বিষয়বস্তুতে চলুন

জওহরলাল/দশ

উইকিসংকলন থেকে

দশ

 ১৯২৩ সালের জানুয়ারী মাসে জওহরলাল আবার জেল হইতে বাহির হইলেন। বাহির হইয়! দেখিলেন কাউন্সিল-প্রবেশ লইয়া কংগ্রেসের মধ্যে স্পষ্টত দুইদল হইয়া গিয়াছে এবং এই দলের মধ্যে মতান্তর ক্রমশ মনান্তরে পরিণত হইতে চলিয়াছে! যাহাতে দুই দলের মধ্যে এই ভেদাভেদ দূর হইয়া যায়, জওহরলাল তাহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন সুফলই ফলিল না।

 জেল হইতে বাহির হইয়া জওহরলাল যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেস কমিটীর সেক্রেটারীরূপে কংগ্রেস অফিসকে গুছাইয়া তুলিবার জন্য মনঃসংযোগ করিলেন। কাজের অভাব ছিল না, বিশেষ করিয়া জওহরলাল ছিলেন কাজ-পাগলা। কিন্তু সমস্ত কাজই যেন তাঁহার উদ্দেশ্যহীন ব্যর্থ বলিয়া মনে হইতে লাগিল, কারণ, কংগ্রেসের দলাদলিতে আকাশ তখন এমন বিষাক্ত হইয়া উঠিয়াছিল যে, তাহার মধ্যে বেশীদূর কোন দিকেই অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না—যদি না একদলের সঙ্গে নির্ম্মমভাবে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় । সেইজন্য মানসিক অবস্থার দিক হইতে জওহরলাল তীব্র এক অশান্তি বোধ করিতে লাগিলেন।

 কাজ ছাড়া এই অশান্তি দূর করিবার পথ নাই, কিন্তু কংগ্রেসের কাজ তখন সূতার মত জড়াইয়া গিয়াছে, যতক্ষণ না তাহার গিট ছাড়াইতে পারা যাইবে, ততক্ষণ তাহা লইয়া কোন কাজ করাই সম্ভব নয়! জওহরলাল কিছুদিনের চেষ্টার পর বুঝিলেন, তাহার একার দ্বারা সেই গিট ছাড়ানো অসম্ভব। সৌভাগ্যবশতঃ এই সময় অন্য আর এক দিক হইতে কাজ করিবার এক সুযোগ আসিয়া উপস্থিত হইল । এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটীর সর্বময় কর্তার আসনে জওহরলালকে বসাইবার প্রস্তাব হইল।

 একটা লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, সেই বৎসরে ভারতবর্ষের বড় বড় মিউনিসিপ্যালিটীতে সর্ব্বোচ্চ আসনে একজন না একজন কংগ্রেসের নেতা বসিয়াছিলেন। কলিকাতায় দেশবন্ধু মিউনিসিপ্যালিটী হইতে কলিকাতার প্রথম মেয়র হইলেন, বম্বে করপোরেসনের প্রেসিডেণ্ট হইলেন মিঃ বিঠলভাই প্যাটেল, আহমদাবাদে বল্লভভাই প্যাটেল, যুক্তপ্রদেশেও সেই পন্থা অনুসরণ করিয়া জওহরলাল এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটীর ভার লইলেন। ভার লইয়াই তিনি বিপুল উদ্যমে নগর-সংস্কারের কাজে লাগিয়া গেলেন। এই সময় জওহরলালের উপর আর এক কাজের দায়িত্ব আসিয়া পড়িল, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সেক্রেটারীর পদ। দিনে পনেরো ষোল ঘণ্টা করিয়া তিনি তখন খাটেন।

 এই সময় হঠাৎ আর একদিক হইতে সুচতুর উপায়ে জওহরলালের উপর প্রভাববিস্তারের চেষ্টা হইতে লাগিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার গ্রীন্ঊড মিয়ার্‌স উপযাচক হইয়া পত্র লিখিয়া জওহরলালের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করিলেন। ক্রমশঃ স্যার মিয়ার্‌স এই পরিচয়কে নিজের চেষ্টায় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত করিলেন। নানাভাবে তিনি জওহরলালকে বুঝাইতে লাগিলেন যে, তাঁহার ন্যায় প্রতিভা য়ুরোপে জন্মগ্রহণ করিলে, যে কোন রাষ্ট্রের একটা প্রধান মন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করিতে পারিতেন।

