বিষয়বস্তুতে চলুন

জওহরলাল/সাত

উইকিসংকলন থেকে

সাত

 বিধাতা যাহাকে বাঁচাইতে যান, তাহাকেই আঘাত দিয়া সচেতন করিয়া তোলেন । তাই বিধাতার আঘাত আসে কল্যাণের অগ্রদূতরূপে। মাইকেল ডায়ারের হাতে দিয়া বিধাতা সেই নির্ম্মম আঘাতে ভারতকে সচেতন করিয়া তুলিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগে যে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হইল, তাহাতে ভারতের জাতীয় আন্দোলন সহসা অতিদ্রুত অগ্রসর হইয়া গেল। যাঁহারা এতদিন পর্যন্ত দূরে সরিয়াছিলেন, তাঁহারা সর্ব্ব দ্বিধা ও সঙ্কোচ ত্যাগ করিয়া ভারতীয় জাতীয় দলের পুরোভাগেআসিয়া দাঁড়াইলেন। পণ্ডিত মতিলাল এতদিন নিয়মতান্ত্রিকতার আড়ালে দূরে সরিয়াছিলেন, জালিনওয়ালাবাগ তাঁহাকে টানিয়া আনিল। পাঞ্জাবের অনাচার সম্পর্কে তদন্ত করিবার জন্য কংগ্রেস একটা কমিটী গঠন করিল। সাক্ষাৎ তদন্তের ভার পড়িল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ও মতিলালের উপর। জওহরলাল তাহাদের সহকারীরূপে এই তদন্তের কাজে যোগদান করিলেন।

 প্রতিদিন অপমানিত, লাঞ্ছিত ও আহত লোকদের মুখে সাক্ষাৎভাবে সেই সব মর্ম্মন্তুদ অত্যাচারের কাহিনী শুনিতে শুনিতে জওহরলালের মনে তাঁহার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মপন্থা স্পষ্টমূর্ত্তিতে জাগিয়া উঠিল। এই সময় তিনি গান্ধীজি এবং দেশবন্ধুর সহিত কর্ম্মক্ষেত্রে যে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ লাভ করেন, তাহা অচ্ছেদ্য বন্ধনরূপে জীবনে স্থায়ী ভাবে রহিয়া যায়। দেশবন্ধু আজ পরলোকগত—গান্ধীজিও আজ জীবিত নাই। প্রত্যেক ভারতবাসী আজ জানে, মহাত্মা গান্ধীর মতে জওহরলাল সব সময় নিজের মত না দিতে পারিলেও, এই দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষের মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক ছিল, তাহা জগতে বিরল। .

 বস্তুত জওহরলাল যেদিন কার্য্যত কংগ্রেস আন্দোলনে যোগদান করেন, সেদিন হইতে কংগ্রেস আন্দোলনের একটা বিশেষ ত্রুটী তাঁহার মনে পীড়া দিতে থাকে।

 কংগ্রেস আন্দোলনের আগে যেদিন বাংলাদেশে প্রথম স্বদেশী আন্দোলন জাগে, জওহরলালের বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় দীক্ষিত মন সেই আন্দোলনকে পুরাপুরি রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে গ্রহণ করিতে পারে নাই। বাঙ্গালাদেশের সেই আন্দোলনের পিছনে বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত লোকদের মনোমত একটা ধর্মের উচ্ছ্বাস ছিল। তারপর যে কংগ্রেস আন্দোলন তিলক ও গান্ধীর নেতৃত্বে জাগিয়া উঠিল, তাহারও পিছনে ছিল, ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিক্ষিত লোকের মনোভাব।

 এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাহিরে, সারা ভারতবর্ষে যে অগণিত কৃষক ও শ্রমিক যুগযুগান্ত হইতে মূক হইয়া পড়িয়াছিল, যাহাদের এনে সমাজের ভিত্তি ও প্রসার, তাহাদের কথা, তাহাদের সমস্যা সেদিন কংগ্রেসের জাতীয় আন্দোলন হইতে বহু দূরে ছিল। গোড়া হইতেই জওহরলালের দৃষ্টি সেইদিকে পড়ে এবং ভাগ্যও তাঁহাকে এই পথে টানিয়া লইয়া যায় ।

 তখন জওহরলাল এলাহাবাদে। হঠাৎ শুনিলেন যে, প্রতাপগড় জেলা হইতে প্রায় দুই শত কিষাণ পঞ্চাশ মাইল পায়ে হাঁটিয়া এলাহাবাদে আসিয়াছে। যমুনার ধারে তাহারা সকলে বসিয়া আছে । অনুসন্ধান লইয়া জানিলেন যে, তালুকদারদের অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া এবং দারিদ্র্যের তাড়নায় কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ হইয়া তাহারা এলাহাবাদে আসিয়াছে। উদ্দেশ্য, এলাহাবাদের বড় বড় লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, যাহাতে তাঁহারা মধ্যস্থ হইয়া তাহাদের বিপদ হইতে উদ্ধার করেন। হঠাৎ এই সব অশিক্ষিত কিষাণদের এইভাবে সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া লইয়া আসিল কে? তাহাদের নিজেদের এমন রাজনৈতিক বুদ্ধি বা শিক্ষা নাই যে তাহারা নিজেদের দুঃখ জানাইবার এই রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করিতে পারে। জওহরলাল অনুসন্ধান লইয়া জানিতে পারিলেন যে, রামচন্দ্র নামে একজন মারাঠী বহুদিন হইতে এই সব জেলায় কিষাণদের মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া তাহাদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া তুলিয়াছেন। এই রামচন্দ্রের নেতৃত্বেই তাহারা এলাহাবাদে অসিয়াছে।

 জওহরলাল যমুনার ধারে সেই কিষাণদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। জওহরলালকে দেখিয়া সরল-প্রাণ কিষাণদের মনে হইল, নিশ্চয়ই যে ব্যক্তির দর্শন-আশায় তাহারা পঞ্চাশ মাইল হাঁটিয়া আসিয়াছে, এই সেই মহাপুরুষ। জওহরলালকে ঘিরিয়া তাহারা তাহাদের ভয়াবহ দৈন্য ও অত্যাচারের কথা সমস্ত বলিল। তাহাদের ফিরিয়া যাইতে হইবে কিন্তু ফিরিয়া যাইতে তাহাদের সাহসে কুলাইতেছে না। কারণ, তালুকদারেরা জানিতে পারিয়াছে যে, তাহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাইবার জন্যই তাহারা এলাহাবাদে আসিয়াছে। সুতরাং প্রতিশোধ লইবার জন্য তাহারা প্রস্তুত হইয়াই আছে। তাহাদের সেই ভয়ঙ্কর আক্রোশের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারে, এমন একজন লোককে সঙ্গে না লইয়া তাহারা ফিরিবে না।

 কৃষকেরা সকলে বলিয়া উঠিল, জওহরলাল সেই লোক—তাঁহাকে তাহাদের সঙ্গে যাইতেই হইবে, স্বচক্ষে দেখিয়া আসিতে হইবে, তাহারা যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহা সত্য না মিথ্যা। জওহরলালের কোন ওজর-আপত্তি তাহারা শুনিল না, তাঁহাকে না লইয়া সেই ক্রুদ্ধ তালুকদারদের সম্মুখে তাহারা কিছুতেই ফিরিবে না। অগত্যা জওহরলালকে কথা দিতে হইল যে, দুইদিন পরে তিনি নিশ্চয়ই যাইবেন।

