বিষয়বস্তুতে চলুন

জয়তু নেতাজী (১৯৫০)/নব-পুরুষসূক্ত বা নেতাজী-বরণ

উইকিসংকলন থেকে

নব “পুরুষ-সূক্ত” বা নেতাজী-বরণ

 বেদের বিখ্যাত পুরুষ-সূক্তের নামে এই প্রবন্ধের নামকরণ করিয়াছি। ঐ পুরুষ-সূক্তে, যে পুরুষ-যজ্ঞের বিবরণ আছে তাহা স্মরণ করিলেই আপনারা আমার অভিপ্রায় বুঝিতে পারিবেন। আচার্য ত্রিবেদীর ভাষায় আমি সেই যজ্ঞের বিবরণ কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিতেছি।

 “এই বিশ্বসৃষ্টি ব্যাপারটাই একটা যজ্ঞ; স্বয়ং বিরাট পুরুষ স্বেচ্ছায় এই যজ্ঞ করিয়াছিলেন। •••বিরাট-পুরুষ আপনাকেই ত্যাগ করিয়াছিলেন আপনাকেই আহুতি দিয়াছিলেন।•••বিরাট-পুরুষ কেবলই আপনাকে ত্যাগ করিতেছেন, কেবলই আপনাকে নিহত করিতেছেন, অথচ তিনি নিহত হইতেছেন না। তাঁহার এই যে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ, তাহা একদিনের অনুষ্ঠান নহে―মহাকাল ব্যাপিয়া চলিতেছে। এই যজ্ঞের প্রায়ণও নাই, উদয়নও নাই; আরম্ভও নাই, সমাপ্তিও নাই, কেন না এই যজ্ঞই ত বিশ্ব-ব্যাপার।••••••

 এই আত্মাহুতিকে আমরা মৃত্যু বলি। এই আত্মাহুতির বিরাম বা অন্ত নাই; মৃত্যুরও বিরাম বা অন্ত নাই। প্রজাপতি আপনাকে ত্যাগ দ্বারা নিহত করিতেছেন, যজমানও আপনাকে ত্যাগ দ্বারা নিহত করিতেছেন। প্রজাপতি মৃত্যুস্বরূপ, যজমানও মৃত্যুস্বরূপ। এই মৃত্যুর অন্ত নাই; কেন না এই মৃত্যুর দ্বারা অমরতা পাওয়া যায়। প্রজাপতি মৃত্যুঞ্জয়, যজমানও মৃত্যুজয়ী।” [যজ্ঞকথা পৃঃ ১৬০―৬৭]

 আমি এই পুরুষ-যজ্ঞকেই―যাহা অনন্তকালে অনুষ্ঠিত হইতেছে―তাহাকেই, একালে আমাদের চক্ষের সম্মুখে অনুষ্ঠিত হইতে দেখিতেছি; আমাদের কালের আমাদের ভাষায় তাহার ব্যাখ্যাও অন্যরূপ, কিন্তু ভিতরের ঘটনা একই। অতএব উপরের নামকরণ দেখিয়া আপনারা বিস্মিত হইবেন না। একালের ঋষি-কবিও সেই যজ্ঞের পুরুষ-সূক্ত রচনা করিয়াছেন, সেইরূপ দুইটি সূক্তই আমাকে এই প্রবন্ধরচনা-রূপ ‘চাপলায়-প্রণোদিতঃ’ করিয়াছে। আমি সেই সূক্ত দুইটি উদ্ধৃত করিয়া আধুনিক ভাবে ও আধুনিক ভাষায় তাহার কিছু ভাষ্য রচনা করিব, আপনারা পাঠ করিয়া পুণ্য সঞ্চয় করুন, আমার ভাগও আপনারাই গ্রহণ করুন। প্রথমে একটু ভূমিকা করি।

 মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও যেমন, তেমনই এক একটা জাতির জীবনে এমন ঘটনা ঘটে, যাহা অতিশয় অপ্রত্যাশিত ও চমকপ্রদ, ব্যক্তির জীবনে ঘটিলে তাহার সংবাদ কেহ রাখে না, তাহা একটি ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যেই শেষ হইয়া থাকে। নাটকে উপন্যাসে এইরূপ ঘটনাকেই আশ্রয় করিয়া কবি-কল্পনা কিঞ্চিৎ স্ফূর্ত্তি পায়, আমরা তেমন ঘটনাকে মানিয়া লই; তেমন ঘটনা নিত্য না ঘটিলেও অসম্ভব বলিয়া মনে হয় না, একটা গভীরতর অর্থে তাহাকে বাস্তব বলিয়া স্বীকার করি, এবং কবির কল্পনা বা অন্তর্দৃষ্টির প্রশংসা করি। কিন্তু সময়ে সময়ে ঐ কবিচিত্তকেই অপর একটি চেতনা আবিষ্ট করে―ব্যক্তি-জীবনের পরিবর্ত্তে বৃহত্তর জীবন, জাতির বা মনুষ্য-সাধারণের নিয়তি― যেন সেই চেতনায় চমকিয়া উঠে; তখন তিনি এক অভূতপূর্ব্ব ঘটনাকে কল্পনায় প্রত্যক্ষ করেন, এবং কালান্তরে ও দেশান্তরে সেই ঘটনা ঘটিতেও দেখা যায়। নটরাজরূপী মহাকাল নৃত্যের মধ্যেই যেখানে পা তুলিয়া যতি-তাল রক্ষা করেন, এ যেন সেই মুহূর্ত্তেরই একটি ঘটনা; কবিও দিব্য আবেশের পরমক্ষণে মহাকালের সেই চকিত চরণপাত নিজ হৃদয়ে অনুভব করেন, সেই মুহুর্ত্তে তিনি ঋষি হইয়া উঠেন; ভুত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান যেখানে এক হইয়া আছে সেইখানে তাঁহার চিৎ-পদ্ম উন্মীলিত হয়, কণ্ঠে দিব্যবাণীর অধিষ্ঠান হয়। ঐ যে ঘটনা উহা নিত্য ঘটে না বটে, তথাপি উহা নিত্যকালের; এইজন্যই উহার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান নাই; যখন উহা সত্যই কোনকালে ঘটে, তখনই আমরা বুঝিতে পারি―এ ঘটনা কালাতিগ, ইহার ইতিহাস স্বতন্ত্র। এইরূপ ঘটনার যে ইতিহাস, আমাদের দেশে তাহাকে ‘পুরাণ’ বলে; তাহাতে কালের পৃথক পদচিহ্নের হিসাব থাকে না―বৃহত্তর গতিচ্ছন্দই ধরা পড়ে। এই অর্থে মহাভারতও ইতিহাস; কিন্তু তাহা সন-তারিখের ইতিহাস নয়, কালের শাশ্বত তরঙ্গধারার ইতিহাস। ইহাকে বাস্তব বা কল্পনা―কোন নামই দেওয়া যায় না। কবিচিত্তে দেশ ও কাল যখন এক হইয়া যায়, যখন এক দিব্য-আবেশের ক্ষণে তাঁহার চক্ষে মানবেতিহাসের বহিরাবরণ খুলিয়া যায়, তখন তিনি এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন―যাহা নিত্যকার ঘটনারাশির যেন একটা পুঞ্জীভূত রূপ, এক একটা মন্বন্তর বা যুগান্তরের প্রতীক। তখন সেই কবির দৃষ্টি, তাঁহার সেই বাণী আমাদিগকে চমকিত করে, তাঁহার সেই বাণীকে আমরা ভষ্যিৎ-বাণী বলিয়াই মনে করি; কিন্তু আসলে তাহা ভবিষ্যৎ-বাণী নয়―শাশ্বত-সত্যের বাণী, তাঁহার সেই কাব্যে আমরা মহাকালের সেই নৃত্যচ্ছন্দই হৃদয়গোচর করি।

