ছেলেবেলা/২

উইকিসংকলন থেকে

পাল্কিখানা ঠাকুরমাদের আমলের। খুব দরাজ বহর তার, নবাবি ছাঁদের। ডাণ্ডা দুটো আট আট জন বেহারার কাঁধের মাপের। হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লাল রঙের হাতকাটা মের্‌জাই-পরা বেহারার দল সূর্য-ডোবার রঙিন মেঘের মতো সাবেক ধন-দৌলতের সঙ্গে সঙ্গে গেছে মিলিয়ে। এই পাল্কির গায়ে ছিল রঙিন লাইনে আঁকজোক কাটা, কতক তার গেছে ক্ষয়ে; দাগ ধরেছে যেখানে-সেখানে, নারকেলের ছোবড়া বেরিয়ে পড়েছে ভিতরের গদি থেকে। এ যেন এ কালের নাম কাটা আসবাব, পড়ে আছে খাতাঞ্চিখানার বারান্দায় এক কোণে। আমার বয়স তখন সাত-আট বছর। এ সংসারে কোনো দরকারি কাজে আমার হাত ছিল না; আর ঐ পুরানো পাল্কিটাকেও সকল দরকারের কাজ থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হয়েছে। এইজন্যেই ওর উপরে আমার এতটা মনের টান ছিল। ও যেন সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপ, আর আমি ছুটির দিনের রবিন্‌সন-ক্রুশো, বন্ধ দরজার মধ্যে ঠিকানা হারিয়ে চার দিকের নজরবন্দি এড়িয়ে বসে আছি।

 তখন আমাদের বাড়ি-ভরা ছিল লোক, আপন পর কত তার ঠিকানা নেই; নানা মহলের চাকর-দাসীর নানা দিকে হৈ হৈ ডাক।

 সামনের উঠোন দিয়ে প্যারীদাসী ধামা কাঁখে বাজার করে নিয়ে আসছে তরি-তরকারি; দুখন বেহারা বাঁখ কাঁধে গঙ্গার জল আনছে; বাড়ির ভিতরে চলেছে তাঁতিনি নতুন-ফ্যাশান-পেড়ে শাড়ির সওদা করতে; মাইনে-করা যে দিনু স্যাকরা গলির পাশের ঘরে ব’সে হাপর ফোঁস্ ফোঁস্ ক’রে বাড়ির ফরমাশ খাটত সে আসছে খাতাঞ্চিখানায় কানে-পালখের-কলম-গোঁজা কৈলাস মুখুজ্জের কাছে, পাওনার দাবি জানাতে; উঠোনে বসে টং টং আওয়াজে পুরোনো লেপের তুলো ধুনছে ধুনুরি। বাইরে কানা পালোয়ানের সঙ্গে মুকুন্দলাল দারোয়ান লুটোপুটি করতে করতে কুস্তির প্যাঁচ কষছে; চটাচট শব্দে দুই পায়ে লাগাচ্ছে চাপড়, ডন ফেলছে বিশ-পঁচিশ বার ঘন ঘন। ভিখিরির দল বসে আছে বরাদ্দ ভিক্ষার আশা ক’রে।

