ছিন্নমুকুল/বিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

বিংশ পরিচ্ছেদ

গুপ্ত শত্রু

 সেই দিন সন্ধ্যাকালে প্রমোদ পদব্রজে যামিনীনাথের বাটী-অভিমুখে আসিতেছিলেন। ক্রমে চৌরঙ্গির দীপমালাশোভিত পথ ছাড়িয়া ভবানীপুরে পদার্পণ করিলেন;[১] গির্জ্জার ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া আটটারও ঘণ্টা পড়িল।

 রজনী দীপমালায় উজ্জ্বলিত নহে, রাজপথ অধিকাংশই গলি ঘুঁজি, গলির সুদূর মোড়ে মোড়ে এক একটি অনুজ্জ্বল তৈলদীপ গলিপথে বৃহৎ ছায়া বিস্তার করিয়া মিটি মিটি জ্বলিতেছে। পথিপার্শ্বের বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকাবলী, এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটীরশ্রেণী সমভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন; কেবল আকাশে কৃষ্ণবর্ণ মেঘে নক্ষত্র হাসিতেছে, নীচে যত্রতত্র দুই একটি খদ্যোৎ জ্বলিতেছে, এবং অট্টালিকা-শ্রেণীর মুক্ত বাতায়ন-পথে এবং কুটীর দ্বার দিয়া গৃহমধ্যস্থ আলোকরেখা দৃষ্ট হইতেছে। সেই অন্ধকার পথে কখনও দুই একটি গ্রাম্য কুকুর চীৎকার করিয়া প্রমোদের পথপার্শ্ব দিয়া দৌড়িয়া যাইতেছিল, কখনও বা মাথার উপর দিয়া কোন নিশাচর পক্ষী কর্কশ রবে ক্ষণকালের জন্য চিন্তামগ্ন প্রমোদের চিন্তা ভঙ্গ করিয়া উড়িয়া চলিয়াছিল। পথে মাঝে মাঝে দুই একটি লোক চলিতেছিল, অন্ধকারে তাহাদিগকে স্পষ্ট চেনা যায় না, প্রমোদও চিনিতে বড় একটা উৎসুক ছিলেন না। তিনি সেই অন্ধকারময়ী স্নিগ্ধ রজনীতে কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া আপন মনেই চলিতেছিলেন। সহসা তাঁহার চিন্তা ভঙ্গ হইল, পিস্তলের শব্দে চমকিত হইয়া তিনি ফিরিয়া দাঁড়াইলেন, অমনি দুইজন মনুষ্য তাঁহার পশ্চাৎ হইতে দৌড়িয়া চলিয়া গেল। তাহাতে তাঁহার স্পষ্ট মনে হইল, যে পলাতকেরা তাঁহারই প্রতি যেন পিস্তল লক্ষ্য করিয়াছিল। তাহারা কোথায় গেল অন্ধকারে ঠিক বুঝা গেল না, কিন্তু বোধ হইল, একটা অট্টালিকাপ্রাচীরে তাহারা যেন মিশিয়া গেল। তিনি “চৌকিদার, চৌকিদার” করিয়া হাঁকিয়া উঠিলেন।

 চৌকিদার তখন মােড়ের মাথায় একটা রেল ঠেসান দিয়া সার্জ্জন সাহেবের উগ্রমূর্ত্তি স্বপ্নে দেখিতেছিলেন; প্রমােদ আসিয়া তাহাকে ধাক্কা মারাতে সে ত্রস্তে উঠিয়াই দীর্ঘ সেলাম ঠুকিয়া চক্ষু রগড়াইতে রগড়াইতে বীর-বিক্রমে লাঠি বাগাইয়া ধরিল। প্রমােদ বলিলেন “দেখতা নেই কোন্ হাম কো মার্‌নেকো ওয়াস্তে পিস্তল চালায়, অওর তোম হিঁয়া নিদ্ যাতা!”