 শিক্ষাসংক্রান্ত ব্যাপারে জওহরলালের আগ্রহ দেখিয়া,স্যার মিয়ার্‌স কথায় কথায় বলিলেন, যদি তাঁহার মত লোক ভারতের কোন প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী হন, তাহা হইলে তিনি কি মনে করেন না যে, দেশের প্রভূত কল্যাণ করিয়া যাইতে পারেন? এইভাবে কথাটা উত্থাপন করিয়া আর একদিন স্যার্ মিয়ার্‌স জানাইলেন, গভর্নরের সঙ্গে তিনি এই সম্পর্কে আলোচনা পর্য্যন্ত করিয়াছেন এবং নিজে তাঁহাকে কথা দিয়াছেন যে, এই ধরণের কোন লোক যদি শিক্ষাবিভাগের ভার গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তিনি তাঁহাকে এই দায়িত্বপালনে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবেন।

 জওহরলালের বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, স্যার মিয়ার্‌স এইভাবে সুচতুর উপায়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিবার জন্য তাঁহার নিকট সরকার তরফের এই প্রস্তাব করিয়াছেন, কিন্তু স্যার মিয়ার্‌সের এত চেষ্টা ব্যর্থ হইয়া গেল। বিদেশী গভর্ণমেণ্টের অধীনে কোন দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা জওহরলাল স্বপ্নেও ভাবিতে পারিতেন না। তাঁহার আত্মচরিতে এই সম্পর্কে তিনি লিখিয়াছেন—ইহা ভাবিতেও আমার ঘৃণা বোধ হইত।

 এই সময় জওহরলালের জীবনে এমন একটা অপ্রিয় ঘটনা ঘটিল, যাহার মধ্য দিয়া তিনি ভারতবর্ষের একটি গভীর ক্ষতস্থানের সাক্ষাৎ পরিচয় পাইলেন। 'সে ক্ষতস্থানটী হইল, ভারতের নেটিভ ষ্টেট। বৃটিশ শাসনের অধীন, এই বিংশশতাব্দীতে, এই সব ষ্টেটের কোন কোনটীতে, এখনও বর্ব্বর-যুগের অন্ধকার সমান প্রতাপে রাজত্ব করিয়া চলিয়াছে। ভারতবর্ষে যেমন বিভিন্ন জাতির লোক, ধর্ম্ম ও ভাষা পাশাপাশি কলরব করিয়া চলিয়াছে, তেমনি এখানে রহিয়াছে পাশাপাশি বিভিন্ন স্তরের সভ্যতা—আদিম বর্ব্বরতা হইতে আরম্ভ করিয়া বর্তমান যুগের সাম্যবাদের স্বপ্ন পর্য্যন্ত—অথবা বলা যাইতে পারে সভ্যতার যে-সব স্তর জগতের অন্যত্র মরিয়া পচিয়া গলিয়া বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, ভারতবর্ষের সভ্যতার মিউজিয়ামে আজও তাহা সংরক্ষিত করিয়া রাখা হইয়াছে।

 পাতিয়ালা এবং নাভা নামে দুই শিখ নেটিভ স্টেট আছে। এই দুই নেটীভ ষ্টেটের শাসকদের মধ্যে অনবরত ঝগড়ার ফলে নাভার মহারাজ সিংহাসনচ্যুত হন এবং তাঁহার বদলে একজন বৃটিশ রাজকর্মচারী সেই ষ্টেট শাসন করিতে থাকেন। এই ব্যাপারে শিখেরা অসন্তুষ্ট হইয়া প্রকাশ্য আন্দোলন দ্বারা নিজেদের অসন্তোষ জানাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। এহেন সময় জাইটো নামে এক গ্রামে শিখেদের এক উপাসনা চলিতেছিল, বৃটিশ প্রতিনিধি সেই উপাসনা বন্ধ করিয়া দিবার হুকুম দিলেন এবং কোন লোক যাহাতে সেই মন্দিরে গিয়া উপাসনায় যোগদান না করিতে পারে, তাহারও ব্যবস্থা করিলেন। এই ব্যাপারে শিখেরা আরও ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল এবং এই বৃটিশ প্রতিনিধির আদেশ অমান্য করিয়া তাহারা দলে দলে সেই মন্দিরের অভিমুখে যাত্রা করিল। কিন্তু মন্দিরে পৌঁছিবার আগেই পুলিশ এবং সৈন্যরা তাহাদের আক্রমণ করিল।

