ছিন্নমুকুল/পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পূর্ব্বঘটনা
সুশীলা বিধবা বলিয়া পরিচিত, হঠাৎ কি করিয়া মৃত্যুকালে তাঁহার স্বামী আসিয়া উপস্থিত হইলেন? এই স্থানে ইহাঁদের পূর্ব্ববৃত্তান্ত কিছু বলা আবশ্যক। তারাকান্তের জ্যেষ্ঠা কন্যা চারুশীলকে তাহার স্বামী বিবাহের পরই সেই হইতে পিত্রালয় হইতে লইয়া গিয়াছিলেন, সেই অবধি তারাকান্তের নিকট পাঠান নাই। তাহাকে আনিবার কথা বলিলেই বিনোদলাল কোন না কোন ওজর করিতেন, আসল কথা চারুশীলাকে ছাড়িয়া তিনি এক দিনের জন্যও একাকী থাকিতে চাহিতেন না। তাহা দেখিয়া তারাকান্ত সুশীলার বিবাহ দিয়া ছোট জামাতাকে ঘর-জামাই করিয়া রাখেন। পুত্রাদি আর কেহই না থাকায় সুশীলাকে তিনি কাছছাড়া করিতে পারিলেন না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ বিবাহের অল্প দিন পরেই জামাতার স্বভাবে একটি বিলক্ষণ দোষ জন্মিল। দয়ানন্দ কি প্রকারে মদ্যপানে শিক্ষিত হইলেন। সুশীলা তাঁহাকে সংশোধনের অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কৃতকার্য্য হইলেন না। একদিন কোথা হইতে দয়ানন্দ মদ খাইয়া গৃহে আসিয়া ভৃত্যকে পুনরায় মদ আনিতে আদেশ করায়, সুশীলা ভৃত্যকে বারণ করিয়াছিলেন। তাহাতে দয়ানন ক্রুদ্ধ হইয়া, সেই মত্ত অবস্থায় সুশীলাকে প্রহার করেন। এই কথা কি করিয়া তারাকান্তের কর্ণে উঠে। তিনি জামাতার আচরণে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া, তাঁহাকে কটূক্তি করেন। দয়ানন্দ ইহাতে অত্যন্ত অপমান বোধ করিলেন। ভাবিলেন তিনি শ্বশুরের অন্নভোজী না হইলে, শ্বশুর তাঁহার প্রতি এরূপ দাসের ন্যায় ব্যবহার করিতে পারিতেন না। অপমানিত হইয়া সেই দিনই তিনি শ্বশুরালয় ত্যাগ করিলেন। তাহাতে সুশীলার অত্যন্ত মনস্তাপ হইল। যাইবার সময় স্বামী সুশীলাকে বলিলেন সুশীলা, আমি তোমাকে বিবাহ করে অন্যায় করেছি, আমরা সমকক্ষ নই। আমি দরিদ্র, তুমি ধনবানের কন্যা। নামে আমি তোমার ভর্ত্তা কিন্তু আসলে ভরণপোষণ কর তুমি। মুখের কথায় আমি তোমার প্রভু, কিন্তু আসলে আমি তোমার দাস মাত্র। পুরুষের পক্ষে এরূপ জীবন কতদূর হেয় ঘৃণাস্পদ এতদিনে তা আমি খুবই বুঝছি। আমি বিদায় হই, তুমি পিত্রালয়ে সুখে থাক।” এই কথায় স্বামীর সমস্ত অসদ্ব্যবহার ভুলিয়া সুশীলা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন “তুমি দরিদ্র, তবে আমি কি? আমিও দরিদ্রের পত্নী। পিতার ধন আছে তাঁরি থাক, তোমার সঙ্গে আমি ভিক্ষা করে জীবন কাটাব, তোমার সঙ্গে বনবাসেও আমার সুখ, তুমি যদি এখানে না থাক তাহলে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে চল।” পত্নীর প্রেমময় করুণবাক্যে দয়ানন্দ যেন কিছু নরম হইলেন। কিন্তু শশুরবাটী ত্যাগ করিবেন এই যে তাঁহার দৃঢ় সঙ্কল্প, তাহা কোন মতেই টলিল না। তিনি সেইদিনই শ্বশুরালয় পরিত্যাগ করিয়া গেলেন।
