জওহরলাল/নয়
নয়
জীবনে কারাগারের সঙ্গে পরিচয়ের সেই প্রথস দিনগুলির কথা জওহরলাল তাহার আত্মচরিতে যেভাবে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে প্রথম প্রথম অবস্থার নূতনত্বের দরুণ এবং একসঙ্গে বহু লোককেই একই দুঃখ ভোগ করিতে হইতেছে, এই চিন্তায় কারাপীড়া তাঁহার মনে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। কিন্তু যতই দিন যাইতে লাগিল, ততই কারাজীবনের ভয়াবহ অলস একঘেয়েমী তাঁহার কর্মব্যস্ত মনকে উদাস ও পীড়িত করিয়া তুলিতে লাগিল। সেই একঘেয়েমী দূর করিবার জন্য কারাগারের মধ্যেই তিনি নিজের জন্য নানারকমের কাজ তৈয়ারী করিয়া লইলেন।
রাজনৈতিক অপরাধী ছাড়া জেলের মধ্যে অন্য যে সব বাসিন্দারা ছিল, তাহাদের দিকে জওহরলালের দৃষ্টি পড়িল। সাধারণ অপরাধীর দল, কেহ বা তাহার মধ্যে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত খুনে ডাকাত কিন্তু সকলেই নিরক্ষর। জেলব্যবস্থার দরুণ তাহাদের মানসিক সংস্কার হওয়া দূরে থাকুক, তাহারা সেই বন্দিদশার একঘেয়ে পরিশ্রমের হাত হইতে মুক্ত হইয়াই আবার নূতন উন্মাদনার আকর্ষণে ছুটিবে— আবার হয়ত ফিরিয়া আসিবে—এইভাবে জেল হইতে জেলে—তাহাদের জীবন সমাজের একটা বৃহৎ অপব্যয়ই হইয়া থাকিবে। জওহরলাল তাঁহার সঙ্গীদের লইয়া এই ধরণের কয়েদীদের পড়াইবার ব্যবস্থা করিলেন। কিন্তু জেলের মধ্যে কর্তৃপক্ষদের সহিত নানারকমের সংঘর্ষ বাঁধিতে লাগিল।
কয়েদীদের সাধারণ সুবিধা-সুযোগ একটির পর একটি তাঁহাদের নিকট হইতে কাড়িয়া লওয়া হইতে লাগিল, তাঁহারাও সঙ্ঘবদ্ধভাবে জেলের মধ্যে নানাভাবে তাঁহাদের মানসিক অভিযোগ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাহার ফলে জেল-কর্ত্তৃপক্ষ তাঁহাদের কয়েকজনকে “দুষ্ট গোরু” বলিয়া বাছিয়া লইলেন এবং অন্য সব কয়েদীদের সহিত যাহাতে এই দুষ্টের দল মিশিবার কোন সুযোগ না পায়, তাহার জন্য তাহাদের আলাদা করিয়া সেই বৃহৎ জেলের সুদূর প্রান্তে সরাইয়া দেওয়া হইল—
সেই দুষ্ট দলের নেতা ছিলেন, জওহরলাল এবং সেই দলে তাঁহার সঙ্গী ছিলেন, পুরুষোত্তমদাস টাওন, মহাদেব দেশাই, জর্জ যোসেফ, বটকৃষ্ণ শর্মা এবং দেবদাস গান্ধী—
শাস্তি স্বরূপ বাহির হইতে খবরকাগজ আসা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে জেলের ভিতর খবর আসা সব সময় বন্ধ হয় না। জওহরলালও সেই অজ্ঞাত রহজনক উপায়ে বাহিরের জগতের যে সব সংবাদ পাইতেন, তাহাতে তাঁহার মন উল্লসিত হইবার মতন কোন উপাদান খুঁজিয়া পাইত না। সমস্ত কংগ্রেস আন্দোলন যেন স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে। অন্য বহু লোকের ন্যায়, জওহরলালের মনেও তখন এই ক্ষোভ হইত যে, জাতির জাগরণের সে শুভলগ্ন, যাহাকে ইংরাজী ভাষায় তিনি 'ম্যাজিক মোমেণ্ট' বলিয়াছেন, তাহা যেন আসিয়া চলিয়া গিয়াছে— তাহার সুযোগ জাতি লইতে পারে নাই—নেতারাও তাহাকে ফিরিয়া যাইতে দিয়াছেন—আবার সে লগ্ন কবে আসিবে, কে বলিতে পারে?