 কয়েকজন সঙ্গীকে লইয়া নির্দিষ্ট দিনে জওহরলাল প্রতাপগড় জেলায় পরিভ্রমণে বাহির হইলেন। গ্রামে গিয়া তিনি দেখিলেন, প্রত্যেক গ্রামবাসীর মুখে চোখে যেন একটা চেতনা জাগিয়া উঠিয়াছে—কয়েক মিনিটের মধ্যে পাশাপাশি সমস্ত গ্রামের লোক তাহারা জড় করিয়া ফেলিল—এক গ্রামের সীমান্ত হইতে একজন চীৎকার করিয়া উঠিল—সী—তা—রা ম—পাশের গ্রামের লোক তাহা শুনিয়া ছুটিয়া আসিল—আসিবার সময় তাহারাও আবার পাশের গ্রামকে সী—তা—রা—ম বলিয়া ডাকিয়া আসিল ।

এইভাবে কয়েক মিনিটের মধ্যে বিশ-পঁচিশখানা গ্রামে সংবাদ চলিয়া গেল এবং দেখিতে দেখিতে দলে দলে কৃষাণরা আসিয়া জুটিতে লাগিল। জওহরলাল অবাক হইয়া দেখিলেন যে মাত্র একটি লোকের চেষ্টায় এই কিষাণরা কি ভাবে নিজেদের সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া তুলিয়াছে ।

 এই সম্পর্কে তাঁহার আত্মচরিতে তিনি লিখিয়াছেন —“আমাদের ঘিরিয়া তাহাদের অজস্র প্রীতি যেন আলোর মত ঝরিয়া পড়িতে লাগিল—কি গভীর আশায় তাহারা আমাদের দিকে চাহিয়া রহিল—যেন আমরা তাহাদের সকল দুঃখ দূর করিয়া দিব—যেন সব অত্যাচার হইতে তাহাদের রক্ষা করিয়া আমরা তাহাদের সামান্য প্রাপ্য তাহাদের দিয়া দিব। তাহাদের কাহারও অঙ্গে সম্পূর্ণ কাপড় একখানি ছিল না। তাহাদের সেই সহজ সরল প্রীতি, সেই নিদারুণ দারিদ্র্য্য, সেই সুগভীর কৃতজ্ঞতাবোধ, তাঁহার সামনে দাঁড়াইয়া থাকিতে লজ্জায় এবং দুঃখে আমাদের দেহমন যেন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল—আমাদের রাজনীতি এই সব লক্ষ লক্ষ অন্নহীন বস্ত্রহীন ভারত-মাতার পুত্রকন্যাদের কথা বাদ দিয়াই চলে — আমাদের সুখসমৃদ্ধ জীবনের পাশাপাশি অর্দ্ধনগ্ন অবস্থায় ইহারাও রহিয়াছে, আমরা তাহা ভুলিয়াও ভাবি না — সেদিন আমার চোখের সামনে আর এক ভারত মূর্ত্তি ধরিয়া জাগিয়া উঠিল, উপবাসী, লাঞ্ছিত, সর্ব্ব-অঙ্গে অত্যাচারের নখ-দন্ত আঘাতে অসহায়—একান্ত অসহায়—দূর শহর হইতে দুই একদিনের অতিথি হইয়া তাহাদের মধ্যে আসিয়াছি—তবুও আমাদেরই উপর তাহাদের সেই সুগভীর আস্থা আমার অন্তঃকরণ পর্য্যন্ত আলোড়িত করিয়া তুলিল এবং সেই সঙ্গে এক অজানা গুরুদায়িত্ব, তাহার বিরাট বোঝার ভারে আমাকে আতঙ্কিত করিয়া তুলিল।"

 তিনদিন গ্রামবাসীদের সঙ্গে বাস করিয়া জওহরলাল ফিরিয়া আসিলেন। কিন্তু ইহার পর হইতে তিনি নিয়ম করিয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন । গান্ধীজির মতবাদ তিনি মনে-প্রাণে গ্রহণ করিলেন এবং যুক্ত-প্রদেশের জাতীয়-আন্দোলনে সাক্ষাৎভাবে যোগদান করিলেন।

