জননী/ছয়

উইকিসংকলন থেকে

ছয়

শীতলের জেল হইয়াছে দু’বছর।

 শ্যামা একজন ভাল উকিল দিয়াছিল। শীতলের এই প্রথম অপরাধ। টাকাও কমলবাবু প্রায় সব ফিরিয়া পাইয়াছিলেন—শ্যামা যে হাজার টাকা লুকাইয়া ফেলিয়াছিল আর শীতল যে শ’তিনেক খরচ করিয়াছিল, সেটা ছাড়া। জেল শীতলের ছ’মাস হইতে পারিত, এক বছর হওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু শীতলের কিনা মাথায় ছিট আছে, বিচারের সময় হাকিমকে সে যেন একদিন কি সব বলিয়াছিল—যেসব কথা মানুষকে খুসি করে না। তাই শীতলকে হাকিম কারাবাস দিয়াছিলেন আঠার মাস আর জরিমানা করিয়া ছিলেন দু’হাজার টাকা, অনাদায়ে আরও দশ মাস কারাবাস। জরিমানা দিলে কমলবাবু অর্ধেক পাইতেন, অর্ধেক যাইত সরকারী তহবিলে। এই জরিমানার ব্যাপারটা শ্যামাকে ক’দিন বড় ভাবনায় ফেলিয়াছিল। মামা না থাকিলে সে কি করিত বলা যায় না। বকুলকে শীতল যেদিন গভীর রাত্রে ফিরাইয়া দিতে আসিয়াছিল, সেদিন দু’টি ঘণ্টা সময়ের মধ্যে তাদের যেন একটা অভূতপূর্ব ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া গিয়াছিল, দুই যুগ একত্র বাস করিয়াও তাহাদের যাহা আসে নাই: স্বামীর জন্য সে রাত্রে বড় মমতা হইয়াছিল শ্যামার। কিন্তু মামা তাহাকে বুঝাইয়া দিয়াছিল জরিমানার টাকা দেওয়াটা বড় বোকামির কাজ হইবে, বিশেষত বাড়ি বাঁধা না দিয়া যখন পূরা টাকাটা যোগাড় হইবে না—টাকা কই শ্যামার? হাজার টাকার নম্বর দেওয়া নোটগুলি তো এখন বাহির করা চলিবে না। বাহির করা চলিলেও আরেক হাজার টাকা? কাজ নাই ওসব দুর্বুদ্ধি করিয়া। আঠার মাস যাকে কয়েদ খাটিতে হইবে সে আর দশ মাস বেশি কাটাইতে পারিবে না জেলে! দশ মাসই বা কেন? বছরে ক মাস জেল যে মকুব হয়। তাবপব শেষের চার ছ’মাস জেলে থাকিতে কয়েদীর কি আর কষ্ট হয়? তখন নামে মাত্র কয়েদী, সকালে বিকালে একবার নাম ডাকে, বাস, তারপর কয়েদীর যেখানে খুসি যায় যা খুসি করে,—রাজার হালে থাকে।

 বাড়িতেও তো আসতে পারে, তবে এক আধ ঘণ্টার জন্যে?

 না তা পাবে না,—জেলের বাইরে যেতে আসতে দেয়, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে এর ওর সঙ্গে কথা বলতে দেয়, তাই বলে নজর কি রাখে না একেবারে? তাছাড়া কয়েদীর পোষাক পরে কোথায় যাবে?—কেউ ধরে এনে দিলে তো শেষ পর্যন্ত দাঁড়াবে পালিয়ে যাচ্ছিল।— আবাব দেবে ছ’মাস ঠুকে। জেলের কাণ্ডকারখানার কথা আর বলিসনে শ্যামা, মজার জায়গা জেল—শীতল যত কষ্ট পাবে ভাবছিস তা সে পাবে না, ওই প্রথম দিকে একটু যা মনের কষ্ট।

 উৎসাহের সঙ্গে গড়গড় করিয়া মামা বলিয়া যায় অবাধ অকুণ্ঠ। কত অভিজ্ঞতাই জীবনে মামা সংগ্রহ করিয়াছে।

 শ্যামা সজল চোখে বলিয়াছিল, এত খবরও তুমি জান মামা। তুমি না থাকলে কি যে করতাম আমি—ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যেতাম।—বছরে ক’মাস কয়েদ মকুব করে মামা? ভাল হয়ে থাকলে বোধ হয় শীগগির ছেড়ে দেয়। একদিন গিয়ে দেখা করে বলে আসব, ভাল হয়েই যেন থাকে।

 পাড়ায় ব্যাপারটা জানজানি হইয়া গিয়াছে। পাড়ার যেসব বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে শ্যামার জানাশোনা ছিল, শ্যামার সঙ্গে তাহাদের ব্যবহারও গিয়াছে সঙ্গে সঙ্গে বদলাইয়া। কেহ সহানুভূতি দেখায় নীরবে ও সরবে: কেহ কোন রকম অনুভূতিই দেখায় না বিস্ময় সমবেদনা অবহেলা কিছুই নয়। পাড়ার নকুড়বাবুর পরিবারের সঙ্গে শ্যামার ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি এখন ওদের বাড়ি গেলে ওরা বসিতে বলিতে ভুলিয়া যায়, সংসারের কাজের চেয়ে শ্যামার দিকে নজর একটু বেশি দিতে মনে থাকে না। কথা বলিতে বলিতে ওদের কেমন উদাস বৈরাগ্য আসে। কত যেন শ্রান্ত ওরা। চোয়াল ভাঙিয়া এখুনি হাই উঠিবে। শ্যামার বাড়িতে যারা বেড়াইতে আসিত, তাদের মধ্যে তারাই শুধু আসা যাওয়া সমানভাবে বজায় রাখিয়াছে। এমন কি বাড়াইয়াও দিয়াছে। যারা আসিলে শ্যামার সম্মান নাই, না আসিলে নাই অপমান।

 বিধান এতকাল শঙ্করের সঙ্গে বাড়ির গাড়িতে স্কুলে গিয়াছে, একদিন দশটার সময় বই-খাতা লইয়া বাহির হইয়া গিয়া খানিক পরে সে আবার ফিরিয়া আসিল। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল, স্কুলে গেলি নে?

 শঙ্করকে নিয়ে গাড়ি চলে গেছে মা।

 তোকে না নিয়েই চলে গেল? কেন রে খোকা, দেরি করে তো যাস নি তুই?

 পরদিন আরও সকাল সকাল বিধান বাহির হইয়া গেল, আজও সে ফিরিয়া আসিল খানিক পরেই, মুখখানা শুকনো করিয়া। শ্যামা তখন বকুলকে ভাত দিতেছিল। সে বলিল, আজকেও গাড়ি চলে গেছে নাকি খোকা?

 বিধান বলিল, ড্রাইভার আমাকে গাড়িতে উঠতে দিলে না মা, বললে, মাসিমা বারণ করে দিয়েছে—

 এমন টনটনে অপমান জ্ঞান বিধানের? থামের আড়ালে সে লুকাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে, সে যেন অপরাধ করিয়া কার কাছে মার খাইয়া আসিয়াছে। শ্যামা বকুলকে ভাত দিয়া রান্নাঘরে পলাইয়া যায়। অতবড় ছেলে তাহার অপমানিত হইয়া ঘা খাইয়া আসিল, ওকে সে মুখ দেখাইবে কি করিয়া?

 দুপুরবেলা শ্যামা বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়িতে গেল। দোতলায় বিষ্ণুপ্রিয়ার নিভৃত শয়নকক্ষ, সিঁড়ি দিয়া শ্যামা উপরে উঠিতে যাইতেছিল, রান্নাঘরের দাওয়া হইতে বিষ্ণুপ্রিয়ার ঝি বলিল, কোথা যাচ্ছ মা হনহন করে?—যেও নি, গিন্নিমা ঘুমুচ্ছে,—এমনি ধারা সময় কারো বাড়ি কি আসতে আছে? যাও মা এখন, বিকেলে এসো।

 শ্যামা বলিল, দিদির হাসি শুনলাম যে ঝি? জেগেই আছেন।

 ঝি বলিল, হাসি শুনবে নি তো কি কান্না শুনবে মা? ওপরে এখন যেতে মানা যেও না।

 শ্যামা অগত্যা বাড়ি ফিরিয়া গেল। ভাবিল, পাঁচটার সময় আর একবার আসিয়া বলিয়া দেখিবে, উপায় কি। বিধানের তো স্কুলে না গেলে চলিবে না? বাড়ি ফিরিতেই বিধান বলিল, কোথা গিয়েছিলে মা?