 চৌকিদার তখন সদর্পে বলিল “নেই বাবু সাব, ও কোই লেড়কা পট্‌কা চালাতা, কুচ ডর নেই।”

 প্র। নেই, নেই, ও পিস্তলকা আওয়াজ হম শুনা,—আবি জলদি হামারা সাথ আও, পিস্তলওয়ালা ভাগকে ও বড়া কোঠিকা অন্দর ঘুস গিয়া হােগা, জলদি হামারা সাথ আও।

 চৌ। চলিয়ে সাব, লেকেন ও কোঠিকা ভিতর এক,—আল্লা! আল্লা!—আপতো চলিয়ে।

 “জলদি হামারা সাথ আও”—বলিয়া প্রমােদ ঊর্দ্ধ-মুখে ছুটিলেন, চৌকিদারও চলিল, কিন্তু “কোন হ্যায় রে, কোন হ্যায় রে,” করিতে করিতে দিঙ্মণ্ডল ফাটাইয়া দিয়া মৃদুপদে প্রমােদের পশ্চাৎবর্ত্তী হইল।

 যে প্রাচীরের কাছে পলাতকেরা মিশাইয়া গিয়াছিল, প্রমোেদ সেই স্থানে দৌড়িয়া আসিয়া দেখিলেন সে স্থানটি অট্টালিকার পশ্চাদ্‌ভাগ। সেখানে আসিয়া প্রমােদ কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না, কিন্তু তখনই আবার পিস্তলের শব্দ হইল, তখনই কিছু দূরে আবার দুই ব্যক্তিকে ছুটিয়া পলাইতে দেখিলেন। পিস্তলের গুলি ভাগ্যবশতঃ তাঁহার অর্দ্ধহস্ত পশ্চাৎ দিয়া গিয়া সজোরে সেই প্রাচীরগাত্রে লাগিল। পিস্তল যে তাঁহার উদ্দেশ্যেই ছােঁড়া হইতেছে, এখন আর তাহাতে বিন্দু মাত্রও সন্দেহ রহিল না। প্রমোদ আশ্চর্য্য ও স্তম্ভিত ভাবে মুহুর্ততকাল দাঁড়াইয়া আবার তাহাদের অনুসরণে চলিলেন। ইতস্ততঃ চাহিয়া কিছুই দেখিতে পাইলেন না, আবার সেই অট্টালিকার পশ্চাদ্‌ভাগে আসিয়া অন্বেষণ করিলেন, এবারেও সেখানে কাহাকেও না পাইয়া তিনি ঘুরিয়া অট্টালিকার সদর-দ্বারে আসিলেন। সেখানে আসিয়া দেখিলেন, ভিতরে আলোক জ্বলিতেছে, কিন্তু দ্বার বন্ধ। তাহার ঠেলাঠেলিতে একজন উড়িষ্যাবাসী দ্বার খুলিয়া বলিল, “বাবু কেরেয়া লইব, ৫০ মুদ্রা।” প্রমোেদ উক্ত ছুতায় বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিলেন, ভৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বাড়ীময় ঘুরিয়া বেড়াইয়া অবশেষে কাহাকেও না দেখিয়া “কোঠি কুচ কামকা নেহি,” এই বাক্যে তাহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়া গৃহ নিষ্ক্রান্ত হইলেন। চলিতে চলিতে পথে কিছু দূরে আসিয়া দেখিলেন একব্যক্তি পিস্তল হস্তে ত্রস্তে একটা গলির মধ্যে ঢুকিল। যাইবার সময় দীপালোক মুখে পড়ায় প্রমোদ হিরণকুমারকে চিনিতে পারিলেন। চিনিয়া চমকিয়া উঠিলেন! একি! হিরণ পিস্তল হস্তে এমন অপ্রকৃতিস্থ ব্যস্তভাবে দ্রুতপদে গলির মধ্যে লুকাইল! হিরণ কি প্রমোদকে মারিতে চেষ্টা করিয়াছিল? অবস্থার ইন্দ্রজালে চকিতের মত প্রমোদের মনে এই সন্দেহ প্রবেশ করিল, কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তার অবসর পাইয়া তিনি ভাবিলেন—“কিন্তু তাহা কি করিয়া হইবে? হিরণ আমাকে মারিতে যাইবে কেন? আমি তাহার কি শত্রুতা করিয়াছি? আমাকে মারিয়া তাহার কি লাভ? আমি জানি হিরণ আমাকে দেখিতে পারে না,— আমি জানি সেই জন্যই আমাকে মকদ্দমায় অন্যায় দণ্ড দিয়াছে কিন্তু তাই বলিয়া সে যে আমার প্রাণবধ করিতে যাইবে ইহা অসম্ভব। আমিও ত তাহাকে দেখিতে পারি না, দেখিলেই সর্ব্বাঙ্গ জ্বলিয়া যায়, কিন্তু সে জন্য প্রাণবধ ইচ্ছা ত দূরের কথা—তাহার কোন অনিষ্ট চিন্তাও কি আমার মনে আসে? না না—ইহা হইতেই পারে না, এরূপ অন্যায় সন্দেহকে মুহূর্ত্তের জন্যও হৃদয়ে পোষণ করা উচিত নহে। তাহার পিস্তল হস্তে থাকিবার সহস্র কারণ থাকিতে পারে। এমনও হইতে পারে যে, যে ব্যক্তি পিস্তল ছুঁড়িয়াছিল তাহারই হাত হইতে হিরণ পিস্তল কাড়িয়া লইয়াছে। কিন্তু তাহা কি সম্ভব? এত শীঘ্র কাড়িবার সময় কোথা? যখনই আমার প্রতি পিস্তল ছুঁড়িতে দেখিলাম তখনি প্রায় হিরণ খুনীর মত ব্যস্তত্রস্তভাবে গলিতে লুকাইল। অবস্থাটা খুবই সন্দেহ জনক।”

