ছিন্নমুকুল/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

স্নেহের পুরস্কার

 কলিকাতা আসিয়া অবধি প্রমোদ মাঝে মাঝে কনকের নিকট দশ বিশ টাকা চাহিয়া পাঠাইতেন। যামিনীনাথ তাঁহাকে যেরূপ পাইয়া বসিয়াছিলেন তাহাতে সুশীলার নিকট হইতে প্রমোদ কলিকাতায় থাকিবার যে খরচ পাইতেন সে অর্থে তাঁহার ব্যয় সঙ্কুলান হইয়া উঠিত না। ধনশালী বলিয়া প্রমোদের খ্যাতি আছে, সুতরাং তাঁহার ঘাড় ভাঙ্গিবার ইচ্ছায় যামিনীনাথ—আজ থিয়েটারে চল, আজ হোটেলে খানা দেও, আজ সারকস দেখিয়া আসি—এইরূপ ধরিয়া পড়িতেন, প্রমোদেরও ধনশালী বলিয়া মনে মনে একটু অহঙ্কার আছে, তিনিও সহজে সে নামটি খোয়াইতে চাহিতেন না। পরে আবশ্যকীয় খরচের জন্য কনকের কাছে টাকা না চাহিলে চলিত না; সুশীলার নিকট চাহিবার যো নাই; সুশীলার বিশ্বাস বেশী টাকা হাতে পাইলেই ছেলেদের স্বভাব বিগড়িয়া যায়, তাঁহার নিকট চাহিলে টাকা পাওয়া দূরে থাকুক বরঞ্চ তাঁহার ক্রোধ ও বিরক্তিভাজন হইবেন, প্রমোদের স্বভাবের প্রতি তাঁহার সন্দেহ হইবে। কি করেন, প্রমোদ দরকার হইলেই চুপে চুপে অগত্যা কনককে পত্র লিখিতেন, কনক কষ্টে সৃষ্টে যে কোন প্রকারেই হউক প্রমোদকে টাকা পাঠাইত। টাকার যোগাড় করিতে কনকের যে কিরূপ মাথা কুটাকুটি করিতে হইত, জানিলে হয় তো প্রমোদেরও মায়া হইত, অযথা খরচ বিষয়ে হয় তো তিনিও সাবধান হইতেন, কিন্তু এপর্য্যন্ত কনক কখনও সে কষ্টের কথা প্রমোদকে বলে নাই। কনক মাসে মাসে যে ১৫ টাকা করিয়া সুশীলার নিকট হইতে জলপানী পাইত, তাহা সে ভ্রাতাকে দিত তাহা ছাড়া রাত্রি জাগিয়া সেলাই করিত এবং গোপনে তাহা বিক্রয় করিয়া টাকাগুলি ভ্রাতাকে পাঠাইত।

 বিশ, পঁচিশ টাকা বলিয়া যেন কনক কষ্টে সৃষ্টে ভাইকে মাঝে মাঝে তাহা যোগাইত, কিন্তু এবার যে প্রমোদ হিতাহিত বিবেচনা শূন্য হইয়া একেবারে ২০০ শত টাকা চাহিয়া পাঠাইয়াছেন, ইহা এখন কনক কোথা হইতে কেমন করিয়া দিবে? অথচ না দিলেই নয়, প্রমোদ লিখিয়াছেন টাকা না পাইলে তাঁহাকে জেলেও যাইতে হইতে পারে। কি ভয়ানক! বালিকা তো ভাবিয়া আকুল। সুশীলার নিকটেও টাকা চাহিবার যো নাই, তাহা আবার প্রমোদের নিষেধ। প্রমোদ জানিতেন কনকের কাছে টাকা চাহিলেই পাইবেন, এমন স্থলে আপনার মার-পিঠ এবং সেই হেতু মকদ্দমা হাঙ্গামার কথা যদি সুশীলাকে না জানাইয়াই চলিয়া যায় তবে আর জানাইবেন কেন? কনক যে কত কষ্ট করিয়া টাকা পাঠায় তাহা প্রমোদ জানিতেন না। টাকা চাহিলেই তিনি পান, তিনি কেবল এই মাত্র জানেন। তাহা যে কনক কোথা হইতে কেমন করিয়া কত কষ্টে জোগায় প্রমোদের তাহা ভাবিবার দরকাব বোধ হইত না। তবে এক একবার কখনও দৈবাৎ যদি এ কথাটি মনে আসিত, যখন মনে হইত বিনা কষ্টে কনকের টাকা পাঠাইবার সম্ভাবনা নাই, তখন প্রমোদ মনে করিতেন ভবিষ্যতে তিনি আর টাকা চাহিবেন না, এবার হইতে মিতব্যয়ী হইবেন। কিন্তু পরেই আবার সে কথা ভুলিয়া যাইতেন। অন্যবারের ন্যায় এবারেও প্রমোদ চাহিবার সময় ভাবিলেন এবার ছাড়া আর কখনও তিনি কনকের নিকট টাকা চাহিবেন না।

 এ দিকে বালিকা কনকের আর দুঃখের সীমা নাই। কি উপায়ে সে এবার ভ্রাতাকে রক্ষা করিবে?