 আমি যে উপস্থিত কোন্ ঘটনার কথা বলিতেছি তাহা আপনারা বোধ হয় ইতিমধ্যে অনুমান করিয়াছেন; বর্ত্তমানে আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারত যাহা দেখিয়া শুধুই উচ্চকিত নয়―উজ্জীবিত হইয়াছে, আমি সেই নেতাজী সুভাষচন্দ্র ও তাঁহার আজাদী ফৌজের অপূর্ব্ব কীর্ত্তির কথাই বলিতেছি। আজ এই ঘটনার কথা সকলেই জানেন, অতঃপর ইহার ইতিহাসরচনাও হইবে; কিন্তু এ ঘটনার ঋক্-মন্ত্র-গাথা পূর্ব্বেই রচিত হইয়াছে―সাহিত্যিক আমি তাহাতেই অধিকতর বিস্মিত হইয়াছি। একটি আমাদের ভাষায় আমাদেরই কবির রচিত―তাহার কথা পরে বলিব; আর একটি এক ইংরেজ কবির রচনা। যে দুই জাতি পরস্পর বিপক্ষ হইয়া এই ঘটনানাট্যের অভিনয় করিতেছে, ঠিক সেই দুই জাতির দুই কবি-প্রতিনিধি এই যজ্ঞের সাম-মন্ত্র রচনা করিয়াছেন―ইহাও একটি আশ্চর্য্য যোগাযোগ বটে। সুইনবার্নের যে কবিতাটিকে এইরূপ দিব্যপ্রেরণার উদ্‌গীথ বলিয়া মনে হয়, বাংলা ছন্দে তাহার সেই বাণীরূপ ও উদাত্ত-গম্ভীর ছন্দধ্বনি ধরা যাইবে না, তথাপি আমি এককালে এই কবিতাটির যে বঙ্গানুবাদ করিয়াছিলাম, তাহারই কিয়দংশ উদ্ধৃত করিব। মূল কবিতাটির নাম―"Super Flumina Bobylonis”, অনেকদিন পূর্ব্বে ‘প্রবাসী’-পত্রিকায় সেই অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল―তখন কে জানিত, তাহা এই ঘটনারই ভবিষ্যৎ-বাণী! এই কবিতায় ইংরেজ কবি, য়িহুদী-ইতিহাসের একটি ঘটনাকে ভাব-ব্যঞ্জনার সহায় করিয়া, অষ্ট্রীয়ার পদানত ও অত্যাচারপীড়িত তদানীন্তন ইটালির স্বাধীনতা-সংগ্রামকে মহিমান্বিত করিয়াছেন, এবং ইটালির বীর সন্তানগণের জবানীতেই ইহা রচনা করিয়াছেন―ভারতীয় আজাদী ফৌজের উদ্দেশে নয়; কিন্তু কে বলিবে, এ কবিতায় আজিকার ঐ ঘটনাই আরও সত্য ও পূর্ণতর রূপে কীর্ত্তিত হয় নাই? কবিতাটির আরম্ভ এইরূপ―

বিদেশের নদীকূলে বসিয়া সকলে মোরা স্মরিনু তোমায়
তিতি’ অশ্রুনীরে,―
বন্দী ছিনু পরবাসে, যুগান্ত-যাতনা সহি’ তুমি অসহায়,
চাহ নাই ফিরে’।

 *  *  *

বিদেশের নদীকুলে দাঁড়ায়ে উঠিনু মোরা, গাহিলাম গান―
নূতন রাগিণী,
গাহিলাম―ওই শোন জননীর মুক্তি-ভেরী! হ’ল অবসান
যন্ত্রণা-যামিনী!

 কবি এ কাহাদের কথা বলিতেছেন? এই নূতন রাগিণীর নূতন গান ঠিক এমনই অবস্থায় কাহাদের কণ্ঠে উৎসারিত হইয়াছিল?

ঘুরেছিনু তব লাগি’ কত দূর-দূরান্তরে, বিজন শ্মশানে―
রুদ্র পিপাসায়,
চিত্তে জ্বালি’ চিতানল ফিরেছিনু দিশে-দিশে জলের সন্ধানে―
বুক ফেটে যায়!

 ―এই ‘রুদ্র পিপাসা’ এবং ‘দিশে-দিশে জলের সন্ধান’—ইহাও কি অক্ষরে অক্ষরে সত্য নয়? তারপর―

শুনেছিনু রূঢ় বাণী―“জানি বটে, হৃদপিণ্ড কঠিন তাহার,
তবু হ’বি নত!
তোরা দাস, দাসীপুত্র―তুহাদের বেত্রদণ্ড, উঞ্ছ কর্ম্মভার―
প্রভুসেবা-ব্রত!

―এই শ্লোকে দাসত্বের যে নিদারুণ অপমান এবং মানবাত্মার যে লাঞ্ছনার কথা রহিয়াছে, তাহা ঐ অবস্থায় সকল জাতির পক্ষেই সত্য বটে; কিন্তু আজ ঠিক এই দিনে এ জাতির পক্ষে সে সত্য যে-ভাবে চাক্ষুষ হইয়া উঠিয়াছে―এমন কি আর কোথাও কখনো হইয়াছিল? আজাদ-হিন্দ-ফৌজের যে বিচার চলিতেছে, তাহা ত’ আর কিছুই নয়―দাস-জাতির সেই স্পর্দ্ধার শাস্তিদান; বেত্রদণ্ড, উঞ্ছ কর্ম্মভার এবং প্রভুসেবা-ব্রত ছাড়া সে যে আর কিছুই প্রত্যাশা করিবে না―করাই যে মহা অপরাধ! ইহার পর, সহসা এই জাতির মধ্যে কেমন করিয়া নব-জাগরণের সাড়া আসিল, জাতির যেন নবজন্ম হইল―এই কবিতায় সে বর্ণনাও কম সার্থক হয় নাই!―

