জীবনের ঝরাপাতা/তের

উইকিসংকলন থেকে
॥ তের॥
(দ্বিতীয় পর্যায়)
শান্তিনিকেতন ও লেখকতার প্রারম্ভ

দিদি যখন কলকাতার বাইরে নিজের ঘর-সংসার করতে গেলেন আমি তখন মার কাছে একা রইলুম। তখন থেকে মার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হল। বিলেত যাওয়ার আগে পর্যন্ত দাদাও ছিলেন, কিন্তু দাদা ব্যাটাছেলে তাঁর বহির্মুখী জীবন। তাঁর সখ অনুসারে তাঁকে আরবী ঘোড়া কিনে দেওয়া হয়েছিল। ভোরে উঠে ঘোড়ায় চড়ে বেড়িয়ে আসা, বিকেলে হয় সরেনদের বাড়ি যাওয়া নয় নিজেদের বাড়িতে তাকে ও অন্যদের এনে খেলাধুলা, সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে বাগানের গর্ত থেকে বেরন শেয়াল শিকার করা—এই সব তাঁর মুখ্য কাজ ছিল। পড়াশুনাটা গৌণ। সেই সময় ‘সখা’ নামে বালকবালিকাদের জন্যে মাসিক পত্রিকায় একটা কবিতা প্রতি-যোগিতা ঘোষিত হল। মা উৎসাহ দেওয়ায় আমি সেই প্রতিযোগিতার জন্যে দাঁড়ালুম। নির্দিষ্ট বিষয়ে কবিতা রচনা করে সখা-অফিসে পাঠিয়ে দিলুম। ফাস্ট আমিই হলুম, প্রাইজ পেলুম একখানা ইংরেজী ‘ক্লাসিকাল ডিক্‌শনারী', যত প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মাইথলজির গল্প। প্রকাশ্যে রচনায় এই আমার হাতে খড়ি। লিখতে আরম্ভ করেছিলুম কিন্তু কয়েক বছর আগেই। আমাদের শৈশবে সেই সময় একবার সপরিবারে বোলপুর যাওয়া হয়। সেকালের শান্তিনিকেতন সত্যই শান্তিনিকেতন ছিল, ছেলে- বুড়ো সকলেরই মনোমোহন। কর্মকোলাহল ও জনকোলাহলশূন্য, শুধু, শান্ত মৌন প্রকৃতির অবাধ রাজত্বের বিস্তার।

