ছিন্নমুকুল/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ছিন্নমুকুল


প্রথম পরিচ্ছেদ

সমর্পণ

 বোম্বাই সহরের পারেল পাহাড়-শিখরস্থ একটি অট্টালিকাকক্ষে চারুশীলা রুগ্নশয্যায় শয়ান; নিকটে ভগিনী সুশীলা আসীন। তখন প্রাতঃকাল; দূরে পাহাড়ের নিম্নদেশে সুনীল সমুদ্র প্রাতঃ-সমীরে সুধীর ভাবে তরঙ্গিত হইতেছিল, এবং বক্ষঃস্থিত নৌকাসমূহকে বিলাস ভাবে মৃদুমন্দ দোলাইয়া, লীলাচ্ছলে বেলাভূমিতে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছিল। সূর্য্য উঠিয়াছে, তাহার সহস্র কিরণমালা বিদ্যুৎ রাশির ন্যায় সেই সমুদ্র-উরসে প্রতিফলিত হইয়া ঝিকমিক করিতেছে। গাছের শিখরে শিখরে, দূরস্থ পর্ব্বতের শিখরে শিখরে, প্রাতঃসূর্য্যের হেমাভ রশ্মি জ্বলিতেছে। তটেই বোম্বাই সহর, পাহাড় হইতে সেই মহানগরীর বিচিত্র রমণীয়তা দ্বিগুণ রমণীয় বলিয়া বোধ হইতেছিল। এখনও সহর সম্পূর্ণ জাগরিত হয় নাই, এখনও বৈষয়িক কোলাহল আরম্ভ হয় নাই, এখনও প্রকৃতির অকৃত্রিম শোভাই চারিদিকে পরিব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছে।

 সুশীলা সাশ্রুলোচনে ভগিনীর সহিত কথা কহিতে কহিতে মাঝে মাঝে মুক্ত বাতায়ন দিয়া এক একবার নিম্নস্থ সহরের প্রতি, এক একবার সেই সূর্য্যরশ্মিশোভিত সমুদ্রের প্রতি চাহিতেছিলেন। সুশীলার বয়ঃক্রম দ্বাবিংশতির অধিক হইবে না। দেখিতে সুশ্রী, চক্ষু নাসিকা ওষ্ঠাধর সকলি সুগঠন, কিন্তু বিধবার বেশ; যুবতী-মুখে প্রৌঢ়ার বিজ্ঞতা ব্যাপ্ত হওয়ায় তাঁহার সৌন্দর্য্যের তেমন আকর্ষণী শক্তি ছিল না। ইহারা দুইজনেই এলাহাবাদের সঙ্গতিপন্ন ব্রাহ্ম স্বর্গীয় তারাকান্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্যা। চারুশীলা বিবাহের পর হইতে স্বামীর সহিত বোম্বাই শহরে ছিলেন; সুশীলার বাল্যকাল হইতেই পিত্রালয়ে বাস। সুশীলা একদিন হঠাৎ শুনিলেন যে, বাণিজ্যে সর্ব্বস্বান্ত হইয়া ভগিনীপতির মৃত্যু হইয়াছে, এবং চারুশীলাও শয্যাগত; শুনিয়া সুশীলা ব্যাকুল হৃদয়ে তাঁহার দূর সম্পর্কীয় দেবর হিরণকুমারকে সঙ্গে লইয়া এখানে আসিয়াছেন।

