জীবনী কোষ/ভারতীয়-ঐতিহাসিক/কবীর

উইকিসংকলন থেকে


কবীর—মধ্যযুগে মুসলমান রাজত্বের সময়ে ভারতে অনেক ধর্ম্ম-সংস্কারক জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে রামনন্দের শিষ্য কবীর একজন প্রধান। তাঁহার পরবর্ত্তী ধর্ম্ম সংস্কারকদের উপরও তাঁহার প্রভাব বহুল পরিমাণে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। কবীর ১৩৯৮ খ্রীঃ অব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫১৮ সালে (মতান্তরে ১৪৫০) পরলোক গমন করেন। তিনি মুসলমানজাতীয় জোলার (তাঁতির) ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম নীরু ও মাতার নাম নীমা ছিল। মুসলমান আমলে অনেক হিন্দু তাঁতি মুসলমান হইয়া ছিল। তিনি রামানন্দের নিকট নূতন সংস্কারমূলক ধর্ম্ম লাভ করেন। সকল প্রকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেই তিনি সংগ্রাম ঘোষণা করেন। এসম্বন্ধে হিন্দু, মুসলমান কাহাকেও তিনি ক্ষমা করেন নাই। সকল সম্প্রদায়ের লোকই তাঁহার সরল-নির্ভীক ধর্ম্মভাবে মুগ্ধ হইয়া, তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এসম্বন্ধে তাঁহার উপর নির্য্যাতন ও কম হয় নাই। সম্রাট সেকেন্দর লোদি (১৪৮৮-১৫১৭ খ্রীঃ) তাঁহাকে ১৪৯৫ খ্রীঃ অব্দে আহ্বান করেন কিন্তু তাঁহার উচ্চ ধর্ম্মভাব দর্শনে মুগ্ধ হইয়া তাঁহার উপহার অত্যাচার করিতে বিরত হন। জাতিভেদ, পৌত্তলিকতা, তীর্থ, ব্রত, মালা, তিলক, মর্কট বৈরাগ্য প্রভৃতি সকল প্রকার কুসংস্কারের মূলেই তিনি প্রচণ্ড আঘাত করিয়ছিলেন। তিনি সাধক হইয়াও বিবাহ করিয়া ছিলেন। তাঁহার স্ত্রীর নাম ছিল লোই। তাঁহার কমাল নামে এক পুত্র ও কমালী নামে এক কন্যা জন্মে। কমলীর সঙ্গে এক ব্রাহ্মণ যুবকের বিবাহ হয়। কমলও একজন উচ্চদরের সাধক ছিলেন। কবীরের মৃত্যুর পরে অনেকে তাঁহাকে একটী সম্প্রদায় গঠন করিতে বলেন। কিন্তু তাঁহার পিতা কোন প্রকার সম্প্রদায় গঠনেরই বিরোধী ছিলেন বলিয়া, তিনি এই প্রকার দল গঠন করিয়া পিতার আচরিত মতের বিরোধী হইতে অনিচ্ছা জ্ঞাপন করেন। কবীরের মৃত্যুর পরে তাঁহার হিন্দু শিষ্যেরা নানা প্রকার কৌশলজাল বিস্তর করিয়া তাঁহাকে হিন্দু বলিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করিয়ছিলেন। এসম্বন্ধে ভক্তমাল গ্রন্থকার ও তাহার টীকাকারেরা প্রসিদ্ধ।

 যদিও কবীর সম্প্রদায় গঠনের অতিশয় বিরোধী ছিলেন, তথাপি তাঁহার, মৃত্যুর পরেই তাঁহার অনুবর্ত্তীরা দুইটী দলে বিভক্ত হইয়া পড়িলেন। কবীরের বাণী সংগ্রহ করিয়া ‘বীজক’ নামক গ্রন্থ রচিত হইল। সুরতগোপাল নামক তাঁহার এক শিষ্য ইহা লইয়া কাশীতে কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাঁহারা ক্রমে ক্রমে হিন্দু শাস্ত্র ও বেদান্তের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িলেন। বাঘেলখণ্ডের রাজা বিশ্বনাথ সিংহজী এই বীজকের এক উৎকৃষ্ট টীকা লিখিয়াছেন। ইহা ‘বঘেলখণ্ডী টাকা’ নামে প্রসিদ্ধ। কবীরের বণিজাতীয় শিষ্য ধর্ম্মদাসজী ছত্রিশগড়ে আর একটী শাখা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি স্বীয় গুরুর ন্যায় বিবাহিত ছিলেন। এই ধারার গুরুরা বরাবরই বিবাহিত। কবীরের অপর শিষ্য বিজলী খাঁ তাঁহার মৃত্যুস্থান মগহরে (বস্তী জিলা) একটি মসজিদ নির্ম্মাণ করিয়া তাহার স্মৃতি রক্ষা করিয়াছিলেন।

 কবীরপন্থী দ্বারা হিন্দী ভাষারও বহুল প্রচার ও উন্নতি হইয়ছিল। কারণ কবীরের বাণী সমস্তই হিন্দী ভাষায় রচিত ও প্রচারিত।