 শান্তিনিকেতন বাড়িটির গাড়িবারান্দার কার্নিসের উপর অনেকগুলি বড় বড় সমুদ্র-শামুক সাজান ছিল। এমন শামুক এর আগে আমরা কখনও দেখিনি, কি রহসময় মনে হত। তার ছিদ্রের ভিতর কান পাতলে এমন একটা শব্দ পাওয়া যেত ঠিক যেন সমুদ্র কল্লোল। সমুদ্র নিজের তরঙ্গঘন চিত্ত যেন চিরদিনের মত তার ভিতর রুদ্ধ করে রেখেছে। 'সমুদ্র' নামটাই তখন আমাদের পক্ষে রহস্যময় ছিল। কর্তা দাদামশায়ের চীন ভ্রমণে যাত্রার বার্তার সঙ্গেই সে নামটি আমাদের পরিচিত হয়েছিল। হয়ত সেই সময়ই তাঁর সংগহীত এই শামুকগুলি। আর রহস্যময় ছিল বোলপুরের খোয়াই পাহাড় ও তাদের মধ্যে দিয়ে বালির ভিতর থেকে ঝির ঝির করে বেরন জলের ঘোট ঘোট ধারাগুলি। ভূতত্ত্ব-বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ আরম্ভ হল আমাদের এখানকার প্রকৃতির ক্রোড়ে। প্রত্যেক বিজ্ঞানশাস্ত্রই মানুষের চিন্তারাজ্য প্রসারিত করে দেয়, কিন্তু ভূতত্ত্ব আর গ্রহনক্ষত্রতত্ত্ব এই দুটির মত মনকে সুদূরগামী, বুদ্ধিকে প্রশস্ত করার সহায়ক বিজ্ঞান আর নেই। দেশের ও কালের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ভূতত্ত্ব, আর উচ্চ থেকে উচ্চস্তরে উঠানর জন্যে গ্রহনক্ষত্রতত্ত্ব। আকাশ আকাশ আকাশ! ফাঁক ফাঁক ফাঁক! কি অন্তহীন ফাঁকা! যেদিকে চাও সেই দিকেই ফাঁকা! কোথাও কিছুতে আটকান নয়। মনকে একেবারে অনন্তের ধারণায় পাকা করে দেয়। কিন্তু অনন্ত খালি শুন্যতায় ভরলে পর্যাপ্ত হয় না, তার ভিতর একটি পূর্ণতার ভাৰও চাই। তাই ল্যাণ্ডস্কেপ পেণ্টররা বলেন সুবিস্তৃত ফাঁকার মধ্যে একটু জীবনের চিহ্ন থাকলেই তবে তার সৌন্দর্যের সম্পূর্ণতা হয়—সুদূরে একটি পাখী, একটি জানোয়ার বা একটি মানুষ। নয়ত অনন্ত একঘেয়ে ও শ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। জীবশরীরবৎ শরীরে আবদ্ধ জীবনের ধারণা না হলেও চলে বোধ হয়। শুধু জীবন্ততার একটি ধারণা চাই। যে অনন্ত অসীম প্রাণ সান্ত সীমাবান সকল প্রাণীর প্রাণের উৎস সেই এক অদ্বিতীয় প্রাণময়কে যদি এই ফাঁকায় ধরতে পারি তবেই আমার অনন্ত শূন্যতা অনন্ত পূর্ণতায় ভরে থাকে। তাই হয়েছিল আমার যখন আমি একবার হিমালয়ে কুলু পাহাড়ে যাচ্ছিলুম আমার পাঁচ বছরের পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে। তখন সেই অবাধ ফাঁকে ছিলুম শুধু আমরা দুটি ও সারা আকাশব্যাপী জীবন্ত ভগবান। কেমন ভগবান আমার? সুপ্ত নয়, জাগ্রত। অপানিপাদ নয়, সর্বতো চক্ষু সর্বত্র শ্রুতিমান গতিবান ব্যাপ্তিবান অন্তর ও বাহিরের আকাশে। আমাদের একটা চোখের জ্যোতি নয়, এমন সহস্র চক্ষের জ্যোতি তাঁর চোখে, একটা কানের শ্রণশক্তি নয়, এমন সহস্র কানের শক্তি। সেই চোখে আমাদের প্রতি নির্নিমেষে চেয়ে আছেন, সেই কানে প্রতি কথাটি শুনছেন। প্রাণময় প্রেমময় তিনি, মৃত নন, কালা কানা হাবা নন-মননময়, বিজ্ঞানজানাময়, জ্ঞানময়, সদা সচেতন, সদাজীবন্ততাময়। এই অনুভূতিটি আমি তখন আমার এক ইংরেজ বান্ধবীকে বর্ণনা করেছিলুম। তাঁর মনে ঐ বর্ণনাটি একটি গভীর রেখা কেটেছিল। বার বার সেটি ফিরে ফিরে আওড়াতেন।