 এইখানে প্রমোদ ভুল করিলেন; মধ্যের অপেক্ষাকৃত মন্দ গতি সময়কে তাঁহার মনের দ্রুতগতির সহিত মিশাইয়া ফেলিলেন।

 ভাবিতে ভাবিতে প্রমোদ যামিনীনাথের বাড়ীর দিকে চলিলেন। “তিনি কখন কাহার কি এমন অনিষ্ট করিয়াছেন যে সে তাঁহার বধ সংকল্প করিবে, তাঁহার এমন কে গুপ্ত শত্রু আছে যে এই উদ্দেশ্যে এই রাত্রে তাঁহার অনুসরণ করিতেছিল! একজন ছোটলোক হইলে বুঝিতেন,ঘড়িচেন লইবার জন্য তাঁহাকে মারিতে গিয়াছিল কিন্তু হিরণের সে উদ্দেশ্য হইতে পাবে না, অন্য উদ্দেশ্য কল্পনা করাও অসম্ভব। তবে কেন সে তাঁহাকে মারিতে যাইবে।” এইরূপ বিস্ময়আলোড়িত সন্দিগ্ধ চিত্তে তিনি যামিনীর বাটীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। তাঁহাকে দেখিবামাত্র ব্যগ্র ভাবে যামিনী জিজ্ঞাসা করিলেন—

 “একি, তুমি এখন! এত রাত্রে!” তখন প্রমোদ পথের সমস্ত বিবরণ বলিলেন। যামিনী শুনিয়া কহিলেন “কি ভয়ানক!”

 হঠাৎ যামিনীর মনে আর একটি অভিপ্রায় সিদ্ধ করিবার ভাব উদয় হইল, তিনি এই সময় এক বাণে দুইটি পাখী মারিতে সংঙ্কল্প করিলেন। পূর্ব্ব-পরিচ্ছদের ঘটনা হইতে যামিনী হিরণের প্রতি অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন, হিরণই সন্ন্যাসীর নিকট তাঁহাকে দোষী বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন, হিরণই যামিনীর সহিত নীরজার বিবাহে বাধা দিয়া প্রমোদের পক্ষ লইয়াছিলেন। যামিনী প্রতিশোধ লইবার উত্তম সুযোগ বুঝিয়া প্রমোদের কথায় লাফাইয়া উঠিয়া বিস্ফারিত নেত্রে বলিয়া উঠিলেন—