 বেলা বেড়ে যায়, রোদ্‌দুর ওঠে কড়া হয়ে, দেউড়িতে ঘণ্টা বেজে ওঠে; পাল্কির ভিতরকার দিনটা ঘণ্টার হিসাব মানে না। সেখানকার বারোটা সেই সাবেক কালের, যখন রাজবাড়ির সিংহ দ্বারে সভাভঙ্গের ডঙ্কা বাজত— রাজা যেতেন স্নানে চন্দনের জলে। ছুটির দিন দুপুরবেলা যাদের তাঁবেদারিতে ছিলুম তারা খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম দিচ্ছে। একলা বসে আছি। চলেছে মনের মধ্যে আমার অচল পাল্কি, হাওয়ায়-তৈরি বেহারাগুলো আমার মনের নিমক খেয়ে মানুষ। চলার পথটা কাটা হয়েছে আমারই খেয়ালে। সেই পথে চলছে পাল্কি দূরে দূরে দেশে দেশে, সেসব দেশের বই পড়া নাম আমারই লাগিয়ে দেওয়া। কখনো-বা তার পথটা ঢুকে পড়ে ঘন বনের ভিতর দিয়ে। বাঘের চোখ জ্বল্ জ্বল্ করছে, গা করছে ছম্ ছম্। সঙ্গে আছে বিশ্বনাথ শিকারী, বন্দুক ছুটল দুম্! ব্যাস, সব চুপ। তার পরে এক সময়ে পাল্কির চেহারা বদলে গিয়ে হয়ে ওঠে ময়ূরপঙ্খি; ভেসে চলে সমুদ্রে, ডাঙা যায় না দেখা। দাঁড় পড়তে থাকে ছপ্-ছপ্ ছপ্-ছপ্। ঢেউ উঠতে থাকে দুলে দুলে, ফুলে ফুলে। মাল্লারা বলে ওঠে, ‘সামাল সামাল, ঝড় উঠল।’ হালের কাছে আবদুল মাঝি, ছুঁচলো তার দাড়ি, গোঁফ তার কামানো, মাথা তার নেড়া। তাকে চিনি, সে দাদাকে এনে দিত পদ্মা থেকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম।

 সে আমার কাছে গল্প করেছিল— একদিন চত্তির মাসের শেষে ডিঙিতে মাছ ধরতে গিয়েছে, হঠাৎ এল কালবৈশাখী। ভীষণ তুফান, নৌকো ডোবে ডোবে। আবদুল দাঁতে রশি কামড়ে ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলে, সাঁতরে উঠল চরে, কাছি ধরে টেনে তুলল তার ডিঙি।

 গল্পটা এত শিগ্‌গির শেষ হল, আমার পছন্দ হল না। নৌকোটা ডুবল না, অমনিই বেঁচে গেল, এ তাে গপ্‌পই নয়। বার বার বলতে লাগলুম, ‘তার পর?’

 সে বললে, ‘তার পর সে এক কাণ্ড! দেখি, এক নেকড়ে বাঘ। ইয়া তার গোঁফ-জোড়া। ঝড়ের সময়ে সে উঠেছিল ও পারে গঞ্জের ঘাটের পাকুড় গাছে। দমকা হাওয়া যেমনি লাগল গাছ পড়ল ভেঙে পদ্মায়! বাঘভায়া ভেসে যায় জলের তােড়ে। খাবি খেতে খেতে উঠল এসে চরে। তাকে দেখেই আমার রশিতে লাগালুম ফাঁস। জানােয়ারটা এত্তো বড়াে চোখ পাকিয়ে দাঁড়ালাে আমার সামনে। সাঁতার কেটে তার জমে উঠেছে খিদে। আমাকে দেখে তার লাল টক্‌টকে জিভ দিয়ে নাল ঝরতে লাগল। বাইরে ভিতরে অনেক মানুষের সঙ্গে তার চেনাশােনা হয়ে গেছে, কিন্তু আবদুলকে সে চেনে না। আমি ডাক দিলুম, আও বাচ্ছা! সে সামনের দু পা তুলে উঠতেই দিলুম তার গলায় ফাঁস আটকিয়ে, ছাড়াবার জন্যে যতই ছট্‌ফট্ করে ততই ফাঁস এঁটে গিয়ে তার জিভ বেরিয়ে পড়ে।’

 এই পর্যন্ত শুনেই আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, ‘আবদুল, সে মরে গেল নাকি?’