 আমাদের সঙ্গে বোলপুরে যাত্রার পার্টিতে সেবার অনেক লোক ছিলেন। আমাদের প্রায় সমবয়সী, আমাদের চেয়ে অনেক বড়, সব রকমের। নতুনমামী, সরোজা দিদি, মোহিনীবাবু, এটর্নি কবি অক্ষয় চৌধুরী ও তাঁর শ্রী-মায়ের সঙ্গে পাতান নাম যাঁর “বিহঙ্গিনী”-এদের মনে পড়ে। বোলপুরের ছোট ছোট স্রোতস্বতীর ধারে মাঝে মাঝে এক একটি সুন্দর নুড়ি পাওয়া যেত! আমাদের কে একজন বিজ্ঞ লোকে বলেছিলেন এক- দিন-“এই যে সব নুড়ি দেখছ, এরা এককালে কোন ফল-ফুল ছিল, এখন জলের তলায় পড়ে থেকে জমে জমে পাথর হয়ে গেছে। এদের বলে ফসিল।” তাই শুনে জায়গাটা চিহ্নিত করে আমরা এক একটা আমলকী পতে পুতে রাখতে লাগলুম। একদিন অন্তর বালি খুড়ে খুড়ে দেখি সেটা কতদূর প্রস্তরায়িত হয়েছে। কে একজন বললেন-“আরে মুর্খরা অমন করে থেকে থেকে বালির থেকে বের করলে ও কি কখন পাথর হবে? চুপ করে পড়ে থাকতে দাও এখন। পঞ্চাশ বছর পরে এলে দেখবে আমলকী আর নেই, একটা নুড়ি পড়ে আছে ঐ জায়গাতে।” আমরা সেই পঞ্চাশ বছরের পরে ফিরে এসে নুড়ি দেখার আশায় আপাত চেষ্টা ছেড়ে দিলুম। পঞ্চাশ বছর যথাসময়েই অতিক্রান্ত হল, সে নুড়ির খোঁজে বেরুতে কিন্তু আর মনেও রইল না, বেরোইওনি কেউ। সে খোয়াইয়ের স্তুূপ, সে বালির বাঁধ, সে জলের ধারা কোথা দিয়ে কোথায় সরে গেছে কেউ নির্ধারিত করেনি। সারা সকালটা বেড়িয়ে ঘুরে ফিরে খাবার ঘুরে লম্বা টেবিলের ধারে বসে সকলে মিলে স্তুপীকৃত লুচি তরকারী ও বোলপুরের প্রসিন্ধ পাতক্ষীরের প্রতি সদাচরণ করে খানিকক্ষণ ধরে বিশ্রাম করতুম সবাই।

 এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে-আমার পিতৃদেবের অশুচ জাতিদের বিনা আড়ম্বরে শুচি করে নেওয়া, তাদের হাতে খাওয়া-দাওয়া ও সব রকম ভৃত্যগিরিতে তাদের নিযুক্ত করা। প্রায় বিশ বছর পরে পঞ্জাবের আর্যসমাজের সংস্পর্শে এসে অছুত উদ্ধার মহাঘটার সঙ্গে সম্পন্ন হতে দেখেছি—কিন্তু বোলপুরে বাবামহাশয় বিনা বাক্যব্যয়ে ডোম বরকন্দাজ স্বরুপ সর্দারের পুত্রকে নিজের খানসামা নিযুক্ত করে, ট্রেনিং দিয়ে দিব্যি উপযুক্ত চাকর তৈরি করে নিলেন। সে-ই টেবিলে আমাদের সবাইকে খাওয়াত, দরকার হলে লুচি ভাজা, মাংস রোস্ট প্রভৃতিও সে-ই করত। এতে উপস্থিত দলের কারো কোন আপত্তি হল না।

 শান্তিনিকেতনে এই সময় আমায় সব প্রথম লেখা পেয়ে বসল। ‘সখা’ আমাদের সত্যিকার সখা ছিল তখন। দুপুর বেলা ঘরের ভিতর বিশ্রাম করতে করতে তার সব রচনা পড়ে পড়ে আমায় রচনা চাপল। দুতিন দিন ধরে অন্যদের লুকিয়ে দু-একটা ছোট গল্প লিখলুম। সরোজা দিদি একদিন ধরে ফেললেন। আমার খাতা কেড়ে নিয়ে সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঠাট্টা করে করে বলতে লাগলেন-“লেখিকা হবেন সরলা! গল্প লেখা হয়েছে! কাগজে বেরুবে নাকি?”