 ওই ওদের বাড়ি।

 কাদের বাড়ি বিধান জিজ্ঞাসা করিল না। ছেলেবেলা হইতে শ্যামা এই ছেলেটিকে অদ্ভুত বলিয়া জানে, রহস্যময় বলিয়া জানে, ছ’বছর বয়সে এই ছেলে তাহার উদাস নয়নে দুর্বোধ্য স্বপ্ন দেখিত, ডাকিলে সাড়া মিলিত না, কথা কহিয়া খেলা দিয়া না যাইত হাসানো, না চলিত ভোলানো। আর নিষ্ঠুর? সময় সময় শ্যামার মনে হইত ছেলে যেন পাষাণ, রক্তমাংসে তৈরি বুক ওর নাই। তারপর ওর প্রকৃতির কত বিচিত্র দিক স্পষ্ট হইয়া উঠিয়া আবার ওর মধ্যেই কোথায় লুকাইয়া গিয়াছে,—একটির পর একটি দুর্বোধ্যতা, রাশি রাশি মুখোস পরিয়া সে যেন জন্মিয়াছিল, একে একে খুলিয়া চলিয়াছে, ওর আসল পরিচয় আজো শ্যামা চিনিল না। কত সময় সে ভয় পাইয়া ভাবিয়াছে, বাপের পাগলামিই কি ছেলের মধ্যে প্রবলতর হইয়া দেখা দিতেছে, ওকি একদিন পাগল হইয়া যাইবে? অত কি ভাবে ও? সময় সময় জননীর উন্মাদ ভালবাসাকে কেমন করিয়া দুপায়ে মাড়াইয়া চলে অতটুকু ছেলে! বিধানকে মনে মনে শ্যামা ভয় করে। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ি যাওয়ার কথা ওকে সে বলিতে পারিল না।

 বিধান বলিল, ওদের গাড়িতে আমি আর স্কুলে যাব না মা, কখ্‌খনো কোনদিন যাব না।

 ওরা যদি আদর করে ডাকতে আসে?

 ডাকতে এলে মেরে তাড়িয়ে দেব।

 শুনিয়া শ্যামারও মনে হইল এই তো ঠিক, অত অপমান তাহারা সহিবে কেন? যাদের মোটর নাই ছেলে কি তাদের স্কুলে যায় না? সহসা উদ্ধত আত্মসম্মান জ্ঞানে শ্যামার হৃদয় ভরিয়া গেল। না, শঙ্করের সঙ্গে গাড়িতে তাহার ছেলেকে স্কুলে যাইতে দেওয়ার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়ার তোষামোদ সে করিবে না।

 পরদিন মামার সঙ্গে ছেলেকে সে স্কুলে পাঠাইয়া দিল। বলিল, এ মাসের ক’টা দিন মোটে বাকি আছে, একটা দিন ট্রামে নগদ টিকিট কিনে ওকে স্কুলে দিয়ে এসো নিয়ে এসো মামা, এ’কদিন তোমার সঙ্গে এলে গেলে তারপর ও নিজেই যাতায়াত করতে পারবে, মাস কাবারে কিনে দেব একটা মাসিক টিকিট।

 বিধান অবজ্ঞার সুরে বলিল, যা তুমি খালি ভাব!—আমার চেয়ে কত ছোট ছেলে একলা ট্রামে চেপে স্কুলে যায়। আমি যেখানে খুসি যেতে পারি মা,—যাইনি ভাবছ? ট্রামে করে কদ্দিন গেছি চিড়িয়াখানায় চলে।

 শ্যামা স্তম্ভিত হইয়া বলিল, স্কুল পালিয়ে একলাটি তুই চিড়িয়াখানায় যাস্ খোকা।

 বিধান বলিল, রোজ নাকি। একদিন দুদিন গেছি মোটে—স্কুল পালাইনি তো। প্রথম ঘণ্টা ক্লাশ হলে কদ্দিন আমাদের ছুটি হয়ে যায়, ক্লাশের একটা ছেলে মরে গেলে আমরা বুঝি স্কুল করি? এমনি হৈ চৈ করি যে হেডমাস্টার ছুটি দিয়ে দেয়।

 প্রথম প্রথম শীতলের জন্য বকুল কাঁদিত। দোতলার ঘরখানা শ্যামা তাহাদের শয়নকক্ষ করিয়াছে, দামি জিনিসপত্রের বাক্স প্যাঁটরা বাড়তি বাসন কোসনও ওই ঘরে থাকে। সকালে বিকালে ওঘরে কেহ থাকে না, শুধু বকুল আপন মনে পুতুল খেলা করে। পুতুল খেলিতে খেলিতে বাবার জন্য নিঃশব্দে সে কাঁদিত। মনের মানুষকে না দেখাইয়া অতটুকু মেয়ের গোপন কান্না স্বাভাবিক নয়, কি মন বকুলের কে জানে। কোন কাজে উপরে গিয়া শ্যামা দেখিত মুখ বাঁকাইয়া চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে বকুল তাহার পুতুল পরিবারটিকে খাওয়াইতে বসাইয়াছে। মেয়ে কার জন্য কাঁদে শ্যামা বুঝিতে পারিত। এ বাড়িতে সেই জেলের কয়েদীটাকে ও ছাড়া আর তো কেহ কোনদিন ভালবাসে নাই। মেয়েকে ভুলাইতে গিয়া শ্যামারও কান্না আসিত।

 মেয়েকে কোলে করিয়া পুরানো বাড়ির ছাদে নূতন ঘরে ঝক্‌ঝকে দেখলে ঠেস দিয়া শ্যামা বসিত বুজিত চোখ। শ্যামার কি শ্রান্তি আসিয়াছে? আগের চেয়ে খাটুনি এখন কত কম, তাই সম্পন্ন করিতে সে কি অবসন্ন হইয়া পড়ে?

 শীতলের জেলে যাইতে যাইতে শীত কমিয়া আসিতে আরম্ভ করিয়াছিল। শীতলের জেলে যাওয়াটা অভ্যাস হইয়া আসিতে আসিতে শহরতলী যেন বসন্তের সাড়া পাইয়াছে। ধানকলের চোঙাটার কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া উত্তরে উড়িয়া যায়, মধ্যাহ্নে যে মৃদু উষ্ণতা অনুভূত হয তাহা যেন যৌবনের স্মৃতি। শ্যামার কি কোনদিন যৌবন ছিল? কি করিয়া সে চারটি সন্তানের জননী হইয়াছে, শ্যামার তো তা মনে নাই। আজ সে দারুণ বিপন্ন, স্বামী তার জেল খাটিতেছে, উপার্জনশীল পুরুষের আশ্রয় তাহার নাই, ভবিষ্যত তাহার অন্ধকার, শহরতলীতে বন-উপবনের বসন্ত আসিলেও জীবনে কবে তাহার যৌবন ছিল তা কি শ্যামার মনে পড়া উচিত? কি অবান্তর তার বর্তমান জীবনে এই বিচিত্র চিন্তা? মুমূর্ষুর কাছে যে নাম-কীর্তন হয়, এ যেন তারই মধ্যে সুর তাল লয় মান খুঁজিয়া বেড়ানো।

 জেলের কয়েদী বাপের জন্য যে মেয়ের চোখের জল, তাকে কোলে করিয়া স্বামীর বিরহে সকাতর হওয়া কর্তব্য কাজ, কিন্তু জননী শ্যামা, তুমি আবার ছেলে চাও শুনিলে দেবতারা হাসিবেন যে, মানুষ যে ছি ছি করিবে।


 মামা বলে, এইবার উপার্জনের চেষ্টা সুরু করি শ্যামা, কি বলিস?

 শ্যামা বলে, কি চেষ্টা করবে?

 মামা রহস্যময় হাসি হাসিয়া বলে, দেখ না কি করি। কলকাতায় উপার্জনের ভাবনা। পথে ঘাটে পয়সা ছড়ানো আছে, কুড়িয়ে নিলেই হ’ল।

 একটা দুটো ক’রে নোটগুলো বদলানো আরম্ভ করলে হয় না?

 তুই ভারি ব্যস্তবাগীশ শ্যামা। থাক না, নোট কি পালাচ্ছে? সংসার তোর অচলও তো হয়নি বাবু এখনো।

 হয়নি, হতে আর দেরি কত?

 সে যখন হবে, দেখা যাবে তখন, এখন থেকে ভেবে মরিস কেন?

 মামার সম্বন্ধে শ্যামা একটু হতাশ হইয়াছে। মামার অভিজ্ঞতা প্রচুর, বুদ্ধিও চোখা, কিন্তু স্বভাবটি ফাঁকিবাজ। মুখে মামা যত বলে কাজে হয়ত তার খানিকটা করিতে পারে, কিন্তু কিছু না করাই তাহার অভ্যাস। কোন বিষয়ে মামার নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই। পদ্ধতির মধ্যে মামা হাঁপাইয়া ওঠে। গা লাগাইয়া কোন কাজ করা মামার অসাধ্য, আরম্ভ করিয়া ছাড়িয়া দেয়। নকুড়বাবু ইনসিওরেন্স বেচিয়া খান, তাঁকে বলিয়া কহিয়া শ্যামা মামাকে একটা এজেন্সী দিয়াছিল, মামারও প্রথমটা খুব উৎসাহ দেখা গিয়াছিল, কিন্তু দুদিন দু’একজন লোকের কাছে যাতায়াত করিয়াই মামার ধৈর্য ভাঙিয়া গেল, বলিল, এতে কিছু হবে না শ্যামা, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে টাকার দরকার, লোককে ভজিয়ে ভাজিয়ে ইনসিওর করিয়ে পয়সার মুখ দেখা দুদিনের কম্ম নয় বাবু, আমার ওসব পোষাবে না। দোকান দেব একটা।

 শ্যামা বলিল, দোকান দেবার টাকা কই মামা?