 তখন অসহযোগ আন্দোলনের একটা প্রবল তরঙ্গ সারা দেশকে দুলাইতেছিল। জওহরলাল তাঁহার আত্মচরিতে লিখিতেছেন,—“দেশের অন্য বহু যুবকের মত, আমি এই আন্দোলনে একেবারে ডুবিয়া গেলাম— এতদিন পর্য্যন্ত জীবনে যাহা কিছু করিয়াছি, যে সব বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, কাজ ও অকাজ লইয়া মত্ত ছিলাম, সমস্তই ভুলিয়া গেলাম—এমন কি বই পড়াও বন্ধ হইয়া গেল। সমস্ত চেতনা, সমস্ত ভাবনা, এই আন্দোলন যেন গিলিয়া লইল—চিরকাল বাড়ীর স্নেহে মানুষ হইয়া আসিয়াছি —পরিবারের সকলের সঙ্গে গভীর স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ কোমলপ্রাণ জীব আমি—কেমন করিয়া জানি না, সেই সংসার, তার সহস্র প্রীতির বন্ধন, মা, বাপ, স্ত্রী—সকলকেই ভুলিয়া গেলাম—সেই সব দিনের কথা স্মরণ করিয়া আজ ভাবি, বাড়ীর লোকদের কি বিষম যন্ত্রণার কারণই তখন ছিলাম—বিশেষ করিয়া আমার স্ত্রীর নিকট-কি অসীম ধৈর্য্য ও ক্ষ্মমা লইয়া তিনি আমার সেই উদাসীনতা সহ্য করিয়াছিলেন—দিনের পর দিন, বাড়ী ফিরিবার কথা পর্যন্ত মনে থাকিত না—অফিসে, পথে, মাঠে, ঘাটে, যখনি যেখানে চোখ বুঁজাইবার প্রয়োজন হইয়াছে ঘুমাইয়াছি—ঘর আনার নিকট হইতে বহু দূরে সরিয়া গেল— অফিস, মিটিং, জনতা সেই ছিল আমার পৃথিবী-

 “গ্রামের সহিত সম্পর্কে আসিয়া বুঝিয়াছিলাম, গ্রামের এই সব লোককে সচেতন করিয়া তুলিতে না পারিলে, আমাদের আন্দোলন বেশী দিন চলিতে পারিবে না—কংগ্রেসেরও তখন বুলি ছিল, গাঁয়ে ফিরে চল তাই গ্রামে গ্রামে অধিবাসীদের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়াইয়া তাহাদের মধ্যে প্রচার করিতে লাগিলাম— ইহাতে দেশের কাজ কতদূর আগাইয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না, কিন্তু একটা জিনিষ স্পষ্ট অনুভব করিলাম, এক আমার নিজের উন্নতি—যে আমি অপরিচিত লোকের সঙ্গে কথা বলিতে পারিতাম না, প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে যে আমি ভীত সঙ্কুচিত হইয়া উঠিতাম—সেই আমি দেখিতে দেখিতে আমার অজ্ঞাতে সর্ব্ব-দ্বিধা, সর্ব্ব-জড়তা হইতে মুক্ত হইয়া উঠিলাম— জনতার মাঝখানে গিয়া পড়িলেই বুঝিতে পারিতাম, সেই মূক জনতার মনে কি হইতেছে—যাহাদের চিনিতাম না, জানিতাম না, তাহাদের দেখিলেই তাহাদের মনের সংবাদ পর্য্যন্ত যেন চোখে ধরা পড়িয়া যাইত—আমার দম্ভে আমি ছিলাম একাকী — সহসা আমার সেই একাকিত্ব ভাঙ্গিয়া-চুরিয়া আমিও জনতার একজন হইয়া গেলাম-আমি জনতাকে চিনিলাম, জনতাও আমাকে চিনিল-”

