জীবনের ঝরাপাতা/চব্বিশ

উইকিসংকলন থেকে

চব্বিশ

সমাজ—পারিবারিক, বান্ধবিক ও সাধর্ম্যিক

তিলক মহারাজা

মানুষের জন্মগত সমাজ হয় পারিবারিক, বন্ধু বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে একটা বান্ধবিক সমাজ তাকে ঘেরে, এবং একই ধর্মসম্প্রদায়গত সমাজও তার আর একটি স্বতন্ত্র থাকে। ছেলেবেলায় আমাদের সমাজ ছিল যোড়াসাঁকোর পরিবারের মধ্যে আবদ্ধ। আমাদের মেলামেশা, খাওয়া-দাওয়া, উৎসব ও শোকে সম্মিলন ছিল শুধু আপনা-আপনির মধ্যে। কাশিয়াবাগানে এসে, থিয়সফি ও সখি-সমিতির দরুন বাইরের অনেক পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে মায়ের বন্ধুতা হওয়ায় মেলামেশার সমাজটা বড় হতে লাগল কিন্তু সে মেলামেশাটা অনেকটা উপর উপর। হিন্দুসমাজের প্রকৃতিই হচ্ছে নিজেদের বৈবাহিক গণ্ডীর মধ্যে নিবন্ধ থাকা। যাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ হতেই পারে না তাদের সঙ্গে হাজার মনের মিল হলেও দুধের উপর সরের মত একটা পাৎলা পার্থক্যের স্তর সদাই বর্তমান থাকে—সেটা বোধ হয় জাতিভেদগত স্তর। যে সকল গোঁড়া হিন্দু-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে আমাদের ভাবসাব হল, তাঁদের গৃহে সবরকম শুভকার্যে আমরা যেতে থাকলুম বটে, কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কায়স্থ হওয়ায় একটু বাইরের লোকের মতই যেতুম। সে বাইরের ভাব ঘুচে গেল ‘ইঙ্গবঙ্গ’ সমাজ বলে একটি সমাজ গড়ে উঠলে এবং আমরা তার অন্তর্ভুক্ত হলে। তাতে যেন পারিবারিক পরিধিটাই বেড়ে গেল। এই সমাজ প্রধানতঃ সাধারণ ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী সমাজ, তাঁদের মধ্যে যাঁরা আঢ্য ও বিলাত প্রত্যাগত তাঁদের সমাজ—দুচারটি খ্রীস্টানও তাতে ছিলেন। সাধারণ ব্রাহ্মদের নিজস্ব সাধর্ম্যিক একটি সমাজও ছিল, যাতে সব অবস্থার ব্রাহ্মব্রাহ্মিকারা ও তাঁদের পুত্রকন্যারা সামিল ছিলেন। আমাদের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল না। এই ধর্মগত পরিবারের চিত্র ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের কন্যাদের গৃহে ও ব্যবহারে অত্যুজ্জ্বল দেখেছি। কলুটোলা বা গোরফের বৈদ্য আত্মীয়রাই শুধু তাঁদের নিজস্ব আত্মীয় ছিলেন না, নববিধান সমাজের প্রচারকমাত্রের, কেশবচন্দ্রের ভক্তমাত্রের পরিবার যেন তাঁদের অন্তরঙ্গ আপন পরিবারস্থ লোক ছিলেন। কুচবিহারের মহারাণী সুনীতি দেবী বা মৌরভঞ্জের মহারাণী সুচারু দেবীর সঙ্গে নববিধানী সর্বসাধারণ মেয়েদের নিশ্চয়ই পার্থক্য ছিল, কিন্তু তাঁরা সেটা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ে ও ভদ্রতায় ঢাকবারই চেষ্টা করতেন, তাদের অনুভব করতে দিতেন না।

