বিষয়বস্তুতে চলুন

ছেলে-ভুল/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।

 একদিবস বৈকালে আমাদিগের পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত একখানি পত্র আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইল। তাঁহারই একজন চাপরাশী সেই পত্রখানি আনিয়া, আমার হস্তে প্রদান করিয়া চলিয়া গেল। খামখানি খুলিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর একখানি টেলিগ্রাম। সেই টেলিগ্রামের উপর সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ,—‘ইহা পাঠমাত্র কলিকাতার যে ঘাটে তমলুকের জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘাটে গমন করিয়া, টেলিগ্রামে লিখিত বালকের অনুসন্ধান কর, এবং কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায় কি না, তাহা সন্ধ্যার পর আমাকে রিপোর্ট করিও।’

 টেলিগ্রামের উপর সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ পাঠ করিয়া, তাহার পরে টেলিগ্রামখানি পাঠ করিলাম। দেখিলাম, কলিকাতার একজন সম্ভ্রান্ত লোক মফঃসল হইতে এই টেলিগ্রাম পুলিসের সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। সেই টেলিগ্রামের মর্ম্ম এইরূপ:—“আমরা সপরিবারে একখানি জাহাজে তমলুক হইতে উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হই। জাহাজ হইতে নামিবার পর দেখিলাম, আমার এক বৎসর বয়স্ক পুত্রকে জাহাজে ভ্রম ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি। সেই সময় জাহাজও উলুবেড়িয়া হইতে ছাড়িয়া দিয়াছিল। সুতরাং সেই জাহাজ ধরিয়া আমরা আমার পুত্রকে কোনরূপে আনিতে সমর্থ হইলাম না। আমার পুত্রটীর অঙ্গে প্রায় দুই সহস্র মূল্যের অলঙ্কার আছে। কোনরূপ সুযোগ করিয়া আমি এই টেলিগ্রামখানি আপনার নিকট পাঠাইতেছি, জাহাজে অনুসন্ধান করিলেই, আমার বালকটীর অনুসন্ধান হইবার সম্ভাবনা। আমরাও যতশীঘ্র পারি, কলিকাতায় গিয়া উপস্থিত হইয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।”

 টেলিগ্রামের মর্ম্ম অবগত হইয়া আমি আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিতে পারিলাম না। একখানি গাড়ি আনাইয়া তৎক্ষণাৎ আরমানি ঘাটাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। ঘাটে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, এখন পর্য্যন্ত তমলুকের জাহাজ আসিয়া কলিকাতায় উপস্থিত হয় নাই।

 আমি আরও কয়েকজন লোক সংগ্রহ করিয়া আরমানিঘাটে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। জাহাজ সম্বন্ধীয় কর্ম্মচারীগণ যাহারা সেই সময় সেই ঘাটে উপস্থিত ছিল, তাহারাও আমার সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।

 ক্রমে জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। জেটিতে জাহাজ ভিড়াইয়া নঙ্গর করা হইলে, আমরা সর্ব্বাগ্রে গিয়া জাহাজে উঠিলাম। জাহাজে যে সকল আরোহী ছিল, তাহারাও ক্রমে জাহাজ হইতে অবতরণ করিতে আরম্ভ করিল। যে সকল আরোহীর সহিত ছোট ছোট বালক ছিল, তাহাদিগকে প্রথমে আমরা জাহাজ হইতে অবতরণ করিতে দিলাম না। যাহাদিগের সহিত কোন শিশুসন্তান ছিল না, তাহারাই প্রথমে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া গেল। উহাদিগকে যতদূর সম্ভব অলঙ্কার-ভূষিত সেই বালকের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কেহই কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। এইরূপে যাহাদিগের নিকট শিশুসন্তান ছিল না, তাহারা জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, যাহাদিগের সহিত শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগকে এক এক করিয়া যাইতে দেওয়া হইল। তাহাদের গমন করিবার সময় তাহাদিগের সমভিব্যাহারে যে সকল শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধে যতদূর জানিয়া লইবার সম্ভাবনা, তাহা জানিয়া লইয়া, এবং উহারা উহাদিগের যে সকল থাকিবার ঠিকানা প্রদান করিল, তাহা লিখিয়া লইয়া উহাদিগকেও যাইতে দিলাম। এক এক করিয়া তাহারা সকলেই প্রস্থান করিল। কিন্তু যে বালকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই বালক সম্বন্ধে কোন ব্যক্তিই কোন কথা বলিতে পারিল না, বা যে সকল বালককে লইয়া তাহাদিগের পিতামাতা আমাদিগের সম্মুখে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গেল, তাহাদিগের কোন শিশুর অঙ্গে কোনরূপ মূল্যবান্ অলঙ্কারও দেখিতে পাইলাম না।