দিন যায় মাস যায়, দয়ানন্দের আর কোন খবর নাই, সুশীলা চাতকিনীর ন্যায় তাঁহার পত্রের জন্য হা-প্রত্যাশ করিয়া থাকেন, প্রত্যহই ভাবেন, আজ নিশ্চয়ই তাঁহার পত্র পাইব, শেষে রাত্রি হইলে হতাশ হইয়া অশ্রুবারিতে মনের জ্বালা নিবারণ করেন। যদি এই দুঃখময় পৃথিবীতে ঈশ্বর আমাদের অশ্রুজল না দিতেন, জানিনা তাহা হইলে কি হইত। ক্রমে একবর্ষ দুইবর্ষ অতীত হইল, তবুও কোন সংবাদ নাই। অবশেষে তৃতীয় বৎসরের শেষে জনরবে শোনা গেল—তিনি কলিকাতা হইতে উড়িষ্যা গমন করিতেছিলেন, ঝড়ে জাহাজ ডুবি হইয়া তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। এই সংবাদে সুশীলা অত্যন্ত মর্ম্ম-পীড়িত হইলেন। তাহার পর হইতে তিনি বিধবাবেশ ধারণ করিয়াছিলেন।
এদিকে দয়ানন্দ শ্বশুরালয় ত্যাগ করিয়া কানপুরে আসিয়া সন্ন্যাসী ফকীরের দলে মিশিলেন। যে বিজন মন্দির এখন তাঁহার সম্পত্তি সেই মন্দিরের ভূতপূর্ব্ব সন্ন্যাসী একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন। সংস্কৃত চর্চ্চার অভিপ্রায়ে দয়ানন্দ ইহাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া ক্রমশ গুরুর এতদূর প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিলেন যে, গুরু মৃত্যুকালে ইহঁকে আপন উত্তরাধিকারী করিয়া গেলেন।
দয়ানন্দের দ্বিতীয় বার দারগ্রহণের বিররণ এইরূপ। কানপুর হইতে কোন একসময় গুরুর সহিত শ্রীক্ষেত্র যাত্রাকালে একজন কন্যাদায়গ্রস্ত গরীব ব্রাহ্মণ-সহযাত্রী কর্ত্তৃক বিশেষ অনুরুদ্ধ এবং গুরুরাদেশ লঙ্ঘনে অপারগ হইয়া ইনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। নীরজা এই বিবাহের একমাত্র সন্তান, কন্যা জন্মিবার অল্পদিন পরেই প্রসূতির মৃত্যু হয়। পত্নী বিয়ােগের পর দয়ানন্দের পূর্ব্বস্মৃতি রুদ্রভাববিরহিত সুকোমল ভাবে মনে উদিত হইল। সুশীলার প্রতি তিনি কিরূপ কঠোর ব্যবহার করিয়াছেন, তাহা বুঝিতে পারিলেন; নিজের অপরাধ হৃদয়ঙ্গম করিয়া, শ্বশুরকৃত অপমান ভুলিয়া গেলেন। তখন সুশীলাকে দেখিতে আসিবার ইচ্ছা হইল, কিন্তু তখন আর কোন্ মুখে দেখা করিতে আসেন? যাহাকে ত্যাগ করিয়া বিবাহ পর্য্যন্ত করিয়াছেন, এখন তাহার নিকট আর কি করিয়া আসিবেন! এইবার নীরজাকে লইয়া কলিকাতা হইতে কানপুর যাইবার সময় কোন মেলা উপলক্ষে কন্যার সহিত কয়েক দিন এলাহাবাদে তিনি বাস করিয়া গেলেন কিন্তু ইচ্ছা সত্ত্বেও কোন মতে একদিন সুশীলার সহিত দেখা করতে আসিতে পারিলেন না।
সুশীলার বাড়ী বেণীঘাট হইতে অধিক দূরে নহে, নীরজা সন্ধ্যাকালে তীরভ্রমণ করিতে করিতে প্রায়ই তাঁহাদের বাড়ীর কাছে আসিয়া পড়িত। কখনও উদ্যানের ঘাটে আসিয়া বসিত, কখনও বা তীরে তীরে বেড়াইয়া দূর হইতে বাড়ীর আলােকের দিকে চাহিয়া চাহিয়া ফিরিয়া যাইত। কেজানে কেন, নিস্তব্ধ নিশীথে সেই শ্বেত নিস্তব্ধ অট্টালিকার দিকে চাহিয়া সে কেমন যেন মুগ্ধ হইয়া পড়িত। মঙ্গলগ্রহের দিকে চাহিয়া কল্পনা সূত্রে বৈজ্ঞানিকের যেমন তাহার জীবদিগের সহিত আলাপ করিতে ইচ্ছা হয়, নীরজাও তেমনই ভাবে সেই অট্টালিকার প্রতি আকৃষ্ট নেত্রে চাহিয়া তাহার অন্তস্থ অজ্ঞাত প্রাণীর পরিচয়ে কুতূহলী হইয়া কত কি কল্পনা করিত।
