ছিন্নমুকুল/ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

হৃদয় প্রকাশ

 প্রত্যূষে গঙ্গা তীরে সোগানের উপর বসিয়া কনক গুণগুণ করিয়া গান গাহিতেছিল। গান গাওয়া কেমন কনকের অভ্যাস, সে সর্ব্বদাই প্রায় আপন মনে আস্তে আস্তে গান না গাহিয়া থাকিতে পারে না। গাহিতেছিল,

এ জনমের মত সুখ ফুরায়ে গিয়েছে সখি,
এখনো তবুও হৃদয়ে জ্বলিছে দুরাশা একি?
জানি এ অভাগী ভালে সুখ নাই কোন কালে,
দুরন্ত পিপাসা তবু থামিবার নহে দেখি।
এত যে যতন করি এ জ্বালা নিভাতে নারি,
প্রেমের এ দাবানল জ্বলি উঠে থাকি থাকি।

 গুণগুণ করিয়া বালিকা কিছু পরে থামিল। তাহার জলমগ্ন ঘটনাটি মনে পড়িয়া গেল; আজ ডুবিলে তাহাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই, আজ আর হিবণকুমার তাহাকে বাঁচাইতে আসিবেন না। বালিকা ভাবিতে ভাবিতে সাশ্রুনেত্রে, গঙ্গাবক্ষঃস্থিত প্রাতঃসমীরণতরঙ্গিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীচিমালা বিক্ষেপ দেখিতে লাগিল; দেখিতে দেখিতে সেই তরঙ্গস্রোত ভঙ্গ করিয়া একখানি নৌকা তীরে আসিয়া লাগিল, কনকের বিস্মিত, মুগ্ধ নেত্রের সম্মুখে সত্যই হিরণকুমার নৌকা হইতে নামিয়া তাহার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 ক্ষণকাল কাহারও মুখে কোন কথা ফুটিল না। উভয়েই যেন মন্ত্রমুগ্ধ; উভয়েই যেন চিরপরিচিত অথচ উভয়েই যেন চির অপরিচিত; উভয়েরই হৃদয় পূর্ণ অথচ উভয়েরই মুখে কোন কথা নাই। কিছুক্ষণ পরে হিরণ বলিলেন “আমি এবার বেহারে যাচ্ছি, চারিটি দিন শুধু আমার হাতে তাই;—কনক তোমার দাদার সঙ্গে কি এখন দেখা হবে?”

 কনক বলিল—“দাদা ত এখানে নেই, কলকাতায় গেছেন।

 হি। কবে আসবেন?

 ক। আজই রাত্রে আসতে পারেন—নয়ত কাল।

 আবার কিছুক্ষণ উভয়ে চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পর সহসা আত্মহারাভাবে হিরণকুমার বলিলেন,—

 “কনক তুমি এখানে স্নেহের রাজ্যে সুখে আছ কিন্তু আমি নিতান্তই অসুখী। তোমা ছাড়া হ'য়ে অবধি আমি সুখ হারিয়েছি, শান্তি হারিয়েছি, পৃথিবীতে আমার আর যেন কেহ নেই কিছু নেই। শয়নে স্বপনে সকল সময়েই তোমার ঐ কনক প্রতিমা বই আর কিছুই দেখিতে পাইনে, কনক তুমি আমাকে পাগল করে তুলেছ—”

 হিরণকুমার মনের আবেগে রুদ্ধশ্বাসে সমস্ত কথাগুলি বলিয়া গিয়া নিশ্বাস লইবার জন্য থামিলেন। আশ্চর্য্যের কথা কিনা জানি না, কনকের পরদুঃখকাতর কোমল মনে হিরণকুমারের এই দুঃখের কথায় দুঃখ হইল না, বরঞ্চ ইহাতে বালিকার দুঃখসিক্ত হৃদয়ে অপুর্ব্ব আনন্দ সমীরের হিল্লোল বহিল। হিবণকুমার আবার বলিলেন—“কনক এ অশান্ত মনকে কিছুতে বাঁধতে না পেরে শেষে তোমার কাছে এসেছি, আমার একটি কথার উত্তর দাও। তোমার একটি কথার উপর আমার জীবন মরণ নির্ভর করছে। কনক আমার এই উন্মত্ত ভালবাসার কি প্রতিদান পাব?”

 কনক মনে মনে বলিল—“যদি বুক চিরিয়া দেখাইবার হইত ত দেখিতে কাহার ভালবাসা বেশী উন্মত্তকর?” কিন্তু তাহার মনের কথা মনেই রহিল, মুখে ফুটিল না। হিরণ তাহার মৌনভাবে আশ্বস্ত হইয়া আবার বলিলেন—“কনক বল বল, আর সন্দেহের ব্যাকুলতায় রেখোনা। তুজি নিজে হন্তারক না হলে আমার সুখে বাধা দেবার আর কে আছে? আমি তোমার কর প্রার্থনা করলে প্রমোদের তাতে অসম্মত হবার কোন কারণই নেই। তোমার জীবন রক্ষা যে করেছে আর কিছু না হোক্ সে তাঁর কৃতজ্ঞতার ভাজন। কিন্তু তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা চাইনে। ভালবাসার উত্তর ভালবাসা। কনক, আমি কি তোমার ভালবাসা পাব?”