 এইরূপে সমস্ত আরোহী জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, আমরা জাহাজের সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরার ভিতর খুঁজিয়া দেখিলাম, যে সকল স্থানে জাহাজের খালাসিদিগের জিনিষপত্র থাকে, বা জাহাজের যে সকল স্থানে তাহাদিগের যাতায়াত আছে, সেইসকল স্থানও উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানে সেই এক বৎসর বয়স্ক বালকের বা তাহার পরিহিত অলঙ্কারের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। তখন আর কি করিব, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারিয়া, জাহাজের সারেংকে ডাকাইলাম। সে আমাদিগের নিকট আগমন করিলে, তাহাকে সেই টেলিগ্রাম দেখাইলাম, এবং তাহাকে সমস্ত কথা বুঝাইয়া বলিলাম। বৃদ্ধ সারেং জাতিতে মুসলমান হইলেও, তাহাকে বেশ ভদ্রলোক বলিয়া অনুমান হইল। সে তাহার অধীনস্থ সমস্ত খালাসি বা জাহাজের অপরাপর ভৃত্যগণকে একত্র করিয়া আমাদিগের সম্মুখেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। তাহার অনুসন্ধানে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবগত হইতে পারিলাম।

 ১ম। দাসদাসী ও পরিবারবর্গ লইয়া দুই তিনটী ভদ্রলোক তমলুকে এই জাহাজে আরোহণ করেন।

 ২য়। তাঁহাদিগের সহিত একটী পরিচারিকার ক্রোড়ে একটী এক বৎসর বয়স্ক বালক ছিল।

 ৩য়। উহার অঙ্গে অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল।

 ৪র্থ। তাঁহারা প্রথম শ্রেণীর একখানি কামরা ভাড়া করেন।

 ৫ম। সেই কামরার ভিতর স্ত্রীলোকগণ ছিলেন।

 ৬ষ্ঠ। চাকর-চাকরাণী কয়েকজন সেই কামরার বাহিরে ছিল।

 ৭ম। বাবুরা সকলে প্রথম শ্রেণীর খোলা জায়গায় এক একখানি চেয়ার ও মোড়া লইয়া বসিয়াছিলেন।

 ৮ম। তাঁহারা কে, কোথা হইতে আসিতেছেন, তাহা কেহই অবগত নহে। কেবল এইমাত্র জানিতে পারা গেল যে, উঁহারা তমলুকে জাহাজে উঠিয়াছিলেন।

 ৯ম। তাঁহারা সকলে উলুবেড়িয়ার ঘাটে অবতরণ করেন।

 ১০ম। সেই সময় তাঁহারা অলঙ্কার-ভূষিত বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন কি না, কেহ বলিতে পারেনা।

 জাহাজের সারেংয়ের সাহায্যে এই কয়েকটীমাত্র বিষয় অবগত হইয়া, ক্ষুণ্ণ মনে আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; এবং আদেশমত আমার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট গমন করিয়া, যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা তাঁহার নিকট আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, এবং যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সহজে যে উহার কোনরূপ অনুসন্ধান হইবে, তাহার সম্ভাবনাও নিতান্ত অল্প। তথাপি যাহাতে আমি সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি, এবং তাহার পরিহিত বহুমূল্য অলঙ্কারগুলির কোনরূপ উদ্ধার করিতে যাহাতে আমি সমর্থ হই, তাহার নিমিত্ত আমার উপর আদেশ প্রদান করিলেন। আমিও তাঁহার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, সেই স্থান হইতে নিজ স্থানে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। আসিবার সময় তাঁহাকে কেবলমাত্র ইহাই বলিয়া আসিয়াছিলাম যে, টেলিগ্রাম পাঠে যেরূপ বুঝিতে পারা যাইতেছে, তাহাতে বোধ হয়, যাঁহার পুত্র পাওয়া যাইতেছে না, তিনি যতশীঘ্র পারেন, কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইবেন। প্রথমতঃ, তিনি যদি আপনার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হন, তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্ব্বক তাঁহাকে যেন আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। প্রধান কর্ম্মচারী মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন ও কহিলেন, “আসিবামাত্রই তাঁহাকে আমি তোমার নিকট পাঠাইয়া দিব।” তিনি আরও কহিলেন, “কেহ যে আপনার শিশুসন্তানকে কখন ভুলক্রমে পরিত্যাগ করিতে পারে, তাহা কিন্তু আমি ইতিপূর্ব্বে আর কখনও দেখি নাই, বা শুনিও নাই। না জানি, ইনি কিরূপ পিতা!”