 মামা রহস্যময় হাসি হাসিয়া বলিল, থাম না তুই, দেখ না আমি কি করি।

 শ্যামা সন্দিগ্ধ হইয়া বলিল, আমার সে হাজার টাকায় যেন হাত দিও না মামা।

 মামা বলিল, ক্ষেপেছিস শ্যামা, তোর সে টাকা তেমনি পুলিন্দে করা আছে।

 সকালে উঠিয়া মামা কোথায় চলিয়া যায়, শ্যামা ভাবে রোজগারের সন্ধানে বাহির হইয়াছে। শহরে গিয়া মামা এদিক ওদিক ঘোরে কোথাও ভিড় দেখিলে দাঁড়ায়, সংএর মত বেশ করিয়া আধ ঘণ্টা ধরিয়া দুটি একটি সহজ ম্যাজিক দেখাইয়া যাহারা অষ্টধাতুর মাদুলি বিষ তাড়ানো ভূত-ছাড়ানো শিকড় বিক্রয় করে, ধৈর্য সহকারে মামা গোড়া হইতে শেষ পর্যন্ত তাহাদের লক্ষ্য করে। ফুটপাতে যে সব জ্যোতিষী বসিয়া থাকে তাদের সঙ্গে মামা আলাপ করে। কোনদিন সে স্টেশনে যায়, কোনদিন গঙ্গার ঘাটে, কোনদিন কালিঘাটে। যে সব ছন্নছাড়া ভবঘুরে মানুষ মানুষকে ফাঁকি দিয়া জীবিকা অর্জন করিয়া বেড়ায় দেখিতে দেখিতে তাদের সঙ্গে মামা ভাব জমাইয়া ফেলে সুখ দুঃখের কত কথা হয়। সাধু নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, শহরে যেমন জাঁকজমক রোজগারের সুবিধা তেমন নয়। বড় বেয়াড়া শহরের লোকগুলি। মফঃস্বলের যাহারা শহরে আসে শহরে পা দিয়া তারাও যেন চালাক হইয়া ওঠে। নাঃ শহরে সুখ নাই। মামা বলে, গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলে কি শহরে সাধুর পয়সা আছে দাদা, যাও না, শিশিতে জল পূরে ধাতুদৌর্বল্যের ওষুধ বেচ না গিয়ে যত ফেনা কাটবে মুখে তত বিক্রি। পথ মামা রোজই হারায়, সে আরেক উপভোগ্য ব্যাপার। পথ জিজ্ঞাসা করিলে কলিকাতার মানুষ এমন মজা করে। কেউ বিনাবাক্যে গট গট করিয়া চলিয়া যায় কেউ জলের মত করিয়া পথের নির্দেশটা বুঝাইয়া দিতে চাহিয়া উত্তেজিত অস্থির হইয়া ওঠে। মন্দ লাগে না মামার। শহরের পথও অন্তহীন শহরের পথেও অফুরন্ত বৈচিত্র্য ছড়ানো। ঘুরিয়া ঘুরিয়া ক্লান্তি আসিবে এতবড় ভবঘুরে কে আছে? প্রত্যহ মামা শহরেই কারো বাড়িতে অতিথি হইয়া দুপুরের খাওয়াটা যোগাড় করিবার চেষ্টা করে, কোনদিন সুবিধা হয়, কোনদিন হয় না। বাড়িতে আজকাল খাওয়া দাওয়া তেমন ভাল হয় না, শ্যামা বড় কৃপণ হইয়া পড়িয়াছে।

 কিছু হ’ল মামা?—শ্যামা জিজ্ঞাসা করে।

 মামা বলে, হচ্ছে রে হচ্ছে। বলতে বলতে কি আর কিছু হয়?

 এদিকে শ্যামার টাকা ফুরাইয়া গিয়াছে। নগদ যা কিছু সে জমাইয়াছিল, ঘর তুলিতে, শীতলের জন্য উকিলের খরচ দিতেই তাহা প্রায় নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল, বাকি টাকায় ফাল্গুন মাস পর্যন্ত খরচ চলিল, তারপর আর কিছুই রহিল না। বড়দিনের সময় রাখাল আসিয়াছিল, টাকা আসে নাই। ইতিমধ্যে শ্যামা তাহাকে দুখানা চিঠি দিয়াছে, দশ বিশ করিয়াও শ্যামার পাওনাটা সে কি শোধ করিতে পারে না? জবাব দিয়াছে মন্দা, লিখিয়াছে, পাওনার কথা কি লিখেছ বৌ, উনি যা পেতেন তার চেয়েও কম টাকা নিয়েছিলেন দাদার কাছ থেকে, যাই হোক, তুমি যখন দুরবস্থায় পড়েছ বৌ, তোমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করা আমাদের উচিত বৈ কি, এ মাসে পারব না, সামনের মাসে কিছু টাকা তোমায় পাঠিয়ে দেব।

 কিছু টাকা, কত টাকা? কুড়ি।

 সেদিন বোধ হয় চৈত্র মাসের সাত তারিখ। বাড়িতে মেছুনি আসিয়াছিল। একপোয়া মাছ রাখিয়া পয়সা আনিতে গিয়া শ্যামা দেখিল দুটি পয়সা মোটে তাহার আছে। বাক্স প্যাঁটরা হাতড়াইয়া ক’দিন অপ্রত্যাশিতভাবে টাকাটা সিকিটা পাওয়া যাইতেছিল, আজও তেমনি কিছু পাওয়া যাইবে শ্যামা করিয়াছিল এই আশা,—কিন্তু দুটি তামার পয়সা ছাড়া আর কিছুই সে খুঁজিয়া পাইল না।

 মাছের দু’ আনা দাম মামাই দিল।

 শ্যামা বলিল, এমন করে আর একটা দিনও তো চলবে না মামা? একটা কিছু উপায় কর? দু’চারখানা নোট তুমি নিয়ে এসো সেই টাকা থেকে, তারপর যা কপালে থাকে হবে।

 মামা বলিল, টাকা চাই?―নে না বাবু দু’পাঁচ টাকা আমারি কাছ থেকে, আমি তো কাঙাল নই? বলিয়া মামা দশটা টাকা শ্যামাকে দিল।

 মামার তবে টাকা আছে নাকি? লুকাইয়া রাখিয়াছে? শ্যামা বলিল, দশ টাকায় কি হবে মামা? চাদ্দিকে অভাব খাঁ খাঁ করছে, কোথায় ঢালব এ টাকা?

 এখনকার মত চালিয়ে নে মা, ফুরিয়ে গেলে বলিস্।

 আর ক’টা দাও। খোকার মাইনে, দুধের দাম—

 মামা হাসিয়া বলিল, আর কোথায় পাব?

 কিন্তু শ্যামার মনে সন্দেহ ঢুকিয়াছে, কিছু টাকা মামা নিশ্চয় লুকাইয়া রাখিয়াছে, এমনি চুপ করিয়া থাকে, অচল হইলে পাঁচ টাকা দশ টাকা বাহির করে। অবিলম্বে আরও বেশি টাকার প্রয়োজন শ্যামার ছিল না, তবু মামার সঙ্গতি আঁচ করিবার জন্য সে পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। মামা শেষে রাগ করিয়া বলিল, বললাম নেই, বিশ্বাস হ’ল না বুঝি? দেখগে আমার ব্যাগ খুঁজে।

 ব্যাগ মামার শ্যামা আগেই খুঁজিয়াছে। দু’খানা গেরুয়া বসন, একটা গেরুয়া আলখাল্লা, কতকগুলি রুদ্রাক্ষ ও স্ফটিকের মালা, কতকগুলি কালো কালো শিকড়, কাঠের একটা কাঁকুই, টিনের ছোট একটি আরসি আর এমনি দুটো চারটে জিনিস মামার সম্বল। পয়সা কড়ি ব্যাগে কিছুই নাই। তবু মামার যে টাকা নাই শ্যামা তাহা পুরাপুরি বিশ্বাস করিতে পারিল না।

 দশটা টাকা যে কোথা দিয়া শেষ হইয়া গেল শ্যামা টেরও পাইল না। মামার কাছে হাত পাতিলে এবার মামা সঙ্গে সঙ্গে টাকা বাহির করিয়া দিল না, বকিতে বকিতে বাহির হইয়া গিয়া একবেলা পরে আবার দশ টাকার একটা নোট আনিয়া দিল। শ্যামার প্রশ্নের জবাবে বলিল, শিষ্য দিয়াছে।

