙ্গী মেয়ে কেউ নেই।
নী। আছে বই কি! গরীব দুঃখী কাঠুরিয়ার মেয়েরা এখানে বনে প্রত্যহই কাঠ সংগ্রহ করতে আসে। বাবা কোথাও গেলে তারা কেউ না কেউ এসে আমার কাছে থাকে।
প্র। কই কালত কাউকে দেখিনি।
বা। কাল বিকালে তাদের একটা পার্ব্বণ ছিল, তাই আসতে পারে নি,—আজ আসবে এখন,—ঐ যে লছমী আসছে।
তাঁহারা দূরে এক অল্পবয়স্কা স্থুলাঙ্গী কৃষ্ণবর্ণা হিন্দুস্থানী রমণীকে দেখিলেন। প্রমোদ সে দিক হইতে বালিকার দিকে চক্ষু ফিরাইয়া আবার বলিলেন “একটি কথা জিজ্ঞাসা করি—আমরা কাল এখানে ছিলেম শুনে আপনার পিতা কি বলবেন?”
নী। তিনি কি বলবেন? নিরাশ্রয় ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছি তিনি তাতে খুসীই হবেন? কত সময় কত পথহারা যাত্রী এখানে আসে,—কত সময় কত বিপন্ন কাঠুরিয়াকে আশ্রয় দিই। এই ত আমার কর্ত্তব্য কর্ম্ম।
বালিকার সরলতা দেখিয়া প্রমোদ একটু হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “তবে আমরা আসি, এ উপকার কখনো ভুল্ব না। যদি আমাদের মত নিরাশ্রয়কে আর কখনো আশ্রয় দেন তো তখন এই পথিকদের কথা মনে করবেন।”
বালিকা কোন উত্তর করিল না, স্থির নেত্রে প্রমোদের দিকে চাহিয়া রহিল। যামিনীকে প্রমোদ বলিলেন “তবে চল যাওয়া যাক্।”
যামিনী নীরজার দিকে চাহিয়া “তবে আসি,” এই কথা ব্যতীত কিছুই বলিলেন না, রমণীও ইহার কোন উত্তর করিল না, সে যেন তখন কি ভাবনায় মগ্ন ছিল। প্রমোদ আর একবার প্রশান্ত নয়নে তাহার দিকে চাহিয়া সেখান হইতে গমন করিলেন।