জীবনচরিত/নিকলাস কোপর্নি‌কস

উইকিসংকলন থেকে

জীবনচরিত।




নিকলাস কোপর্নি‌কস।




 পূর্ব্বকালে কাল্ডি‌য়া, ইজিপ্ট, গ্রীস প্রভৃতি নানা জনপদে জ্যোতির্ব্বিদ্যার বিলক্ষণ অনুশীলন ছিল; কিন্তু খৃষ্টীয় শাকের ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব্বে, জ্যোতির্ম্মণ্ডলীর বিষয় বিশুদ্ধৰূপে বিদিত হয় নাই। পূর্ব্বকালীন পণ্ডিতগণের এই স্থির সিদ্ধান্ত ছিল যে, পৃথিবী স্থির এবং অন্তরিক্ষবিক্ষিপ্ত জ্যোতিষ্কসমুদায়ের মধ্যস্থিত; চন্দ্র, শুক্র, মঙ্গল, সুর্য্য, অন্যান্য গ্রহগণ ও নক্ষত্রমণ্ডল তাহার চতুর্দ্দ‌িকে এক এক মণ্ডলাকার পথে পরিভ্রমণ করে; আর তাহদের দূরত্ব ও বেগের বিভিন্নতা প্রযুক্ত, দিবসে ও রজনীতে নভোমণ্ডলের বিচিত্র আকার দেখিতে পাওয়া যায়। এই মত ইয়ুরোপে বহু কাল পর্য্য‌ন্ত প্রবল ও প্রচলিত ছিল।

 খৃষ্টীয় শাক প্রারম্ভের ছয় শত বৎসর পূর্ব্বে, এনাক্সিমেণ্ড‌র, পিথাগোরস প্রভৃতি গ্রীসদেশীয় পণ্ডিতগণের মনে অনতিপরিস্ফুট রূপে এই বোধোদয় হইয়াছিল যে সূর্য্য‌ অচল পদার্থ; পৃথিবী একটি গ্রহ, অন্যান্য গ্রহবৎ যথা নিয়মে সূর্য্য‌ের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করে। তাঁহারা সাহসপূর্ব্বক আপনাদিগের এই বিশুদ্ধ মত প্রচার করিয়াছিলেন; কিন্তু তৎকাল প্রচলিত ধর্ম্মশাস্ত্রের সহিত ঘোরতর বিসংবাদিতা প্রযুক্ত, সাধারণ লোকেরা যৎপরোনাস্তি বিদ্বেষ প্রদর্শন করাতে, বদ্ধমূল করিতে পারেন নাই।

 চতুর্দ্দ‌শ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইটালি দেশে বিদ্যানুশীলনের পুনরারম্ভ হইলে,[১] সমুদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যোতির্ব্বিদ্যার কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ আদর হইতে লাগিল। কিন্তু তৎকালে যে মত প্রচলিত ছিল তাহা অরিষ্টটল, টলেমি ও অপরাপর প্রাচীন জ্যোতির্ব্বিদগণের অনুমোদিত প্রণালী অপেক্ষা বিশুদ্ধ ছিল না। তাহাতে এই সিদ্ধান্ত প্রতিপন্ন ছিল যে, সূর্য্য‌ ও গ্রহমণ্ডল ভূমণ্ডলের চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করে। যাহা হউক, পরিশেষে এনাক্সিমেণ্ডর ও পিথাগোরসের সঙ্কল্পিত বিশুদ্ধ মত পুনরুজ্জী‌বিত হইবার শুভ সময় উপস্থিত হইল।