 এই ধার্মিক এক-পরিবারত্বের অভিজ্ঞতা মহর্ষির পরিবারে আমাদের ছিল না। কারণ ৬নং যোড়াসাঁকোর বাইরে যাঁরা আদি ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ছিলেন—তাঁরা শুধু সমাজে যেতেন আসতেন, উপাসনায় যোগদান করতেন ও ব্রহ্মসঙ্গীত শুনে তৃপ্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। মহর্ষির পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মিলন করাতে সঙ্কুচিত হতেন, অন্তত কোনদিন করাননি। তার একটা কারণ বোধ হয় তাঁরা পুরুষেরা বাইরে এসে নিরাকার ব্রহ্মোপাসনা করলেও, তাঁদের বাড়ির ভিতরে মেয়েদের দরুনই কোন রকম পুরানো আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তন হয়নি। তাই আমাদের সাধর্ম্যিক সমাজ বলে কিচ্ছু ছিল না।

 ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে আমরা অল্পে অল্পে গ্রস্ত হলুম—বিশেষ করে কাশিয়াবাগান ছেড়ে যখন বালিগঞ্জে উঠে এলুম। নিজ বালিগঞ্জে তখন বেশী ঘর বাসিন্দা ছিলেন না—তখন ঘরবাড়ি সেখানে বেশি ছিল না, শুধু বড় বড় বাগান ও জমি ছিল। তার অধিকাংশের মালিক ছিলেন টি পালিত। তিনিই লোক বসাতে লাগলেন, আবাদ করতে লাগলেন বালিগঞ্জে—নিজের বাগান টুকরো করে করে বেচে বন্ধু-বান্ধবের কাছে। আমরা কাশিয়াবাগান থেকে যে ২৬নং বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে উঠে এসেছিলুম—সেটা যদু মল্লিকের সম্পত্তি ছিল—পরে ৩নং সানি পার্কে আমাদের নিজের বাড়ি হল। ৬নং সানি পার্কে আশু চৌধুরী বাড়ি করলেন, ১৯নং স্টোর রোডের উপর তৈরি পুরানো বাড়ি মেজ মামা কিনলেন—কে জি গুপ্ত ৬নং স্টোর রোডে বাড়ি করলেন, ইন্দিরার বিয়ে হলে প্রথম প্রথম ১৪নং বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে রইল, পরে ব্রাইট স্ট্রীটে নিজের বাড়িতে গেল। দিদি প্রথমে ঝাউতলা রোডে বাড়ি করলেন, পরে হাজরা রোডে এলেন। এই রকমে বালিগঞ্জ ময়দানের আশেপাশে ও কাছাকাছি আমাদের আত্মীয় ও বন্ধুবর্গের একটি বৃহৎ কলনি স্থাপিত হল। ইঙ্গ-বঙ্গ বন্ধুদের সবাই প্রায় পূর্ববঙ্গের লোক। তাঁদের সকালে বাঙ্গাল দেশীয় ব্যঞ্জনসহ ভাত খাওয়া ছাড়া আর সব বিষয়ে পুরো সাহেবিয়ানার সঙ্গে চাক্ষুষ হল। তাই দেখে আমার প্রাণ তাঁদের ভিতর কতক পরিমাণে স্বদেশীয়তা ঢোকাবার জন্যে পথ খুঁজে নিলে। কপালে টিপ পরা, পায়ে আলতা পরা ত ধরালুমই —তার উপর বাঙলার দেশীয় পালপার্বণগুলিকে সাহেবী রূপ দিয়ে এঁদের গ্রহণোপযোগী করলুম। শ্রীপঞ্চমীর দিন নিমন্ত্রণ পত্রের উপর পৃষ্ঠায়—“বসন্তোৎসব” লিখে ভিতর পৃষ্ঠায় চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করলুম। তার ফুটনোটে এক লাইন টোকা রইল—“মেয়েদের বাসন্তী রঙের শাড়ি বা ব্লাউজ ও পুরুষদের পরিচ্ছদের কোথাও না কোথাও একটুখানি বাসন্তী রঙের আভাস ধারণ বাঞ্ছনীয়।” মেয়েরা ত বাসন্তী রঙের সুন্দর সুন্দর শাড়ি-জামা পরে এলেনই—পুরুষরাও এলেন ধুতি-চাদরের সঙ্গে ফিকে বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবী পরিধান করে, এবং যাঁরা কোটপ্যাণ্ট পরে এলেন তাঁরাও কণ্ঠে বাসন্তী রঙের নেকটাই ধারণ করলেন বা বাদামী রঙের রেশমী রুমাল তাঁদের বুক পকেট থেকে উঁকি মারতে লাগল। সন্ধ্যে হলে ঘরের ভিতর এসে গান-বাজনা হতে লাগল। আমার