 কবীর লেখাপড়া জানিতেন না। কিন্তু সহজজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধিবলে ধর্ম্মের গভীর তত্ত্ব, শাশ্বত সত্য ও মধুর কবিতা প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। তিনি ভগবানকে রাম (আনন্দময়), প্রভু, সাঁই (স্বামী) আল্লা, খোদা (স্বধা বা আত্মপ্রতিষ্ঠা), পুরাসাহেব (পূর্ণব্রহ্ম), অনুগঢ়িয়া দেবা (অগঠিত, স্বয়ম্বু দেবতা) এই সকল নামে উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। কবীরের সময়ে হিন্দু ও মুসলমান পরম্পর প্রতিবেশী হওয়াতে পরস্পরের ধর্ম্মমতে প্রভাব পরস্পরের উপর পড়িয়ছিল। কিন্তু মুসলমান তখন দেশের রাজা। তাঁহাদের ধর্ম্মবিশ্বাসের ও গোঁড়ামির জোর রাজশক্তির সাহায্যে অত্যন্ত প্রবল ছিল। সেইজন্য আত্মরক্ষার জন্য ব্রাহ্মণগণ আপনাদের আচার ও সামাজিক বিধি দৃঢ়তর নিয়মে বদ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। এই অতি কঠোর নিয়মের গণ্ডিতে সমাজের প্রাণ যেন হাঁপাইয়া উঠিতেছিল। এই সময়েই রামানন্দ ও তাঁর শিষ্যগণ ধর্ম্মবিপ্লব উপস্থিত করিয়া সর্ব্বধর্ম্মসমন্বয় করবার চেষ্ট করেন। কবীরের প্রভাব তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্ত্তী বহু সাধুভক্তের জীবনের উপর প্রতিফলিত হইয়াছিল। আহমদাবাদের দাদু এক কবীরপন্থীর শিষ্য ছিলেন, প্রসিদ্ধ হিন্দি কবি তুলসীদাস, রাজপুতানার সাধিকা মীরাবাই, শিখধর্ম্ম প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক প্রভৃতি তাঁহার বিশেষ গুণগ্রাহী ও ভক্ত ছিলেন। গুরু নানক তীর্থ পর্য্যটন ব্যপদেশে কাশীতে উপস্থিত হইয়া কবীরের অমৃতময়ী বাণী শ্রবণ করেন। শিখ ধর্ম্মশাস্ত্র ‘গ্রন্থসাহেব’ কবীরের বাণীতে পরিপূর্ণ। তদ্ভিন্ন অযোধ্যার জগজ্জীবন দাস প্রতিষ্ঠিত সৎনামী সম্প্রদায়, মালব দেশের বাবালাল প্রতিষ্ঠিত বাবালালী সম্প্রদায়, গাজীপুরের শিবনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত শিবনারায়ণী সম্প্রদায় প্রভৃতি বহু সাধকসঙ্ঘ কবীরের উদার মতের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। এই সকল সাধু মহাত্মাদের চেষ্টায় উত্তর ভারতের হিন্দু-মুসলমানের গোঁড়ামী ও অন্ধ কুসংস্কার বহুল পরিমাণে হ্রাস পাইয়াছে। কবীর ধর্ম্মভাবের ব্যাকুলতায় দূর দূরান্তর দেশসমূহে পর্য্যটন করিয়া, অবশেষে গোরখপুরের নিকটবর্ত্তী হিমালয়ের পদমূলে মগহর গ্রামে আসিয়া বাস করিতে থাকেন। তৎকালীন লোকের অন্ধবিশ্বাস ছিল যে, ব্যাসকাশীর ন্যায় মগহরে মৃত্যু হইলে মানুষ পরজন্মে গর্দ্দভযোনিতে জন্মগ্রহণ করে। তাঁহার হিন্দু ভক্তগণ তজ্জন্য তাঁহাকে স্থানান্তরে গমন করিতে অনুরোধ করিলে তিনি বলেন,—“কাশীতে দেহত্যাগ করিয়া, স্থান মাহাত্ম্যে মুক্তিলাভ, আমি চাই না। যদি ভগবদ্ভক্তি থাকে, তবে সেই মূল্য দিয়াই আমি মগহর বাসেই মুক্তির অধিকারী হব।” কবীরের মৃত্যুর পর তাঁহার দেহের সৎকার লইয়া হিন্দু ও মুসলমান শিষ্যগণের মধ্যে ঘোরতর কলহের সৃষ্টি হয়। কিম্বদন্তী আছে যে তাঁহার দেহের আচ্ছাদন অপসারিত করিলে দেখা যায় যে, তথায় মৃতদেহের পরিবর্ত্তে কতকগুলি ফুল পড়িয়া আছে। সেই ফুল বণ্টন করিয়া হিন্দু শিষ্যগণ একভাগ কাশীতে লইয়া দাহ করেন এবং কাশীস্থিত কবীরচৌবা নামক স্থানে সেই ভস্ম সমাধিস্থ করেন। মুসলমান ভক্তগণ ফলের অপর অর্দ্ধাংশ মগহরেই কবর দিয়া রাখেন। তজ্জন্য ঐ উভয় স্থানই কবীরপন্থীদের তীর্থস্থান হইয়া রহিয়াছে।