 কনক কোন উত্তর করিল না, সে ভাবিতেছিল সত্যই কি প্রমোদ হিরণকুমারের প্রার্থনা গ্রাহ্য করিবেন, কেনই বা গ্রাহ্য না করিবেন? দুজনের দেখা শুনা কথাবার্তা হইলে প্রমোদের ভ্রম নিশ্চয়ই ঘুচিয়া যাইবে। হিরণকুমারের মহত্ত্বে, সাধুতায় তিনি অবশ্যই মুগ্ধ হইবেন।

 এদিকে দেখিতে দেখিতে পূর্ব্ব গগন উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ঘাটে ঘাটে গঙ্গাস্নানে আগমনকারী বয়স্কা রমণীগণের কথোপকথনধ্বনি উত্থিত হইয়া প্রশান্ত গঙ্গাবক্ষ সমধিক চঞ্চল করিয়া তুলিল। কনকের যেন মোহ ভাঙ্গিল। একজন অপরিচিত পুরুষের সহিত এই বিজনতটে তাহাকে একাকী গল্প করিতে দেখিলে অন্যেরা কি মনে করিবে? প্রমোদই কি ইহা জানিলে সন্তুষ্ট হইবেন? হিরণকুমারের প্রতি তাহার বিদ্বেষভাব কি আরও বর্দ্ধিত হইবে না? এই ভাবিয়া সহসা তাহার মুখকান্তি মলিন হইয়া পড়িল। কনক অনেকবারই ভাবিল, প্রমোদের তাঁহার প্রতি বিদ্বেষভাবের কথা হিরণকুমারকে বলিবে, কিন্তু পারিয়া উঠিল না, কোন মতেই যেন তাহার সে অবসর ঘটিল না। হিরণেরও সহসা চমক ভাঙ্গিল, বুঝিলেন, প্রমোদ এখানে নাই, অধিক ক্ষণ তাঁহার আর এখানে থাকা ঠিক হইতেছে না। কনকও তাঁহাকে সেই কথা বলিবে ভাবিতেছে, কিন্তু তিনি আগেই বলিলেন, “কনক এখনি আমার যেতে হবে, আর সময় নেই, তুমি আমার কথার উত্তর দাও, বল তুমি আমাকে ভালবাস?”

 কনক আর সমস্ত ভুলিয়া সলজ্জে অবনত মুখে বলিল—“বাসি।” এই কথাটীতে হিরণের মাথার ভিতর দিয়া চকিতের মধ্যে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড যেন ঘুরিয়া গেল, হৃদয়ের দ্বারে শোণিত উচ্ছ্বাস বেগে ঝাঁপাইয়া পড়িল। তিনি কি বলিবেন, কি করিবেন ভাবিয়া না পাইয়া কনকের হাতখানি দুই হাতে ধরিয়া কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, পরে আনন্দকম্পিত কণ্ঠে কহিলেন, “কত দিন কত সময় অন্তরে নিদারুণ শূন্যতা উপলব্ধি করে, কি সুতীব্র নিরানন্দে অভিভূত হয়ে পড়েছি। জীবনের মঙ্গল উদ্দেশ্যে পর্য্যন্ত তখন সন্দেহ জন্মেছে, বিধাতাপুরুষকে পর্য্যন্ত কত না অভিশাপ প্রদান করেছি। আজ মনে হচ্ছে, —এ ভালবাসা এ আনন্দ যার জন্যে সঞ্চিত ছিল তার মত সার্থক জীবন আর কার! তার মত বিধাতার প্রিয়পুত্র আর কে?” হিরণ আনন্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া নীরব হইলেন। কনকেরও দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়িল। হিরণ আবার বলিলেন, “কনক সত্যই কি তুমি আমার? কেবল মনে নয়, আমার নয়নেও কি তুমি এখন থেকে চিরবিরাজিত, চিরপ্রকাশিত হয়ে থাকবে? কেবল অন্তরে নয়, বাইরে জগৎসংসারের সাক্ষাতেও কি এখন থেকে তুমি আমার চির আপনার হ’য়ে, গৃহলক্ষ্মী রূপে বিরাজ করবে? কে জানে এত সৌভাগ্য মনে করতেও যেন কেমন আশঙ্কা হয়। কনক আজ তবে এখন বিদায় লই। কাল আবার তোমার দাদার সঙ্গে দেখা করতে আসব।”

 বলিয়া তিনি নৌকায় উঠিলেন, দাঁড়িরা ক্ষিপ্রহন্তে দাঁড় বাহিয়া অল্প ক্ষণের মধ্যেই পরস্পরের দৃষ্টিপথ হইতে পরস্পরকে দূরে লইয়া ফেলিল; কিন্তু মুগ্ধ প্রণয়ী দুই জন তাহার পরও বহুক্ষণ পর্য্যন্ত সতৃষ্ণনেত্রে পরস্পরের উদ্দেশে শূন্য পথে চাহিয়া রহিলেন।