“হে সুন্দর বসন্ত বারেক ফিরাও
আজি মধুর অতীত কাল”

গান এই উপলক্ষে রচিত হয়ে প্রথমে গীত হল।

 তারপর পূর্ববঙ্গের মেয়েরা যে অনেকেই সুন্দর মিষ্টান্ন তৈরি করতে পারেন তার পরিচয় পেয়েছিলুম। সেটা জাতীয়ভাবে কাজে লাগাবার চেষ্টা করলুম—“পৌষপার্বণ”-এর নিমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়ে। অনেকগুলি মেয়েকে আমাদের বাড়িতে সকালেই আমন্ত্রণ করলুম বাড়িতে এসে সকলে মিলে নানারকম পিঠেপুলি, পাটিসাপটা, সরু চাকলি প্রভৃতি তৈরি করতে। একটা রীতিমত যজ্ঞিবাড়ি বসে গেল যেন। মধ্যাহ্নে সবাই একত্রে মিলে খিচুড়ি খেয়ে আবার তাড়াতাড়ি পিঠে গড়তে লেগে গেল। কাজ শেষ হলে তবে খানিকটা বিশ্রাম করে, অপরাহ্ণে মুখ-হাত ধুয়ে, সঙ্গে আনা ভাল কাপড় পরে ফিটফাট হয়ে মাঠে নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে মিলিত হল। তাদের বাড়ি থেকে মা-বাপ ও অন্যান্য বোন-ভাইরাও ততক্ষণ এসেছেন।

 আর একবার ‘নবান্ন’র নিমন্ত্রণ করলুম। চায়ের পেয়ালায় প্রথমে এক এক পেয়ালা নবান্ন দেওয়া হল, তারপরে চা ও তার আনুষঙ্গিক সব কিছু এল।

 এই সময় ছেলেমেয়েদের একটি মিশ্র সঙ্গীত ক্লাবও খুলেছিলাম—আমাদের বাড়িতেই—ইংরেজী ও দেশী উভয়বিধ সঙ্গীতাভিজ্ঞদের সঙ্গীত-চর্চার জন্যে। এতে অতুলপ্রসাদ ও তাঁর বোনেরা সবাই ছিলেন। তাদের মুখে ও অতুলের নিজের মুখে তাঁর গান প্রথম শোনার সুযোগ হল। ‘উঠগো ভারতলক্ষ্মী’ সার্কাসে শোনা একটি ইতালীয় সরে বসান। বাঙ্গলা কথায় সুরটি ভারি খাপ খেয়েছে। আরও কতকগুলি প্রেমের গানের কথায় ও সুরে মুগ্ধ হলুম। তার মধ্যে আজও বিশেষ করে মনে পড়ে—

“আজি স্বরগ আবাস তুমি এসো ছাড়ি।
আজি বরষে বরষা বিরহ বারি!
আজি ফুলে নাহিক মধুগন্ধ,
মলয়ে নাহিক মৃদু মন্দ,
জীবনে নাহিক গীত ছন্দ
তোমারে ছাড়ি।”

 তাঁর যে যে গান তখন শুনেছিলাম সবগুলির স্বরলিপিই “শতগানে” আছে।

 ক্লাব থেকে মধ্যে মধ্যে একটি করে কন্সার্ট হত—তাতে বাইরের সকলকে নিমন্ত্রণ করা হত। শেষ কন্সার্ট হয়েছিল দিদির আয়োজনে খুব ধুমধাম করে আমার একটা জন্মদিনে। এ-ক্লাব চলল ততদিন, যতদিন মেয়ে মেম্বররা একে একে প্রজাপতির নির্বন্ধে দূরে সরে না পড়লেন।

 সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে প্রজাপতির বার্তা নিয়ে আমারও কাছে তাঁর দূত দুই-একবার উঁকি-ঝুঁকি মেরেছিল—কিন্তু বিধাতার দূত তাকে বিদায় করে দিলে—“এখনো সময় আসেনি” বলে। বিধাতার বিধান-পাশ হাতে নিয়ে সময় এল কয়েক বছর পরে পঞ্চনদের কূল হতে এবং আমায় বন্ধনে বাঁধলে।

 “হিন্দু-মুসলমান”এর উপর বক্তৃতাটি ভারতীতে বেরয় এবং ইংরেজীতে ভাষান্তরিত হয়ে এলাহাবাদের ‘‘Hindusthan Review’’তে দেখা দেয়। তাছাড়া “কংগ্রেস রিপাব্লিক” বলে ভারতীতে লেখা আমার আর একটি বাঙলা প্রবন্ধও “Hindusthan Review’’তে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়। এই দুটি প্রবন্ধ ভারতের উত্তর-পশ্চিমবাসী অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লালা লাজপৎ রায় সেই সময় একবার বাঙলা দেশে আসেন। প্রবন্ধ দুটি পড়ে ও যোগেশ চৌধুরীর কাছে ‘‘বীরাষ্টমী” প্রভৃতির কথা শুনে তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমি বাড়ি ছিলুম না। শুনলাম, এত আগ্রহ ছিল তাঁর—দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে বসে ছিলেন। কিন্তু সেদিন আমার ফিরতে অনেক দেরী হওয়ায় অবশেষে চলে যান। পরের দিন আবার আসেন। এবার আমার সঙ্গে দেখা হল ও অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথাবার্তা হল। তিনি জিজ্ঞেস করায় দেশকে স্বাধীন করার জন্যে আমি আমার প্ল্যান ব্যক্ত করলুম, তিনিও তাঁর প্ল্যান কতকটা বললেন। মিলে গেল অনেক, দুজনেরই মতে পেতে হবে—Victory from within or mighty death from without.

‘‘আত্মনৈব আত্মানং জয়তে
আত্মৈব রিপুরাত্মনাং।”

 ইতিমধ্যে বরোদা থেকে অরবিন্দ ঘোষের চিঠি নিয়ে আমার কাছে এলেন যতীন বাঁড়ুয্যে। অরবিন্দের দাদা অক্সফোর্ড-খ্যাত কবি মনোমোহন ঘোষ আমার খুব বন্ধু হয়েছিলেন। তাঁর অতি সুন্দর সুন্দর কবিত্বরসপূর্ণ চিঠিতে আমার ডেক্স ভরে গিয়েছিল। দুই ভাই-ই প্রকৃতিগত ‘visionary’ ছিলেন। একজনের vision বা স্বপ্ন কাব্যেই পর্যবসিত ছিল, আর একজনের vision কার্যে অনূদিত হল। যতীন বাঁড়ুয্যে যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্যে বরোদা সৈন্যে ভর্তি হওয়া একজন সামান্য সৈনিক। আমি তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে লাগলুম। সেও আমার খুব অনুগত হল। বারীন ঘোষের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে কলকাতার এক পাড়ায় ভারত-উদ্ধার দল স্থাপিত হল। যতীন বাঁড়ুয্যে তার একজন প্রধান কর্মকর্তা—সেখানেই খায়-দায়, থাকে, আর যারা দলে আসে তাদের কসরৎ ও ড্রিল করায় এবং ঘোড়ায়-চড়া শেখায়। ঘোড়ায় চড়তে জানাটা বরোদার একটা বিশেষত্ব। রাজপ্রাসাদের অঙ্গনে মহারাণী চিম্নাবাঈকে আমি দেখেছি, একজন শিখ সর্দারের সাহায্যে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘোড়াকে কাবু করা অভ্যেস করতে। যতীন বাঁড়ুয্যে তাদের দলের ছেলেদের উপরে বর্ণিত যা কিছু শেখাত, তাতে আমার অনুমোদন ছিল। খালি আমার মতভেদ হল যখন শুনলুম, তাদের দল থেকে ডাকাতি চালানর হকুম বেরিয়েছে। এ বিষয়ে নাকি নিবেদিতার সঙ্গে তাদের দলের সম্পূর্ণ ঐকমত্য ছিল। নিবেদিতা বলতেন বটে, ব্রিটিশ শাসনে দেশ থেকে চোর-ডাকাতের ভয় লুপ্ত হয়ে দেশব্যাপী শান্তি বিস্তারটাই হল এদেশের পুরুষদের পৌরুষ ধংসের কারণ; কতকটা অশান্তি না থাকলে পৌরুষ জাগ্রত হয় না, সেইজন্যে ডাকাত থাকার দরকার। ওখানে যা কিছু পরামর্শাদি হত, যতীন বাঁড়ুয্যে আমাকে জানাত। একদিন বললে—“কাল ভোর রাত্রে একদল লোক ডায়মণ্ড হার্বারের কাছে একটা বুড়ির বাড়ি গিয়ে তাকে মেরে মাটির নীচে পোঁতা তার অগাধ ধন নিয়ে আসবে। বুড়ির কেউ নেই।”