 চৈত্র মাসের মাঝামাঝি ইংরাজি মাস কাবার হইলে একদিন সকালে শ্যামা রাণীকে জবাব দিল। রাণীকে সে দু’মাস আগেই ছাড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিল, ঝি রাখিবার সামর্থ্য তাহার কোথায়?—মামার জন্য পারে নাই। মামা বলিয়াছিল, বড় তুই ব্যস্তবাগীশ শ্যামা, এত খরচের মধ্যে একটা ঝির মাইনে তুই দিতে পারবি নে, কত আর মাইনে ওর? আগে অচল হোক, তখন ছাড়াস, একা একা তুই খেটে খেটে মরবি, আমি তা দেখতে পারব না শ্যামা—। এবার মামাকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই রাণীকে শ্যামা বিদায় করিয়া দিল। সারাদিন টহল দিয়া সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়া মামা খবরটা শুনিয়া বলিল, তাই কি হয় মা! এতগুলো ছেলেমেয়ে, একা তুই পারবি কেন? ওসব বুদ্ধি করিস নে, এমনি যদি খরচ চলে একটা ঝির খরচও চলবে। আমি ওর মাইনে দেব’খন যা।

 সকালে মামা নিজে গিয়া রাণীকে ডাকিয়া আনিল। বলিল, এমনি তো কাজের অন্ত নেই, বাসনমাজা ঘর-ধোয়ার কাজও যদি তোকে করতে হয় শ্যামা, ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে কে তাকাবে লো, ভেসে যাবে না ওরা? এ বুড়ো যদ্দিন আছে, সংসার তোর একভাবে চলে যাবে শ্যামা, কেন তুই ভেবে ভেবে উতলা হয়ে উঠিস্?

 শ্যামার চোখে জল আসে। কলতলায় রাণী বাসন মাজিতেছে,—এতক্ষণ ও কাজ তাকেই করিতে হইত, নিজের মামা ছাড়া তাহা অসহ্য হইত কার? সংসারে আত্মীয়ের চেয়ে আপনার কেহ নাই। মানুষ করিয়া বিবাহ দিয়াছিল, তারপর কুড়ি বছর দেশবিদেশে ঘুরিয়া আসিয়া আত্মীয় ছাড়া কে মমতা ভুলিয়া যায় না?

 শ্যামাকে উপার্জনের অনেক পন্থার কথা শুনাইবার পর যে পন্থাটি অবলম্বন করা চৈত্র মাসের মধ্যেই মামা স্থির করিয়া ফেলিল। শ্যামাকে এক দিন তাহার আভাসটুক আগেই সে দিয়া রাখিয়াছিল। শুভ পয়লা বৈশাখ তারিখে মামা দোকান খুলিল।

 বড় রাস্তায় গলির মোড়ের কাছাকাছি ছোট একটি দোকান ঘর খালি হইয়াছিল, বার টাকা ভাড়া। গলি দিয়া বার তিনেক পাক খাইয়া শ্যামার বাড়ি পৌঁছিতে হয়। একদিন বাড়ি ফিরিবার সময় ‘এই দোকান ভাড়া দেওয়া যাইবে’ খড়ি দিয়া আঁকাবাঁকা অক্ষরে এই বিজ্ঞাপনটি পাঠ করিবামাত্র মামার মতলব স্থির হইয়া গেল। ঘরটি ভাড়া লইয়া মামা মনোহারি দোকান খুলিয়া বসিল। ছোট দোকান, পুতুল, খাতা, পেন্সিল, চা, বিস্কুট, লজেঞ্জস, হ্যারিকেনের ফিতা, মাথার কাঁটা, সিঁদুর এই সব অল্প দামি জিনিসের, দু’ বোতল সুবাসিত পরিশোধিত নারিকেল তৈলের বোতলের চেয়ে দামি জিনিস মামার দোকানে রহিল কিনা সন্দেহ। কাঁচের কেস, আলমারি প্রভৃতি কিনিয়া দোকান দিয়া বসিতে দু’শ টাকার বেশি লাগিল না। মামা দোকানের নাম রাখিল শ্যামা ষ্টোরস্।

 দু’শ টাকা মামা পাইল কোথায়? জিজ্ঞাসা করিলে মামা বলে, শিষ্য দিয়েছে। কেমন শিষ্য জানিস শ্যামা, বোম্বাই শহরের মার্চেণ্ট জুয়েলার—লাখোপতি মানুষ। প্রয়াগে কুম্ভমেলায় গিয়ে হাজার হাজার ছাইমাখা সন্ন্যাসীর মধ্যে গেরুয়া কাপড়টি শুধু পরে গায় একটা কুর্তা চাপিয়ে এক ধারে বসে আছি না একরতি ভস্ম না একটা রুদ্রাক্ষ জটাফটাতো কস্মিন কালে রাখিনে। ওই অত সাধুর মধ্যে লাখোপতি মানুষটা করলে কি, অবাক হয়ে খানিক আমায় দেখলে, দেখে সটান এসে লুটিয়ে পড়ল পায়ে। বলল, বাবা এত ঝুটা মালের মধ্যে তুমি সাচ্চা সাধু, তোমার ভড়ং নেই, অনুমতি দাও সাধু, সেবা করি। মামা অকৃত্রিম আত্মপ্রসাদে চোখ বুজিয়া মৃদু মৃদু হাসে।

 শ্যামা বলে, তা যদি বল মামা এখনো তোমার মুখে চোখে যেন জ্যোতি ফোটে মাঝে মাঝে। কিছু পেয়েছিলে মামা, সাধনার গোড়ার দিকে সাধুরা যা পায় টায়, ক্ষেমতা না কি বলে, কে জানে বাবু, তাই কিছু?

 মামা নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, পাই নি? ছেড়েছুড়ে দিলাম বলে, লেগে যদি থাকতাম শ্যামা—

 দোকান করার টাকাটা তবে ভক্তই দিয়াছে। শ্যামার সেই হাজার টাকায় হাত পড়ে নাই? শ্যামার মন খুঁতখুঁত করে। কুড়ি বছর অদৃশ্য থাকিবার রহস্য আবরণটি এক সঙ্গে বাস করিতে করিতে মামার চারিদিক হইতে খসিয়া পড়িতেছিল। শ্যামা যেন টের পাইতেছিল দীর্ঘকাল দেশ বিদেশে ঘুরিলেই মানুষের কতগুলি অপার্থিব গুণের সঞ্চার হয় না। একটু হয়ত খাপছাড়া স্বভাব হইয়া যায়, তার বেশি আর কিছু নয়। বিনা সঞ্চয়ে ঘুরিয়া বেড়ানো ছাড়া হয়ত এসব লোকের দ্বারা আর কোন কাজ হয় না। মামা যে এমন একটি ভক্তকে বাগাইয়া রাখিয়াছে, চাহিলেই যে দু’চারশ টাকা দান করিয়া বসে, শ্যামার তাহা বিশ্বাস করিতে অসুবিধা হয়। তেমন জবর দস্ত লোক তো মামা নয়?

 একদিন সন্ধ্যার পর চাদরে গা ঢাকিয়া শ্যামা দোকান দেখিয়া আসিল। দোকান চলিবে ভরসা হইল না। শ্যামা-ষ্টোরসএর সামনে রাস্তার ওপারে মস্ত মনোহারি দোকান, চারপাঁচটা বিদ্যুতের আলো, টিমটিমে কেরাসিনের আলো জ্বালা মামার অতটুকু দোকানে কে জিনিস কিনিতে আসিবে? মামার যেমন কাণ্ড, দোকান দিবার আর যায়গা পাইল না।

 মামার উৎসাহের অন্ত নাই, বিধান ও খুকী দোকান দোকান করিয়া পাগল, মণিরও দুবেলা দোকানে যাওয়া চাই। মামা ওদের বিস্কুট ও লজেঞ্জুষ দেয়, দোকানের আকর্ষণ ওদের কাছে তাহাতে আরও বাড়িয়া গিয়াছে। জিনিস বিক্রয় করিবার সখ বিধানের প্রচণ্ড। বলে, এবার যে খদ্দের আসবে তাকে আমি জিনিস দেব দাদু, এ্যাঁ? মামা বলে, পারবি কি খোকা, খদ্দের বিগড়ে দিবি শেষে! কিন্তু অনুমতি মামা দেয়। বিধান ছোট শো-কেসটির পিছনে টুলটার উপরে গম্ভীর মুখে বসে, মামা কোণের বেঞ্চিটার উপর বসিয়া চশমা চোখে দিয়া বিড়ি টানিতে টানিতে খবরের কাগজ পড়ে। ক্রেতা যে আসে হয়ত সে পাড়ার ছেলে, ঈর্ষার দৃষ্টিতে বিধানের দিকে চাহিয়া বলে, কি রে বিধু!—বিধান বলে, কি চাই? সে পাকা দোকানী, কেনা বেচার সময় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব অচল, খোস গল্প করিবার তার সময় কই? চশমার ফাঁক দিয়া মামা সহকারীর কার্যকলাপ চাহিয়া দ্যাখে, বলে, কালি? ওই ও কোণার টিনের কৌটোতে—দু’বড়ি এক পয়সায়, কাগজে মুড়ে দে বোকা!

