জওহরলাল/ষোল
ষোল
মাত্র আটদিন ছুটি ভোগ করিয়া জওহরলাল আবার সেই জেলের ভিতরে তাহার পূরানো কুঠুরিতে ফিরিয়া আসিলেন — সেখানে তাহার বন্ধুরা, সৈয়দ মাহমুদ, নর্ম্মদাপ্রসাদ এবং ভগ্নিপতি রণজিৎ পণ্ডিত অপেক্ষা করিতেছিলেন।
বিচারে এবার সব অপরাধ মিলাইয়া দীর্ঘ দুই বৎসব গাঁচ মাস সশ্রম কারাদণ্ড হইল - ইহা হইল কারাগারের সহিত তাঁহার পঞ্চম মিলন—মিলনের কাল ক্রমশ দীর্ঘতর হইয়া উঠিতে লাগিল—
বাহিরে তখন স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রুর চেষ্টায় রাউণ্ড টেবিল কন্ফারেন্সের আয়োজন চলিতেছিল-
১৯৩১ সালের ২৬শে জানুয়ারী জওহরলাল আবার কারাগার হইতে বাহির হইলেন — বাহির হইয়াই শুনিলেন যে, কমলা কারাগারে—এবং পিতা মৃত্যুশয্যায়। তাড়াতাড়ি তিনি পিতার মৃত্যুশয্যার পাশে চলিয়া আসিলেন। শেষ-শয্যায় শায়িত সেই গৌরব-সূর্য্যের দিকে চাহিয়া জওহরলাল বুঝিলেন, তাঁহার মুখে-চোখে বিদায়-গোধুলির আলো আসিয়া পড়িতেছে—জীবনের প্রথম দিন হইতে সেদিন পর্য্যন্ত যে-পিতা বন্ধুর মত— সহচরের মত—জীবনের পাশে পাশে তাঁহাকে লইয়া চলিয়াছেন—মৃত্যুর গহন পথে যে পিতার সহিত পুত্র এক অপূর্ব্ব মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ— জীবনসংগ্রামের সেই শ্রেষ্ঠ সহচর তাঁহার জীবন হইতে চলিয়া যাইবেন—এই বেদনায় জওহরলালের সংযমী চিত্তও বেদনায় ভরিয়া উঠিল—সর্ব্বকাজ পরিত্যাগ করিয়া তিনি পিতার শেষ-শয্যার পাশে জাগিয়া উঠিলেন—
মহাত্মা গান্ধী এবং সেই সঙ্গে কংগ্রেসের সমস্ত বিশিষ্ট নেতা তখন আনন্দভবনে সমবেত হইয়াছেন— রণক্লান্ত সেনাপতির শেষ-শয্যাকে ঘিরিয়া তাঁহারা আজ সকলে উপস্থিত—দুঃখের কথা নয়—বিদায়ের কথা নয়-দেশের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আসন্ন কর্ত্তব্য লইয়া তাঁহারা আলোচনা করিতেছেন— শেষ-শয্যায় শুইয়া পণ্ডিত মতিলাল তাহা শুনিতেছেন— জীবনের শেষমুহূর্ত্ত পর্যন্ত দেশের কাজে সকলের সঙ্গে তাঁহারও কাজের অংশ থাকিবে— শেষকালে এমন সময় আসিল যখন আর শ্রবণে কিছুই প্রবেশ করিতে চাহিল না - পাশের ঘরে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির আলোচনা চলিতে লাগিল। পণ্ডিত মতিলাল গান্ধীজীকে ডাকিয়া বলিলেন— “মহাত্মাজী, আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে, চল্লাম বড় দুঃখ, স্বাধীন ভারত দেখে যেতে পারলাম না, তবে এই আশ্বাস নিয়ে চল্লাম, আপনি তা অর্জন কর্বেনই, হয়ত আপনি তা অর্জন করেছেন! ”
দেশের নিকট, জাতির নিকট এই তাঁহার শেষবাণী!
৬ই ফেব্রুয়ারী সকালবেলা পিতার শয্যার পাশে সারারাত জাগিয়া বসিয়া আছেন— সারা রাত্রি বড় অস্থিরতায় কাটিয়াছে—প্রভাতে তিনি ঘুমাইয়া পড়িলেন—জওহরলাল দেখিলেন, সারারাত্রির ক্লান্তির পর প্রভাতের সেই নিদ্রায় মুখের রেখাগুলি বহুদিন পরে আবার প্রশান্ত হইয়া আসিয়াছে। সেই প্রশান্ত মুখের দিকে চাহিয়া তিনি আনন্দিত হইয়া উঠিলেন। সহসা জননীর চিৎকারে তিনি চমকাইয়া উঠিলেন! তিনি যাহা বুঝিতে পারেন নাই, নারী সহজেই তাহা বুঝিয়াছিলেন।
রণক্লান্ত বীর সত্যই ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, তবে সে নিদ্রার আর জাগরণ হইবে না।
গান্ধীজি আনন্দ-ভবনে রহিয়া গেলেন। বন্ধুহীন সেই শূন্যদিনে গান্ধীজি জওহরলালের পাশে থাকিয়া, যেভাবে তাঁহার পিতার স্থান পূরণ করিয়াছিলেন, জওহরলালের জীবনে তাহা চিরদিনের জন্য গাঁথিয়া গেল—সমস্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের বাহিরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে সেদিন তাহাদের দুজনের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়িয়া উঠিয়াছিল, জওহরলাল তাঁহার আত্মচরিতে অপূর্ব্ব ভাষায় তাহার যে বর্ণনা দিয়াছেন, প্রত্যেক মানুষের মনকে তাহা স্পর্শ করিবে।