 “হিরণকে তুমি পিস্তল হাতে গলিতে ঢুকতে দেখলে—বটে! এখন আসল ব্যাপারটা আমার চক্ষের সামনে খুলে গেল, আমি সব বুঝতে পারছি।”

 প্রমোদ সবিস্ময়ে বলিলেন—

 “কি? তোমার কথাতো আমি কিছুই বুঝতে পারচিনে, তোমার ও কি আমার মত হঠাৎ সন্দেহ হচ্ছে নাকি?”

 যা। সন্দেহ নয় ঠিকই, আর কোন ভূল নেই; সেই পাষণ্ডেরই এই কাজ।

 প্রমোদ আবার বলিলেন “কি কাজ? আমাকে মারতে যাওয়া? কিন্তু—যার কারণ নেই—”

 যা। কারণ নেই? এই জঘন্য ঘাতকের কাজ তারি।

 প্রমোদ তখন শিহরিয়া বলিলেন “হিরণকে আমি যতই ঘৃণা করি না কেন, তাকে এরূপ কার্য্যে পারগ মনে করতে পারি নে, বিশেষতঃ তাতে তার লাভ কি? হঠাৎ তাকে দোষী মনে হয় বটে, কিন্তু সে সুধু ক্ষণিকের সন্দেহ মাত্র। অসম্ভব, এক জন ভদ্র লোকের পক্ষে এ কাজ অসম্ভব, বিশেষতঃ অকারণে।”

 যা। তুমি জাননা তাই এ কথা বলছ। তুমি জান, হিরণ সন্ন্যাসীর সম্পর্কীয় ব্যক্তি?

 প্র। না।

 বা। নীরজাকে নিয়ে যাবার সময় সন্ন্যাসী হিরণকে সঙ্গে আনেন, সেই সময় কথায় কথায় দেখলেম হিরণ তোমাকেদূর কত ঘৃণা করে।”

প্রমোদ একটি ছোট খাট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন “সন্ন্যাসী তবে নীরজাকে নিয়ে গেছেন?”

 যা। হ্যাঁ। আমি এইমাত্র তাঁদের গাড়ীতে চড়িয়ে আসছি।

 প্র। তার পর?

 যা। হিরণের সাক্ষাতে সন্ন্যাসী তোমার প্রশংসা করছিলেন—তোমাকে জামাতা করবেন এইরূপ অভিপ্রায় জানাচ্ছিলেন—তাতে অবশ্য আমি বল্লেম—‘হ্যাঁ, প্রমোদ সর্ব্ব প্রকারেই নীরজার উপযুক্ত।’ এই কথায় হিরণ ভয়ানক চটে উঠে তোমার চরিত্রের উপর কত কি যে অপবাদ দিতে লাগল সে আর কি বলব। আমিও তাতে রেগে গেলুম—আমাদের দুজনের হাতাহাতি হবার উপক্রম, শেষে গোলযোগ দেখে হিরণ চলে গেল। তখন এর মানে মোদ্দা বুঝতে পারিনি, তার পর সন্ন্যাসীর মুখে শুনলেম হিরণ নীরজাকে বিবাহ করতে চায়। তুমি কি বুঝছ না, কণ্টক বিবেচনায় তোমাকে সে পথ থেকে সরাতে যাচ্ছিল?

 প্রমোদ শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। এখন কারণ পাইয়া তাঁহারও হিরণকে দোষী বলিয়া মনে হইল। অকারণে অন্য কেহ তাঁহার প্রাণবধের চেষ্টা করিবে তাহা আর মনে করিতে পারিলেন না। তিনি হিরণকে সম্পূর্ণ দোষী ভাবিয়া বলিলেন “Scoundrel! তার তো আমি কোন অনিষ্টই করি নি; কিন্তু সে ছোট বেলা থেকে আমার শত্রুতায় ব্রতী হয়েছে।”