 এদিকে দোকান চলে, ওদিকে মামা আজ দশটাকা কাল পাঁচটাকা সংসার খরচ আনিয়া দেয়: মামার চারিদিকে রহস্যের ভাঙ্গা আবরণটি আবার যেন গড়িয়া উঠিতে থাকে। পাড়ার লোকে এতকাল মামাকে অতিথি বলিয়া খাতির করিত, এখন প্রতিবেশী গৃহস্থের প্রাপ্য সহজ সমাদর দেয়, তবে অতটুকু দোকান দেওয়ার জন্য পাড়ার অনেক চাকুরে বাবুর কাছে মামার আসন নামিয়া গিয়াছে, খুব যারা বাবু দু’এক পয়সার জিনিস কিনিতে মামাকে তাদের কেহ তুমি পর্যন্ত বলিয়া বসে।

 মামা বলে, কি চাই বললে? পরিমল নস্যি? ওই ও দোকানে যাও!

 অপমান করিয়া মামার কাছে কারো পার পাওয়ার যো নাই।

 বৈশাখ মাস শেষ হইলে শ্যামা একদিন বলিল, দোকানের হিসাবপত্র করলে মামা, লাভটাভ হ’ল?

 মামা বলিল, লাভ কিরে শ্যামা, বসতে না বসতে কি লাভ হয়? খরচ উঠুক আগে।

 শ্যামা বলিল, নতুন দোকান দিয়ে বসার খরচ দু’এক মাসে উঠবে না তা জানি মামা, তা বলিনি, বিক্রীর ওপোর লাভটাভ কি রকম হল হিসাব করনি?—কত বেচলে, কেনা দাম ধরে কত লাভ রইল, করনি সে হিসাব?

 মামা বলিল, তুই আমাকে দোকান করা শেখাতে আসিসনে শ্যামা।

 এবার গ্রীষ্মের ছুটি হওয়ার আগে ক্লাশের ছেলেদের অনেকেই নানা স্থানে বেড়াইতে যাইবে শুনিয়া বিধানের ইচ্ছা হইয়াছিল সেও কোথাও যায়—কোথায় যাইবে? কোথায় তাহার কে আছে, কার কাছে সে গিয়া কিছুদিন থাকিয়া আসিতে পারে? বনগাঁ গেলে হইত,—মন্দাকে শ্যামা চিঠি লিখিয়াছিল, মন্দা জবাব দিয়াছে এখন সেখানে চারিদিকে বড় কলেরা বসন্ত হইতেছে—এখন না গিয়া বিধান যেন পূজার সময় যায়।

 বিষ্ণুপ্রিয়ারা এবার দার্জিলিং গিয়াছে। তখনও স্কুলের ছুটি হয় নাই,—শঙ্কর সঙ্গে যাইতে পারে নাই। বিষ্ণুপ্রিয়া এখানে থাকিবার সময় শঙ্কর বোধ হয় সাহস পাইত না, বিষ্ণুপ্রিয়া দার্জিলিং চলিয়া গেলে একদিন বিকালে সে এ বাড়িতে আসিল।

 শ্যামা বারান্দায় তরকারি কুটিতেছিল। বিধান কাছেই দেয়ালে ঠেস্ দিয়া বসিয়া ছেলেদের একটা ইংরাজি গল্পের বই পড়িতেছিল, মুখ তুলিয়া শঙ্করকে দেখিয়া সে আবার পড়ায় মন দিল।

 শঙ্করকে বসিতে দিয়া শ্যামা বলিল, কে এসেছে দেখ খোকা।

 বিধান শুধু বলিল, দেখেছি।

 বিধান কি আজো সে অপমান ভোলে নাই, বন্ধু বাড়ি আসিয়াছে, তার সঙ্গে সে কথা বলিবে না? লাজুক শঙ্করের মুখখানা লাল হইয়া উঠিয়াছিল, শ্যামা টান দিয়া বিধানের বই কাড়িয়া লইল, বলিল, নে, ঢের বিদ্যে হয়েছে, যা দিকি দুজনে দোতালায়, বাতাস লাগবে একটু,—যা গরম এখানে।

 বিধান আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে গিয়া বসিল। শ্যামা বলিল, তোমাদের ঝগড়া হয়েছে নাকি শঙ্কর?—ও বুঝি কথা বলে না তোমার সঙ্গে? পাগল ছেলে!—না বাবা, যেও না তুমি, পাগলাটাকে আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

 ঘরে গিয়া শ্যামা ছেলেকে বোঝায়। বলে যে শঙ্করের কি দোষ? শঙ্কর তো তাদের অপমান করে নাই, যে বাড়ি বহিয়া ভাব করিতে আসে তার সঙ্গে কি এমন ব্যবহার করিতে হয়? ছি! কিন্তু এ তো বোঝানোর ব্যাপার নয়, অন্ধ অভিমানকে যুক্তি দিয়া কে দমাইতে পারে? ছেলেকে শ্যামা বাহিরে টানিয়া আনে, সে মুখে গোঁজ করিয়া থাকে। শঙ্কর বলে, আমি যাই মাসিমা।

 আহা বেচারীর মুখখানা ম্লান হইয়া গিয়াছে।

 শ্যামা রাগিয়া বলে, ছি খোকা ছি, একি ছোট মন তোর, একি ছোটলোকের মত ব্যবহার? যা তুই আমার সামনে থেকে সরে।—বোসো বাবা তুমি, কটা কথা শুধোই—দিদি পত্র দিয়েছে? সেখানে ভাল আছে সব? তুমি যাবে না দার্জিলিং স্কুল বন্ধ হলে?

 শ্যামা শঙ্করের সঙ্গে গল্প করে, হাঁটুতে মুখ গুঁজিয়া বিধান বসিয়া থাকে, কি ভয়ানক কথা ছেলেকে সে বলিয়াছে শ্যামার তা খেয়ালও থাকে না। তারপর বিধান হঠাৎ কাঁদিয়া ছুটিয়া দোতালায় চলিয়া যায়। লাজুক শঙ্কর বিব্রত হইয়া বলে, কেন বকলেন ওকে?—বলিয়া উসখুস করিতে থাকে।

 তারপর সেও উপরে যায়। খানিক পরে শ্যামা গিয়া দেখিয়া আসে দুজনে গল্প করিতেছে।

 সেই যে তাহাদের ভাব হইয়াছিল, তারপর শঙ্কর প্রায়ই আসিত। শঙ্করের ক্যারমবোর্ডটি পড়িয়া থাকিত এ বাড়িতেই, উপরে খোলা ছাদে বসিয়া সারা বিকাল তাহারা ক্যারম খেলিত। বন্ধে তাহার সহিত বিধানের দার্জিলিং যাওয়ার কথাটা শঙ্করই তুলিয়াছিল, বিষ্ণুপ্রিয়া ইহা পছন্দ করিবে না জানিয়াও শ্যামা আপত্তি করে নাই, তেমন আদর যত্ন বিধান না হয় নাই পাইবে, সেখানে অতিথি ছেলেটিকে পেট ভরিয়া খাইতে তো বিষ্ণুপ্রিয়া দিবেই? কিন্তু রাজি হইল না বিধান। একসঙ্গে দার্জিলিং গিয়া থাকার কত লোভনীয় চিত্রই যে শঙ্কর তার সামনে আঁকিয়া ধরিল, বিধানকে বাঁকানো গেল না। যথাসময়ে শঙ্কর চলিয়া গেল সেই শীতল পাহাড়ী দেশে, এখানে বিধানের দেহ গরমে ঘামাচিতে ভরিয়া গেল।

 মনে মনে শ্যামা বড় কষ্ট পাইল। অভাব অনটনের অভিজ্ঞতা জীবনে তাহার পুরানো হইয়া আসিয়াছে। এমন দিনও তো গিয়াছে যখন সে ভাল করিয়া দেহের লজ্জাও আবরণ করিতে পারে নাই। কিন্তু আজ পর্যন্ত চারটি সন্তানের কোন বড় সাধ শ্যামা অপূর্ণ রাখে নাই—আকাশের চাঁদ চাহিবার সাধ নয়, শ্যামার ছেলেমেয়ে অসম্ভব আশা রাখে না। শ্যামার মত গরীবের পক্ষে পূরণ করা হয়ত কিছু কঠিন এমনি সব সাধারণ আব্দার। বিধান একবার সাহেবি পোষাক চাহিয়াছিল, তাদের ক্লাশের পাঁচ ছ’টি ছেলে যে রকম বেশ পরিয়া স্কুলে আসে। দোতালার ঘরের জন্য ইঁট সুরকি কিনিয়া শ্যামা তখন ফতুর হইয়া গিয়াছে। তবু ছেলেকে পোষাক তো সে কিনিয়া দিয়াছিল।