তব তটিনীর তটে নগর-নগরী যত, নাগরীর বেশে
মগ্ন নিরন্তর
দিবা-স্বপ্ন, নৃত্যগীতে―যতদিন না উদিল দীর্ঘ নিশাশেষে
সৌভাগ্য-ভাস্কর।

ফুল-হিন্দোলায় শুয়ে, সুখতন্দ্রারত সবে চন্দ্রাতপতলে―
ওষ্ঠে মৃদু জ্বালা!
ললাটে কলঙ্ক, তবু কুঞ্চিত কুন্তলদাম,―পরিয়াছে গলে!
মল্লিকার মালা।

তারা কভু হেরে নাই তব গিরি-নদীতীর―পিতৃপিতামহ-
পরিচয়হারা!
ভুলেছিল শক্তিমন্ত্র―ইষ্ট দেবদেবীগণে, ছিল অহরহ
মধু-মাতুয়ারা।

তব নদনদীপথে শুষ্ক খাতে যবে পুণঃ আইল জুয়ার,
তীব্রতৃষাহরা―
মিথ্যার মুকুট খুলি’ ফেলিল ধুলায় টানি’ সন্তান তুহার
―কলঙ্ক-পসরা।


আজ আমরা দিকে দিকে কেবল ইহাই দেখিতেছি, যত দিন যাইবে ততই দেখিব।

 কিন্তু এই কবিতার যে অংশ পড়িলে সত্যই রোমাঞ্চ হয় তাহা পরের পংক্তিগুলিতে এক মহাপুরুষের কথা,―সে যে কে, আজ আর কোন ভারতবাসীকে তাহা বলিয়া দিতে হইবে না। কবিতার এই অংশের একটু ব্যাখ্যা আবশ্যক। জীবন্ত সমাধি হইয়াছে যে দেশমাতৃকার, তাঁহার সেই সমাধি-গহ্বরের রুদ্ধদ্বার সমীপে পৌঁছিয়া বীর সন্তানগণ এক অপূর্ব্ব দৃশ্য দেখিল―গহ্বর-দ্বারের সেই প্রকাণ্ড প্রস্তর-কপাট কে খুলিয়া ফেলিয়াছে এবং সেই কপাটের উপর দাঁড়াইয়া এক দিব্যদর্শন পুরুষ! সেই পুরুষ তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া যে বাণী উচ্চারণ করিল তেমন বাণী তাহারা পূর্ব্বে কখনো শোনে নাই। সেই আহ্বানবাণী এইরূপ―

‘হের দেখ, জননীর দেহ হ’তে ঘুচিয়াছে প্রেতের বসন
শ্মশান-আগারে,
পিশাচ-প্রহরী যত মন্ত্রৌষধিবশে যেন ঘুমে অচেতন―
স্বপন-বিকারে!

‘হের হেথা শূন্য শয্যা! স্বর্ণজ্যোতি-কিরীটিনী অনিন্দ্যসুন্দরী
নাহি যে শয়ান,
মাতা আর মৃতা নয়! ভুবন-ললাম সে যে রাজ-রাজেশ্বরী!
মুছ দু’নয়ান!’

নেতাজীর বাণী যাহারা স্বকর্ণে শুনিয়াছে, তাহারাই বলিবে এ কাহার কণ্ঠস্বর। সেই পুরুষ-দেবতাই তাহাদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন―

“সেই মাতা কহিছেন―কণ্ঠে মোর―তোমা সবে, কর্ণে―মর্ম্মমূলে
আজি এ বারতা―
কোরো না বিশ্বাস কেহ অভিজাত-জনে কভু, কিম্বা রাজকুলে―
রাজাদের কথা।


ইহাই কি প্রথম হইতে শেষ পয্যন্ত তাঁহার একমাত্র সতর্ক-বাণী নয়? আজ এখনও সেই সতর্কবাণীর আবশ্যকতা সমান রহিয়াছে―এমনই আমাদের মূঢ়তা! ইহার পর, কবি সেই পুরুষের কণ্ঠে মৃত্যু-জয়ের মহামন্ত্র উচ্চারণ করাইয়াছেন―