 যে অধুনাতন পণ্ডিত পূর্ব্বনির্দিষ্ট বিলুপ্তপ্রায় বিশুদ্ধ মত পুনরুজ্জীবিত করেন, তাহার নাম নিকলাস কোপর্নি‌কস। তিনি, ১৪৭৩ খৃঃ অব্দে ফেব্রুয়ারির উনবিংশ দিবসে, বিষ্টুলা নদীর তীরবর্ত্ত‌ী থরন নগরে জন্ম গ্রহণ করেন। উক্ত স্থান এক্ষণে প্রুসিয়ার রাজার অধিকারের অন্তর্গত। জর্ম্মনির অন্তঃপাতী ওয়েষ্টফেলিয়া প্রদেশ কোপর্নি‌কসের পিতার জন্মভূমি। তিনি থরন নগরে চিকিৎসকের কার্য্যে নিযুক্ত হইয়া তথায় বাস করেন। তৎপরে প্রায় দশ বৎসর অতীত হইলে কোপর্নিকসের জন্ম হয়।

 কোপর্নি‌কস বাল্যকালে ক্রাকোর বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু গণিত, পারপ্রেক্ষিত, জ্যোতিষ ও চিত্রকর্ম্ম এই কয়েক বিদ্যায় স্বভাবতঃ অতিশয় অনুরাগী ছিলেন। শৈশবকালেই জ্যোতিষ বিষয়ে বিশিষ্টরূপ প্রতিপত্তি লাভার্থে অত্যন্ত উৎসুক হইয়া, ইটালির অন্তর্ব্বর্ত্তী‌ বলগ্না নগরের বিশ্ববিদ্যালয়ে উক্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিলেন। সকলে অনুমান করেন তাঁহার অধ্যাপক ডোমিনিক মেরিয়া পৃথিবীর মেরুদণ্ড পরিবর্ত্ত‌ বিষয়ে যে আবিস্কিয়া করেন তদ্দ্বা‌রাই তৎকাল প্রচলিত জ্যোতির্ব্বিদ্যা ভ্রান্তিসঙ্কুল বলিয়া তাঁহার প্রথম উদ্বোধ হয়। অনন্তর বলগ্না হইতে রোমনগরী প্রস্থান করিয়া তথায় কিয়দ্দি‌বস সুচারুরূপে গণিত শাস্ত্রের শিক্ষকতা কার্য্য সম্পাদন করিলেন।

 কিয়দ্দি‌ন পরে কোপর্নি‌কস স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তৎকালে তাঁহার মাতুল অর্স‌্ম‌িলণ্ডের বিশপ অর্থাৎ ধর্ম্মাধ্যক্ষ ছিলেন; তিনি তাঁহাকে ফ্রা‌য়েনবর্গে‌র প্রধান দেবালয়ে যাজকতা পদে নিযুক্ত করিলেন। সেই সময়ে থরন নগরের লোকেরাও তাঁহাকে আপনাদিগের এক দেবালয়ে দ্বিতীয় ধর্ম্মাধ্যক্ষের পদে নিরূপিত করেন। এক্ষণে তিনি এই সঙ্কল্প‌ করিলেন, দেবালয়সংক্রান্ত কর্ম্ম ও বিনা বেতনে দরিদ্র লোকের চিকিৎসা এবং অভিলষিত বিদ্যার অনুশীলন এই তিন বিষয় অবলম্বন করিয়া জীবন ক্ষেপণ করিব। প্রধান দেবালয়ের অদূরবর্ত্তী এক উন্নত ভূভাগের উপর ফ্রা‌য়েনবর্গের যাজকদিগের নিমিত্ত যে সমস্ত বাসস্থান নিয়োজিত ছিল, তথা হইতে অত্যুৎকৃষ্ট রূপে গ্রহ নক্ষত্রাদির পর্য্যবেক্ষণ করিতে পারা যায়। কোপর্নি‌কস তাহার অন্যতম স্থানে অবস্থিতি করিলেন।

 অনুমান হয়, ১৫০৭ খৃঃ অব্দে, পিথাগোরসের মত উৎকৃষ্ট বলিয়া কোপর্নি‌কসের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে। কিন্তু তৎকালীন লোকের যেরূপ সংস্কার ছিল, উক্ত মত তাহার নিতান্ত বিপরীত। এই নিমিত্ত তিনি মনে মনে স্থির করিলেন এই মত অবলম্বন অথবা প্রচার বিষয়ে সাবধান হইতে হইবেক। তৎকালে দূরবীক্ষণের সৃষ্টি হয় নাই। তদ্ভিন্ন গণিতবিদ্যাসংক্রান্ত আর যে সকল যন্ত্র ছিল তাহাও অত্যন্ত অপকৃষ্ট ও অকর্ম্মণ্য। কোপর্নি‌কস পর্যবেক্ষণ সাধন নিমিত্ত যে দুইটি যন্ত্র পাইয়াছিলেন তাহা দেবদারু কাষ্ঠে অতি সামান্যরূপে নির্ম্মিত ও পরিমাণচিহ্ন স্থলে মসিরেখায় অঙ্কিত। এই মাত্র