 কত দিন পরে আজ দুই ভগিনীতে সাক্ষাৎ, সেই চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়ঃক্রমের সময় স্বামীর সহিত চারুশীলা বোম্বাই চলিয়া আসেন, তখন সুশীলা দশম বর্ষীয়া মাত্র; সেই অবধি আর তাঁহাদের দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। তাহার পর এই অল্প দিনের মধ্যে দুজনের জীবনে কত ঘটনা ঘটিয়াছে, কত পরিবর্ত্তন হইয়াছে। সেই বিদায়ের সময় জীবনের কেবল আরম্ভ মাত্র, তখন জীবনে কতই সুখের আশা ছিল, কিন্তু ইহার মধ্যেই সব ফুরাইয়াছে, ইহার মধ্যেই দীপ নির্ব্বাণ হইয়াছে, দুজনেই বিধবা হইয়াছেন। এখন এই অবস্থায় দুজনের দেখা হইয়া তাঁহারা কত কাঁদিতেছিলেন, কাঁদিতে কাঁদিতে দুজনে কতই দুঃখের কথা কহিতেছিলেন, সে সকল এস্থলে বলা বাহুল্য মাত্র। অশ্রু মুছিতে মুছিতে একবার সুশীলা বাটীর সন্নিধানস্থ উদ্যানে দৃষ্টিপাত কারিলেন―দেখিলেন উদ্যানে দুইটি বালক বালিকা খেলিতেছে, কিছু দূরে হিরণকুমার দাঁড়াইয়া তাহাদের খেলা দেখিতেছেন। হিরণকুমার অষ্টাদশবর্ষীয়, তাঁহার বর্ণ উজ্জ্বলশ্যাম, চক্ষু সুদীর্ঘ, দৃষ্টি শাস্ত অথচ জ্যোতির্ম্ময়। যৌবনের প্রাক্কালে যে সকল মনের গুণ স্ফূর্ত্তি পাইয়া মানুষের বাহ্য আকৃতিকেও স্ফূতির্ময় করিয়া তোলে, সেই সকল গুণের প্রাচুর্য্যবশতঃ যেন হিরণকুমারের মুখে এবং সমস্ত শরীরে একটি অলৌকিক তেজের প্রভাব প্রকাশ পাইতেছিল। হিরণকুমার দেখিলেন, বালকটি কখনও উদ্যানে কোদাল লইয়া মাটি কাটিতেছে, কখনও দৌড়িয়া গাছের কোন শুষ্ক শাখা ভাঙ্গিতেছে, কখনও বা কোন জলপাত্র হস্তে লইয়া ফুলগাছের গোড়ায় জল ঢালিতেছে। বালকটি দশমবর্ষীয়, শরীর সুগোল সুঠাম হৃষ্টপুষ্ট, মুখাবয়ব সুন্দর, কৃষ্ণ ভ্রযুগলের নীচে চঞ্চল চক্ষুদ্বয় যেন জ্বলিতেছে, কুঞ্চিত কেশরাশি উন্নত ললাট বেষ্টন করিয়া তাহার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করিতেছে। মুখশ্রী দেখিলে বালকটিকে সরল উদারচেতা, এবং কিছু উদ্ধতস্বভাব বলিয়া বোধ হয়।

 বালিকাটি কিছু কৃশ, ক্ষুদ্র মস্তকে নিবিড় কেশজাল,—তাহা স্কন্ধদেশের নিম্নভাগ পর্য্যন্ত আবরিত করিয়াছে; মধ্যে মধ্যে সেই স্থানচ্যুত ভ্রমরকৃষ্ণ কেশরাশি বৃক্ষে কপোলে পড়িয়া তাহার গোলাপকলিকা সদৃশ মুখখানির মধুরতা বৃদ্ধি করিতেছে। তাহার সেই সুদীর্ঘ কেশর-ঘন চক্ষু দুইটির দৃষ্টি শান্ত ও করুণ; দৃষ্টিতে যেন কেমন সঙ্কুচিত, কেমন শশঙ্কিত ভাব; নেত্রপল্লব যেন কিসের ভারে সর্ব্বদাই ভারাক্রান্ত, তাহাদের যেন সেই দীর্ঘায়তন চক্ষুর সমস্ত আয়তন বিকাশ করিবার সামর্থ্যই নাই। মুখখানি শৈশবের চঞ্চলতাপূর্ণ প্রফুল্লভাবে স্ফূর্ত্তিযুক্ত নহে। তাহা কেমন যেন ঈষৎ বিষণ্নভাবে আবরিত, পূর্ণিমার জ্বলন্ত উজ্জ্বলতার উপর যেন মেঘের ছায়া পড়িয়া সমস্ত মুর্ত্তিতে একটি ভয়ের ভাব, একটি বিষণ্ন ভাব, একটি করুণ ভাব আঁকিয়া দিয়াছে।