“নিজ কর্ম্ম-ফল-ভুক্ পুরুষ নিজেই পাতে নিজ সিংহাসন
ধরণীর ’পর,
বিশ্বতরে আত্মপ্রাণ যে বা করে পরিহার, জেনো সেইজন
মরিয়া অমর।

“মিটায়ে দিয়েছে সে যে মৃত্যুর সকল দাবী, আছে তার কি
শমন-শাসনে?
দু’দিনের বিনিময়ে বরিয়া লয়েছে বীর অন্তহীন দিবা,
অমর্ত্ত্য-আসনে!”

ইহাও বেদের সেই পুরুষ-সূক্ত―সেই যজ্ঞ ও যজ্ঞের আহুতিমন্ত্র। এই মৃত্যুই অমৃতের সোপান, সেই আত্মাহুতি কখনও নিষ্ফল হইতে পারে না। এখানেও মানুষকে মানুষের ভাষায় সেই পুরুষ আশ্বাস দিতেছেন―

স্মৃতির হিমাদ্রিশিরে, জীবনযাত্রা-উৎস-মূলে, মানব মানসে―
সে কীর্ত্তি-কিরণ
যে-ঠাঁই যেখানে পড়ে, মৃতসঞ্জীবন সেই প্রাণের পরশে
মরিবে মরণ!

যে দীপ নির্ব্বাণ আজি, বিফল হয়েছে যেই পুণ্য অবদান,
কালকুক্ষিগত―
সেই ব্যথা, ব্যথিতের চন্দ্রানন হারাবে না, র’বে জ্যোতিষ্মান,
সুন্দর শাশ্বত।

―এ সকল কথা নূতন নয়, বরং অতিশয় পুরাতন; এ সেই গীতার কথা―‘নহি কল্যাণকৃৎ কশ্চিৎ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি,’ ‘স্বল্পমপাস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ’, ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’―‘তস্মাৎ যুদ্ধস্ব, ভারত!’ কিন্তু কোন্ সত্য পুরাতন নয়? সেই পুরাতনকেই নূতন করিয়া তুলিতে না পারিলে তাহার মূল্যই বা কি? এ বাণী কেবল তাহারই কণ্ঠে জীবন্ত হইয়া উঠে―যে স্বয়ং পুরুষ-যজ্ঞের সেই পুরুষ, যে নিজেকে নিঃশেষে সেই যজ্ঞে আহুতি দিয়াছে।

এই বাণী প্রচারিল দেশ-জাতি-ত্রাতা সেই দেবতার মুখে,
আজও সেই গান

শোনা যায়,―বাঁচিয়া উঠেছি তাই মৃতপ্রায়া জননীর বুকে
স্তন্য করি’ পান।

মায়ের মন্দিরে আর হইবে না পশুযাগ―বেদীর পাষাণ
রবে শুভ্র শিলা,
বিদেশ-নদীর কূলে কাঁদিব না―দেশে হেথা আলোর নিশান,
দেবতার লীলা!

 আজ এ দেশে যাহা ঘটিতেছে তাহার সহিত মিলাইয়া দূরদেশ ও দূর কালের কবির রচিত এই শ্লোকগুলি যখন আবার পড়িলাম, তখন মনে ইহাই হইল যে, এই কবিতায় যে দিব্যপ্রেরণা রহিয়াছে তাহা বেদমন্ত্রের মতই অপৌরুষেয়; ইহাতে দেশ বা কালের খণ্ডদৃষ্টি নাই―যাহা সত্য ও চিরন্তন তাহাই ইহাতে ছন্দোময় হইয়া উঠিয়াছে।