 অসহযোগ আন্দোলনের মুখে গভর্ণমেণ্ট নির্বিচারে দলে দলে লোককে কারারুদ্ধ করিয়াছিল। কিন্তু তাহার ফলে কারাগার সব ভরিয়া উঠিল—কারাগার নিয়ন্ত্রণের নানা সমস্যা জাগিয়া উঠিল। তখন গভর্ণমেণ্ট দলশুদ্ধ লোককে এক সঙ্গে কারারুদ্ধ করার নীতি পরিত্যাগ করিয়া বাছিয়া বাছিয়া “মাথা”গুলিকে ধারয়া রাখিতে লাগিল। এই নীতির ফলে কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা একে একে সবাই তখন কারাগারে গিয়ে উঠিতে লাগিলেন। সারা দেশময় একটা ধর-পাকড়ের রব পড়িয়া গেল। ভারতীয় সৈন্য-মহলে বিদ্রোহ প্রচার করার অপরাধে আলী ভ্রাতৃদ্বয় ইতিমধ্যেই কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন। ঠিক সেই সময় প্রিন্স অফ ওয়েল্‌স ‌ ভারত পরিভ্রমণে আসিলেন। গভর্ণমেণ্ট প্রিন্স অফ ওয়েল্‌‌স্-কে অভ্যর্থনা করিবার জন্য তিনি যেখান যেখান দিয়া যাইবেন, সেখানে সেখানে প্রকাশ্য অভিবাদন ও উৎসবের আয়োজন করিল। কংগ্রেস তাহার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করিল, যুবরাজ যেখান দিয়া যাইবেন, জনতা যেন সেই সংক্রান্ত সমস্ত উৎসব বয়কট করে, সেদিন যেন সকলেই হরতাল পালন করে। কংগ্রেসের এই চাল ব্যর্থ করিবার জন্য, গভর্ণমেণ্ট বাংলা কংগ্রেসের ভলানটিয়ার বাহিনীকে বে-আইনী সঙ্ঘ বলিয়া ঘোষণা করিলেন।

 বাংলার নিরুদ্ধ-কণ্ঠ আত্মা দেশবন্ধুর বাণীতে অমর ভাষা পাইল, ‘আমার দুই হাতে মনে হইতেছে লৌহশৃঙ্খলের দাগ পড়িয়া গিয়াছে, সারা দেহে শৃঙ্খলের বোঝা-বন্ধনের জ্বালায় দেহমন অগ্নিময়—সারা ভারত আজ বন্ধনশালা - এক বিরাট কারাগারযদি আমি কারাগারে যাই বা তাহার বাহিরে থাকি, তাহাতে কি যায় আসে? যদি আমি এই পৃথিবীতেই না থাকি, তাহা হইলেই বা কি যায় আসে?'

 এই জ্বালাময় বাণী সেদিন অন্য বহু যুবকের মনে যে ব্রত উদযাপনের প্রতিভা জাগাইয়া তুলিয়াছিল, জওহরলালের চিত্তেও তাহা এক অপূর্ব্ব অনুরণন জাগাইয়া তুলিল। গভর্নমেণ্ট যুক্ত-প্রদেশের কংগ্রেসবাহিনীকেও বে-আইনী সঙ্ঘ বলিয়া ঘোষণা করিল। জওহরলাল গভর্ণমেণ্টের এই হুমকীর প্রতিবাদে নিজের প্রদেশের ভলানটিয়ার বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করিয়া গড়িয়া তুলিবার জন্য আগাইয়া চলিলেন। প্রতিদিন কাগজে ভলানটিয়ারদের নামের তালিকা প্রকাশিত হইতে লাগিল। প্রথম নাম পড়িল, পণ্ডিত মতিলালের। গভর্ণমেণ্টও কালবিলম্ব না করিয়া আবার ধর-পাকড় শুরু করিল! দলে দলে ভলান্‌‌টিয়ার কারারুদ্ধ হইতে লাগিল।