উপকরণ সম্পন্ন হইয়া, স্বাবলম্বিত মত প্রমাণসিদ্ধ করিবার নিমিত্ত যে সমস্ত গবেষণা আবশ্যক, কয়েক বৎসর তৎসম্পাদন বিষয়ে মনোনিবেশ করেন। পরিশেষে ১৫৩০ খৃঃ অব্দে এক গ্রন্থ প্রস্তুত করিলেন; তাহাতে এই নূতন প্রণালী বিশেষ রূপে ব্যাখ্যাত হইল।

 অন্যান্য লোক অপেক্ষা সমধিক জ্ঞানালোকসম্পন্ন বহুসংখ্যক বিদ্বান্‌ ব্যক্তিরা পূর্ব্বা‌বধি কোপর্নি‌কসের মত অবগত ছিলেন। এক্ষণে তাঁহারা সমুচিত সমাদর ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহা গ্রাহ্য করিলেন। এতদ্ভিন্ন সমুদায় লোক ও ধর্ম্মোপদেশকগণ অপেক্ষাকৃত অজ্ঞ ও কুসংস্কারাবিষ্ট ছিলেন; সুতরাং তাঁহাদের তদ্বিষয়ে শ্রদ্ধা জন্মিবার বিষয় কি।

 পূর্ব্বকালীন লোকেরা বিচারের সময় চিরাগত কতিপয় নিৰ্দ্ধারিত নিয়মের অনুবর্তী হইয়া চলিতেন; সুতরাং স্বয়ং তত্ত্বনির্ণয় করিতে পারিতেন না, এবং অন্যে সুস্পষ্ট রূপে বুঝাইয়া দিলেও তাহা স্বীকার করিয়া লইতেন না। তৎকালীন লোকদিগের এই রীতি ছিল পূর্ব্বাচার্য্য‌েরা যাহা নির্দেশ করিয়া গিয়াছিলেন, কোন বিষয়, তাহার বিরুদ্ধ বা বিরুদ্ধবৎ আভাসমান হইলে, তাহা শুনিতে চাহিতেন না। বস্তুতঃ তাঁহারা কেবল প্রমাণ প্রয়োগেরই বিধেয় ছিলেন তত্ত্বনির্ণয়নিমিত্ত স্বয়ং অনুধ্যান বা বিবেচনা করিতেন না। ইহাতে এই ফল জম্মিয়াছিল নির্ম্মলমনীষাসম্পন্ন ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা বা অনুসন্ধান দ্বারা যে

নূতন নূতন তত্ত্ব উদ্ভাবিত করিতেন তাহা, চিরসেবিত মতের বিসংবাদী বলিয়া, অবজ্ঞা রূপ অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত হইত। এই এক সিদ্ধান্ত তাঁহাদের বিশ্বাসক্ষেত্রে বদ্ধমূল হইয়াছিল যে পৃথিবী অচল ও অপরিচ্ছিন্ন বিশ্বের কেন্দ্রভূত। এই মত পূর্ব্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরা প্রামাণিক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন, বহুকালাবধি প্রচলিত হইয়া আসিয়াছে, এবং বস্তু সকল স্থলদৃষ্টিতে আপাততঃ যেরূপ প্রতীয়মান হয় তাহার সহিতও আবিরুদ্ধ; বিশেষতঃ তৎকালীন লোকেরা বোধ করিত বাইবলেরও স্থানে স্থানে ইহার পোষকতা আছে। এই সকল পর্য্যালোচনা করিয়া কোপর্নি‌কস সেই অনেক বৎসরের আয়াসসম্পাদিত গ্রন্থ সহসা প্রচার করিতে পারিলেন না।