 শ্যামার চোখে আজকাল সব সময় একটা ভীরুতার আভাস দেখিতে পাওয়া যায়। শীতলের উপরেও কোনদিন সে নিশ্চিন্ত নির্ভর বাখিতে পারে নাই। কমল প্রেসের চাকরীতে শীতল যখন ক্রমে ক্রমে উন্নতি করিতেছিল তখনও নয়। তবু তখন মনে যেন তাহার একটা জোর ছিল। আজ সে জোর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চোরের বৌ? জীবনে এ ছাপ তাহার ঘুচিবে না, স্বামীর অপরাধে মানুষ তাহাকে অপরাধী করিয়াছে। কেহ বিশ্বাস করিবে না, কেহ সাহায্য দিবে না, সকলেই তাহাকে পরিহার করিয়া চলিবে। যদি প্রয়োজনও হয়, ছেলেমেয়েদের দু বেলার আহার সংগ্রহ করিবার সঙ্গত উপায় খুঁজিয়া পাইবে না। বন্ধুবান্ধব আত্মীস্বজন সকলে যাহাকে এড়াইয়া চলিতে চায়, নিজের পায়ে ভর দিয়া দাঁড়াইবার চেষ্টা সে করিবে কিসের ভরসায়? বিধবা হইলেও সে বোধ হয় এতদূর নিরুপায় হইত না। দু বছর পরে শীতল হয়ত ফিরিয়া আসিবে, হয়ত আসিবে না। আসিলেও শ্যামার দুঃখ সে কি লাঘব করিতে পারিবে? নিজের প্রেস বিক্রয় করিয়া কতকাল শীতল অলস অকর্মণ্য হইয়া বাড়ি বসিয়াছিল সে ইতিহাস শ্যামা ভোলে নাই। তবু তখন শীতলের বয়স কম ছিল, মন তাজা ছিল। এই বয়সে দু’বছর জেল খাটিয়া আসিয়া আর কি সে এত বড় সংসারের ভার গ্রহণ করিতে পারিবে? নিজেই হয়ত সে ভাব হইয়া থাকিবে শ্যামার।

 এক আছে মামা। সেও আবার খাঁটি একটি রহস্য, ধরা ছোঁয়া দেয় না। কখনো শ্যামার আশা হয় মামা বুঝি লাখপতিই হইতে চলিয়াছে, কখনো ভয় হয় মামা সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে। সংসারে শ্যামা মানুষ দেখিযাছে অনেক, এরকম খাপছাড়া অসাধারণ মানুষ একজনকেও তো সে স্থায়ী কিছু করিতে দেখে নাই। সংসারে সেটা যেন নিয়ম নয়। সাধারণ মোটা বুদ্ধি সাবধানী লোকগুলিই শেষ পর্যন্ত টিঁকিয়া থাকে, শীতলের মত যারা পাগলা, মামার মত যারা খেয়ালী হঠাৎ একদিন দেখা যায় তারাই ফাঁকিতে পড়িয়াছে। জীবন তো জুয়া খেলা নয়।

 স্কুল খুলিবার কয়েকদিন পরে শঙ্কর দার্জিলিং হইতে ফিরিয়া আসিল। শ্যামার সাদর অভ্যর্থনা বোধ হয় তাহার ভাল লাগিত, একদিন সে দেখা করিতে আসিল শ্যামার সঙ্গেই। শ্যামা দেখিয়া অবাক। পকেটে ভরিয়া সে দার্জিলিংএর কয়েক রকম তরকারি লইয়া আসিয়াছে। বিধান তখন দোকানে গিয়াছিল হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিয়া, শ্যামা শঙ্করের সঙ্গে আলাপ করিল। বকুল নামিয়া আসিল নিচে। মার গা ঘেঁষিয়া বসিয়া বড় বড় চোখ মেলিয়া সে সবিস্ময়ে শঙ্করের দার্জিলিং বেড়ানোর গল্প শুনিল। শুধু বিধানকে নয়, শঙ্কর বকুলকেও ভালবাসে। কেবল সে বড় লাজুক বলিয়া বিধানের কাছে যেমন বকুলের কাছে তেমনি ভালবাসা কোথায় লুকাইবে ভাবিয়া পায় না। পকেটে ভরিয়া সে কি শ্যামার জন্য শুধু তরকারিই আনিয়াছে? মুখ লাল করিয়া বকুলের জিনিসও সে বাহির করিয়া দেয়: কে জানিত দার্জিলিং গিয়া বকুলের কথা সে মনে রাখিবে?

 শ্যামা বড় খুসি হয়। সোনার ছেলে, মাণিক ছেলে। কি মিষ্টি স্বভাব! আম কাটিয়া শ্যামা তাহাকে খাইতে দেয় তারপর রঙীন স্ফটিকের মালা গলায় দিয়া বকুল গল গল করিয়া কথা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে দেখিয়া হাসিমুখে কাজ করিতে যায়, পাঁচ মিনিট পরে দেখিতে পায় দুজনে দোতালা গিয়াছে। রাণীকে শোনাইয়া শ্যামা বলে, বড় ভাল ছেলে রাণী, একটু অহঙ্কার নেই। তারপর দোতালায় দুম্‌দাম করিয়া ওদের ছুটাছুটির শব্দ ওঠে, বকুলের অজস্র হাসি ঝরণার মত নিচে ঝরিয়া পড়ে, এ ওর পিছনে ছুটিতে ছুটিতে একবার তাহারা একতলাটা পাক দিয়া যায়। দুরন্ত মেয়েটার পাল্লায় পড়িয়া লাজুক শঙ্করও যেন দুরন্ত হইয়া উঠিয়াছে।

 পরদিন বিধান স্কুলে চলিয়া গেলে শ্যামা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দেখা করিতে গেল। দাসী তখন স্নানের আগে বিষ্ণুপ্রিয়ার চুলে গন্ধ তেল দিতেছিল, চওডা-পাড় কোমল সাড়িখানি লুটাইয়া বিষ্ণুপ্রিয়া আনমনে বসিয়াছিল শ্বেতপাথরের মেঝেতে, কে বলিবে সেও জননী। এত বয়সে ওর ঢং দেখিয়া মনে মনে শ্যামার হাসি আসে—প্রথম কন্যার জন্মের পর ও আবার সন্ন্যাসিনী সাজিয়াছিল। আজ প্রতিদিন তিনটি দাসী মিলিয়া ওই স্থূল দেহটাকে ঘষিয়া মাজিয়া ঝকঝকে করিবার চেষ্টায় হয়রাণ হয়। গালে রঙটঙ দেয় নাকি বিষ্ণুপ্রিয়া?

 বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল, বোসো।

 শ্যামা মেঝেতেই বসিয়া বলিল, কবে ফিরলেন দিদি? দিব্যি সেরেছে শরীর, রাজরাণীর মত রূপ করে এসেছেন, রঙ যেন আপনার দিদি ফেটে পড়ছে। অসুখ শরীর নিয়ে হাওয়া বদলাতে গেলেন, আমরা এদিকে ভেবে মরি কবে দিদি আসবেন। খবএ পেয়ে ছুটে এসেছি।

 বিষ্ণুপ্রিয়া হাই তুলিল। উদাস ব্যথিত হাসির সঙ্গে বলিল, এসেই আবার গরমে শরীরটা কেমন কেমন করছে, উঠতে বসতে বল পাইনে, বেশ ছিলাম সেখানে—খুকি তো কিছুতে আসবে না, কিন্তু ইস্কুল টিস্কুল সব খুলে গেল, কত আর কামাই করবে? তাই সকলকে নিয়ে চলেই এলাম।

 দার্জিলিংএ শুনেছি খুব শীত?—শ্যামা বলিল।

 শীত নয়? শীতের সময় বরফ পড়ে। বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল।

 একথা সেকথা হয়, ভাঙা ভাঙা ছাড়া ছাড়া আলাপ। শ্যামার খবর বিষ্ণুপ্রিয়া কিছু জিজ্ঞাসা করে না। শ্যামার ছেলেমেয়েরা সকলে কুশলে আছে কি না, শ্যামার দিন কেমন করিয়া চলে জানিবার জন্য বিষ্ণুপ্রিয়ার এতটুকু কৌতূহল দেখা যায় না। শ্যামার বড় আপশোষ হয়। কে না জানে বিষ্ণুপ্রিয়া যে একদিন তাহাকে খাতির করিত সেটা ছিল শুধু খেয়াল, শ্যামার নিজের কোন গুণের জন্য নয়। বড়লোকের অমন কত খেয়াল থাকে। শ্যামাকে একটু সাহায্য করিতে পারিলে বিষ্ণুপ্রিয়া যেন কৃতার্থ হইয়া যাইত। না মিটাইতে পারিলে বড়লোকের খেয়াল নাকি প্রবল হইয়া ওঠে শ্যামা শুনিয়াছে। আজ দুঃখের দিনে শ্যামার জন্য কিছু কবিবার সখ বিষ্ণুপ্রিয়ার কোথায় গেল? তারপর হঠাৎ এক সময় শ্যামার একটা অদ্ভুত কথা মনে হয়, মনে হয় বিষ্ণুপ্রিয়া যেন প্রতীক্ষা করিয়া আছে। কিছু কিছু সাহায্য বিষ্ণুপ্রিয়া তাহাকে করিবে, কিন্তু আজ নয়—শ্যামা যেদিন ভাঙিয়া পড়িবে, কাঁদিয়া হাতে পায়ে ধরিয়া ভিক্ষা চাহিবে, এমন সব তোষামোদের কথা বলিবে ভিখারির মুখে শুনিতেও মানুষ যাহাতে লজ্জা বোধ করে—সেইদিন।

