ছিন্নমুকুল/ষট‍্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

ষট্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

পরিত্যক্তা

 প্রমোদ আর কনককে ডাকেন না,—তাহার কাছে আসেন না, সে নিকটে আসিলে কথা পর্য্যন্ত কহেন না। স্বামী কনকের প্রতি অসন্তুষ্ট, নীরজাও আর তাহার দিকে ফিরিয়া চাহে না। অমন ভগিনীগতপ্রাণ, দেবদুর্ল্লভ ভ্রাতার যে অবাধ্য, এমন ভ্রাতার শত্রুকে যে মিত্র করিতে চায় তাহার সহিত আবার ভাব রাখিতে আছে! তাই নীরজাও আর কনকের কাছে বসে না, তাহার সহিত কথা কহে না, দেখা হইলে মুখ ভার করিয়া চলিয়া যায়, কনক কথা কহিতে গেলে মুখ ফিরাইয়া অর্দ্ধ উত্তর দিয়া কাজের ভান করিয়া সরিয়া পড়ে। এত বড় বাড়ীটা কনকের পক্ষে যেন শ্মশানপুরী। এখানে আপনার বলিয়া দুট স্নেহের কথা বলিতেও তাহার কেহ নাই। এমন কি দাসদাসীরাও তাহার পক্ষ লইয়া একটা কথা কহিতে সাহস করে না। বামা তাহার সেই যে দরদের দাসীটি, অল্প দিন হইল তাহারও মৃত্যু হইয়াছে। কনক এই অন্ধকার রাজ্যে এখন নিতান্ত অসহায় নিতান্ত একাকী।

 একদিন নীরজার মুখ খানি শুষ্ক বিষণ্ন দেখিয়া কনক সাহসে ভর করিয়া বলিল, “নীরজা, কেন ভাই, তোর মুখখানি অত শুকনো? কিছু অসুখ ক’রেছে?”

 নী। কি আর অসুখ করবে?

 ক। তবে তোমার মুখ অত শুকনো দেখাচ্ছে কেন?

 নী। আমার ঐ রকমই মুখ।

 ক। আমি কি ভাই, তোমার মুখ আর কখন দেখি নি?

 নী। আমার মুখ আর তুমি দেখবে কেন? তোমার দাদার মুখই বা তুমি দেখবে কেন? তোমার হিরণের মুখ দেখগে।

 কনক কষ্টে লজ্জায় অপমানে নিরুত্তর হইয়া রহিল।

 সেদিন দ্বিপ্রহরে আহারান্তে প্রমোদ শয়নকক্ষে বিশ্রাম করিতে আসিয়া নীরজাকে জিজ্ঞাসা করিলেন “নীরজা তোমার ভাই কি হয়েছে? কেন অত বিষণ্ন কমলিনি আমার?”

 নীরজা বলিল, “তাও কি বুঝতে পার না সোণার চাঁদ? তোমাকে অসুখী দেখলে আমার মনে কি সুখ থাকতে পারে? সকালে তুমি অমন ভাবে চলে গেলে সেই থেকে—

 “আমি বিষণ্ন হলেই তুই বিষণ্ন হবি? তোকে বিষণ্ন দেখলে যে আমার বুক ফেটে যায় সোণার কমল—"

 “আর তোমাকে বিষণ্ণ দেখলে যে আমি মরে যাই সোণার মাণিক।”

 ইহার অব্যম্ভাবী পরিমাণে উভয়ের প্রেমময় বাহুবন্ধনে ও অধরমিলনে তাঁহাদের অসুখঅশান্তি অচিরাৎ অতলসুখমগ্ন হইল। প্রমোদ বলিলেন—“এখানে থাকলে দেখছি আমাদের কারোই মনভাল থাকবে না, বাড়ীর বাতাসটা কিরকম যেন অসুখ অশান্তিতে ভ’রে উঠেছে। চল দিন কতকের জন্য বোটে ক'রে বেড়িয়ে আসা যাক্‌।”

শুনিয়া নীরজার আহ্লাদ ধরিল না। সেই প্রস্তাব করিল “তবে কানপুরে চল। অনেকদিন বাবাকে দেখিনি, মনটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে, আর—আমাদের বনটিকে, কুটিরটিকেও চল একবার দেখে আসি।” প্রমোদ আর একবার পূর্ব্বাভিনয় করিয়া সহাস্যে বলিলেন, “আমিও তাই মনে করেছি। কিন্তু বনের পাখীটি বন দেখে যেন শিকল কাটে না।”

 ক্রমে দু-এক দিনের মধ্যেই তাঁহাদের বেড়াইতে যাইবার সমস্ত উদ্যোগ হইয়া গেল।

 সকলই প্রস্তুত। দ্রব্য সামগ্রী যা কিছু বোটে উঠিতে বাকী ছিল সকলি উঠিল। দাসদাসীর কোলাহল আরম্ভ হইল। কনককে একাকী ফেলিয়া আজ তাঁহারা বোটে যাইবেন। অন্য সময় হইলে তিন জনেই যাইতেন; কিন্তু এখন কনক তাঁহাদের চক্ষের শূল, তাহাকে একাকী কষ্ট ভোগ করিবার জন্য রাখিয়া, তাঁহারা দুই জনেই বেড়াইতে চলিলেন।

