ছিন্নমুকুল/দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

গৃহবিচ্ছেদ

 কনকের সেই “বাসি কথাটি” নিশাকালের বীণাঝঙ্কারবৎ হিরণের কর্ণে লাগিয়া রহিল, অমন মিষ্ট কথা আর কখনও জীবনে তিনি শোনেন নাই, শুনিবেনও না। সমস্তদিন তিনি কি যেন এক আনন্দের মোহে অভিভূত হইয়া রহিলেন। পরদিন সন্ধান লইয়া শুনিলেন প্রমোদ কলিকাতা হইতে এলাহাবাদে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। অপরাহ্নে তাঁহার সহিত দেখা করিতে গেলেন। সবে মাত্র প্রমোদ কনককে কাঁদাইয়া বিদায় দিয়া নিতান্ত বেখোস্ মেজাজে বসিয়া আছেন, চাকর আসিয়া হিরণকুমারের নাম লেখা একখানি কার্ড তাঁহার হাতে দিয়া বলিল” বাবু গাড়ীতে বসে আছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।” প্রমোদ কার্ডথানি টেবিলে ফেলিয়া চটিয়া উঠিলেন—“Let him go to—বল্‌গে বাবু বাড়ী নেই, এখন দেখা হবে না।” চাকর হিরণকুমারকে তাহাই গিয়া বলিল; হিরণ বুঝিলেন প্রথম কথাটা মিথ্যা, দেখা করবেন না ইহাই সত্য। ভাবিলেন নিতান্তই তিনি অসময়ে আসিয়াছেন, কলিকাতা হইতে গৃহে ফিরিয়া এখনো বাহিরের লোকের সহিত প্রমোদের দেখা করিবার অবসর হয় নাই। কিন্তু একে স্বভাবতঃ প্রেমিক হৃদয় অসহিষ্ণু, অধীর, ধৈর্য্যাবলম্বনে অপটু, তাহাতে হিরণকুমারের প্রতীক্ষা করিবার সময়ও অধিক নাই, এই সময়ের মধ্যে তিনি প্রমোদের সহিত কথা কহিয়া বিবাহ ঠিক করিয়া যাইতে একান্ত ইচ্ছুক, অতএব তাঁহার সহিত দেখা করার অপেক্ষা আর না করিয়াই বাড়ী ফিরিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহার বক্তব্য পত্রাকারে লিখিয়া সেই অপরাহ্নেই প্রমোদকে তাহা পাঠাইয়া দিলেন।

 হিরণের পত্র পাইয়া প্রমোদের আপাদমস্তক জ্বলিয়া উঠিল, একে কিছু পূর্ব্ব হইতেই কনকের অবাধ্য আচরণে তিনি অপ্রকৃতিস্থ আছেন—তাহার পব হিরণকুমারের বিবাহ প্রস্তাবে তাঁহার ক্রোধের সীমা রহিল না। হিরণকুমার কোথাকার কে? তাহার সহিত কনকের বিবাহ! হিরণের স্পর্ধা তাঁহার অমার্জ্জনীয় বোধ হইল! এ বিবাহ হইবার নহে, ইহা তিনি তখনই স্পষ্ট করিয়া লিখিতে বসিলেন; কিন্তু কলম হাতে লইয়া মনে হইল, বিবাহ না হইবার কারণ কি দিবেন? হিরণকে কি লিখিবেন, তুমি আমার শত্রু সেই জন্য কনকের রক্ষাকারী হইলেও তাহার সহিত তোমার বিবাহ হইবার নহে। এ কথা ত আর লেখা যায় না। হাজার হৌক্‌ সে কনকের প্রাণদান দিয়াছে, তাহার পরিবর্ত্তে ভদ্রতাও ত একটা আছে। প্রমোদ কলম রাখিয়া ভৃত্যকে বলিলেন “বাবুকে বলতে বল, উত্তর কাল পাবেন।”