 আমি শুনে বললুম—“অতি চমৎকার কথা! এক অসহায় বুড়িকে মেরে তার ধন নেবে তোমরা! বাহবা! কত পৌরুষ!—এ রক্ত-কলুষিত ধন নিয়ে করবে কি তোমরা?”

 “দেশের কাজ করব।”

 “দেশমাতা কি তোমাদের এই মলিন হাতের কাজ গ্রহণ করবেন? তাঁর একটি নিঃসহায় নিরপরাধিনী বৃদ্ধা সন্তানের হনন তাঁর সইবে?”

 “নিশ্চয়ই! তিলক মহারাজের এই আদেশ।”

 “আমি কিছুতেই তা বিশ্বাস করতে পারিনে—যতক্ষণ না তাঁর নিজের মুখে শুনি। আমি যাব তাঁর কাছে, তাঁকে জিজ্ঞেস করব। যতদিন না আমি ফিরি, ততদিন পর্যন্ত এ হত্যা তোমরা স্থগিত রাখবে—আমাকে কথা দাও।”

 “আচ্ছা তাই হবে।”

 আমি দুই-একদিনের মধ্যে পুণায় গিয়ে তিলকের সঙ্গে দেখা করার আয়োজন করলুম। আমার পূর্বোক্ত বন্ধু ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট-জেনারেল মিস্টার হায়দরী ছুটীতে বম্বে যাচ্ছিলেন, আমি তাঁর সঙ্গে বম্বে বেড়াতে যার বললুম তাঁকে। তাঁকে জানালুম পথে পুণায় নামব আমি দুইএকদিনের জন্যে, সেখানে দু-একটি বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বম্বেতে আসব।

 পুণা এলফিনস্টোন কলেজের ভূতপূর্ব প্রফেসর আধ-পাগলা বৃদ্ধ গোবিন্দ কড়কড়ে আমাদের বহু পুরাতন পারিবারিক বন্ধু। তাঁকে টেলিগ্রাম করে দিলুম আমি আসছি। তিনি স্টেশনে আমায় নিতে এলেন। তিনি থাকেন খড়কি ছাউনিতে। খড়কি যেতে পথে মুলা ও মঠা দুই নদীর সঙ্গম দেখা যায়। এই সঙ্গমের একটি বাংলোতে যখন মেজমামা থাকতেন প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে, তখন আমার দাদা জ্যোৎস্নানাথের জন্ম হয় সেখানে, সুরেনের জন্মও তার এক বছর পরে এই সঙ্গমের ধারে। তাই দাদা ও সুরেন দুজনকেই “পুণা-ব্রাহ্মণ” বলি আমরা।