 বেয়নেটের আঘাতে, গুলির আলিঙ্গনে, মন্দিরযাত্রীরা ধূলায় শুইতে লাগিল। পুলিশের বেয়নেট যত চলে, মন্দির-যাত্রীদের চলিবার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হইয়া উঠে। এই নিত্য নির্ম্মম ব্যবহার এখন সারা ভারতবর্ষের দৃষ্টি আবর্ষণ করিল, অন্তত জওহরলালকে এই মন্দির-যাত্রীর দল তীব্রভাবে আকর্ষণ করিল।

 মৃত্যুকে উপেক্ষা করিয়া যাহারা পথ চলিতে জানে, জওহরলাল ছিলেন মনেপ্রাণে তাহাদেরই সঙ্গী। তাই তিনি ঠিক করিলেন, জাইটো গিয়া স্বচক্ষে ব্যাপারটি দেখিয়া আসিবেন।

 এই স্থির করিয়া তাঁহার দুইজন সহকর্ম্মী গিডওয়ানী এবং সান্তানুমের সঙ্গে তিনি জাইটো যাত্রা করিলেন। সেখানে গিয়া যখন তাঁহারা উপস্থিত হইলেন, তখন একদল জাঠা মন্দিরের অভিমুখে চলিয়াছিল। পুলিশ আসিয়া তাহাদের ঘিরিয়া ফেলিল এবং সেই সঙ্গে পুলিশের একজন লোক আসিয়া তাঁহাদের উপর হুকুম জারী করিল, তাঁহারা যেন জাইটোতে প্রবেশ না করেন এবং এই মুহূর্ত্তেই যেন ফিরিয়া যান। জওহরলাল তাহার উত্তরে জানাইলেন, জাইটোতে তাঁহারা তো ঢুকিয়া পড়িয়াছেন, সুতরাং আদেশের প্রথম অংশের কোন মানেই হয় না। আর দ্বিতীয় অংশ সম্বন্ধে কথা হইল, তাঁহারা যখন কর্পূর নন, তখন এক মুহূর্তের মধ্যেই উবিয়া যাইতে পারেন না। ফিরিয়া যাইবার ট্রেণের যথেষ্ট বিলম্ব আছে, সুতরাং ফিরিয়া যাইতে হইলেও অনেকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হইবে। পুলিশের কর্মচারীটি এই উত্তরের প্রত্যুত্তরে তাঁহাদের তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার করিলেন!