 প্রমোদ ইহার পর কনককে ডাকিয়া পাঠাইলেন। ভাবিলেন, এ সম্বন্ধে কনকের মতামত জিজ্ঞাসা করিলেই সে অমত প্রকাশ করিবে, হিরণকে উত্তর দেওয়া তখন তাঁহার পক্ষে খুবই সহজ হইয়া আসিবে। কনকের সহিত কথাবার্ত্তায় প্রমোদের মনে হইয়াছিল এখন বিবাহ করিতেই কনক নারাজ—নহিলে তাঁহার ইচ্ছার বিপরীতে সে কখনই কথা কহিত না। সুতরাং হিরণকুমারের প্রস্তাবও যে সে পূর্ব্ববৎ অগ্রাহ্য করিবে তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র সংশয় ছিল না। ইতিপূর্ব্বে রুষ্ট কথায় কনককে যে কষ্ট দিয়াছেন—এই অবসরে তাহার মনের মত কথা কহিয়া তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার অভিপ্রায়ও মনে আঁটিলেন।

 আবার প্রমোদ কেন ডাকিয়াছেন— বালিকা ভয়ে ভয়ে তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। যখন দেখিল প্রমোদের মুখে ক্রোধের লক্ষণ কিছুই নাই তখন সে নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিল। প্রমোদ বলিলেন—“আয় আমার কাছের এই চৌকিতে বোস্।” কনক বসিল, প্রমোদ টেবিলের উপরকার কেরোসিনের ল্যাম্পটা আর একটু উজ্জ্বল করিয়া দিয়া হিরণের চিঠিখানি কনকের হাতে দিলেন। কনক বলিল “কার চিঠি?” প্রমোদ বলিলেন, “পড়্ না, ভারী মজার চিঠি? কি উত্তর দেব তুই বলে দে।”

 কনক চিঠি খুলিল, খুলিয়া প্রথমেই দেখিতে গেল কে লিথিয়াছে; দেখিল হিরণকুমারের পত্র। বুঝিল তিনি কি লিখিয়াছেন,—তাহার আর পড়া হইল না; আপনাআপনি হাতটি নীচু হইয়া পড়িল,—মুখ আরক্তিম হইয়া উঠিল, বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্ম ওষ্ঠে ভালে পদ্মপত্রে নীহারবৎ শোভিত হইল, বালিকা মৌনভাবে আনত দৃষ্টিতে পত্র হস্তে ধরিয়া বসিয়া রহিল।

 প্রমোদ তাহার ভাব দেখিয়া হাসিয়া বলিলেন, “ভয় নেই আমি আর তোকে বিয়ে করতে বলছি নে। চিঠিখানা যে পড়তে দিলুম সে কেবল তোর জাঁকটা বাড়াতে। কত লোকে যেচে বর পায় না আর আপনা হতেই তোর কত বর জুটছে! তা নিজের গুমর নিজে ত তুই বুঝলি নে—এক লাইন না পড়তে পড়তে ভড়কে গেলি। দে চিঠিখানা—জবাব লিথে দিই।” বলিয়া চিঠিখানি কনকের হাত হইতে লইয়া উত্তর লিখিতে বসিলেন—

 কনক সহসা আগ্রহের স্বরে বলিয়া উঠিল, “কিন্তু”—প্রমোদ ইহাতে মুখ তুলিয়া বলিলেন—“ন। এবার আর তোর ভাবনা নেই। লিখছি, তোকে বিয়ের প্রস্তাব করা বৃথা, তোর বিয়ে করতে ইচ্ছা নেই। কেমন সন্তুষ্ট কি না?”