কারাগারের ভিতরে থাকিয়াই তিনি খবর পাইলেন যে, কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যেও দলাদলি দেখা দিয়াছে এবং কংগ্রেস দুইটি স্পষ্ট দলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। এক দলের নাম হইয়াছে, নো-চেন্জার অর্থাৎ যাঁহারা পরিবর্ত্তন চান না, আর এক দলের নাম হইয়াছে, প্রো-চেন্জার, অর্থাৎ যাহারা পরিবর্ত্তনের স্বপক্ষে। প্রথম দলের নেতা হইলেন, মাদ্রাজের সি, রাজাগোপালচারি, কংগ্রেসের পুরাতন অসহযোগ প্রোগ্রামের কোন পরিবর্ত্তন করিতে তিনি সম্মত নন্; দ্বিতীয় দলের নেতা হইলেন, বাংলার দেশবন্ধু এবং যুক্তপ্রদেশের পণ্ডিত মতিলাল, তাঁহাদের মত হইল, আগামী নির্ব্বাচনে যোগদান করিয়া নূতন আইনসভার সমস্ত আসন দখল করিয়া লওয়া এবং সেখানে গিয়া আমলাতন্ত্রকে যথাযোগ্য ভাবে বাধা দেওয়া।
শাসন-পরিষদে যাওয়া না-যাওয়া লইয়া সারা দেশময় তখন দলাদলির এক কুৎসিত রূপ ফুটিয়া উঠিল, যাহার অন্তরালে কংগ্রেসের সেই বিপুল আদর্শবাদ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হইয়া যাইতে লাগিল। এই সমস্ত চিন্তা কারাগারে জওহরলালকে পীড়িত ও চিন্তিত করিয়া তুলিতে লাগিল। চিন্তার সবচেয়ে বিশেষ কারণ ছিল যে, তখন গান্ধীজি স্বয়ং দীর্ঘমেয়াদে কারারুদ্ধ।
এই দুশ্চিন্তা এবং নৈরাশ্যের সহিত কারাজীবনের বাধ্যতামূলক একঘেয়েমির বোঝা মিলিয়া তাঁহার মনকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। সেই বৈচিত্র্যহীনতার হাত হইতে আত্মরক্ষা করিবার জন্য তিনি প্রতিদিন রাত্রিবেলায় একদল নূতন সঙ্গীর সহিত দেখাশোনার ব্যবস্থা করিয়া লইয়াছিলেন—অবশ্য জেল কর্ত্তৃপক্ষের অজ্ঞাতে অন্য সকলের অগোচরে প্রতিদিন মাথার উপরে তাহারা দেখা দিত—ভাল করিয়া তাহাদের মুখ দেখা যাইত না—বড় দূরে দূরে থাকিয়া দেখা শোনা হইত—তবুও সেই দূরত্বের ব্যবধান ভেদ করিয়া তাঁহার অনুসন্ধানী মন তাহাদের একটী একটী করিয়া চিনিতে চেষ্টা করিত—কারাগারের বন্দী আর আকাশের তারা—প্রতি রাত্রিতে তাঁহাদের দেখাশুনা হইত-জওহরলাল চিনিতে চেষ্টা করিতেন, কাল সপ্তর্ষি মাথার উপরে ছিল, আজ তাহারা কোথায় গেল —একে একে পরিচিত তারাগুলি খুঁজিয়া বাহির করিতে চেষ্টা করিতেন—বৈচিত্রহীনতার বিভীষিকা হইতে বাঁচিবার জন্য তাঁহার সৃজনশীল মন এই খেলা আবিষ্কার করিয়া লইয়াছিল।