বিষয়বস্তুতে চলুন

জওহরলাল/তের

উইকিসংকলন থেকে

তের

 ১৯২৮ সালে কলিকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন বসিল। এই বৎসরেও জওহরলাল কংগ্রেসের সেক্রেটারী হইলেন। প্রত্যেক বৎসরে সভাপতি বদলাইয়াছে, কিন্তু কংগ্রেস-প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরূপে জওহরলাল রহিয়া গিয়াছেন!

 কলিকাতা কংগ্রেসের প্রেসিডেণ্ট হইলেন পিতা, আর সেক্রেটারী হইলেন পুত্র! পরের বৎসর লাহোরে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হইবে, তাহার সভাপতিরূপে মহাত্মা গান্ধীকে সকলে ধরিয়া বসিল। গান্ধীজি তখন কংগ্রেসের সাক্ষাৎ পরিচালনার দায়িত্ব হইতে নিজেকে দূরে রাখিয়াছিলেন। তিনি কোনমতেই সম্মত হইলেন না—তাহার পরিবর্ত্তে তিনি সভাপতির পদে জওহর- লালের নাম প্রস্তাব করিলেন, এবং তাহাই গৃহীত হইল। লাহোর কংগ্রেসের সভাপতি হইলেন, পণ্ডিত জওহরলাল। পিতার শূন্য-আসনে আসিয়া বসিল পুত্র। ইহাতে সব চেয়ে বেশী আনন্দিত হইলেন পণ্ডিত মতিলাল।

 মাত্র চল্লিশ বৎসর বয়সে জওহরলাল এই বিরাট সম্মান ও দায়িত্বের অধিকারী হইলেন। তাঁহার পূর্ব্বে এত কম বয়সে মাত্র আর দুইজন এই সম্মানের অধিকারী হইয়াছিলেন, গোখলে এবং আবুল কালাম আজাদ। কিন্তু জওহরলালের পক্ষে চরম গৌরবের বিষয় যে, সেই বৎসরে নিখিল ভারত ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেসেরও সভাপতি তিনি নির্ব্বাচিত হন। কংগ্রেসের অধিবেশনের কয়েক সপ্তাহ আগেই নাগপুরে ট্রেডইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। এই দুই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতিরূপে জওহরলালের মনে এক বিপুল দুরাকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠে—তাহার মধ্য দিয়া তিনি এই দুই বিচ্ছিন্ন এবং বিভিন্ন পথগামী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে যদি এক পথে টানিয়া আনিতে পারেন— যদি কংগ্রেসকে সাম্যবাদে দীক্ষিত করিতে পারেন— যদি কংগ্রেসের পরিধির মধ্যে জাতির শ্রমিক এবং কৃষকদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে লইয়া আসিতে পারেন— যদি জাতীয় আন্দোলনের পুরোভাগে সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক এবং কৃষকদের দাঁড় করাইতে পারেন—

 কিন্তু কিছুদিন যাইতে-না-যাইতে জওহরলাল বুঝিলেন যে তাঁহার এই আশা দুরাশা মাত্র—এবং তাঁহার সমস্ত অভিজ্ঞতা দিয়া যে সত্য তিনি উপলব্ধি করিয়াছেন, তাহা অতি সুন্দরভাবে তিনি তাঁহার আত্মচরিতে প্রকাশ করিয়াছেন—“জাতীয়তা সাম্যবাদের পথে তখনি অগ্রসর হইতে পারে, যখন সে জাতীয়তাকেই বাদ দিয়া চলিতে শিখিবে- "

 কার্য্যত এই দুই আন্দোলনের ধারাকে যদিও জওহরলাল তাহার ঈপ্সিত এক পথে লইয়া আসিতে পারেন নাই, তথাপি আইডিয়ার দিক হইতে এই ব্যাপারে তাঁহার দান কম নয়। আইডিয়ার প্রসার হইতে অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই একদিন ভারতবর্ষে এই দুই রাজনৈতিক ভাবধারার সমন্বয় ঘটিবে এবং সেদিন জওহরলালের নাম কৃতজ্ঞ ভারতবাসী শ্রদ্ধায় স্মরণ করিবে।