 সারাদিন স্থানীয় জেলের একটা ছোট্ট কুঠুরীতে তাহাদের তালাচাবি দিয়া আটক করিয়া রাখা হইল। সন্ধ্যার মুখে তাঁহাদের হাঁটাইয়া ষ্টেশনের দিকে লইয়া যাওয়া হইল। তাঁহার ডান হাতের কব্জীতে হাতকড়া লাগাইয়া তাহার সহিত সান্তানুমের হাতের হাতকড়ার সঙ্গে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল। হাতকড়ার সঙ্গে একটা লোহার “ছিকলি” ছিল। পুলিশের লোকটী সেই ছিকলি ধরিয়া চলিয়াছিল। গিডওয়ানীর একটু বরাৎ ভাল ছিল। তাহারও হাতে হাত-কড়া এবং ছিকলি ছিল, তবে অন্য কাহারও সহিত তাহা সংযুক্ত ছিল না। এই অবস্থায় রাস্তা দিয়া হাঁটাইয়া তাঁহাদের ষ্টেশনে লইয়া আসা হইল এবং ট্রেনে কারয়া নাভায় গিয়া নাভা জেলে তাঁহাদের তুলিয়া দেওয়া হইল; এবং হাতকড়া বাঁধা অবস্থাতেই জওহরলাল ও সান্তানুমকে একঘরে চাবি দিয়া রাখা হইল! দুইজনের হাত একসঙ্গে হাতকড়া বাঁধা। সুতরাং একজনকে নড়িতে হইলে, অপরকেও নড়িতে হয়। এই অপূর্ব্ব-বন্ধন-দশার নূতনত্বের মধ্যে জওহরলাল বেদনার অপেক্ষা কৌতূহলই বেশী অনুভব করিয়াছিলেন। তাঁহার শিক্ষা এবং মানসিক গঠন, উচ্ছ্বাস অথবা আত্ম-বিলাসিতার ধার ধারিত না। যেদিন রাজনীতি জীবনের ধর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন, সেদিন তিনি এই ধরনের অভিজ্ঞতার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করিয়া লইয়াছিলেন, তাই তাঁহার বিরাট আত্মচরিতের মধ্যে আমরা তাঁহার নিজের কথা খুব কমই শুনিতে পাই।

 প্রতিদিন তাঁহাদের সেই অবস্থায় আদালতে আনা হইত এবং আদালতের কাজ হইয়া গেলে আবার জেলের কুঠরীতে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া হইত। বিচার শেষ হইতে প্রায় পনেরো দিন লাগিয়া গেল এবং এই পনেরো দিন ধরিয়া সেই অপূর্ব্ব বিচারের যে বিবরণ তিনি তাঁহার আত্মচরিতে লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে মনে হয়, যেন উহা বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতের কোন ব্যাপার নয়, অশিক্ষিত বর্ব্বর য়ুগের স্মৃতি।

 এই সম্পর্কে তিনি লিখিতেছেন, “যে কয়েকদিন ধরিয়া বিচার হইল, তাহার মধ্যে এমন বিচিত্র সব ঘটনা নিত্য ঘটিতে লাগিল, যাহা হইতে বৃটিশকর্তৃত্বে ভারতের নিটিভ ষ্টেটের শাসনকার্য্যের ব্যাপার স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। সমস্ত বিচারপদ্ধতিটা একটা হাস্যকর প্রহসন—সেইজন্যই হয়ত বাহির হইতে কোন সংবাদপত্রের প্রতিনিধিকে সেখানে ঢুকিতে দেওয়া হয় না। পুলিশের যাহা খুসী, পুলিশ তাহা করিতে পারে। বিচারকের আদেশ মানিতে সে বাধ্য নয়— এমন কি প্রকাশ্য আদালতে বিচারকর্ত্তার্কেই পুলিশের লোক ধমক দিয়া দিল— বেচারা বিচারকর্ত্তাকে তাহা মানিয়া লইতে হইল—বহুবার দেখিলাম, পুলিশের লোক বিচারকর্ত্তার হাত হইতেই কাগজপত্র জোর করিয়া টানিয়া লইল!”

 এই ভাবে বিচার চলিবার পর, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাঁহাদের দেড় বৎসর কারাদণ্ড হইল। কিন্তু সেই দিনই সন্ধ্যাবেলা পুলিশের কর্তা জেলে আসিয়া তাঁহাদের জানাইয়া গেলেন যে, তাঁহাদের দণ্ড আপাতত মুলতুবী রাখা হইয়াছে, সুতরাং তাঁহারা এখন ফিরিয়া যাইতে পারেন; এবং এই দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ করিবার পর তাঁহারা আবার এলাহাবাদে ফিরিয়া আসিলেন।

 সেই বৎসর দক্ষিণ দেশে ককোনদে কংগ্রেসের যে অধিবেশন হইল, তাহার সভাপতি হইলেন মহম্মদ আলী। মহম্মদ আলী জওহরলালকেই সেক্রেটারীরূপে মনোনীত করিলেন। এই পদগ্রহণে জওহরলালের তখন যথেষ্ট আপত্তি ছিল, কিন্তু মহম্মদ আলীর সনির্বন্ধ অনুরোধে তাঁহাকে গ্রহণ করিতেই হইল। যদিও এই দুইজনের মধ্যে মানসিক গঠনের যথেষ্ট বৈষম্য ছিল—মহম্মদ আলী ছিলেন একজল ধর্ম্মনিষ্ঠ লোক, ধর্ম্মসম্বন্ধে জওহরলাল ছিলেন উদাসীন—তবুও মহম্মদ আলী ভারতের নবীন যুবকদের মধ্যে জওহরলালকেই সব চেয়ে বেশী ভালবাসিতেন।

