বিষয়বস্তুতে চলুন

জওহরলাল/চৌদ্দ

উইকিসংকলন থেকে

চৌদ্দ

 লাহোর কংগ্রেসের পরের বৎসর গান্ধীজি সিফিল ডিসোবিডিয়েন্‌স আন্দোলন শুরু করিবেন বলিয়া কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিকে জানাইলেন। এই আইন-অমান্য-আন্দোলনের সূত্রপাত হইবে, লবণআইন ভঙ্গ করিয়া!

 যখন গান্ধীজি এই প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন, তখন অনেকের ন্যায় জওহরলালও আইন-অমান্য-আন্দোলনের এই বিচিত্র উপায় সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়াছিলেন; এবং গান্ধীজির সহিত তাহা লইয়া তাহার বাদপ্রতিবাদও হয়। তবে অন্যান্য বহু ব্যাপারের ন্যায়, এ ব্যাপারে গান্ধীজি ওয়ার্কিং কমিটীর সকলের মত পরিবর্ত্তন করাইলেন। জওহরলাল গান্ধীজির সহিত বাদানুবাদ করিলেও, একটী বিষয় তিনি নিঃসন্দেহভাবে জানিতেন, তাহা হইল অর্দ্ধ-তপস্বী রাজনৈতিকের জনতার এবং ঘটনা-প্রবাহের মনস্তত্ত্ব বুঝিবার স্বভাবত প্রতিভা—

 সেইজন্য বারবার গান্ধীজির সহিত মতের অনৈক্য হইলেও, তিনি অনুগত শিষ্য এবং সহচরের মত তাঁহার অনুসরণ করিয়াছেন। বিশেষ করিয়া লবণআন্দোলনে গান্ধীজি জগতের সামনে প্রমাণ করিয়া দিলেন যে, ঘটনার গতি-প্রবাহ-জ্ঞান সম্বন্ধে যদি কোন বিজ্ঞান থাকে, তাহা হইলে সে বিষয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক।

 যে আন্দোলনের সূচনায় সকলেই, এমন কি বৃটীশ গভর্ণমেণ্ট, একটা হাস্যকর কিছু আশঙ্কা করিয়া সেই অর্দ্ধউন্মাদ লোকটীকে তাঁহার নিজের খেয়াল-মাফিক অগ্রসর হইতে দিয়াছিলেন, কয়েকদিন যাইতে না যাইতে সকলের সঙ্গে বৃটীশ গভর্ণমেণ্টও বুঝিলেন, লোকটীর বিচারে তাঁহারা কি ভুলই না করিয়াছেন। এই লবণ-আন্দোলনকে ভিত্তি করিয়া ভারতের জাতীয়-আন্দোলনের স্তিমিত শিখা যেন দাবানলের মত জ্বলিয়া উঠিল—এতদিন যে আন্দোলন শহরের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, গান্ধীজি বৃটীশ-শাসন যন্ত্রের রক্ষীদের দ্বারাই তাহা ভারতের সুদূরতম গ্রামে তাহাকে লইয়া আসিলেন—ভদ্রবেশী আমলাতন্ত্রের আড়ালে যে পীড়নকারী অত্যাচারী মূর্ত্তি ছিল, যাহা বক্তৃতায় বা মুখের কথায় লোককে দেখানো বা বোঝানো সম্ভব ছিল না-

 লবণ-সত্যাগ্রহীর অসীম তিতিক্ষা এবং সেই সঙ্গে পুলিশের ততোধিক কঠিন প্রহার- তাহা সুদূরতম গ্রামবাসীর চোখের সামনে তুলিয়া ধরিল—চোখেদেখা জিনিসকে আর ভুল বুঝিবার অবকাশ রহিল না। গান্ধীজির নেতৃেত্ব সম্বন্ধে জওহরলালের মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল, তাহা সম্পূর্ণভাবে তিরোহিত হইয়া গেল। যাহাতে এই আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধভাবে পরিচালিত হয়, তাহার জন্য জওহরলাল শহর হইতে শহরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আন্দোলনের বেগ তীব্রতর হইয়া উঠিল ।

 একদল সত্যাগ্রহী কারারুদ্ধ হয়, তাহার স্থলে পূর্ব্ব-নির্দিষ্ট আর একদল বাহির হয়। কংগ্রেস প্রত্যেক দলকে সতন্ত্রভাবে কাজ করিবার স্বাধীনতা দিয়াছিল এবং গান্ধিজীর নির্দেশ অনুযায়ী প্রত্যেক দলের একজন করিয়া নেতা বা পরিচালক থাকিতেন। তিনি কারারুদ্ধ হইলে, তিনিই স্থির করিয়া যাইতেন, তাঁহার স্থলে কে সেই দায়িত্ব গ্রহণ করিবে। এইভাবে একটা আন্দোলন মাথা তুলিয়া উঠিল। আবার চারিদিকে ধর-পাকড়, বেয়নেটচার্জ্জ—নিষ্পেষণের নানা মূর্ত্তি জাগিয়া উঠিল—

 জওহরলাল রাইপুরে এক সভায় যোগদান করিবার জন্য যাইতেছিলেন, সেই সময় পথে তাঁহাকে গ্রেফতার করা হইল। গান্ধীজির ব্যবস্থা অনুযায়ী জওহরলাল, তাঁহার অনুপস্থিতিতে গান্ধীজিকে কংগ্রেসের প্রেসিডেণ্ট মনোনীত করিয়া গেলেন, যদি গান্ধিজী সম্মত না হন, তাহা হইলে প্রেসিডেণ্ট হইবেন পণ্ডিত মতিলাল। কিন্তু গান্ধীজি যে সম্মত হইবেন না, তাহা জওহরলাল জানিতেন। তাই তাঁহার অনুপস্থিতিতে পণ্ডিত মতিলাল পুত্রের দায়িত্ব স্কন্ধে তুলিয়া লইলেন । তখন তাঁহার শরীর ভাঙ্গিয়া পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, রীতিমত তাঁহার চিকিৎসা চলিতেছে কিন্তু কারাপ্রবাসী পুত্রের অসমাপ্ত দায়িত্ব পিতা হইয়া তিনি কি করিয়া প্রত্যাখ্যান করেন? সেই অসুস্থ অবস্থাতেই পণ্ডিত মতিলাল সেই বিরাট দায়িত্ব তুলিয়া লইলেন। বিচারে জওহরলালের ছয়মাস কারাদণ্ড হইল।

 তাহার পরের মাসেই গান্ধীজি কারারুদ্ধ হইলেন। তখন কংগ্রেসের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পণ্ডিত মতিলালের উপর আসিয়া পড়িল। সেই অসুস্থ শরীর লইয়া তিনি বম্বে আসিলেন। সেই সময় বম্বে প্রদেশ এই আন্দোলনে ডগমগ করিতেছিল। মতিলালের আগমনে তাহা যেন আরও তীব্র হইয়া উঠিল। বম্বের কাজ শেষ করিয়া পণ্ডিত মতিলাল যখন এলাহাবাদে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তাঁহার অসুস্থ শরীর আর ভার বহন করিতে অক্ষম। ডাক্তারদের সনির্ব্বন্ধ অনুরোধে কিছুকাল বিশ্রামের জন্য মুসৌরী যাইবার প্রস্তাব স্থির হইল। মুসৌরী যাইবার দিন যাত্রার আয়োজন করিতেছেন, এমন সময় পুলিশ আসিয়া জানাইল, তাহার বিশ্রামের জায়গা গভর্ণমেণ্টই ঠিক করিয়া রাখিয়াছেন, মুসৌরী নয়, নয়নী জেল।