 আর একটি এইরূপ পুরুষ-সূক্ত―খুব নিকটে, আমাদের দেশে, আমাদেরই কবির কণ্ঠে উদ্গীত হইয়াছে; কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের। আমরা সে কবিতা যৌবনে বহুবার পড়িয়াছি―এ কালের পাঠক বোধ হয় আর পড়ে না, কারণ সে কবিতায় আধুনিক ভঙ্গি নাই; বহুবার পড়িয়াছি বলিয়াই ভুলি নাই, তাই আজ এই ঘটনার পর সে কবিতার স্বরূপ আবিষ্কার করিয়া চমকিত হইয়াছি। একদিন যাহা ছিল একটি উৎকৃষ্ট কবিতা মাত্র, আজ তাহাই যেন ভারত-ভাগ্যবিধাতার কঠোচ্চারিত এক দিব্যবাণী, বা দৈববাণী! রাম জন্মিবার আগেই যেমন বাল্মীকির মনোভূমিতে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল, এখানেও তেমনই এক বাঙালী কবির চিত্তে তখনও-অনাগত এক আদর্শ বীর-নেতার জন্ম হইয়াছিল। সেই আসন্নপ্রায় আবির্ভাবকে কবি যেন কোন দিব্যদৃষ্টির বলে তখনই প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন! সমগ্র জাতির মুক্তি-পিপাসা কবির অন্তরতম চেতনাকে অধিকার করিয়া একটি আকুল কামনার রূপ ধারণ করিয়াছিল,―সেই কামনাই যেন একটি পুরুষ-মুর্ত্তি গড়িয়া লইয়া তাহাতেই বিশ্রাম লাভ করিয়াছে। কিন্তু সেই ভাবমূর্ত্তি যে এমন শরীরী হইয়া উঠিবে, কবিও কি তাহা জানিতেন? ইহাকেই বলে আর্ষ প্রেরণা, তাই আজ যখন এই পুরুষ-সূক্ত পাঠ করি এবং সেই পুরুষকেই বলিতে শুনি―

তুরঙ্গমসম অন্ধ নিয়তি―
বন্ধন করি’ তায়,
রশ্মি পাকড়ি’ আপনার করে
বিঘ্ন-বিপদ লঙ্ঘন ক’রে
আপনার পথে ছুটাই তাহারে
প্রতিকূল ঘটনায়।

শতবার করি’ মৃত্যু ডিঙায়ে
পড়ি জীবনের পারে;
প্রান্তগগনে তারা অনিমিখ
নিশীথ-তিমিরে দেখাইছে দিক,
লোকের প্রবাহ ফেনায়ে ফেনায়ে
গরজিছে দুইধারে!

আয়, আয়, আয়―ডাকিতেছি সবে,
আসিতেছে সব ছুটে।
বেগে খুলে যায় সব গৃহদ্বার,
ভেঙে বাহিরায় সব পরিবার,
সুখ-সম্পদ, মায়া মমতার
বন্ধন যায় টুটে!

যত আগে চলি বেড়ে যায় লোক,
ভরে’ যায় ঘাট বাট,
ভুলে যায় সবে জাতি-অভিমান,
অবহেলে দেয় আপনার প্রাণ,
এক হয়ে যায় মান-অপমান―
ব্রাহ্মণ আর জাঠ!

যখন সেই নেতার মুখে ঠিক এই কথাই শুনি, তখন স্তম্ভিত হইয়া যাই; কবির কণ্ঠে সেদিন এ কোন্ সরস্বতী ভর করিয়াছিল―এ যে একেবারে প্রতি অক্ষরে সত্য! শুধুই কি তাই? সেই পুরুষের―সেই ‘নেতা’র―সাধন-জীবনের ইতিহাস, তাহার অন্তরের জপমন্ত্রটিও কবি ধরিয়া দিয়াছেন―

এমনই কেটেছে দ্বাদশ বরষ,
আরও কতদিন হবে―
চারিদিক হ’তে অমর-জীবন
বিন্দু বিন্দু করি’ আহরণ
আপনার মাঝে আপনারে আমি
পূর্ণ দেখিব কবে!

কবে প্রাণ খুলে বলিতে পারিব―
পেয়েছি আমার শেষ;
তোমরা সকলে এস মোর পিছে,
নেতা[] তোমাদের সবারে ডাকিছে―
আমার জীবনে লভিয়া জীবন
জাগো রে সকল দেশ!

নাহি আর ভয়, নাহি সংশয়,
নাহি আর আগু-পিছু।
পেয়েছি সত্য, লভিয়াছি পথ,
সরিয়া দাঁড়ায় সকল জগৎ,
নাই তার কাছে জীবন-মরণ,
নাই নাই আর কিছু!

