জওহরলাল/পনেরো
পনেরো
পিতা আর পুত্রে আবার দেখা হইল—কারাগারে। পণ্ডিত মতিলালের স্বাস্থ্যের দরুণ, জেলকর্তৃপক্ষ তাঁহাকে জওহরলালের কাছে কাছেই রাখিলেন। সৈয়দ মাহমুদ এবং জওহরলাল দুইজনে মিলিয়া পণ্ডিত মতিলালের সেবা করিতে পাইয়া, সেই কারাজীবনের একঘেয়েমীর হাত হইতে বাঁচিলেন।
এই সময় জেলের বাহিরে স্যার তেজ বাহাদুর সাপ্রু যাহাতে কংগ্রেসের সহিত গভর্ণমেণ্টের একটা আপোষনিষ্পত্তি হইয়া যায়, তাহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছিলেন। কংগ্রেসপক্ষের তখন অধিকাংশ নেতাই কারাগারে। স্যার তেজ-বাহাদুর এবং মিঃ জয়াকর বড়লাটের নিকট অনুমতি লইয়া কারাগারের মধ্যেই কংগ্রেস-নেতাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করিতেছিলেন। হঠাৎ গান্ধীজির নিকট হইতে এক পত্র পাইয়া তাঁহারা দুইজনে নয়নী-জেলে কারারুদ্ধ পিতা পুত্রের নিকট উপস্থিত হইলেন।
দুইদিন ধরিয়া বহু বাদানুবাদের পর জওহরলাল জানাইলেন যে, মহাত্মা গান্ধী এবং ওয়ার্কিং-কমিটির সদস্যদের সহিত পরামর্শ না করিয়া তাঁহারা কোন কথাই দিতে পারেন না। সুতরাং স্যার তেজ বাহাদুর এবং মিঃ জয়াকরকে ফিরিয়া যাইতে হইল। ফিরিয়া গিয়া তাঁহারা বড়লাটের মত করাইলেন, যাহাতে যারবাদা জেলে, অবরুদ্ধ কংগ্রেস নেতারা গান্ধীজির সহিত মিলিত হইতে পারেন—
মহাত্মা গান্ধী তখন যারবাদা জেলে বাস করিতেছিলেন, ভারতের বিভিন্ন কারাগার হইতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণ স্পেশাল ট্রেণে সকলে আসিয়া যারবাদা জেলে সম্মিলিত হইলেন। জেলের ভিতরেই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি বসিল! তিনদিন ধরিয়া এই আলোচনা চলে। তাহার পরে আবার প্রত্যেকে যে যাহার কারাগারে ফিরিয়া গেল।
যাতায়াত এবং পরিশ্রমের ফলে পণ্ডিত মতিলালের শরীর আবার ভাঙ্গিয়া পড়িল। কারাগারের সেই বাধ্যতামূলক জীবনের পঙ্গুতা, সেই অমোঘ সীমাবদ্ধতা, তাহার রাজ-চিত্তে তীব্র আঘাত করিত, তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না— সহ্য অবশ্য তিনি করিতেন, কিন্তু তাহা করিতে গিয়া আত্মজ্বালা ও নিষ্পেষণে তাঁহার শরীর ও মন জ্বলিয়া যাইত।
অবশেষে তাঁহার স্বাস্থ্যের দুর্ল্লক্ষণ দেখিয়া তারত সরকার ৮ই সেপ্টেম্বর তাহাকে কারামুক্ত করিয়া দিলেন। ইহার প্রায় একমাস পরে ছয়মাস কারাগারের পর জওহরলালও মুক্ত হইলেন। কিন্তু করাগার হইতে বাহিরে পা বাড়াইয়াই তাঁহার মনে হইল, কয়-দিনের জন্যই বা এই মুক্তি!
কারাগার হইতে বাহির হইয়াই জওহরলাল স্থির করিলেন যে, অন্তত তাঁহার প্রদেশে তিনি কর-অমান্য-আন্দোলন শুরু করিয়া দিবেন। এতদিন ধরিয়া গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে যে প্রচারকার্য্য করা হইয়াছে, আজ সময় আসিয়াছে, তাহাদের লইয়া একটা সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার।
জওহরলাল জানিতেন, বেশীদিন তিনি জেলের বাহিরে থাকিতে পারিবেন না, তাই এই আন্দোলনের সূচনার জন্য তিনি ব্যগ্রভাবে অতি দ্রুত সব কাজ করিতে লাগিলেন। তাঁহার প্রদেশের কৃষাণ এবং তাঁহাদের প্রতিনিধিদের লইয়া তিনি এক বিরাট সম্মিলনের আয়োজন করিলেন। এই সম্মিলনে প্রায় ষোলো শো কৃষাণ-প্রতিনিধি বিভিন্ন গ্রাম হইতে যোগদান করিলেন! জওহরলাল তাঁহাদের সামনে কর-অমান্য-আন্দোলনের প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন; এবং এই উপলক্ষে তিনি যে বক্তৃতা দিলেন, তিনি তখন জানিতেন না যে, সেই বক্তৃতাই তাঁহার জেলে ফিরিয়া যাইবার “টিকিট” হইয়া গেল।
এই সময় পণ্ডিত মতিলাল মুসৌরীতে ছিলেন। একটু সুস্থ হওয়ায় পুত্রের সঙ্গে দেখা করিবার জন্য তিনি এলাহাবাদ যাত্রা করিলেন। পিতাকে প্রত্যুদ্গমন করিয়া আনিবার জন্য জওহরলাল ষ্টেশনে য়াইলেন। কিন্তু সেদিন ট্রেন আসিতে অত্যন্ত বিলম্ব করিল । এলাহাবাদে সেইদিন আর একটি সভা হইতেছিল। বাধ্য হইয়া তাঁহার স্ত্রী কমলা নেহেরুকে সঙ্গে লইয়া তাঁহাকে সভায় চলিয়া যাইতে হইল।
সভার কাজ শেষ করিয়া স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া জওহরলাল পিতার সহিত দেখা করিবার জন্য উৎসুক হইয়া বাড়ী ফিরিতেছিলেন। মাঝপথে পুলিশের গাড়ী আসিয়া তাঁহাদের গাড়ী থামাইল। পুলিশের হাতে ছিল, ওয়ারেণ্ট, কারানিমন্ত্রণ-পত্র। পথ হইতে জওহরলালকে আবার ফিরিয়া যাইতে হইল, সেই কারা-তীর্থে—পিতার সহিত আর দেখা হইল না- কমলা নেহরু একা ফিরিয়া আসিলেন আনন্দভবনে—জওহরলাল আবার প্রবেশ করিলেন নয়নীজেলে-