 গোবিন্দ কড়কড়ের বাড়িতে পৌঁছে স্নানাহার সমাপন করে তাঁকে বললুম—“মারহাট্টা পত্রের সম্পাদক এন সি কেলকার আমার বন্ধু। তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে যাব।” অপরাহ্নে গোবিন্দের ফিটন গাড়িতে কেলকারের বাড়ি পৌঁছলুম। তাঁকে বললুম—“তিলকের সঙ্গে আমার দেখা হওয়া একান্ত দরকার। তার বন্দোবস্ত করুন। তাঁর বাড়ি আমি যাব না, আপনার বাড়িতে তাঁকে ও আমাকে দুজনকেই আগামীকাল খেতে নিমন্ত্রণ করুন।” তিনি তাই করলেন। তখন তিলকের নামে তায়ি মহারাজ সংক্রান্ত ফৌজদারী মকদ্দমা চলছে। তাঁর বাড়ির মধ্যে, আশেপাশে—ডিটেকটিভ গিজগিজ করছে, তাঁর সঙ্গে সেখানে কথাবার্তা কওয়া একেবারে নিরাপদ নয়। তিলকের সঙ্গে যে দেখা করতে আসে, তারই উপর পুলিসের নজর পড়ে ও তার গতিবিধি বাধাসঙ্কুল হয়।

 পরদিন কেলকারের বাড়ি মধ্যাহ্ন ভোজনে তিলক মহারাজের সঙ্গে দেখা। তাঁর সে সময় এক মুহূর্তের অবসর নেই। নিজের ডিফেন্স নিজে প্রস্তুত করছেন। কেলকারের বাড়িতেও রাশীকৃত আইনের বই ও অন্যান্য কাগজপত্র সঙ্গে করে এনেছেন। আমার সঙ্গে তাঁর আগে কখনও দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, এই প্রথম দেখা। চেহারায় একটা বলশালিত্বের ও একটা অটল দৃঢ়তার ছাপ। গোখলের চেহারায় যে কোমলতা ছিল, তা নেই। যেন একটি সজীব দৃঢ় বলস্তম্ভ বসে আছেন আইনের বই ও নথিপত্র ঘেরাও হয়ে। কেলকারের কাছে আমার কথা শুনবামাত্র তিনি তাঁর এত কাজ সত্ত্বেও এসেছেন।

 আমার সমস্যা আমি তাঁকে বললুম—শেষে প্রশ্ন করলুম—‘‘আপনি কি যুবকদের ডাকাতির অনুমোদন করেন?”

 খুব জোর দিয়ে বললেন—“একেবারেই না। এ বিষয়ে ধর্মের দিক থেকে দুর্নীতি-সুনীতির কথা না তুলে শুধু রাজনৈতিক দিক থেকেই বলছি, পুণা-যুবকদের ডাকাতির অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি—এ-কাজ একেবারে নিরর্থক, নিষ্ফল। ধরা পড়বেই। আর দেশের লোককে খুন করে টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে দেশের লোককেই নিজেদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলবে। আমার এ বিষয়ে অনুমোদন একেবারে নেই—আপনি মুক্তঘরে সেখানে গিয়ে এ-কথা ঘোষণা করতে পারেন। যারা আমার নাম নিয়ে এ আদেশ প্রচার করছে তারা ঠায় মিথ্যে কথা বলছে।”

 আমি তাঁর কথায় আশাতীত আনন্দলাভ করলুম। সেই পর্যন্ত তিনি আমার পুজ্য হলেন। নেতার মতন নেতা বটে। হাল্কা মনে কেলকারের আয়োজিত ভোজ্যবস্তুর ‘বাসুন্দি’ ও ‘শ্রীখণ্ডে’র প্রতি বিশেষ করে অবহিত হলুম। তারপর বম্বেতে আট-দশ দিন কাটাতে গেলুম।

 সে সময় পুণায় একলা একলা গিয়ে তিলকের সম্মুখীন হওয়ার জন্যে একজন নিঃসঙ্গী বাঙালী মেয়েকে যে কতটা সাহস বুকে বাঁধতে হয়েছিল, তা কেউ অনুমান করতে পারছেন কি না জানিনে। যাহোক আমার যাত্রা সফল হল, সাহস সার্থক হল, এই আনন্দে পূর্ণ হয়ে আমি বাড়ি ফিরলুম ও যতীন বাঁড়ুয্যেদের সঙ্কল্পিত ক্রিয়ার প্রতিরোধ করলুম।