 বাড়ি ফিরিয়া শ্যামা বড় অপমান বোধ করিতে লাগিল। মনে মনে বিষ্ণুপ্রিয়াকে দুটি একটি শাপান্তও করিল। তবু একদিক দিয়া সে যেন খুসিই হয়, একটু যেন আরাম বোধ করে। অন্ধকার ভবিষ্যতে এ যেন ক্ষীণ একটি আলোক বিষ্ণুপ্রিয়ার এই অপমানকর নিষ্ঠুর প্রত্যাশা। একান্ত নিরূপায় হইয়া পড়িলে বিষ্ণুপ্রিয়ার হাতে পায়ে ধরিয়া কাঁদাকাটা করিয়া সাহায্য আদায় করা চলিবে এ চিন্তা আঘাত করিয়াও শ্যামাকে যেন সান্ত্বনা দেয়।

 দিনগুলি এমনিভাবে কাটিতে লাগিল। আকাশে ঘনাইয়া আসিল বর্ষার মেঘ, মানুষের মনে আসিল সজল বিষণ্ণতা। ক দিন ভিজিতে ভিজিতে স্কুল হইতে বাড়ি ফিরিয়া বিধান জ্বরে পড়িল। হারান ডাক্তার দেখিতে আসিয়া বলিল ইনফ্লুয়েঞ্জা হইয়াছে। রোজ একবার করিয়া বিধানকে সে দেখিয়া গেল। আজ পর্যন্ত শ্যামার ছেলেমেয়ের অসুখে বিসুখে অনেকবার হারান ডাক্তার এ বাড়ি আসিয়াছে, শ্যামা কখনো টাকা দিয়াছে কখনো দেয় নাই। এবাব ছেলে ভাল হইয়া উঠিলে একদিন সে হারান ডাক্তারের কাছে কাঁদিয়া ফেলিল, বলিল, বাবা, এবার তো কিছুই দিতে পারলাম না আপনাকে?

 হারান বলিল, তোমার মেয়েকে দিয়ে দাও, আমাদের বকুলরাণীকে?

 কান্নার মধ্যে হাসিয়া শ্যামা বলিল, তা নিন, এখনি নিয়ে যান।

 শ্যামার জীবনে এই আরেকটি রহস্যময় মানুষ। শীর্ণকায় তিরিক্ষে মেজাজের লোকটির মুখের চামড়া যেন পিছন হইতে কিসে টান করিয়া রাখিরাছে, মনে হয় মুখে যেন চকচকে পালিশ করা গাম্ভীর্য। সর্বদা কি যেন সে ভাবে। বাস যেন সে করে একটা গোপন সুরক্ষিত জগতে,—সংসারে মানুষের মধ্যে চলাফেরা কথাবার্তা যেন তাহার কলের মত, আন্তরিকতা নাই অথচ কৃত্রিমও নয়। শ্যামার কাছে সে যে টাকা নেয় না এর মধ্যে দয়ামায়ার প্রশ্ন নাই, মহত্ত্বের কথা নাই, টাকা শ্যামা দেয় না বলিয়াই সে যেন নেয় না, অন্য কোন কারণে নয়। শ্যামা দুরবস্থায় পড়িয়াছে একথা কখনো সে কি ভাবে?

 মনে হয় বকুলকে বুঝি হারান ডাক্তার ভালবাসে। শ্যামা জানে তা সত্য নয়। এ বাড়িতে আসিয়া হারানের বুঝি অন্য এক বাড়ির কথা মনে পড়ে, শ্যামা আর বকুল বুঝি তাহাকে কাদের কথা মনে পড়াইয়া দেয়। বকুলকে কাছে টানিয়া হারান যখন তাহার মুখের দিকে তাকায় শ্যামাও যেন তখন আর একজনকে দেখিতে পায়, গায়ে শ্যামার কাঁটা দিয়া ওঠে। এ বাড়িতে রোগি দেখিতে আসিবার জন্য হারান তাই লোলুপ, একবার ডাকিলে দশবার আসে, না ডাকিলেও আসে। মানুষকে অপমান না করিয়া যে কথা বলিতে পারে না। রোগির অবস্থা সম্বন্ধে আত্মীয়ের ব্যাকুল প্রশ্নে পর্যন্ত যে সময় সময় আগুনের মত জ্বলিয়া ওঠে বহুদিন আগে শ্যামার কাছে সে পোষ মানিয়াছিল। শ্যামা তখন হইতে সব জানে। একটা হারানো জীবনের পুনরাবৃত্তি এইখানে হারানের আরম্ভ হইয়াছিল। একান্ত পৃথক, একান্ত অমিল পুনরাবৃত্তি তা হোক তাও হারানের কাছে দামি। শ্যামা ছিল হারানের মেয়ে সুখময়ীর ছায়া। সুখময়ীর কথা শ্যামা শুনিয়াছে। এই ছায়াকে ধরিয়া হারান শ্যামার সমান বয়সের সময় হইতে সুখময়ীর জীবন স্মৃতির বাস্তব অভিনয় আবিষ্কার করিয়াছে। বকুলের মত একটি মেয়েও নাকি সুখময়ীর ছিল। শ্যামার ছেলেরা তাই হারানের কাছে মূল্যহীন, ওদের দিকে সে চাহিয়াও দেখে না। এ বাড়িতে আসিয়া শ্যামা ও বকুলকে দেখিবার জন্য সে ছটফট করে।

 অথচ শামা ও বকুলকে সে স্নেহ করে কিনা সন্দেহ। ওরা তুচ্ছ, ওরা হারানের কেউ নয়, হারান পুলকিত হয় শ্যামার কণ্ঠ ও কথা বলার ভঙ্গিতে,—শ্যামার চলন দেখিয়া, বকুলের দুরন্তপনা ও চাঞ্চল্য দেখিয়া তাহার মোহের সীমা থাকে না। মমতা যদি হারানের থাকে তাহা অবাস্তবতার প্রতি—শ্যামার উচ্চারিত শব্দ ও কয়েকটি ভঙ্গিমায় এবং বকুলের প্রাণের প্রাচুর্যে—মানুষ দুটিকে হারান কখনো ভালবাসে নাই। শোকে যে এমন জীর্ণ হইয়াছে সে কবে রক্তমাংসের মানুষকে ভালবাসিতে পারিয়াছে?

 শ্যামা তাই হারানের সঙ্গে আত্মীয়তা করিতে পারে নাই। হারানের কাছে অনুগ্রহ দাবী করিতে আজো তাহার লজ্জা করে। বিধানের চিকিৎসা ও ওষুধের বিনিময়ে কাঞ্চন মুদ্রা দিবার অক্ষমতা জানাইবার সময় হারান ডাক্তারের কাছে শ্যামা তাই কাঁদিয়া ফেলিল।

 বিধানের পরে অসুখে পড়িল বকুল। বকুলের অসুখ? বকুলের অসুখ এ বাড়িতে আশ্চর্য ঘটনা। মেয়েকে লইয়া পালাইয়া গিয়া সেই যে শীতল তাহার জ্বর করিয়া আনিয়াছিল সে ছাড়া জীবনে বকুলের কখনো সামান্য কাসিটুকু পর্যন্ত হয় নাই। রোগ যেন পৃথিবীতে ওর অস্তিত্বের সংবাদই রাখিত না। সেই বকুলের কি অসুখ হইল এবার? ছোটখাট অসুখ তো ওর শরীরে আমল পাইবে না। প্রথম ক’দিন দেখিতে আসিয়া হারান ডাক্তার কিছু বলিল না, তারপর রোগের নামটা শুনাইয়া শ্যামাকে সে আধমরা করিয়া দিল। বকুলের টাইফয়েড হইয়াছে।

 জান মা, এই যে কলকেতা শহর এ হ’ল টাইফয়েডের ডিপো, এবার যা সুরু হয়েছে চাদ্দিকে জীবনে এমন আর দেখিনি, তিরিশ বছর ডাক্তারি করছি, সাতটি টাইফডে রোগির চিকিচ্ছে কখনো আর করিনি এক সঙ্গে—এই প্রথম।