 এই কথায় কনককে যেরূপ হর্ষোৎফুল্ল দেখিবেন আশা করিয়াছিলেন— সেরূপ দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার কথায় সে যেন অধিকতর বিষণ্ন গম্ভীর হইয়া পড়িল, চক্ষু দুটি সজল হইয়া উঠিল, কিন্তু নয়নের জল নয়নেই আবার মিলাইয়া পড়িল, ভূমিতে পড়িল না।

 প্রমোদ-আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, “একি তুই এমন বিষণ্ন হয়ে পড়লি? এখন ত আর আমি তোকে অমতে বিয়ে করতে বলছি নে।”

  বালিকা কোন উত্তর করিল না, কেবল তাহার নীরব মুখকান্তিতে সুদারুণ একটা উদ্বেগ প্রকটিত হইল। প্রমোদ সন্দিগ্ধ হইয়া গম্ভীর ভাবে কহিলেন, “আমি ত তোরি মনের কথা লিখছি। এই একটু আগে তুই বলেছিস্ বিয়ে করতে তোর ইচ্ছা নেই। তখন আমি তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলুম সত্যি, কিন্তু এখন আমি তোর সঙ্গে পূর্ণভাবে একমত হয়েই এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করছি, তাহলে কেন তোর এ বিষণ্ণ ভাব?”

 কনক পাষাণ-প্রতিমাবৎ নিরুত্তর; চক্ষে স্থির দৃষ্টি, তাহাতে পলক নাই, জ্যোতি নাই, বদনমণ্ডল পাংশুবর্ণ, হৃদয়ে রক্ত-স্রোত বহিতেছে কি না সন্দেহ। কনকের ভাব দেখিয়া প্রমোদ এবার বিরক্তির ভাবে বলিলেন, “কনক কথা কও না; চুপ করে রইলে যে?”

 কনক কি যেন বণিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু কথা আটকিয়া গেল, বলিতে পারিল না। প্রমোদ উত্তরের আশায় অনেক ক্ষণ তাহার মুখের দিকে চাহিয়া চাহিয়া শেষে বিরক্ত হইয়া বলিলেন,

 “কনক তুমি দেখছি আমাকে পাগল ক’রে তুলবে? এই এখনি একটু আগে দৃঢ়ভাবে বিবাহে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে, এখন আবার কথা কইতে কি হ'ল, বিবাহ করবে না কি? আমাকে উত্তর দেও।”

 বালিকা ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে মুখ খুলিল, কিন্তু সুস্পষ্ট স্বরে কহিল, “আমার অমত নেই।” কাল কনক কোন মতেই যামিনীনাথের সহিত বিবাহে সম্মত হইল না, আর আজ তাহার হিরণকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা! প্রমোদের শোণিত উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, তিনি এখন বুঝিলেন এই কারণেই তবে কনক কাল বিবাহে অসম্মত হইয়াছিল। হিরণকে তাঁহার কণ্টক স্বরূপ মনে হইল, মনে মনে তাহার উপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িলেন।

 তিনি কম্পিত স্বরে বলিলেন,  “কিন্তু আমার আপত্তি আছে। এখনও কি এ বিবাহ করতে চাও?” উত্তর না পাইয়া আবার বলিলেন,

 “তুমি বিবাহ করতে পার, আমি কিছুই বলব না, কিন্তু তা হলে তোমাতে আমাতে এই পর্যন্ত সম্পর্ক শেষ—এ কথা যেন মনে থাকে।” প্রমোদ হিরণকে মনে মনে শত শত অভিসম্পাত দিতে দিতে ক্রোধ ভবে সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।

 হিরণকে—তাঁহার চিরশত্রু হিরণকে কনক ভালবাসিল! হিরণের জন্যই তাঁহার বন্ধুকে বিবাহ করিতে চাহিল না, হিরণের জন্যই তাঁহার কথা অগ্রাহ্য করিল, তাঁহার মনোরথ ব্যর্থ করিল! বার বার হিরণ হইতেই কি তিনি আঘাত পাইতেছেন না? তাঁহার শত্রুতা করিতেই হিরণের জন্ম!

 প্রমোদ কিছু পরে হিরণের চিঠির উত্তরে লিখিয়া দিলেন যে, বিবাহ হইবে না।