অন্যদিনের মত সেই বর্ষা রজনীতেও নীরজা নদীতীরে ভ্রমণ করিতেছিল। কিছুক্ষণ হইতে মেঘ করিয়াছিল কিন্তু নীরজা অরণ্যরালিকা, বৃষ্টির ভয় তাহার ছিল না, যখন মেঘ ঘনাইয়া আসিল, বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল তখন তাহার হৃদয় একটি অপূর্ব্ব আনন্দে পূর্ণ হইল। নীরজার প্রকৃতিই এমনি উপাদানে গঠিত যে মেঘের ডাকে তাহার হৃদয় নাচিয়া উঠিত, বিদ্যুৎ চমকিলে সে যেন তাহা ধরিবার আশায় ছুটোছুটি করিত, বৃষ্টি পড়িলে অনেক সময় সে তাহার সেই সুললিত দেহ খানি, নিবিড় জলবৎ কুন্তলরাশি ভিজাইয়া দয়ানন্দের তিরস্কাবের পাত্র হইত।
সেদিন সে মেঘবৃষ্টির রুদ্রগম্ভীর শোভার মধ্যে আত্মবিস্মৃত হইয়া ভুলিয়া গেল এ তাহার পরিচিত অরণ্যতল নহে, এ অপরিচিত উদ্যানভূমি। বালিকা এইরূপ সময়ে মন্দিরের আলোক লক্ষ্য করিয়া যেমন বাড়ী ফিরিত তেমনি বজ্রধ্বনি হইবামাত্র অট্টালিকার আলোক লক্ষ্য করিয়া অভ্যাস বশতঃ গান গাহিতে গাহিতে প্রাচীর তলে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিল। অতীতের স্মৃতিতেই তাহার হৃদয় ভাসিতেছিল, বর্ত্তমান তাহার মন হইতে অপসৃত। তাহারই গানে সেদিন কনক ও সুশীলা মুগ্ধ হইয়াছিলেন।
এদিকে সন্ন্যাসী বাড়ী আসিয়া নীরজাকে না দেখিয়া নদীতীরে খুঁজিতে গেলেন, গানের শব্দ লক্ষ্য করিয়া অট্টালিকাপ্রাচীরতলে আগমন করিলেন, সেই সময় বিদ্যুতালোকে মুক্তবাতায়ন পথে সুশীলার সহিত দেখা হইল। একবার দেখিয়া পরদিন তাঁহাকে দেখিবার ইচ্ছা তাঁহার আরও প্রবল হইল কিন্তু এতদিন পরে এখন আবার কোন্ ছুতায় কি বলিয়া পত্নীকে মুখ দেখাইতে আসিবেন? সেই দিন হইতে তাঁহার আর একটি ইচ্ছার সঞ্চার হইল। নীরজার সহিত প্রমোদের বিবাহ দিয়া সুশীলার পিতৃবংশ ও তাঁহার বংশ আবার এক করিতে তাঁহার অত্যন্ত ইচ্ছা হইল, কিন্তু দেখিলেন সে ইচ্ছাও পূর্ণ হইবে না। যামিনী নীরজাকে রক্ষা করিয়াছে, যামিনীকে তিনি জামাতা করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুত এখন অন্য কোন কথা মনে আনাই অন্যায়। পরদিনই দয়ানন্দ কন্যাকে লইয়া কানপুর যাত্রা করিলেন। দেখিলেন এখানে থাকিয়া সুশীলাকে দেখার ইচ্ছা দমন করা দুঃসাধ্য। কিছু দিন পরে যখন যামিনী কানপুরে গিয়া প্রমোদের সহিত নীরজার বিবাহপ্রস্তাব করিলেন, তখন দয়ানন্দ মহাহ্লাদ সহকারে এ প্রস্তাবে সম্মত হইয়া লজ্জা সঙ্কোচ সমস্ত ত্যাগ করিয়া এই উপলক্ষে সুশীলার সহিত একবার দেখা করিতে আসিলেন। আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহা দেখিবেন জানিলে হয়তো আসিতেন না।