 লাহোর কংগ্রেসে জওহরলাল বহুদিন পরে কংগ্রেসের কার্য্য-ধারাকে একটা গতি দিলেন। য়ুরোপ হইতে দ্বিতীয়বার ফিরিয়া আসার পর হইতে জওহরলালের মনে কংগ্রেসের আদর্শরূপে পূর্ণ-স্বাধীনতার বাণী-ঘোষণার যে পরিকল্পনা ছিল, লাহোর কংগ্রেসে তাহাকে কার্য্যকরী করিয়া তুলিলেন। কংগ্রেস পূর্ণস্বাধীনতার আদর্শ গ্রহণ করিল এবং সেই সঙ্গে একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রস্তাব উত্থাপিত হইল, শাসনপরিষদের পদ ত্যাগ করিয়া কংগ্রেস সভ্যদের সম্পূর্ণভাবে দেশের কাজে আত্মনিয়োগ।

 প্রকাশ্য কংগ্রেসে এই প্রস্তাব গৃহীত হইয়া গেল এবং লাহোর কংগ্রেস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেস সদলবলে শাসন - পরিষদ হইতে বাহির হইয়া আসিল। এই লাহোর কংগ্রেসে স্বাধীনতার প্রস্তাব ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে, জওহরলাল দেশের জনসাধারণের মনে এই স্বাধীনতা-প্রস্তাবের গুরুত্ব প্রচার করিবার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা দিবস বলিয়া একটি স্বতন্ত্র দিন নিদ্দিষ্ট করিয়া দিলেন—উক্তদিন প্রতি বৎসরে স্বাধীনতাকামী ভারতীয় নরনারী জাতীয় পতাকার সম্মুখে স্বাধীনতা প্রস্তাবের বাণীকে স্মরণ করিবে-এবং সেই ব্রত-উদ্‌যাপনের জন্য নিজেকে উৎসর্গীকৃত করিবে—২৬শে জানুয়ারী হইল সেইদিন-

 লাহোর কংগ্রেসের পর হইতে সহসা জওহরলালের নাম সারা ভারতে ছড়াইয়া পড়িল। বিশেষ করিয়া দেশের তরুণদিগের নিকট তিনি এক নূতন ধরণের “হিরো” হইয়া উঠিলেন—মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু ব্যতীত বোধ হয় আর কোন কংগ্রেস নেতা জনতার মন এতখানি আর অধিকার করিতে পারে নাই— মাঘ-মেলার সময় তাঁহার দর্শনের জন্য দলে দলে তীর্থযাত্রীর দল তাঁহাদের বাড়ীতে আসিয়া যতক্ষণ না তাঁহার দর্শন পাইত, অপেক্ষা করিয়া থাকিতপ্রত্যেক দশ মিনিট অন্তর তাঁহাকে আসিয়া দর্শন দিতে হইত—

 এই সময় তাহার খ্যাতি জনসাধারণের মধ্যে এমন ভাবে প্রভাব বিস্তার করে যে, লোকের মুখে মুখে তাঁহার সম্বন্ধে নানা রোমাঞ্চকর কাহিনীর সৃষ্টি হইল। এখনও পর্যন্ত সেই সব কাহিনী লোকের মনে বদ্ধমূল হইয়া আছে, যদিও তিনি নির্ম্মমভাবে তাঁহার আত্মচরিতে তাঁহার সম্বন্ধে সেই সব কাহিনীর মূলোচ্ছেদ করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু নিজের চারিদিকে “হিরোর” আলোকচ্ছটা নিজের হাতে মুছিয়া ফেলিয়া দিবার যতই চেষ্টা জওহরলাল করুন না কেন, আজ তিনি জনসাধারণের মনে যে স্থান অধিকার করিয়া আছেন, সেখানে “হিরোর” সেই রামধনু-রঙা বর্ণচ্ছটা ঘিরিয়া থাকিবেই।