জওহরলাল/বার
বার
সেই বৎসরে (১৯২৮) ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবনের দিকে ফিরিয়া চাহিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, হঠাৎ যেন নানা দিক হইতে ভারতের রাজনৈতিক চেতনা সেই বৎসরে সজাগ ও সচেতন হইয়া উঠে। যেন অনেকগুলি দরজা একসঙ্গে কে খুলিয়া দিয়াছে। এতদিন জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে একমাত্র কংগ্রেসের রাজনীতিই লোকচক্ষুর সামনে ছিল—সে বৎসর ভারতবর্ষ প্রথম ট্রেড-য়ুনিয়ন আন্দোলনের মারফৎ সাম্যবাদী রাজনীতি এবং তাহার স্বতন্ত্র সম্বন্ধে সচেতন হইল— অবশ্য ট্রেডয়ুনিয়ন আন্দোলন তাহার কয়েক বৎসর পূর্ব্ব হইতেই ভারতবর্ষে দেখা দিয়াছিল কিন্তু এতদিন তাহা যেন অস্পষ্ট হইয়া ছিল। মুক্তি-আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকদের স্বার্থ ছাড়া, শ্রমিকদের স্বার্থের যে একটা বড় যোগ আছে, এবং নিরস্ত্র হইলেও সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিকদের হাতে মুক্তি-আন্দোলনের নানা অস্ত্র আছে, যাহা প্রয়োগ করিলে তাহারা শাসক সম্প্রদায়কে রীতিমত চিন্তিত করিয়া তুলিতে পারে, সেই বৎসরেই তাহা ভারতে প্রকট হইয়া উঠে। সেই সঙ্গে আর এক নূতন আন্দোলন মাথা তুলিয়া উঠে—যুবক আন্দোলন!
এই দুইটী নূতন আন্দোলনের সঙ্গে জওহরলালের অতি ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। সেই বৎসরে জওহরলাল অতীতকালের পরিব্রাজকদের মত ভারতের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত ঘুরিয়া ঘুরিয়া এই সব নূতন মতবাদ প্রচার করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। আটটী বিভিন্ন প্রদেশের বাৎসরিক কন্ফারেন্সে সভাপতিত্ব করিবার জন্য তিনি আমন্ত্রিত হন—পাঞ্জাব, দিল্লী, মালাবার এবং যুক্তপ্রদেশ। তাহা ছাড়া, বম্বে এবং বাংলা দেশে সেই বৎসরে ছাত্র বা যুবক-আন্দোলনের যতগুলি প্রধান সভা হইয়াছিল, তাহার অধিকাংশতেই তিনি সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন।
বহু সভার সভাপতিত্ব করা আমাদের দেশে খুব একটা ক্বতিত্বের পরিচয় নয়, অনেক অল্পশিক্ষিত বা অর্দ্ধশিক্ষিত লোকদের ভাগ্যেও তাহা ঘটিয়া থাকে— জওহরলাল সম্বন্ধে এই কথা উল্লেখ করিবার উদ্দেশ্য হইল যে, এই সব সভা-সমিতির মধ্য দিয়া তরুণভারতে তাহার যোগ্য প্রতিনিধির মুখ হইতে এই প্রথম স্পষ্ট ভাষায় কংগ্রেসের রাজনীতি ছাড়া, জগতের বৃহত্তর রাজনীতির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা শুনিতে পাইল, অস্পষ্ট উচ্ছাসময় সাম্যবাদের পরিবর্ত্তে কার্যকরী বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের বাস্তব পরিচয় পাইল।
ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারায়, এতদিন যে সব ভাবধারা টুক্রো টুক্রো রূপে এদিকে ওদিকে উঁকিঝুঁকি মারিতেছিল, তাহার বলিষ্ঠ আবির্ভাবে ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারায়, এক নূতন যুগের প্রবর্ত্তন হইল বলা যাইতে পারে; এবং ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস-লেখক যখন এই যুগের রাজনৈতিক ভাবধারার ইতিহাস লিখিবেন, তখন এই সব নূতন চিন্তা-ধারার আদি-প্রবর্ত্তকদের মধ্যে জওহরলালের নাম গোড়ার দিকেই তিনিই উল্লেখ করিবেন।