হৃদয়ের মাঝে পেতেছি শুনিতে
দৈববাণীর মত―
উঠিয়া দাঁড়াও আপন আলোতে,
ওই চেয়ে দেখ কতদুর হ’তে
তোমার কাছেতে ধরা দিবে বলে’
আসে লোক শত শত![]

 তাই বলিয়াছি, এ কবিতা পড়িয়া মনে হয়, সারা ভারতবর্ষ আজ যাহার নেতৃত্ব-গৌরবে গৌরবান্বিত―সেই আদর্শ বীর-নেতার জন্ম যেমন বাঙলার মাটিতেই হইয়াছে, তেমনই, এ যুগের বাঙলার যিনি শ্রেষ্ঠ কবি তাঁহার চিত্ত-ভূমিতেই সেই বীরের আত্মা অনেক পূর্ব্বে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিল! মহাপুরুষগণের আগমনবার্ত্তা কবি-ঋষির চিত্তে যে আগেই পৌঁছায় তাহার অনেক গল্প আমরা প্রাচীন শাস্ত্রে পাঠ করিয়াছি, কিন্তু একালে এরূপ অলৌকিক কাহিনী কেহ বিশ্বাস করে না। ইংরেজ কবির যে কবিতাটি ইতিপূর্ব্বে উদ্ধৃত করিয়াছি তাহা যদি কোন অর্থে লৌকিক হয়, রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা সত্যই অলৌকিক; এখানে তিনি যাহার কথা বলিতেছেন, সে যে আর কেহ নয়―প্রতি ছত্রে তাহার প্রমাণ আছে, পাঠক-পাঠিকাগণকে আমি মিলাইয়া দেখিতে বলি; সুভাষচন্দ্রের সারা জীবনের সাধনা, তাঁহার বিভিন্ন সময়ের উক্তিসমূহ এবং তাঁহার সর্ব্বশেষ কীর্ত্তি―এক কথায় তাঁহার অন্তর ও বহির্জীবনের পূর্ণ প্রতিকৃতি―এই একটি কবিতার মধ্যে অভ্রান্ত রেখায় ফুটিয়া উঠিয়াছে। আরও আশ্চর্য্যের বিষয়―কবি ও কর্ম্মবীর দুজনেরই জন্মস্থান এই বঙ্গভূমি।

 কিন্তু ইহাও আশ্চর্য্যের বিষয় নয়। এবার এই বাংলাদেশেই ভারতের আত্মা নূতন রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। সমগ্র

ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া তাহার আয়ােজন চলিয়াছিল―আজিকার বাঙালী সে কথা ভুলিয়াছে; “বাংলার নবযুগ” নামক গ্রন্থে আমি সে কাহিনী সবিস্তারে বলিয়াছি। বঙ্কিমচন্দ্র যে জাতীয়তা-মন্ত্র প্রচার করিয়াছিলেন, তাহাতে একটা বিশিষ্ট সমাজ ও বিশিষ্ট আদর্শকে সম্মুখে রাখিলেও, তাঁহার দৃষ্টি ছিল সার্ব্বভৌমিক ভারতীয় দৃষ্টি―নবযুগের এই নব-ধর্ম্মের আদি প্রচারক তিনিই। এই জাতীয়তা-ধর্ম্ম স্বামী বিবেকানন্দের ধ্যান-দৃষ্টিতে আরও বিশুদ্ধ ও গভীর হইয়া উঠে,―জাতির হৃদয়ে তিনিই প্রকৃত ‘মহাভারতে’র বীজ বপন করেন। তারপর রবীন্দ্রনাথও তাঁহার কবি-জীবনে ভারতীয় ভাব-সাধনার অত্যুচ্চ শিখর কখনও ত্যাগ করেন নাই, বাঙালী হইয়াও তিনি খাঁটি ভারতীয় কবি―ভারতের আদর্শ ই তাঁহার বাঙালীত্বকে তৃপ্ত করিয়াছে। তাই আজ সেই যুগব্যাপী সাধনার ফলস্বরূপ আমরা যাহা প্রত্যক্ষ করিতেছি তাহার মূল যে এই বাংলার মাটিতেই নিহিত থাকিবে, তাহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে; এবং একজনের কল্পনায় ও অপরের জীবনে উহা যে একই রূপ ধারণ করিয়াছে তাহাতে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, বাঙালী ভুল করে নাই―তাহার সেই সাধনা মিথ্যা নহে। তথাপি, বাস্তবে ও কল্পনায় এই যে সাদৃশ্য, ইহার কারণ আরও গভীর―প্রবন্ধের ভূমিকায় আমি সেই কথাই বলিয়াছি।