 বড়দের ঠাট্টা-বিদ্রুপ ছোটদের মর্মবিদারক হয়, তাঁর ঠাট্টায় আমার লেখবার প্রবৃত্তি বন্ধ হয়ে গেল। তার অনেক পরে মায়ের উৎসাহে ‘সখা'তে কবিতা প্রতিযোগিতায় কবিতা পাঠালুম। লেখার স্রোতটা কিন্তু ধারাবাহিকভাবে তখন থেকে চলল যে তা নয়। তখন আমি বেশী নিযুক্ত থাকতুম পড়তে। স্কুলের পড়া বলছিনে বাঙলা সাহিত্য, বিশেষ করে পুরনো ভারতী। একেবারে মগ্ন হয়ে থাকতুম তার ভিতর। ঈলিয়াডের অনুকল্পে ‘রামিয়াড়’ প্রভৃতি নতুন মামার কৌতুক রচনা হাসিগত উচ্চ সাহিত্য-রসে আমায় একেবারে ভরপূর রাখত। তখন ভারতীতে প্রতি মাসে হাস্যপ্রধান ‘নক্সা’ বেরত। আমি একবার বিনা নামে একটা নক্সা লিখলুম। মা ভারতীতে বের করলেন। চলে গেল বড়দেরই কারো লেখা বলে। সেই পর্যন্ত নিজের উপর একটা ভরসা এল-লিখতে পারি। বহ, বর্ষ পরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গান যখন আমার কর্ণকুহরে এল- সেগুলো আর মজলিসী আমোদ-প্রমোদের কোটরে পড়ে থাকতে পেল। মহীশূর প্রবাসের অব্যবহিত পর্বে সেগুলি সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ভারতীতে একটি প্রবন্ধ পাঠালম-‘বাঙলায় হাসির গান ও তার কবি। সাহিত্যের সমুচ্চস্তরে তাদের আসন পাতা হয়ে গেল। দ্বিজ রায় শেষ পর্যন্ত আমার সে বন্ধুকৃত্যটি ভোলেন নি।

 ‘সখা’য় কবিতার পর ‘বালক'-এ আমার দু-একটা রচনা বেরয়। গিরীন্দ্রমোহিনীর সঙ্গে মার তখন ভাব হয়েছে ও ‘মিলন’ পাতাল হয়েছে। তাঁর দেবর অক্রূর দত্ত পরিবারের গোবিন্দ দত্ত রবিমামার বন্ধ ও সাহিত্য-রসিক। 'বালকে' প্রকাশিত আমার একটি লেখার তিনি খুব রসগ্রাহী হলেন ও রবিমামাকে সে বিষয়ে লিখে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন-“একদিন এই নবীন লেখনী বঙ্গ সাহিত্যে প্রবীণতায় নিজের স্থান নেবে।” রবিমামাই তাঁর চিঠি আমায় পড়ে শোনালেন একটু, হাসতে হাসতে। সে হাসি ঐ ভবিষ্যদ্বাণীর অনুমোদনে বা সন্দিহানে জানিনে। তখন আমার বয়স বার বছর।

 ইতিমধ্যে আমার এণ্ট্রান্সের টেস্ট পরীক্ষার দিন কাছাকাছি এল। মা শুনে না ভেবে চিন্তেই একটা মন্তব্য করে ফেললেন—“নিশ্চয়ই ফাস্ট হবি?” আমার শুনে হাসি পেল। এমন অদ্ভুত কথা মা কি করে বললেন? হেমপ্রভা থাকতে আমি ফাস্ট হব! কিন্তু আশ্চর্য এই যে মাতৃত্বচনই সত্য হল। শুধ, টেস্টে যে ক্লাসে প্রথম হলুম তা নয়, সেবার এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় আমিই পাস হলুম এবং স্কলার্শিপও পেলুম—আর হেমপ্রভা বেচারী কোন্ একটা বিষয়ে কম নম্বর পাওয়ার সবসদ্ধ একবারে ফেল হয়ে গেল। এই আঘাতে তার brain fever হল। দুবছর ধরে তার পড়া বন্ধ রইল।

 এবারকার এণ্ট্রান্স পরীক্ষায় ইতিহাসের কাগজ পড়েছিল এন ঘোষ, ব্যারিস্টারের হাতে। তিনি সেকালের ইংলিশ পাঠ্যপুস্তকের একজন ‘নোট' লেখক ও ‘ইণ্ডিয়ান নেশন’ সাপ্তাহিক কাগজের সম্পাদক। সেবার ইতিহাসের প্রশ্নাবলীর মধ্যে মেকলের ‘লর্ড ক্লাইভ' নামক পাঠ্যপুস্তকের উপর ভিত্তি করে ক্লাইভের বঙ্গবিজয় সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন ছিল। তাতে খুব বেশী নম্বর নির্ধারিত ছিল। আমি মেকলের প্রতিপাদ্য বাঙালী চরিত্রের হয়তার প্রতিবাদ করে পাঠ্যপুস্তকের লিখিত মন্তব্যের বিপরীত নিজের মন্তব্যপূর্ণ উত্তর দিয়েছিলুম। পরম্পরায় কানে এল মিস্টর এন ঘোষ তার দরুন আমার নম্বর না কেটে আমায় খুব ভাল নম্বরই দিয়েছিলেন, আর খোঁজ করেছিলেন এ মেয়েটি কে? কাদের বাড়ির? ইতিহাসের কাগজে নাকি আমি সেবার প্রথম হয়েছিলুম। তখন আমার বয়স তের বছর। বাঙালী জাতি সম্বন্ধে আমার আত্মাভিমান তখনই মাথা খাড়া করেছিল। এরই পূর্ণ বিকাশ দেখা দিলে বছর দশ-বার পরে কিপলিং-এর একখানা ছোট গল্পের বইয়ের একটা গল্পে বাঙালী জাতিকে ভীষণভাবে অবমানিত পেয়ে তার প্রতিবিধানকল্পে আমি যে দেশ ও জাতিব্যাপী প্রচেষ্টা আরম্ভ করলুম তাতে। সে বিষয়ে বিস্তারিত কথা যথাসময়ে আসবে। ইতিমধ্যে আমার বাঙালী জাত্যভিমানের মধ্য-বিকাশ হল প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি বঙ্গবীরদের স্মৃতি উদ্বোধক উৎসবের প্রবর্তনায়।

