জওহরলাল/আট
আট
সেবার প্রায় ত্রিশ হাজার লোক কারাবাসী হন । যুবরাজ ভারতের নগরে নগরে পরিভ্রমণ করিয়া গেলেন—শূন্য, পরিত্যক্ত নগর—যেন মৃতের দেশ!
কিন্তু যিনি এই আন্দোলনের জনক, তিনি তখনও জেলের বাহিরে ছিলেন। গভর্ণমেণ্ট যে কোন কারণেই হউক, তাঁহাকে এ-বার স্পর্শ করিল না। সহসা জেলের মধ্যে জওহরলাল শুনিলেন যে, মহাত্মা গান্ধী এই আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন। এই সংবাদে জওহরলালের মন, অন্য বহু যুবকের মনের মতই ভাঙ্গিয়া পড়িল এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, মহাত্মা গান্ধী একটা মস্ত বড় ভুল করিলেন। যে উত্তেজনার মুখে জওহরলাল জেলে ঢুকিবার সময় দেশকে দেখিয়াছিলেন তাঁহার ধারণা হইয়াছিল যে, আর খানিকটা সেই উত্তেজনাকে ধরিয়া রাখিতে পারিলে, ভারতে এক বিরাট অহিংস গণবিপ্লব সংশোধিত হইবে- হঠাৎ সেই সময় তিনি তাহার পরিবর্ত্তে শুনিলেন যে, স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন! তাহার কারণ, চৌরিচৌরা নামক এক অতি নগণ্য জায়গায় একদল উত্তেজিত লোক অহিংস-নীতি ভুলিয়া কতকগুলি পুলিসের লোককে পুড়াইয়া মারিয়াছে।
সেদিন অন্য বহু লোকের ন্যায় জহরলালও গান্ধীজির এই ব্যবহারকে সমর্থন করিতে পারেন নাই। তবে অন্য লোকের ন্যায় তিনি গান্ধীজিকে সরাসরি দোষী বলিয়া নিন্দা করিতে পারিলেন না। কারণ, এই লোকটাকে তিনি যৌবনের অন্তরঙ্গ দৃষ্টি দিয়া ভাল করিয়া দেখিয়া লইয়াছিলেন এবং তাঁহার পাশ্চাত্য শিক্ষার সমস্ত দম্ভ ত্যাগ করিয়া তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি জানিতেন যে, আর যাহাই হউক, এই ব্যক্তি কোন ভয়ের দ্বারা বিচলিত হন না, কোন মিথ্যার দ্বারা মুগ্ধ হন না। তাই মনে যতই তিনি বেদনা পান না কেন, তিনি বিচার করিয়া দেখিতে লাগিলেন এবং অচিরকালের মধ্যে বুঝিতে পারিলেন যে, এই অভিজ্ঞ জননেতা, যিনি অঙ্কশাস্ত্রের মত জন-নীতি অধ্যয়ন করিয়াছেন, তিনি ভুল করেন নাই। উত্তেজনার মুখে সাধারণ নেতার চোখে যে-সব জিনিষ পড়ে না, অথবা চোখে পড়িলেও যাহা স্বীকার করিতে হইলে নিজেকে প্রকাশ্যভাবে ছোট করিতে হয়, মহাত্মা গান্ধী তাহার ঊর্দ্ধে নিজেকে তুলিতে পারেন।
চৌরি-চৌরার সেই সামান্য ঘটনার মধ্যে তিনি জনতার মনের যে পরিচয় পাইয়াছিলেন, তাহাতে তিনি শঙ্কিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, এইভাবে ঘটনার ধারা চলিলে, অহিংস আন্দোলন অচিরকালের মধ্যেই বিনষ্ট হইয়া যাইবে— ভারতে গণ-উত্থানের সময় এখনও আসে নাই। তাই অনর্থ বাড়িবার মুখেই তিনি সেই আন্দোলন প্রত্যাহার করিয়া জনতাকে গড়িয়া তুলিবার জন্য আরও সময় লইলেন। কিন্তু গভর্নমেণ্ট গান্ধীজিকে কারাগারের বাহিরে রাখা আর যুক্তিসঙ্গত মনে করিল না । গান্ধীজিও কারারুদ্ধ হইলেন ।
জওহরলাল এবং পণ্ডিত মতিলালের বিচারে ছয় মাস কারাদণ্ড হইয়াছিল। কংগ্রেসের নীতি অনুযায়ী তাঁহারা বিচারে কোন অংশ গ্রহণ করেন নাই। তবে এই বিচারসম্পর্কে জওহরলাল তাঁহার আত্মচরিতে যে বর্ণনা দিয়াছেন, তাহা হইতে বোঝা যায় যে, কি হাস্যকর ভাবে এই সব মামলা সাজানো হইত।
জওহরলাল লিখিতেছেন,—“পিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, কংগ্রেস ভলান্টিয়ার নামক অবৈধ সমিতির তিনি সভ্য ছিলেন, এবং তাহা প্রমাণ করিবার জন্য একটি কাগজ, তাঁহার স্বাক্ষর-সমেত আদালতে দেখানো হয়। স্বাক্ষরটী হিন্দীতে করা ছিল। হিন্দীতে স্বাক্ষর তিনি ইতিপূর্ব্বে করেন নাই বলিলেই হয়, এবং স্বাক্ষরটি এমন জড়ানো যে খুব কম লোকই বুঝিতে পারে যে, সেটী তাঁহার স্বাক্ষর। স্বাক্ষরটী যে তাঁহার, তাহা প্রমাণ করিবার জন্য আদালতে একজন জীর্ণ-স্থবির লোককে দাঁড় করানো হয়। তিনি হলফ করিয়া বলেন যে তিনি জানেন যে, এটা পিতার স্বাক্ষর। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল এই যে, লোকটী সম্পূর্ণ নিরক্ষর এবং কাগজখানি প্রকাশ্য আদালতে সে উল্টা করিয়াই ধরিয়া পরীক্ষা করিল।”
তিন মাস কারাবাসের পর, জওহরলাল জানিতে পারিলেন যে, পুলিস বুঝিতে পারিয়াছে যে, তাঁহাকে ভুল করিয়া ধরা হইয়াছিল, সুতরাং কারাগারে থাকিবার আর তাঁহার কোন প্রয়োজন নাই। কিন্তু মাস দেড়েক কারাগারের বাহিরে থাকিতেই পুলিশ আবার বুঝিল যে, তাহারা ভুল করিয়াছে— জওহরলালের স্থান কারাগারের ভিতরেই হওয়া উচিত। তিনি পুনরায় গ্রেফতার হইলেন এবং একরাশ অভিযোগের ফলে, সব মিলাইয়া এক বৎসর নয় মাস কারাদণ্ড লাভ করিলেন। যেখান হইতে আসিয়াছিলেন, আবার সেখানে ফিরিয়া যাইতে হইল।