 খেলা করিতে করিতে সহসা বালকটি বালিকার নিকটে দৌড়িয়া আসিয়া বলিল “কনক, আয়, আয়, দেখবি কেমন ফুল ফুটেছে?” বালিকা আস্তে আস্তে বলিল “কোথায়?” “ঐ দিকে”—এই কথা বলিয়াই বালক কনকের হস্তাকর্ষণ পূর্ব্বক সেই দিকে তাহাকে লইয়া চলিল। বালিকা দুর্ব্বল, ভ্রাতার সঙ্গে সমান দৌড়িতে পারে না, কষ্টে খানিক দূর আসিয়া, পড়িবার উপক্রম করিল, অমনি বালক “তুই চল্‌তে পারিস নে—তুই থাক্‌” বলিয়া মনের বেগে সেই প্রস্ফুটিত ফুলবৃক্ষের নিকট দৌড়িল, তাহার আর বিলম্ব সহে না। বালকটি চঞ্চল অসংযতচিত্ত, যখনি যা মনে আসে তখনি তাহা না করিয়া থাকিতে পারে না। বালক হইতে বালিকাটি আবার সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন, সে যেন দৌড়িতে জানে না, যেন চলিতে জানে না, একস্থানে দাঁড়াইয়া নিস্তব্ধে, অনিমেষলোচনে, সমুদ্রক্রীড়া দেখিতেই সেই সপ্তমবর্ষীয়া বালিকা নিমগ্ন ছিল। দেখিতে দেখিতে তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়ে কত কি ভাবের উদয় হইতেছিল কে বলিবে। সহসা একটি পুষ্পবৃক্ষস্থিত প্রজাপতির প্রতি তাহার দৃষ্টি পড়িল। সে অতি ধীরে ধীরে, অতি ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ করিয়া যে গাছে প্রজাপতি বসিয়াছিল সেই গাছের নিকট আসিয়া একদৃষ্টে প্রজাপতির দিকে চাহিয়া রহিল, পরে কি ভাবিয়া কে জানে আস্তে আস্তে তাহার ক্ষুদ্র হাতটি তুলিয়া প্রজাপতির গাত্র স্পর্শ করিতে গেল, অমনি প্রজাপতিটা উড়িয়া আর একটি বৃক্ষে গিয়া বসিল। বালিকার মুখকান্তি যেন বিষণ্নতর হইয়া পড়িল, যেন মনে মনে বলিতে লাগিল “প্রজাপতি, তুমি পলাইলে কেন, আমি আদর করিয়া ছুঁইতে গেলাম, তবে পলাইলে কেন?” বালিকা ক্ষুণ্নমনে সেখান হইতে সরিয়া একটি প্রস্ফুটিত গোলাপ ফুলের নিকট গেল; বিষণ্নভাবে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ফুলটি দেখিতে লাগিল। দেখিতেও ভয়, কে যেন এখনি আসিয়া তাহার দেখায় বাধা দিবে, কে যেন তাহার সেই ভালবাসার ফুলটি তাহার দেখা বন্ধ করিবার জন্যই তুলিয়া লইবে। বালিকা ফুলের দিকে চাহিয়া চাহিয়া ধীরে ধীরে সেই ফুলটির বৃন্তে আপনার কুসুম-হস্ত রাখিল, ধীরে ধীরে সেই ফুলটি তুলিয়া হস্তে লইয়া সতৃষ্ণ নয়নে দেখিতে লাগিল। ফুল তুলিবার সময় বালক দেখে নাই; হঠাৎ এদিকে দৃষ্টি পড়ায়, ভগিনীর হস্তে ফুল দেখিতে পাইবামাত্র, সক্রোধে ছুটিয়া আসিয়া ক্রোধকম্পিত স্বরে বলিল “আমার গোলাপ ছিঁড়লি যে?” বালিকা ভয়ে জড়সড় হইয়া কাঁদ কাঁদ ভাবে ভ্রাতার দিকে চাহিয়া রহিল, কি যেন বলিতে গেল কিন্তু পারিল না, কথা আটকিয়া গেল। আবার আরক্ত নয়নে তাহার ভ্রাতা বলিল “তুই যে বড় আমার