 যামিনী বলিলেন—

 “আমার তো রাগে শরীর কাঁপছে, কি করে পাষণ্ডকে শাস্তি দেওয়া যায়? খুনের দাবিতে তার নামে নালিশ কর।”

 এই কথায় প্রমোদ ঘৃণার হাসি হাসিয়া বলিলেন “এ কথা নিয়ে নালিশ করতে গেলে আমার নিজেকেই ছোট করা হবে, তা আমি করর না।”

 যামিনী অনেক বলিয়া কহিয়াও ইহাতে তাহাকে রাজি করাইতে পারিলেন না, যামিনীনাথের বিশেষ পীড়াপীড়িতে শেষে প্রমোদ বলিলেন—

 “হিরণের বিরুদ্ধে তো তেমন প্রমাণ কিছুই নেই, কি বলেই বা নালিশ করব? তার হাতে পিস্তল দেখেছি এই যা বলবার কথা, তা তো সে অস্বীকার করতে পারে।”

 যা। প্রমাণ বিশেষ না থাকলে শাস্তি না হতে পারে, কিন্তু খুনের দাবীতে তাকে কোর্টে যেতে হলেই বিলক্ষণ অপমান।”

 প্রমোদ বলিলেন “না তাতে আর কাজ নেই। তাতে তারও অপমান আমারো। বিশেষ আমি যদি হেরে যাই তাহলে মহা লজ্জার কথা। হিরণকে চিনে রইলুম এই যথেষ্ট।”

 কোনমতে না পারিয়া অগত্যা যামিনী সে চেষ্টা হইতে ক্ষান্ত হইলেন। তখন ক্রমে অন্যান্য কথা আসিয়া পড়িল। প্রমোদের মনের ইচ্ছা নীরজার কথা পাড়েন, কিন্তু সে কথা কহিতে গেলেই আপনা হইতে যেন মুখ বন্ধ হইয়া যায়, লজ্জা সঙ্কোচ আদি কত কি ভাব আসিয়া তাঁহার ইচ্ছার উপর আধিপত্য করে। নীরজার সহিত দেখা করিবার অভিপ্রায়ে ইতিমধ্যে তিনি আর একদিন সন্ধ্যাকালে এখানে আসিয়াছিলেন কিন্তু যামিনী গৃহে না থাকায় তাঁহাকে হতাশ হইয়া ফিরিয়া যাইতে হয়। সে কথাও প্রমোদ যামিনীর নিকট তুলিতে পারিলেন না। আসল কথা তাহার অন্তরাত্মা তাঁহার মনের নিভৃত বিজনে গোপনে বলিতেছিল—“যামিনী নীরজাকে উদ্ধার করিয়াছে—নীরজা যামিনীরই প্রাপ্য—তাহাতে তোমার কোন অধিকারই নাই, তাহাকে যদি ভালবাস ত মনে মনে নীরবে ভালবাস—সে কথা প্রকাশ করিও না।” কিছুক্ষণ পরে প্রমোদ কহিলেন—

 “সন্ন্যাসীর যে আমাদের উপরে আর সন্দেহ নেই তাতে আমার মনের একটা মস্ত বোঝা নেমে গেছে।”

 যামিনী তাঁহাকে যে সংবাদ দিবার অবসর খুঁজিতেছিলেন এই কথায় তাহার সুযোগ বুঝিয়া বলিলেন—

 “হাঁ, ভাই তোমাকে এতক্ষণ একটা কথা বলা হয় নি। সন্ন্যাসী আমার প্রত্যুপকার স্বরূপ নীরজাকে সমর্পণ করছেন। আমি তাঁকে যদিও বল্লেম, নীরজার আমি যোগ্যপাত্র নই, প্রমোদই তার যোগ্যপাত্র তিনি আমাকেই জামাতা করবেন স্থির করেছেন।”