 রাত্রি দ্বিপ্রহর, নিস্তব্ধ অন্ধকারময় পৃথিবী খদ্যোতিকামালায় রঞ্জিত, আর উপরে নীল অনন্ত আকাশ তারকামালায় খচিত। সেই তারাখচিত আকাশের দিকে চাহিয়া বালিকা কনক কাঁদিতেছিল। তাহার দুঃখ সেই জানে, সে দুঃখ কাহারও কাছে বলিবার নহে। কাহারও কাছে মনের দুঃখ প্রকাশ করিতে না পারিয়া বালিকা নির্ব্বাক্ তারাদলের নিকট হৃদয় খুলিয়া কাঁদিতেছিল। কাঁদিতে কাঁদিতে বালিকা উঠিল, আবার গৃহে প্রবেশ করিল, একটী দীপের নিকট আসিয়া হস্তস্থিত একখানি পত্র লইয়া আবার পড়িতে লাগিল—

 “ভাই কনক,

 “অতিশয় বিপদে পড়িয়াছি, তুমি বই আমার আর উপায় নাই। ২০০ শত টাকা চিঠি পাইবামাত্র নিশ্চই পাঠাইবে, তা না হইলে হয় তো জেলে যাইতে হইবে। কনক, এইবার ভাই, আর একবার স্নেহময়ী ভগিনীর কাজ কর।

 এইবার শেষবার, আর তোমাকে এরূপ অনুরোধ করিব না। আর সকল করা পরে লিখিব।

তোমার স্নেহময় দাদা 
প্রমোদ। 

 পুঃ

 দেখ ভাই, মাকে এ সকল কথা কিছু বলিও না।

প্রমোদ।” 

 কনক কতবার চিঠিখানি পড়িল, কতবার অশ্রুজল মুছিল। কি উপায়ে ২০০ শত টাকা সে প্রমোদকে পাঠাইতে পারে, কি করিয়া প্রমোদকে বাঁচাইবে, তাহার কতই উপায় খুঁজিতে লাগিল। ভাবতে ভাবিতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইল, নিরুপায় বালিকা অতি প্রত্যুষে উঠিয়াই গোপনে স্বহস্তনির্মিত সেলাই গুলি, এবং আপনার রেশমী ও জরীর দামি সাড়ি কয়েকখানি ও আংটি একটি লইয়া, বামা দাসীকে উঠাইয়া গোপনে সেই গুলি বিক্রয়ের জন্য দিল। বামা তাহাদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করিয়াছে;—তাহাদের খুব অনুরক্ত ও বিশ্বাসী।

 কিন্তু বিক্রয় কবে হইবে? মনে করিলেই কিছু বিক্রয় হয় না, এদিকে আজই টাকা না পাইলে নয়। বালিকা অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িল। দাসীর উপর একান্ত ভরসা রাখিয়া তাহার প্রত্যাগমন প্রত্যাশায় পথ চাহিয়া রহিল।—দাসী ভোরে বাহির হইয়াছিল দ্বিপ্রহরের কিছু পূর্ব্বে বাড়ী ফিরিয়া ৫০টি টাকা তাহাকে আনিয়া দিল, এবং সেই সঙ্গে দুইখানি বারাণসী সাড়ী ও আংটিটী ফেরত দিয়া বলিল—“এগুলোর ত কিছু করতে নারনু; সেই বোম্বাই সাড়ী আর সেলাইগুলােই উঠলো। অত দামের আংটিটী—বলে কি না পঞ্চাশে দাও ত বাঁধা রাখি। তাও আজ টাকা দেবে না,বলে রেখে যা, যাচাই করে নেব। কাপড় দুখানা তুমি বল্লে ১৫০ টাকা দাম—তারা কেউ ৫০ এর বেশী দিতে চায় না। তাই রাগ কোরে ফেরত আন্‌নু। এত তাড়াতাড়ি কি কিছু দর পাওয়া যায় গা।”