ফুল ছিঁড়লি।” বালিকা তেমনি করুণ দৃষ্টিতে তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। যেন নীরবে ছল ছল নেত্রে কত ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছে, কিন্তু কোন কথা ফুটিয়া বাহির হইল না। একবার অতি অস্ফুট মৃদুস্বরে, অতি ধীরে ধীরে বলিল, “আর তুলব না”; সে কথা ক্রুদ্ধ বালকের কর্ণে প্রবেশ করিল না। ভগিনীকে মৌন দৃষ্টে বালক উত্তরোত্তর অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া, “কেন ফুল ছিঁড়লি” বলিতে বলিতে সরোষে বালিকাকে মারিতে হস্তোত্তোলন করিল, এমন সময় কে একজন অপরিচিত ব্যক্তি আসিয়া তাহার হাত চাপিয়া ধরিল। সেই অপরিচিত ব্যক্তিটি হিরণকুমার। তিনি এতক্ষণ দাঁড়াইয়া তাহাদের খেলা দেখিতেছিলেন। বালকটি বালিকাকে মারিতে উদ্যত দেখিয়া তিনি আর নিরপেক্ষ থাকিতে পারিলেন না। তিনি ছুটিয়া আসিয়া বালকের হাত চাপিয়া ধরিলেন। বালক তাঁহার ব্যবহারে অত্যন্ত আশ্চর্য্য, অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল; সে কখনো কিছুতে বাধা পায় নাই, যখনি যাহা মনে করিয়াছে তখনি তাহা করিয়াছে, সহসা আজ বাধা পাইয়া নিতান্ত অপমানিত বোধে সরোষে হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু চেষ্টা নিষ্ফল হওয়ায় মনে মনে গর্জ্জিতে লাগিল। বালক্ একদিকে সরল ও উদার, অন্যদিকে গর্ব্বিত ও উদ্ধত— কাহারো প্রভুত্ব সহ্য করিতে পারে না, কিছুতে বাধা প্রাপ্ত হইলে অত্যন্ত ভয়ানক হইয়া উঠে। সে মিষ্ট কথার দাস কিন্তু বল-পূর্ব্বক কেহ তাহাকে কিছুই করাইতে পারে না, অতি অল্পেতেই সে ক্রুদ্ধ হয়, আবার অল্পেতেই তাহার ক্রোধ নিবিয়া যায়। ছেলেবেলা হইতে বালক বাপ মায়ের অতিশয় আদুরে, তাঁহাদের নিকট হইতে কখনো কোন বিষয়ে প্রায় ধমক্ খায় নাই, যখনি তাহার সহিত তাহার ভগিনীর বিবাদ হইয়াছে, সে পিতামাতার কাছ হইতে স্বপক্ষেই সমর্থন পাইয়া আসিয়াছে, এই কারণে তাহার স্বভাব অন্যের সুখ দুঃখের প্রতি কতকটা উদাসীন ও আত্মম্ভরি হইয়া পড়িয়াছে। তাহা না হইলে—তাহার পিতামাতা যত্ন করিয়া শিক্ষা দিতে জানিলে এই উদার বালকটির স্বভাব অতি উৎকৃষ্ট হইতে পারিত। তাহার অদৃষ্টে যাহা কখনও হয় নাই তাহা আজ হওয়াতে সে অপ্রকৃতিস্থ হইয়া পড়িল। এই অপমান তাহার যেন শিরায় শিরায় বিঁধিতে লাগিল। বালক যখন দেখিল হাত ছাড়াইতে একান্ত অক্ষম, তখন সে আর কিছু না করিয়া, মৌনভাবে আরক্ত লোচনে হিরণের দিকে চাহিয়া রহিল। পাছে হাত ছাড়িলে বালক আবার বালিকাকে মারে, সেই ভয়ে হিরণ হাত না ছাড়িয়া আস্তে আস্তে বলিলেন “আর বোন্‌টিকে মারবে না বল!” বালক এই কথায় কেবল ক্রোধকম্পিত স্বরে বলিল “মারবো।”