 জওহরলাল বুঝিলেন, অগ্নি-মন্ত্রে দীক্ষার লগ্ন তাহার আগাইয়া আসিতেছে।যে পথে দলে দলে তাহার সহকর্ম্মীরা কারা-তীর্থে চলিয়াছে, এতদিন পরে সেই পথে তাঁহাকেও চলিতে হইবে। সে পথের আহ্বান স্পষ্ট শুনিতে পাইলেন। কারাগারের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ পরিচয় তখনও হয় নাই। এক অজানা অনুভূতির নূতনত্বে তাঁহার মন ভরিয়া উঠিল। কবে কোন্ সময়ে ডাক পড়িবে, তাই তিনি কংগ্রেস অফিসে দ্বিগুণ উদ্যমে সমস্ত কাজ সারিয়া লইবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন।

 এই সময়কার ঘটন! সম্পর্কে তিনি লিখিতেছেন— “সেদিন কংগ্রেস আফিসে কাজ করিতে করিতে বেলা হইয়া গিয়াছিল, এমন সময় অফিসের একজন কেরাণী উত্তেজিত অবস্থায় ছুটিয়া আসিয়া জানাইলেন, পুলিশের লোকে ওয়ারেণ্ট লইয়া আসিয়াছে—বাড়ী ঘেরাও করিতেছে—আমিও যে এই সংবাদে উত্তেজিত হইয়া উঠি নাই, তাহা নয় কারণ আমার জীবনে সেই হইল এই বিষয়ের প্রথম অভিজ্ঞতা—কিন্তু সেই উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে যৌবনসুলভ এক বাহাদুরী জাগিয়া উঠিল, ভিতরে যতই উত্তেজিত হই না কেন, আমার অফিসের লোকদের সামনে তাহা কিছুতেই প্রকাশ করা হইবে না-পুলিশ আসুক বা যাক, আমি তাহাতে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ থাকিব, এমনিধারা উদাসীন সাজিয়া গেলাম — সেইজন্য একজন কেরাণীকে ডাকিয়া গম্ভীরভাবে আদেশ দিলাম, সার্চের সময় তিনি যেন পুলিশ কর্মচারীর সঙ্গে থাকিয়া তাঁহার সাহায্য করেন এবং অফিসের অন্য সব কেরাণীদের বলিলেন, তাঁহারা যেমন কাজ করিতেছেন, তেমনি করিয়া চলুন। কোথাও যে কিছু ঘটিতেছে, তাহা যেন আমাদের কাজে বা কথায় ধরা না পড়ে ।

 “এই সময় আমারই এক সহকর্মী অফিসের বাহিরে ধরা পড়েন; একজন পুলিসের সঙ্গে তিনি আমার নিকট বিদায় লইতে আসিয়াছিলেন। তখন এই বাহাদুরীর উন্মাদনায় আমি এমনি মত্ত যে, স্মরণ করিতে বেদনায় ও লজ্জায় মন ভরিয়া যায়, আমি এই বিদায়-গ্রহণ ব্যাপারটাকেই কোন আমল দিলাম না এবং একান্ত উদাসীন ভাবে বন্ধুটির আগ্রহের কোন উত্তরই দিলাম না। আমার নিকটে যখন পুলিস আসিল, আমি চিঠি লিখিতেছিলাম। গভীরভাবে পুলিসকে অপেক্ষা করিতে বলিলাম, যতক্ষণ আমার চিঠি লেখা না শেষ হয়—তারপর পুলিসের সঙ্গে বাড়ী আসিলাম। সেখানে শুনিলাম, পিতার এবং আমার একই সঙ্গে ওয়ারেণ্ট বাহির হইয়াছে!”

 পিতা ও পুত্রে একই সঙ্গে সেদিন যে-যাত্রা সুরু করিলেন, তাহ! শুধু মৃত্যু আসিয়াই ছিন্ন করিতে পারিয়াছিল।