 কনক একেবারে যেন বসিয়া পড়িল। এখনো দেড় শত টাকার অনটন। কিরূপে আজই ইহার জোগাড় করে। হাতের বালা ছাড়া তাহার অন্যান্য যথা সর্ব্বস্ব দামী সম্পত্তি সে টাকা সংগ্রহের জন্য দিয়াছিল!—এখন এই দুগাছি বাঁধা দেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর দেখিল না। অথচ তাহাতে কিরূপ বিপদ তাহাও বুঝিল। সুশীলা জানিলে রক্ষা রাখিবেন না। তাহার পুরাতন বালা ছােট হওয়াতে সবে মাত্র দুই দিন হইল এই নূতন বালা সুশীলা তাহাকে পরিতে দিয়াছেন, এখনো ইহার দাম পর্য্যন্ত দেওয়া হয় নাই। কিন্তু কি করিবে,—আজই দুই শত টাকা না পাঠাইলে প্রমােদের জেলে যাইতে হইবে! এখন অন্য বিপদ ভাবিবার সময় কোথা? সে হাতের বালা খুলিয়া দাসীকে দিয়া বলিল—“তুই এই দুগাছি নিয়ে যা, বাঁধা রেখে ১৫০ টাকা নিয়ে আয়, জানিসত দাদা বাবু চেয়েছেন—আজ না পাঠালেই নয়।”—

 দাসী। কিন্তু মাঠাকরুণ হাত খালি দেখলে যে রাগ করবেন্ গা, তখন কি হবে? দাদা বাবু কি আর মায়ের কাছে চাইতে নারলে!

 কনক। মা কি দিতেন—কেবল বকতেন। যাহ’ক তুই যেন মাকে বলিসনে, দাদার কাছ থেকে আমি তােকে বক্‌সিস চেয়ে দেব, যা তুই এখন বালা জোড়া নিয়ে যা—শীঘ্র টাকাটা এনে দে।” প্রমোদ ত দাসীকে বলিতে বারণ করেন নাই,—আর দাসীকে না বলিয়াই বা তাহার উপায় কি? কি করিয়া নহিলে আজই টাকার জোগাড় করে।—

 দাসী বলিল “আমার কিন্তু খুব ভয় নাগছে—মাঠাকরুণ জানলে রক্ষে রাখবেন্ না।”

 কনক। মা টের পাবেন না,—আমাকে জরির চুড়ি এক জোড়া এনে দিস, পরব এখন,—আর লম্বা জামায় হাত ঢাকা থাকলে অত তাঁর নজরে পড়বে না। তাব পর তুই বেনাবসী শাড়ি দুখানা বিক্রি করে আর আংটিটা বাঁধা দিয়ে কি আর ১৫০ টাকা আন্‌তে পারবিনে? দু এক দিনের মধ্যেই বা জোড়া তাহলে খালাস করে আনা যাবে।”

 বলিয়া—দেরাজ হইতে তাহার অবশিষ্ট সম্বল দুইটি টাকা মাত্র বাহির করিয়া দাসীর হাতে দিয়া বলিল “চার আনা দিয়ে এক জোড়া জরির চুড়ি আনিস্—বাকিটা তুই নিস্—আবার মাসকাবারি পেলে তোকে কিছু দেব।”

 দাসী তখন বিনা বাক্যব্যয়ে চলিয়া গেল।

 কিন্তু দৈব কনকের বিরুদ্ধ পক্ষ অবলম্বন দিল। পরদিন বালা বিক্রি ওয়ালী নূতন বালার দাম লইতে আসিল। বাল। জোড়া ঠিক নূতন নহে—একজন মহিলা অল্পদিন পরিয়া অর্থের আবশ্যকতাবশতঃ দাসী দ্বারা বিক্রয় করিতে পাঠাইয়াছেন। সুশীলা পুরাতন বলিয়া বানি দিতে অস্বীকৃত, তাই দর দাম চলিতেছিল। সে দিন এই লইয়া দুই এক কথায় দাসীর সহিত একটু বচসা হইল, সে বলিল “তবে বালা ফেরত দাও।” সুশীলাও রাগ করিয়া বলিলেন—“যদি বানিই দেব—তাহলে পুরাণ বালা নেব কেন—গড়াতে কি আর পাবি নে”।

 কনককে ডাক পড়িল,—কনক আসিলে সুশীলা বলিলেন—“দরে বনছে না—বালা দুগাছা ফেরত দিতে হবে, খুলে দাও—আমি সেকরা ডেকে নতুন বালা গড়াতে দেব এখন”।