 হিরণ। তবে তোমার হাত ছাড়ব না।”

 বালক। “হাত ছেড়ে দেও, তুমি হাত ধরবার কে?” হিরণ আবার বলিলেন “বল মারবে না, তা হলে এখনি ছেড়ে দেব।” বালক আর একবার হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিল কিন্তু পূর্ব্বের ন্যায় নিষ্ফল হইয়া বলিয়া উঠিল “আমার বোন্, আমি মারব— তুমি বলবার কে?” তাহাকে এইরূপ ক্রোধান্ধ দেখিয়া, হিরণকুমার মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। বালক তাহাতে আরও যেন অপমানিত বোধ করিয়া নীরবে ফুলিতে লাগিল। বালিকা এতক্ষণ ভয়ে এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল, এখন আস্তে আস্তে কাছে আসিয়া হিরণকে বলিল “দাদার হাত ছেড়ে দাও”—হিরণ হাত ছাড়িয়া দিলেন। বালক তঅখন গম্ভীর ভাবে আরক্ত অথচ অশ্রুময় লোচনে নিস্তব্ধে বাগান হইতে প্রস্থান করিল। অন্য সময় হইলে সে হয় তো মাতার নিকট আসিয়া কত অভিযোগ করিত—কিন্তু আজ তাহা করিল না, একাকী আজ শয়নগৃহে আসিয়া অনেকক্ষণ শুইয়া রহিল। হিরণ বালিকার হাত ধরিয়া গৃহাভিমুখী হইলেন। গৃহে আসিতে আসিতে বালিকা বলিল “কেন তুমি দাদার হাত ধরলে?”

 ইহার অনেকক্ষণ পরে বালক বালিকা দুইটি, রুগ্নকক্ষে মাতার নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। বালকটি অন্য দিনের ন্যায় তত প্রফুল্ল নহে—যেন কিছু ম্রিয়মাণ, তাহা দেখিয়া পীড়িতা মাতা ব্যাকুল ভাবে তাহাকে কাছে ডাকিলেন। কাছে বসিলে চারুশীলা তাঁহার দুর্ব্বল রুগ্নহস্তে ধীরে ধীরে পুত্রের মস্তকে হাত বুলাইয়া দিতে দিতে বলিলেন, “কেন রে প্রমোদ, আজ তোর মুখখানি শুক্‌নো দেখছি কেন।” বালক কথা কহিল না। ততক্ষণ বালিকা কনকলতা ভয়ে ভয়ে গৃহের একটি পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহাকে তাহার মাতা কিছুই বলিলেন না—একবার তার দিকে চাহিয়াও দেখিলেন না। মাতার পক্ষপাতিতা দেখিয়া সুশীলা তাহাকে ডাকিয়া কোলে বসাইয়া চারুশীলাকে বলিলেন “দিদি, এটি বুঝি তোমার ফেল্‌না মেয়ে?” চারুশীলার সেই রুগ্ন ওষ্ঠে দিবাভাগের বিদ্যুতের ন্যায় একটু হাসির রেখা পড়িল। ক্রমে দিন যাইতে লাগিল; কত চিকিৎসক আসিয়া দেখিল, কিছুতেই চারুশীলা আরোগ্য লাভ করিতে পারিলেন না। দুই সপ্তাহ কাল কষ্টে জীবন ধারণ করিয়া ভগিনীর হস্তে সন্তানগুলি সমর্পণ পূর্ব্বক তিনি প্রাণত্যাগ করিলেন। সুশীলা শোকসন্তপ্ত চিত্তে তাহাদিগকে লইয়া এলাহাবাদে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন।