বিষয়বস্তুতে চলুন

জওহরলাল/এগার

উইকিসংকলন থেকে

এগার

 ১৯২৬ সালের মার্চ্চ মাসে অসুস্থ পত্নীকে সঙ্গে লইয়া জওহরলাল আবার ইউরোপের দিকে অগ্রসর হইলেন। প্রায় দেড় বৎসরকাল য়ুরোপে বাস করিয়া জওহরলাল সস্ত্রীক যখন ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিলেন, তখন মাদ্রাজে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসিতেছিল। এই দেড় বৎসর কাল ভারতবর্ষ হইতে দূরে য়ুরোপে বাস করার ফলে জওহরলাল যখন ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহার মনে কতকগুলি সিদ্ধান্ত বেশ স্পষ্ট আকার ধারণ করিয়াছে।

 প্রথম য়ুরোপ-প্রবাসের ফলে তিনি য়ুরোপে বসিয়া সে সব বিশ্বপ্রগতির ধারা স্বচক্ষে লক্ষ্য করিয়াছিলেন, তিনি বুঝিয়াছিলেন যে, ভারতবর্ষকে সেই সব বিশ্বজনীন ভাব-ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রাখিয়া চলিতে হইবে—জগতের ঘটনাপ্রবাহ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিয়া আর কোন দেশ স্বতন্ত্রভাবে নিজের ভাগ্য নিজের মতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিবে না-বিশ্বঘটনার প্রবাহের মধ্যে প্রত্যেক দেশ তরঙ্গ-সূত্রে আবদ্ধ— সেইজন্য ভারতবর্ষকেও সেই সব ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যোগসূত্র রাখিতে হইবে—কর্ম্মক্ষেত্রে তাহা রাজনৈতিক কারণে সম্ভব না হইলেও, আইডিয়ার দিক হইতে তাহার পথ বন্ধ করিয়া রাখিলে চলিবে না।

 দ্বিতীয়, এতদিন পর্য্যন্ত কংগ্রেস তাহার রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য সম্বন্ধে যে সব বিবৃতি দিয়াছে, যেমন স্বরাজ, স্বায়ত্ত-শাসন ইত্যাদি সেই সব অস্পষ্ট কথাগুলি বাদ দিয়া কংগ্রেসকে দ্ব্যর্থহীন রাজনৈতিক ভাষায় তাহার আদর্শকে স্পষ্ট করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে—এবং সে আদর্শ হইল, ভারতের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা।

 তৃতীয় হইল, রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পিছনে একটা তেমনিই প্রবল সামাজিক আন্দোলনের যোগ থাকা চাই-ভারতের গ্রাম্য জীবনের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এত ত্রুটী আছে যে, তাহা সংশোধন না করিয়া রাজনীতিক্ষেত্রে বহুদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় ।

 য়ুরোপ হইতে ফিরিয়া আসিয়া জওহরলাল কংগ্রেস আন্দোলনের মধ্যে এই তিনটী ভাবধারার প্রভাব বিস্তার করিবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করিতে লাগিলেন। বিশেষ করিয়া শেষোক্ত ধারা সম্বন্ধে তিনি বিচার করিয়া দেখিলেন যে, যেহেতু কংগ্রেস আজ রাজনৈতিক আন্দোলন লইয়া বিশেষভাবে বিব্রত, তাহার পক্ষে সামাজিক সংস্কারে নামা এখন সম্ভব হইবে না, সুতরাং সেক্ষেত্রে তিনি স্থির করিলেন যে, কংগ্রেসের কোনও পদ তিনি লইবেন না। গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া শেষোক্ত আন্দোলনের জন্য তিনি নিজেকে মুক্ত রাখিবেন। কিন্তু তাঁহার সে কল্পনা কার্য্যকরী হইবার আগেই কংগ্রেস তাঁহাকে আবার টানিয়া লইল।

 মাদ্রাজের অধিবেশনে যোগদান করিয়া তিনি কতকগুলি নূতন প্রস্তাব কংগ্রেসের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। তিনি যে সব সিদ্ধান্ত নিজের মনে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, এই প্রস্তাবগুলি সেই সম্পর্কেই। তিনি বিস্মিত হইয়া দেখিলেন যে, তাঁহার সমস্ত প্রস্তাবগুলিই গৃহীত হইল। তখন তাঁহার মনে সন্দেহ জাগিল যে, যাঁহারা তাঁহার প্রস্তাব সমর্থন করিয়াছেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই সেই প্রস্তাবের মর্ম্ম স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেন নাই। বিশেষ করিয়া পূর্ণ-স্বাধীনতার প্রস্তাব-সম্বন্ধে তিনি অচিরকালের মধ্যেই বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার সন্দেহ অমূলক হয় নাই। সেই পূর্ণ-স্বাধীনতার প্রস্তাব লইয়া ওয়ার্কিং কমিটীতে তীব্র বাদানুবাদ জাগিয়া উঠিল ।

 ইতিমধ্যে জওহরলাল পুনরায় কার্যকরী ভাবে কংগ্রেসের সহিত জড়াইয়া পড়িলেন। মাদ্রাজ অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন ডাঃ আনসারী। তিনি জওহরলালকে ধরিয়া বসিলেন, অন্তত তাহার সময়টুকু জওহরলালকে কংগ্রেসের সেক্রেটারীর দায়িত্ব বহন করিতে হইবে। জওহরলাল সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করিতে পারিলেন না, যদিও তিনি বুঝিলেন যে, কংগ্রেসের সেক্রেটারীর পদ তাহার এক রকম একচেটিয়া হইয়া উঠিতেছিল।