 কনকের মাথায় বজ ভাঙ্গিয়া পড়িল, সে নির্ব্বাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। সুশীলা বলিলেন—“চুপ করে রইলে যে অমন করে? কেন কি হয়েছে।” বলিয়া সন্দিগ্ধ চিত্তে নিকটে আসিয়া হাত ধরিয়া দেখিলেন—হাত শূন্য। সক্রোধে বলিলেন “বালা কি হোল! বুঝি খুলে রেখেছিলে, হারিয়ে গেছে?” বালিকাকে স্তম্ভিত নিরুত্তর দেখিয়া বুঝিলেন—যাহা ভাবিয়াছেন তাহাই ঠিক। তখন কনকের উপর রাগ করিয়া তাহাকে বকা বৃথা বাক্যব্যয়, তিনি তৎক্ষণাৎ নীচে আসিয়া সরকার দ্বারবানদিগকে ডাকাইয়া চুরি বৃত্তান্ত অবগত করাইয়া বলিলেন—“সন্ধান কর কে নিয়েছে,—যদি পাওয়া যায় ভাল, নইলে সকলকেই পুলিসে দিতে হ’বে।”

 বাড়ীতে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। সরকারবাবু প্রত্যেক দাসদাসীকে স্বতন্ত্র ডাকাইয়া নানারূপ প্রলোভন দ্বারা গুপ্ত কথা আদায়ে যত্নবান হইলেন—আর তাঁহার কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইবা মাত্র জমাদার শোভারাম পাঁড়ে তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া লাঠির আস্ফালনে ও ক্রুদ্ধ ভাষায় শাস্তির ভয় প্রদর্শনে বেচারাদিগকে বাগ মানাইবার প্রয়াস পাইতে লাগিল। অবশেষে উভয়ের সম্মিলিত ছলে বলে কৌশলে,তন্ত্রমন্ত্র ও ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তি অনুসারে একজন গোবেচারা ভৃত্য দোষী বলিয়া প্রতিপন্ন হইল। তাহার কথা বাধিয়া গিয়াছে, সে নানা রূপ বেফাঁস কথা কহিয়াছে—অধিকন্তু সে সর্ব্বাপেক্ষা বেশী ভয় পাইয়াছে, মুখটি শুকাইয়া তাহার আম্রচূর্ণ হইয়া গিয়াছে,—আর অধিক প্রমাণের আবশ্যক কি! তাহাকে পুলিসের হস্তে সমর্পণ করা সঙ্গত বিবেচনায় পুলিসে চুরির খবর পাঠান হইল।

 এদিকে ভীত, সশঙ্কিত, আত্মহারা কনক—আর নীরবে থাকিতে পারিল না। তাহার জন্য একজন নির্দ্দোষীর শাস্তি হইতে চলিয়াছে,—সে সুশীলার নিকট আসিয়া সাশ্রুপূর্ণ নয়নে কহিল-“রাম চুরি করে নি, বালা আছে।”

 সুশীলা আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন—“বালা আছে? কোথায়?”

 “বাঁধা দিয়েছি”।

 “বাঁধা দিয়েছ? আর এই সব নিরীহ চাকরদের উপর জুলুম দেখেও তুমি এতক্ষণ চুপ করে ছিলে? কি ভয়ানক! তোমার অত টাকার দরকার কিসের? বাঁধা দিয়েছ কেন?”

 “আমি মনে করেছিলুম দু-একদিনের মধ্যেই বালাটা খালাস করব।”

 কিন্তু তোমার অত টাকার দরকার কি? তুমি যে মাসকাবারি পাও তাইত তোমার খরচের জন্য যথেষ্ট।”

 কনক ইহার কি উত্তর দিবে? মিথ্যা কথা বলা তাহার অভ্যাস নাই,—নহিলে একবার চেষ্টাও করিতে পারিত।—সে কেবল নীরবে অশ্রুপাত করিতে লাগিল। সুশীলা কুদ্ধ হইয়া আবার বার বার প্রশ্ন করিলেন,—“অত টাকা কি করলে—উত্তর দাও।”

 এই সময় কনকের দাসী আসিয়া উপস্থিত হইল, সে সাড়ী বিক্রয়ের চেষ্টায় বাহিরে গিয়াছিল। আসিয়া এই ব্যাপার দেখিয়া প্রথমে ভীত তাহার পর কনকের দুর্দ্দশায় কাতর হইয়া পড়িল। কনকের প্রতি এইরূপ পীড়ন দেখিয়া বলিয়া ফেলিল, “তা ওকি আর টাকা খেয়ে ফেলেছে! দাদাবাবু চেয়ে পাঠিয়েছে—তাই দিয়েছে—তুমি ত আর চাইলে দেবে না,—ও না দিলে কে দেয়?”

 সুশীলা রাগিয়া বলিলেন—“প্রমোদ চেয়ে পাঠিয়েছে! অত টাকা সে কখনো চাইবে না,—সেত আর বওয়াটে ছেলে নয়। দাঁড়াও আমি জিজ্ঞাসা করছি।”

 দাদার নাম করায় কনক ক্রুদ্ধ কটাক্ষে দাসীর দিকে চাহিল; দাসী বুঝিল—একথা বলিয়া ভাল করে নাই—সে কথাটা সারিয়া লইবার অভিপ্রায়ে বলিল—‘তা সব টাকা দাদা বাবুকে দিয়েছে তা বলছিনে, দিদিমণির কি খরচ নেই! কত দানধ্যান করছে—যে যখন টাকা চাচ্ছে তাকে দিচ্ছে।’

 “সেজন্য ত মাসহারা ১৫ টাকা পায়।”

 “১৫ টাকায় কি তোমাদের ঘবের দানধ্যান চলে গা!

 আমি সেদিন গাছ প্রতিষ্ঠা করনু—তাতেইত ১৫ গণ্ডা টাকা খরচ হােল। সেদিন বারােয়ারি পূজার জন্য চাঁদা নিতে এল তাতে তুমি কিছু দিলে না দিদিমণি তখনি যে ১৫ টাকা দিলে। এই বেণী ঘাটের ঠাকুর সে দিন চাইতে এল—”

 ব্রাহ্মকন্যা হইয়া দেবপূজায় কনক দান করিয়াছে শুনিয়া সুশীল মর্ম্মান্তিক চটিয়া গেলেন। এরূপ অপব্যয় আর কিসে হইতে পারে? তিনি কনকের ব্যবহারে যেমন ব্যথিত তেমনই ক্রুদ্ধ হইলেন। লুকাইয়া বালা বাধা দিয়া সে টাকা ঐ প্রকার অন্যায় দানে খরচ করিয়াছে, তাহাই যথেষ্ট অপরাধ— তাহার উপর অপরাধ করিয়া অপরাধ স্বীকারেও সাহস নাই। সে চোর, সে মিথ্যাবাদী,—তাহার গুরুভক্তি নাই, ঈশ্ববে পর্য্যন্ত ভক্তি নাই—নহিলে সে কখনও দেবপূজার জন্য চাঁদা দিতে পারে!

 কনকের হীন স্বভাব কিরূপে সংশােধন করিবেন তাহাই ভাবিয়া তিনি আকুল হইয়া পড়িলেন। বালিকার সরল মূর্ত্তি পর্য্যন্ত এখন তাঁহার নয়নে কুটিল বলিয়া বােধ হইতে লাগিল। তাহার বিষাদময়ী নম্রপ্রতিমা তিনি কপটতায় পরিপূর্ণ দেখিলেন। কনকের মাতা তাহার এইরূপ ঘৃণ্য স্বভাবের দোষেই যে তাহাকে ভাল বাসিতে পারেন নাই এখন তাহা বেশ ভাল করিয়াই বুঝিতে পারিলেন। হায় হায়! তাহাদের ঘরের মেয়ে এমন “মিটমিটে ডাইন!” সুশীলা নিতান্ত ব্যথিত, দুঃখিত হইয়া পড়িলেন।

 কনকের দোষের নিমিত্ত তাহাকে কি শাস্তি দিবেন তাহা স্থির করিতে তাঁহার মুস্কিল লাগিল। অবশেষে এই আজ্ঞা করিলেন, ক্রমাগত বার দিন ধরিয়া, একাকী একটি গৃহে তাহার পাপের মার্জ্জনা চাহিয়া ঈশ্বরের নিকট সে প্রার্থনা করিবে। বার দিন সে কাহারও সহিত কথা কহিতে পারিবে না, আহারের সময় দাস দাসীরা সেই গৃহে খাদ্য দ্রব্য লইয়া আসিবে, রাত্রেও তাহার গৃহে প্রদীপ জ্বলিবে না। এই নিয়মে কনক সেই দিন হইতে বার দিনের জন্য কারারুদ্ধ হইল।

 দাসী বালা বাঁধা দিয়া টাকা আনিয়া দিয়াছে বলিয়া তাহারও শাস্তি হইল, তাহাকে জবাব দিয়া দিলেন। কিন্তু বাঙ্গালী কর্ম্মিষ্ঠা দাসীর অভাবে কিছুদিন বিস্তর অভাব ভোগ কবিবার পর—ভবিষ্যতে গুরুদণ্ডেব ভয় প্রদর্শনে বর্ত্তমান দণ্ডাজ্ঞা প্রত্যাহরণ করিতে বাধ্য হইলেন।