 শুনিয়া প্রমোদের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল, কথাটি তীক্ষ্ণ শেলস্বরূপ তাঁহাকে বিদ্ধ করিল। কিন্তু তিনি আপনাকে সামলাইয়া লইতে চেষ্টা করিলেন, ভাবিলেন যামিনী নীরজার স্বামী হইবে ইহাতো সৌভাগ্যের কথা, প্রমোদ যদি নীরজাকে যথার্থ ভাল বাসেন, ইহাতে তাঁহার আনন্দ হওয়াই উচিত। এইরূপে মনকে যুক্তি দ্বারা বুঝাইতে চেষ্টা করিয়া মনে মনে স্থির করিলেন, যতই কষ্ট হউক, ভবিষ্যতে তিনি আপনার স্বার্থময় ইচ্ছা ত্যাগ করিয়া নীরজার সুখেই সুখী হইতে চেষ্টা করিবেন। কিন্তু বুদ্ধি এবং আকাঙ্ক্ষা দুইটি স্বতন্ত্র বস্তু, প্রায় স্থলেই ইহাদের বিরোধ ঘটে,—এবং উভয়ের তাড়নায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হইয়া উঠে। ঐ কথা শুনিবার পর হইতে প্রমোদ কেমন নিস্তব্ধ হইয়া পড়িলেন, কেমন অন্যমনষ্ক, কেমন নির্জীবভাবাপন্ন হইয়া পড়িলেন; সহস্র চেষ্টা করিয়াও আর আগের মত কথা কহিতে সক্ষম হইলেন না। এক দিকে মনকে বুঝাইবার ইচ্ছা, অপর দিকে হৃদয়ের সহস্র উচ্ছ্বাসের তরঙ্গ বহিতে লাগিল। প্রমোদের চক্ষে গভীর চিন্তার ভাব, অথচ অধরে কষ্টনিঃসৃত শুষ্ক হাসির নিরুজ্জল আভাস। যদিও তিনি হৃদয়ের ভাব ঢাকিতে বলপূর্ব্বক হাসিতেছেন, কিন্তু, অনিচ্ছার সেই মৌখিক হাসিতে তাঁহার বিষাদভাব দ্বিগুণ প্রকাশিত হইতেছিল। অনেক চেষ্টাতেও কোন মতেই তাঁহার সে মৌন ভাব ঘুচিল না, তখন তিনি আর বেশী ক্ষণ সেখানে না থাকিয়া বাটী যাইবার জন্য বিদায় গ্রহণ করিলেন।

 বাহিরে আসিয়া প্রমোদ চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাঁহার চক্ষে পৃথিবী আকাশ সকলই শূন্য বোধ হইতে লাগিল। পৃথিবীতে লোক নাই, বৃক্ষ নাই, আলো নাই, আকাশে যেন চাঁদ নাই, তারা নাই, মেঘ নাই—স্বর্গমর্ত্ত্য সকলই যেন শূন্যময় অন্ধকার। প্রমোদ এবার বহির্জ্জগৎ হইতে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ খুঁজিয়া দেখিলেন, দেখিলেন হৃদয়ের মধ্যেও সেই শূন্যময় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নাই।

 ইহারই তিন চার দিন পরে কনকের এক পত্রে প্রমোদ অবগত হইলেন সুশীলা সাংঘাতিক পীড়ায় আক্রান্ত। শুনিয়া প্রমোদ সেই রাত্রেই রেলগাড়ীতে এলাহাবাদ যাত্রা করিলেন। গাড়ীতে যামিনীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার কাছে শুনিলেন সন্ন্যাসী যামিনীকে কানপুরে ডাকিয়া পাঠাইয়াছেন। তিনি যামিনীকে দুই এক দিনের জন্য এলাহাবাদে থাকিয়া যাইতে অনুরোধ করিলেন। নীরজাকে নিশ্চয় লাভ করিবেন জানিয়া এখন যামিনীরও আর সে বিষয়ে তত ব্যগ্রতা ছিল না। তিনি প্রমোদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন।


  1. ছিন্নমুকুল ৩০ বৎসরও পূর্ব্বেকার লেখা। তখন ভবানীপুর এখনকার মত সুবিস্তৃত রাজপথসমুহে বা এমন দীপস্তম্ভাবলীতে সুশোভিত ছিল না।