 এই ধর্মের ব্যাপার লইয়া দুইজনের মধ্যে তুমুল বাদানুবাদ চলিত, সেইজন্য জওহরলাল চেষ্টা করিয়া সে প্রসঙ্গ তাঁহার সামনে উত্থাপন করিতেন না। কিন্তু এই চেষ্টাকৃত নীরবতা মহম্মদ আলী সহ্য করিতে পারিতেন না, তিনি নিজেই উপযাচক হইয়া ধর্ম্মতত্ত্ব সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন তুলিতেন এবং যাহাতে জওহরলাল তাঁহার শুষ্ক বৈজ্ঞানিক মতবাদ ত্যাগ করিয়া ধর্ম্ম সম্বন্ধে সচেতন হন, তাহার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। ধর্ম্ম বা ঈশ্বর সম্বন্ধে মহম্মদ আলী এত সচতেন থাকিতেন যে, কংগ্রেসের প্রস্তাবের মধ্যে যেখানেই কোন সুযোগ পাইতেন, সেখানেই তিনি “ঈশ্বরের দয়ায়” অথবা ঈশ্বরের নাম যে কোন প্রকারে উল্লেখ করিতেন, কিন্তু তাঁহার সেক্রেটারী প্রস্তাবের ভাষা হইতে সেই কথাগুলি তুলিয়া দিতে চাহিতেন। ইহা লইয়া আবার দুইজনে বাদানুবাদ করিত।

 পরের বৎসর বেলগমে যে কংগ্রেসের অধিবেশন হইল তাহাতে মহাত্মা গান্ধী সভাপতি হইলেন। মহম্মদ আলীর মত তিনিও জওহরলালকে সেক্রেটারীরূপে বাছিয়া লইলেন। ইহার পরের বৎসর কানপুরে যখন কংগ্রেসের পুনরধিবেশন হইল, তখন জওহরলাল বাহিরের কাজে এবং মানসিক দুশ্চিন্তায় খুবই বিব্রত হইয়া পড়িয়াছেন।

 কংগ্রেসের সেক্রেটারীর কাজ ছাড়া, এলাহাবাদ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কাজও তখন তাঁহাকে করিতে হইতেছিল। এই সমস্ত কাজের মধ্যে আর একটি কাজ ছিল, পীড়িত স্ত্রীর সেবা। তাঁহার স্ত্রী কমলা নেহরু বহুদিন হইতে অসুখে ভুগিতেছিলেন এবং ক্রমশই তাঁহার অবস্থা খারাপ হইয়া আসিতেছিল। জওহরলাল তাঁহাকে হাসপাতালে রাখিতে বাধ্য হন কিন্তু সেখানেও বিশেষ কোন অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চিকিৎসকগণ সুইজারল্যাণ্ডে বায়ুপরিবর্তনের পরামর্শ দিলেন।

 জওহরলাল স্থির করিলেন স্ত্রীকে লইয়া সুইজারল্যাণ্ডে যাইবেন।

 এই সিদ্ধান্তের পিছনে স্ত্রীর ভগ্নস্বাস্থ্যের আশা ছাড়াও তাঁহার নিজের দিক হইতে আরও একটি ইচ্ছা ছিল। কংগ্রেসের কাজের মধ্যে তাঁহার মন কোন তৃপ্তি পাইতেছিল না—নানারকমের সন্দেহে এবং সংশয়ে তাঁহার মন অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল— তাই তিনি স্থির করিলেন দূরে গিয়া নিরপেক্ষভাবে সমস্ত ব্যাপারটা একবার ভাল করিয়া বিশ্লেষণ করিয়া দেখিবেন।