 মাদ্রাজ কংগ্রেসের কয়েকমাস পরে ভারতবর্ষে সাইমন কমিশন আসিল। কংগ্রেস এই কমিশনকে বয়কট করিবার জন্য অনুজ্ঞা জারী করিল । সারা দেশে সাইমন কমিশনের বয়কট- ব্যাপার লইয়া তুমুল সাড়া পড়িয়া গেল এবং পাঞ্জাবে লালা লজপৎ রায়ের অকাল-মৃত্যু এই আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করিয়া তুলিল।

 এই বয়কট সম্পর্কে এক শোভাযাত্রা পরিচালনা করিবার সময় লালাজী পুলিশ কর্তৃক প্রহৃত হন এবং তাহার কয়েকদিন পরে সেই আঘাতের প্রতিক্রিয়ার ফলে দেহত্যাগ করিতে বাধ্য হন। এই শোচনীয় মৃত্যুর ফলে জনসাধারণ যেমন একদিকে মর্ম্মাহত হইল— অন্যদিকে তেমনই সাইমন কমিশন বয়কট আন্দোলন আপনা হইতেই জনতার মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল। সাইমন কমিশন যেখানেই যান, সেখানেই কৃষ্ণপতাকাধারী কংগ্রেস-ভলাণ্টিয়ারের দল “ফিরে যাও সাইমন” বাণীতে তাঁহাদের অভিনন্দন জানায়। পুলিস আর সৈন্য আসিয়া নির্ম্মমভাবে জনতার উপর পড়িয়া প্রহারে জর্জ্জরিত করিয়া তাহাদের দল ভাঙ্গিয়া দিতে লাগিল। কিন্তু কমিশানের অভিনন্দনের পক্ষ হইতে তাহা স্বভাবতই কুৎসিৎ হইয়া উঠিতে লাগিল।

 জওহরলাল তখন ছিলেন লাক্ষ্ণৌ শহরে। সাইমন কমিশন আসিয়া পৌঁছিবার আগের দিন তিনি শোভাযাত্রী দলের সহিত পথে বাহির হইলেন। ভারতের অন্যত্র যাহা ঘটিতেছিল, সেদিন লক্ষ্ণৌ শহরেও তাহা ঘটিল। অশ্বারোহী পুলিশ ও সৈন্যের দল তাঁহাদের উপর আসিয়া পডিল এবং নির্ম্ম্মমভাবে প্রহার সুরু করিল। অন্য সকলের সহিত জওহরলালও সেই আঘাতের অংশ লইলেন। কংগ্রেসের ব্যবস্থা-অনুযায়ী এক একজন নেতার অধীনে ষোলো জন করিয়া ভলান্‌টিয়ার লইয়া এক একটা শোভাযাত্রা গঠিত হইয়াছিল। আক্রমণকারী পুলিশের দল যখন ঘোড়া শুদ্ধ ঘাড়ে চড়িয়া প্রহার সুরু করিল, ভলা্ন্‌টিয়ারগণ, প্রথম ধাক্কা দাঁড়াইয়া সামলাইল। কিন্তু আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহারা আত্মরক্ষার স্বাভাবিক নীতি অনুযায়ী সামনের দোকানে এবং ফুটপাথে উঠিয়া দাঁড়াইল। পুলিস সেখানেও তাহাদের অনুসরণ করিল।

 জওহরলালের জীবনে লাঠি-প্রহার এই প্রথম। তাঁহার আত্মচরিতে এই সম্পর্কে তিনি লিখিতেছেন—“প্রথম দু’টী জোর আঘাতের পর আত্মরক্ষা স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশে পা দুইটী একবার ফুটপাথের দিকে আগাইয়া গেল কিন্তু পর মুহূর্ত্তেই মনের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব জাগিয়া উঠিল। আমি কি এতই ভীরু আর কাপুরুষ? পা থামিয়া গেল, যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেইখানেই দাঁড়াইয়া রহিলাম—দেখি, আমি একা—আমার চারিদিকে সব ক্রুদ্ধ ক্রূর মুখ!”

 সেদিন রাত্রিতে তাহারা যখন কংগ্রেস অফিসে ফিরিয়া গেলেন, তখন তাঁহাদের পক্ষের অধিকাংশই ক্ষত-বিক্ষত। জওহরলালের আঘাত অবশ্য গুরুতর হয় নাই কিন্তু সর্ব্বাঙ্গে তীব্র বেদনা। পরের দিন ভোরবেলা, আসল শোভাযাত্রা বাহির হইবে, কারণ সেইদিন শহরে সাইমন কমিশন আসিবে। আগের দিনের দেহের বেদনা ঝাড়িয়া ফেলিয়া দিয়া জওহরলাল শোভাযাত্রার নেতারূপে পথে বাহির হইলেন।

 শোভাযাত্রা ষ্টেশনের কাছাকাছি আসিলে, পুলিস এবং অশ্বারোহী সৈন্যের দল তাঁহাদের উপর আসিয়া পড়িল। তাহার পর কয়েক মিনিটের মধ্যে যাহা ঘটিয়া গেল, জওহরলাল তাঁহার আত্মচরিতে লিখিতেছেন যে, তাহাকে একটা ছোটখাট যুদ্ধ বলা যাইতে পারে। তবে যুদ্ধে দুইদলই পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করে। কিন্তু এ যুদ্ধে একদল প্রহার করে, আর একদল নীরবে তাহা সহ্য করে। সেদিনকার সেই ঘটনা সম্পর্কে জওহরলাল লিখিতেছেন—“সেদিন দেহে যে যাতনা অনুভব করিয়াছিলাম, আজ আর তাহার চিহ্নমাত্র নাই, কিন্তু তাহার স্মৃতি মনে রহিয়া গিয়াছে—”