 কনক সেই সকাল হইতে একাকী বারান্দায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া বোটে জিনিসপত্র উঠান দেখিতেছিল এবং কাঁদিতেছিল। যে ভ্রাতার জন্য আপনার জন্মেব সুখ বিসর্জ্জন দিল, প্রাণ হইতে প্রিয়তম, আপনার হইতেও আপনার হৃদয়সর্ব্বস্ব হিরণকে পর্য্যন্ত আজীবন কষ্টে ফেলিল, যে ভ্রাতার কষ্ট হইবে বলিয়া সে হিরণকে বিবাহ করিতেও অসম্মত হইল, সেই ভ্রাতার আচরণে কাঁদিবে না?

 নীরজা আজ আহ্লাদে পরিপূর্ণ। প্রথমতঃ কানপুরে বেড়াইতে যাইতেছে, আবার পিতাকে দেখিবে,— তাহার বাল্যসখীদের দেখিবে, সেই আজন্মপরিচিত অরণ্যভূমি—যেখানে প্রমোদকে প্রথমে দেখিয়াছিল সেইখানে আবার একত্রে দুজনে বেড়াইতে পারিবে,—এই সকল সুখের কল্পনা,—ইহার উপর আবার একটা গর্ব্বময় উচ্ছাস যে, তাহার সুখের জন্যই এ সকল আয়োজন!—নীরজার আহ্লাদ দেখে কে? তাহার ঈষৎ দর্পপূর্ণ পদনিক্ষেপ, তাহার ওষ্ঠাধরের বিকশিতভাব, তাহার চক্ষুর কটাক্ষ-আস্ফালন, সকলই তাহার উল্লাসভাবের সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে।

 বেলা দ্বিপ্রহরে নীরজা বোটে উঠিতে যাইবার সময় সিঁড়িতে নামিতে নামিতে হস্তের পানের ডিবা দাসীকে দিয়া বলিল,

 “যাদি, কনক, কি করছেরে?”

 বোধ হয় কনককে একাকী রাখিয়া যাইতে নীরজার এক একবার মন কেমন করিতেছিল। নীরজা হৃদয়ের অন্তরতল পর্য্যন্ত খুঁজিয়া দেখিলে হয়তো দেখিতে পাইত যে, সে এখনও কনককে একটু একটু ভালবাসে, নহিলে তাহার জন্য অতটুকু কষ্টই বা হইবে কেন? নীরজার অনেকবারই মনে হইতে লাগিল, আহা কনক যদি আগেকার মতই থাকিত, না বদলাইয়া যাইত তো বেশ হইত! নীরজার কথায় দাসী বলিল, “দিদিঠাকরুণ বারাণ্ডায় দাঁড়িয়ে জিনিষপত্র তোলা দেখছেন; আহা! বৌঠাকরুণ, তাঁকে সঙ্গে নিলেনা কেন গা? আহা তাঁর মুখটি শুকিয়ে গেছে।”

 শুনিয়া নীরজার একটু মমতা হইল। দাসী আবার বলিল, “দেখ বৌঠাকরুণ, দিদিঠাকরুণ দিনকের্ দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, তাই পাড়ার অনেকে অনেক কথা বলে।”

 নী। কি বলে।

 দাসী। বলে,—ওমা, অমন লক্ষ্মী বোনটি, যেমন রূপে তেমনি গুণে, মুখে যেন কথাটি নেই; তা ভাইটা বুঝি কষ্ট দেয়, নইলে অমন শুকিয়ে যাচ্ছে কেন? ভাইটা ছেলেবেলা হতে বড় দুরন্ত।

 শুনিয়া নীরজা জ্বলিয়া গেল। কনকের জন্য প্রমোদের এত জ্বালা, আবার তার উপর এই অপবাদ! কনক পোড়ারমুখী কি প্রমোদকে কষ্ট দিতেই জন্মিয়াছিল? কনকের উপর এতক্ষণ যে মমতাটুকু সে অনুভব করিতেছিল এই কথায় তাহা একেবারেই লোপ পাইয়া গেল। সে ক্রুদ্ধ হইয়া ভাবিল, বোটে গিয়াই এ কথা আগে স্বামীকে বলিরা, ইহার একটা প্রতিকার বিধান করিবে!

 একে একে তাঁহারা বোটে উঠিলেন,—কনক দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল; যখন বোট ছাড়িয়া দিল, তাঁহারা দৃষ্টিপথের অতীত হইয়া পড়িলেন, তখন কনক ঘরে আসিয়া কাঁদিতে লাগিল।