 আবদুল বললে, ‘মরবে তার বাপের সাধ্যি কী? নদীতে বান এসেছে, বাহাদুরগঞ্জে ফিরতে হবে তাে? ডিঙির সঙ্গে জুড়ে বাঘের বাচ্ছাকে দিয়ে গুণ টানিয়ে নিলেম অন্তত বিশ ক্রোশ রাস্তা। গোঁ গোঁ করতে থাকে, পেটে দিই দাঁড়ের খোঁচা, দশ-পনেরাে ঘণ্টার রাস্তা দেড় ঘণ্টায় পৌছিয়ে দিলে। তার পরেকার কথা আর জিগ্‌গেস কোরাে না বাবা, জবাব মিলবে না।’

 আমি বললুম, ‘আচ্ছা, বেশ, বাঘ তাে হল, এবার কুমির?’

 আবদুল বললে, ‘জলের উপর তার নাকের ডগা দেখেছি অনেকবার। নদীর ঢালু ডাঙায় লম্বা হয়ে শুয়ে সে যখন রােদ পােহায়, মনে হয়, ভারী বিচ্ছিরি হাসি হাসছে। বন্দুক থাকলে মােকাবিলা করা যেত। লাইসেন্‌স ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু মজা হল। একদিন কাঁচি বেদেনি ডাঙায় বসে দা দিয়ে বাখারি চাঁচছে, তার ছাগল-ছানা পাশে বাঁধা। কখন নদীর থেকে উঠে কুমিরটা পাঁঠার ঠ্যাঙ ধরে জলে টেনে নিয়ে চলল। বেদেনি একেবারে লাফ দিয়ে বসল তার পিঠের উপর। দা দিয়ে ঐ দানো-গিরগিটির গলায় পোঁচের উপর পোঁচ লাগালাে। ছাগল-ছানা ছেড়ে জন্তুটা ডুবে পড়ল জলে।’

 আমি ব্যস্ত হয়ে বললুম, ‘তার পরে?’

 আবদুল বললে, ‘তার পরেকার খবর তলিয়ে গেছে জলের তলায়, তুলে আনতে দেরি হবে। আসছে বার যখন দেখা হবে চর পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে আসব।’

 কিন্তু আর তাে সে আসে নি, হয়তাে খোঁজ নিতে গেছে।


 এই তাে ছিল পাল্কির ভিতর আমার সফর। পাল্কির বাইরে এক-একদিন ছিল আমার মাস্টারি; রেলিঙগুলাে আমার ছাত্র, ভয়ে থাকত চুপ। এক-একটা ছিল ভারি দুষ্ট, পড়াশুনােয় কিচ্ছুই মন নেই; ভয় দেখাই যে, বড়াে হলে কুলিগিরি করতে হবে। মার খেয়ে আগাগােড়া গায়ে দাগ পড়ে গেছে, দুষ্টুমি থামতে চায় না— কেন-না, থামলে যে চলে না, খেলা বন্ধ হয়ে যায়। আরাে একটা খেলা ছিল, সে আমার কাঠের সিঙ্গিকে নিয়ে। পূজায় বলিদানের গল্প শুনে ঠিক করেছিলুম সিঙ্গিকে বলি দিলে খুব একটা কাণ্ড হবে। তার পিঠে কাঠি দিয়ে অনেক কোপ দিয়েছি। মন্তর বানাতে হয়েছিল, নইলে পুজো হয় না—

সিঙ্গিমামা কাটুম্,
আন্দিবোসের বাটুম,
উলুকুট ঢুলুকুট ঢ্যাম্‌কুড়্ কুড়্
আখ্‌রোট বাখ্‌রোট খট্ খট্ খটাস—
পট্ পট্ পটাস্।

 এর মধ্যে প্রায় সব কথাই ধার করা, কেবল আখরোট কথাটা আমার নিজের। আখরোট খেতে ভালোবাসতুম। খটাস্ শব্দ থেকে বোঝা যাবে আমার খাঁড়াটা ছিল কাঠের। আর পটাস্ শব্দে জানিয়ে দিচ্ছে সে খাঁঁড়া মজবুত ছিল না।