 পরিশেষে রেটিকস নামে তাঁহার এক বান্ধব, সংক্ষেপে তদীয় গ্রন্থের মর্ম্ম সঙ্কলন পূর্ব্বক সাহস করিয়া, ১৫৪০ খৃঃ অব্দে, এক ক্ষুদ্র পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলেন; কিন্তু তাহাতে স্বীয় নাম নির্দ্দ‌েশ করিলেন না। ইহাতে কেহ বিদ্বেষ প্রকাশ না করাতে, সেই ব্যক্তিই পর বৎসর আপন নাম সমেত উক্ত পুস্তক পুনর্মু‌দ্রিত করিলেন। উভয় বারেই এই মত কোপর্নি‌কসের বলিয়া স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। ঐ সময়ে ইরাস্ম‌স রেন্‌হোল্ড নামক এক পণ্ডিত এক খানি পুস্তক প্রচার করেন। তাহাতে তিনি এই নূতন মতের ভূয়সী প্রশংসা লিখিয়া, তৎপ্রব-

র্ত্ত‌ককে দ্বিতীয় টলেমি বলিয়া বর্ণনা করেন। সর্ব্বদা এরূপ ঘটিয়া থাকে, কোন লব্ধপ্রতিষ্ঠ ভ্রান্তিপ্রবর্তকের সহিত তুল্যমূল্য করিয়া গণনা করিলেই তত্ত্বপ্রদর্শকের যথেষ্ট প্রশংসা করা হয়।

 তখন কোপর্নি‌কস, আত্মীয়বর্গের প্রবর্ত্ত‌নাপরতন্ত্র হইয়া আপন গ্রন্থ প্রচার করিতে সম্মত হইলেন। তদনুসারে, নরম্বৰ্গবাসী কতিপয় পণ্ডিতের অধ্যক্ষতায়, তন্নগরস্থ যন্ত্রে গ্রন্থ মুদ্রিত হইতে লাগিল। তৎকালে তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়াছিলেন; জীবিত থাকিয়া আপন গ্রন্থ প্রচারিত দেখা তাঁহার ভাগ্যে ঘটিয়া উঠিল না। গ্রন্থ মুদ্রিত হইবামাত্র, তাহার বন্ধু রেটিকস একখানি পুস্তক পাঠাইয়া দেন। কিন্তু ঐ পুস্তক তাহার তনুত্যাগের কয়েক দণ্ড মাত্র পূর্বে তাঁহার নিকট পহুছে। ১৫৪৩ খৃঃ অব্দে, মে মাসের ত্রয়োবিংশ দিবসে তিনি কলেবর পরিত্যাগ করেন।

 এইরূপে, কোপর্নি‌কসের মত ভূমণ্ডলে প্রচারিত হইল। কিন্তু গ্রন্থকর্ত্তার মৃত্যু হইয়াছিল এই বলিয়াই হউক, কিংবা তাদৃশ প্রগাঢ় গ্রন্থ সচরাচর সকলের বুদ্ধিগম্য হইবার বিষয় নহে সুতরাং তদ্দ্বা‌রা সাধারণ লোকের বুদ্ধিব্যতিক্রম বা মতপরিবর্তের সম্ভাবনা নাই এই বোধ করিয়াই হউক,অথবা অন্য কোন অনির্ণীত হেতু বশতঃ, কোন সমাজ বা সম্প্রদায়ের লোক বিদ্বেষ প্রদর্শন করে নাই।


  1. পূর্ব্বকালে গ্রীসদেশে ও রোমরাজ্যে বিদ্যার বিলক্ষণ অনুশীলন ছিল। পরে রোমরাজ্যের উচ্ছেদ হইলে ক্রমে ক্রমে বিদ্যানুশীলমের লোপ হইয়া যায়। অনন্তর এই সময়ে ইটালি দেশে পুনর্ব্বা‌র বিদ্যার অমুশীলন আরম্ভ হয়।