 রবীন্দ্রনাথ এই কবিতাটি (‘গুরু গােবিন্দ’―মানসী) রচনা করিয়াছিলেন―ভারতের ইতিহাস-প্রসিদ্ধ এক বীরের জীবনকে উপলক্ষ্য করিয়া, সুইনবার্ণ যেমন করিয়াছিলেন―আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনাকে তাঁহার কবি-হৃদয়ের অর্ঘ্য নিবেদন করিবার জন্য। উভয় কবিতার মধ্যেই মানবাত্মার অপরাজেয় শক্তি ও মহিমা কীর্ত্তিত হইয়াছে। ইতিহাসের এক একটি পুণ্যক্ষণে যে মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান হইয়া থাকে―যে-যজ্ঞে সেই এক বিরাট-পুরুষ আপনাকে আহুতি দেন, যাহার হবির্গন্ধে ও মন্ত্রচ্ছন্দে যজমান আমরা সেই মহাপ্রাণের সঙ্গে আমাদের প্রাণ যুক্ত করিয়া অমৃতত্ব-লোভে অধীর হই―উভয় কবি সেই একই যজ্ঞের পুরুষ-সূক্ত রচনা করিয়াছেন। আমরা দেখিয়াছি, ইংরেজ কবি এই যজ্ঞের গূঢ় তাৎপর্য্য যেরূপ বুঝিয়াছেন তাহাতে ঐ আত্মাহুতি, ঐ মৃত্যুই অমৃতের সোপান―উহাই আত্মার পরম ধর্ম্ম; তিনি মৃত্যুকেই মহিমান্বিত করিয়াছেন, তাহাতে পুরুষ যজ্ঞের একদিক অতিশয় যথার্থরূপে প্রকাশ পাইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ যে সূক্তটি রচনা করিয়াছেন তাহাতে মৃত্যু অপেক্ষা জীবনের কথাটাই বড় হইয়াছে―সেই পুরুষ আপনার বিরাট প্রাণ ক্ষুদ্রের মধ্যে বিলাইয়া দিয়া মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করে, চারিদিকে মহাজীবনের সাড়া পড়িয়া যায়। এখানে মৃত্যুর চিন্তাই যেন নাই, একের তপস্যায় আর সকলের সর্ব্বভয়, সর্ব্ববন্ধন ঘুচিবে - প্রবৃদ্ধ জীবন-চেতনায় মৃত্যুর সংস্কার পর্য্যন্ত তিরোহিত হইবে। এ পুরুষের মুখে কেবল ইহাই শুনি―“আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগো রে সকল দেশ!” অতএব মূলে দুইটি এক হইলেও, রবীন্দ্রনাথের কবি-চিত্তে যাহার ছায়া পূর্ব্বগামিনী হইয়া দেখা দিয়াছিল, আজ তাহার ঐ জীবন্ত রূপ দেখিয়া মনে হয়―কোন ঊর্দ্ধলোকে আত্মার অমরত্বলাভই পরম-পুরুষার্থ নয়, এই জীবনেই মৃত্যুকে জয় করিতে হইবে; বেদোক্ত বিরাট পুরুষ যেমন আত্মোৎসর্গের দ্বারা, অর্থাৎ তাহার অসীমাকে সীমাবদ্ধ করিয়া, এই সৃষ্টির ধারাকে প্রবাহিত ও প্রাণবন্ত করিয়াছে, তেমনই আজিকার এই নব পুরুষ-সূক্তও সেই পুরুষের পুণ্য-অবদান কীর্ত্তন করিবে―“যাহার জীবনে লভিয়া জীবন জাগিবে সকল দেশ”।

পৌষ, ১৩৫২

  1. মূল কবিতায় ‘নেতা’র স্থলে ‘গুরু’ আছে।
  2. পরে জানিয়াছি, এই কবিতাটি সুভাষচন্দ্রের অতিশয় প্রিয় ছিল, তাঁহার পত্রাদিতে ইহার একাধিক উল্লেখ আছে। ‘তরুণের স্বপ্ন’ নামক পুস্তকের একস্থানে তিনি ইহার কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন―‘কবিরা অন্তর্য্যামী তাই অপরের প্রাণের কথা তাঁহারা এমন করিয়া প্রকাশ করতে পারেন’। সুভাষচন্দ্র তখনও ‘স্বপ্ন’ দেখিতেছিলেন, তাই কবির স্বপ্ন ও তাঁহার নিজের স্বপ্নে এই মিল দেখিয়া আশ্চর্য্য বােধ করেন নাই―তখনও তিনি নিজে জানিতেননা যে, ঐ কবিতা স্বপ্ন নহে, তাঁহারই জীবনচরিত।