 এমনি, ছেলেদের চেয়ে বকুলের সম্বন্ধে শ্যামা ঢের বেশি উদাসীন হইয়া থাকে। সেবাযত্নের প্রয়োজন মেয়েটার এত কম, নিজের অস্তিত্বের আনন্দেই মেয়েটা সর্বদা এমন মশগুল যে ওর দিকে তাকানোর দরকার শ্যামার হয় না। কিন্তু বকুলের কিছু হইলে শ্যামা সুদ সমেত তাহাকে তাহার প্রাপ্য ফিরাইয়া দেয়, কি যে সে উতলা হইয়া ওঠে বলিবার নয়। বকুলের অসুখে সংসার তাহার ভাসিয়া গেল। কে রাঁধে কে খায়, কোথা দিয়া কি ব্যবস্থা হয়, কোন দিকে আর নজর রহিল না, অনাহারে অনিদ্রায় সে মেয়েকে লইয়া পড়িয়া রহিল। এদিকে রাণীও বকুলের প্রায় তিন দিন পরে একই রোগে শয্যা লইল। মামা কোথা হইতে একটা খোট্টা চাকর আর উড়িয়া বামুন যোগাড় করিয়া আনিল, পোড়া ভাত আর অপক্ক ব্যঞ্জন খাইয়া মামা, বিধান আর মণির দশা হইল রোগির মত, শ্যামার কোলের ছেলেটি অনাদরে অনাদরে মরিতে বসিল। বালক ও শিশুদের চেয়ে কষ্ট বোধ হয় হইল মামারই বেশি। দায়িত্ব, কর্তব্য আর পরিশ্রম, মামার কাছে এই তিনটিই ছিল বিষের মত কটু, মামা একেবারে হাঁপাইয়া উঠিল। এতকাল শ্যামার সচল সংসারকে এখানে ওখানে সময় সময় একটু ঠেলা দিয়াই চলিয়া যাইতেছিল, এবার অচল বিপর্যস্ত সংসারটি মামাকে যেন গ্রাস করিয়া ফেলিতে চাহিল, তারপর রহিল অসুখের হাঙ্গামা, ছুটাছুটি, রাতজাগা, দুর্ভাবনা এবং আরও কত কিছু। ওদিকে রাণীর খবরটাও মাঝে মাঝে মামাকে লইতে হয়, ন’দিনের দিন মামা লুকাইয়া কলিকাতা হইতে একজন ডাক্তার আনিয়াছিল, রাণীর কতকগুলি খারাপ উপসর্গ দেখা দিয়াছে, সে বাঁচিবে কিনা সন্দেহ। দীর্ঘ যাযাবর জীবনে ভদ্র অভদ্র মানুষের ভেদাভেদ মামার কাছে ঘুচিয়া গিয়াছিল, কত অস্পৃশ্য পরিবারের সঙ্গে মামা সপ্তাহ মাস পরমানন্দে যাপন করিয়াছে, যেটুকু ভাসা ভাসা স্নেহ করিবার ক্ষমতা মামার আছে রাণী কেন তাহা পাইবে না? রাণী মরিবে জানিয়া মামার ভাল লাগে না, বহুকাল আগে শ্যামার বিবাহ দিয়া শূন্য ঘরে যে বেদনা ঘনাইয়া আসিয়া মামাকে গৃহছাড়া করিয়া ছিল যেন তারই আভাস মেলে। আর বকুল? শ্যামার মেয়েটাকে নিস্পৃহ সন্ন্যাসী মামা কি এত ভালবাসিয়াছে যে ওর রোগ-কাতর মুখখানি দেখিলে সে পীড়া বোধ করে, তাহার ছুটিয়া পালাইতে ইচ্ছা হয় অরণ্যে প্রান্তরে, দূরতম জনপদে,—মানুষের হৃদয় যেখানে স্বাধীন, শোক দুঃখ স্নেহ ভালবাসার সঙ্গে মানুষের যেখানে সম্পর্ক নাই? মামার মুখ দেখিয়া শ্যামা সময় সময় ভয় পাইয়া যায়। বকুলের অসুখের ক’দিনেই মামা যেন আরও বুড়া হইয়া পড়িয়াছে। মিনতি করিয়া মামাকে সে বিশ্রাম করিতে বলে, যুক্তি দেখাইয়া বলে যে মামার যদি কিছু হয় তবে আর উপায় থাকিবে না। কিন্তু মামা যেন কেমন উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া গিয়াছে, সে বিশ্রাম করিতে পারে না, প্রয়োজনের খাটুনি খাটিয়া তো সারা হয়ই, বিনা প্রয়োজনেও খাটিয়া মরে।

 রাণী যথাসময়ে মারা গেল, বকুলের সেদিন জ্বর ছাড়িয়াছে। বর্ষার সেটা খাপছাড়া দিন,—কি রোদ বাহিরে, মেঘশূন্য কি নির্মল আকাশ! কেবল শ্যামার নিদ্রাতুর আরক্ত চেখে জল আসে। এ ক’দিন শ্যামা যেন ছিল একটা কামনার রূপক, সন্তানকে সুস্থ করার একটি জলন্ত ইচ্ছা-শিখা—আজ তাহাকে চেনা যায় না। চোদ্দ দিনে বকুলের জ্বর ছাড়িয়াছে? কিসের চোদ্দ দিন—চোদ্দ যুগ।

 শ্রাবণের শেষে মামা একদিন দোকানটা বেচিয়া দিল। দোকান করা মামার পোষাইল না। ভদ্রলোক দোকান করিতে পারে? শ্যামা হাসিয়া বলিল, তখনি বলেছিলাম মামা, দিও না দোকান তুমি, কেন দোকান চালাতে পারবে?—কত টাকা লোকসান দিলে?

 মামা বলিল, লোকসান দেব আমি? কি যে তুই বলিস শ্যামা।

 তাহ’লে কত টাকা লাভ হ’ল তাই বল?

 না লাভ হয় নি, টায় টায় দেনা-পাওনায় মিল খেয়েছে, ব্যস্। যে দিনকাল পড়েছে শ্যামা, আমি বলে তাই, আর কেউ হ’লে ঘর থেকে টাকা ঢেলে খালি হাতে ফিরে আসত কত কোম্পানী এবার লালবাতি জ্বেলেছে জানিস?

 দোকান বেচিয়া মামা এবার করিবে কি? যে দুর্নিনেয় উৎস হইতে দরকার হইলেই দশ বিশটা টাকা উঠিয়া আসে, চিরকাল তাহা টিঁকিবে তো? মামা কিছু বলে না। করুণভাবে মামা শুধু একটু হাসে, উৎসুক চোখে আকাশের দিকে তাকায়। শরৎ মানুষকে ঘরের বাহির করে বর্ষান্তে নবযৌবনা ধরণীর সঙ্গে মানুষের পরিচয় কাম্য, কিন্তু বর্ষা তো এখনো শেষ হয় নাই। মামা, ওই দেখো আকাশে নিবিড় কালো সজল মেঘ শরৎ, কোথায় যে তুমি দেশে দেশে নিজের মনের মৃগয়ায় যাইতে চাও? মামার বিষণ্ণ হাসি, উৎসুক চোখ শ্যামাকে ব্যথা দেয়। শ্যামা ভাবে কিছু করিতে না পারিয়া হার মানার দুঃখে মামা ম্রিয়মাণ হইয়া গিয়াছে, ভাগ্নীর ভার লইবে বলিয়া অনেক আস্ফালন করিয়াছিল কিনা এখন তাহার লজ্জা অসিয়াছে। চোরের মত মামা তাই অস্বস্তিতে উসখুস করে। আহা, বুড়া মানষ সারাটা জীবন ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাটাইয়া আসিয়া সংসারের পাকা উপার্জনে অভ্যস্ত লোক গুলির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কেন পারিয়া উঠিবে? টাকা তো পথে ছড়ানো নাই। ঘরে ঘরে যুবক বেকার হাহাকার করিতেছে। ষাট বছরের ঘর-ছাড়া বিবাগী এতগুলি প্রাণীর জীবিকা অর্জনের পথ খুঁজিয়া পাইবে কোথায়? শ্যামা বড় মমতা বোধ করে। বলে, অত ভেবো না মামা, ভগবান যাহোক একটা উপায় করবেন।

 ভগবান? মামার বোধ হয় ভগবানের কথা মনে ছিল না। ভগবান যে মানুষের যাহোক একটা উপায় করেন এও বোধ হয় এতদিন তাহার খেয়াল থাকে নাই। শ্যামা মনে পড়াইয়া দিলে মামা বোধ হয় নিশ্চিন্ত মনেই শ্যামা ও তাহার চারিটি সন্তানকে ভগবানের হাতে সমর্পণ করিয়া ভাদ্রের তিন তারিখে নিরুদ্দেশ হইয়া গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলিয়া গেল, কিছু মনে করিস নে শ্যামা, তোর সেই হাজার টাকাটা খরচ করে ফেলেছি,—শ’ দেড়েক মোটে আছে, নে। বড়ো মামাকে শাপ দিস্‌নে মা, একটি টাকা মোটে আমি সঙ্গে নিলাম।

 শাপ শ্যামা দেয় নাই। পাগলের মত কি যেন সব বলিয়াছিল। কথা গুলি মিষ্টি নয়। কোন ভাগ্নীই সাধারণত মামাকে ওসব কথা বলে না। ক্যাম্বিশের ব্যাগটি হাতে করিয়া কম্বলের গুটানো বিছানাটা বগলে করিয়া মামা যখন চলিয়া গেল শ্যামা তখনও পাগলের মত কি সব যেন বলিতেছে।