ছিন্নমুকুল/নবম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

নবম পরিচ্ছেদ

দূরে নৌকা

 নিদারুণ যন্ত্রণায় আকুল হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ক্রমে যখন বালিকা একান্ত ক্লান্ত অবসন্ন হইয়া পড়িল, তখন শোকতাপহারী তন্দ্রা আসিয়া তাহাকে বিশ্রাম প্রদান করিলেন। কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই সহসা কাহার কঠিন হস্তস্পর্শে বালিকা চমকিত হইয়া জাগিয়া উঠিল। তথন চারিদিক ঘনঘোর অন্ধকার, কিছুপূর্ব্বে নৌকায় যে আলো জ্বলিতেছিল তাহাও নিভিয়া গিয়াছে, অনবরত দাঁড়ের ঝপ্ ঝপ্ শব্দ নিস্তব্ধ রজনীর ভয়ঙ্কর ভাব বৃদ্ধি করিয়া তুলিতেছে, তাহা হইতেও ভয়ানক, তাঁহার শিয়রে বসিয়া একজন মনুষ্য অস্ফুট কণ্ঠে তাহাকে কি বলিতেছে। নিদ্রিত হইয়া সে তাহার বিপদের কথা সমস্ত ভুলিয়া গিয়াছিল, তাই নিদ্রাভঙ্গে সহসা শীর্ষদেশে মনুষ্য দেখিয়া সে পুনরায় চীৎকার করিবার উপক্রম করিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপনার বিপন্ন অবস্থা ও দস্যুদিগের সেই নিষেধ বাক্য মনে পড়ায় অমনি থামিয়া গেল। ব্যক্তি মৃদুস্বরে বলিল “ভয় নাই আস্তে কথা কও, আমি তোমাকে উদ্ধার করব।” যখন নীরজা ভাবিতেছিল তাহার আশা ভরসা কিছুই নাই—সে অকুল পাথারে ভাসিয়াছে, তখন রক্ষার কথা শুনিয়া মুমূর্ষু ব্যক্তির সুরা সেবনের ন্যায় সহসা আনন্দে তাহার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া উঠিল— কিন্তু মুহূর্ত্ত মধ্যেই হতাশ্বাস হইয়া সন্দিগ্ধচিত্তে জিজ্ঞাসা করিল “তুমি কে? এখানে যারা ছিল তারা কোথায় গেল? তুমি আমাকে কেমন করে রক্ষা করবে?”

 উত্তর হইল “তারা ঘুমোতে গেছে, আমি এখন পাহারায় আছি, আমি এ নৌকার একজন দাঁড়ি, তোমার দুর্দ্দশায় দয়া হয়েছে। আমার কথামত কাজ করলে তোমাকে উদ্ধার করতে পারি।”

 নীরজা ভাবিল ‘আমি নিরুপায়, যদি এর প্রতারণার ইচ্ছা থাকে তা হলেও মরব, এখানে থাকলেও মরব, এরূপ স্থলে এ’কে বিশ্বাসই করা যাক। সে বলিল “কি করতে হবে?”

 “এখন কিছুই করতে হবে না, তুমি কেবল পালাবার চেষ্টা কর’ না, পরে আমি গোপনে কোন ভদ্রলোকের সাহায্য নিয়ে তোমাকে উদ্ধার করব। কিন্তু যা বলি বিশ্বাস করে কাজ করো।”

 নীরজা সে কথায় সম্মত হইল, তখন দাঁড়ি সেখান হইতে গিয়া নৌকার দ্বারদেশে শুইয়া রহিল। ক্রমে দিন যাইতে লাগিল, প্রত্যহই নীরজা উদ্ধারের জন্য লালায়িত হইতে লাগিল। দুই তিন দিনের মধ্যে নৌকা এলাহাবাদে আসিয়া লাগিল। যে দাঁড়ি নীরজাকে আশা দিয়াছিল, সে তীরে খাদ্য দ্রব্য কিনিতে নামিল, সুতরাং নৌকা তীরে লাগাইয়া অন্যেরা তাহার প্রত্যাগমন পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিতে লাগিল। মাঝি খাদ্য সামগ্রী লইয়া নৌকায় উঠিয়া নীরজাকে চুপে চুপে বলিল “আর ভয় নেই, তোমার উদ্ধারের জন্য শীঘ্রই একখানি নৌকা আসছে।” নীরজা আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, সে আকাঙ্ক্ষিত সময়ের জন্য বড়ই অধীর হইয়া পড়িল। ক্রমে সন্ধ্যা হইল, একটু একটু মেঘ করিয়া বৃষ্টি পড়িতে লাগিল, গবাক্ষপথে মুখ দিয়া অন্ধকার জলরাশির দিকে চাহিয়া চাহিয়া নীরজা উদ্ধারের আশায় ব্যাকুল হইয়া রহিল। প্রত্যেক নৌকাই ঝপ ঝপ্ শব্দে তাহার আশা বাড়াইয়া আবার চোখের উপর দিয়া অন্য দিকে চলিয়া যায়, নীরজা অমনি হতাশ অবসন্ন হইয়া পড়ে। দেখিতে দেখিতে অবশেষে সত্য সত্যই একখানি নৌকা তীব্রবেগে এই নৌকার নিকট আসিয়া ইহার গতিরোধ করিল, ভয়ে মাঝিরা নৌকা থামাইল, অমনি একটি ভদ্র যুরা লাফাইয়া এ নৌকায় উঠিয়া আসিলেন। ঘন ঘন বন্দুকের শব্দে ভীত হইয়া নৌকার লোকেরা তাঁহার সহিত বিবাদ করিল না; কে কোথায় লুকাইল, কে কোথায় পলাইল তাহার ঠিকানা রহিল না। সুতরাং অনায়াসে যুবা নৌকামধ্যে নীরজার নিকট আসিলেন। নৌকার দীপালোকে নীরজা সেই যুবাকে চিনিতে পারিল, নীরজা দেখিল—যামিনীনাথ তাহার উদ্ধারকারী। যামিনীনাথ তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য্য ভাবে বলিলেন “তুমি বনবালা! এস আমার সঙ্গে এই বোটে শীঘ্র এস।” দস্যুহস্তমুক্ত হইয়া আহ্লাদে নীরজার কথা কহিবার শক্তি ছিল না, সে নিঃশব্দে যামিনীনাথের সঙ্গে সঙ্গে গিয়া তাঁহার বোটে উঠিল। বোট ছাড়িয়া দিল।