 আমি যখন এণ্ট্রান্স পাস করলুম ফণিদাদা তখন রাজসাহী কলেজে প্রোফেসর। মাকে দিদি সেখানে নিজের কাছে কয়েক মাসের জন্যে নিয়ে যাবার আয়োজন করলেন। সেবার এলাহাবাদে বোধ হয় প্রথম কংগ্রেসের অনুষ্ঠান চলছে। বাবামশায় সেখানে। আমি তাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেলাম। গাড়ি যখন ছাড়ে ছাড়ে আমার হঠাৎ কান্না পেল, আমি খুব কাঁদতে লাগলুম। মায়ের দয়া হল। তখনো সময় আছে, তাড়াতাড়ি আমার জন্যেও টিকিট নেওয়া হল। আমার কাপড়-চোপড় পরের ট্রেনে পাঠানর বন্দোবস্ত হল। আমি চল্লম তাঁদের সঙ্গে। সেই প্রথম কলকাতা থেকে দুরে বাঙলার অভ্যন্তরে যাওয়া আমার।

 সেদিন কেঁদে আমি জিতে গেলুম।

 কিন্তু ঐ বয়সে কান্নাটা আমার স্বভাবসিদ্ধ ছিল না—হাসিটাই আমার প্রকৃতিগত ছিল। কথায় কথায় কারণে অকারণে আমার হাসি পেত। ক্লাসে বসে প্রোফেসারের কাছে পড়ছি, হঠাৎ দক্ষিণের বারান্দার কার্নিসে বসে কাক কা কা করে ডেকে উঠলে হাসি সামলাতে পারতুম না। সর্বদা হাসিখুশির ও গল্প জমান স্বভাবের দরুনই বোধ হয় আমি স্কুলে ছোট-বড় সকলের লোকপ্রিয় ও বন্ধু ছিলুম।

 রাজশাহীতে স্যার তারকনাথ পালিতের পুত্র সিভিলিয়ান লোকেন পালিত এ্যাসিস্ট্যাণ্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের পারিবারিক বন্ধুত্ব। আমরা গিয়ে অবধি দিদির বাড়িতে তাঁর প্রায় সারাদিন কাটত। একবার করে কোর্টে যাওয়া ছাড়া। তাঁর পিতার মত তিনিও ভারী গল্পুড়ে ছিলেন, আর কি চিত্তহারক সব গল্প করতেন তাঁর কেম্ব্রিজের বন্ধুদের। তাঁর এক একজন বন্ধু নাম ধাম গণ ও কর্মে আমাদের এত পরিচিত হয়ে পড়েছিলেন ঠিক যেন আমাদেরই ব্যক্তিগত বন্ধু। লোকেন ছিলেন অত্যন্ত 'intellectual', ইংরেজী কাব্য ও সাহিত্যে গভীরভাবে প্রবিষ্ট, তাঁর সঙ্গে নানা কথার আলোচনায় সুখ ছিল। তিনি বললেন একদিন—“এত যে ভাব ছিল আমার ইংরেজ ও স্কচ সহপাঠীদের সঙ্গে নিজেদের মধ্যে কোন পার্থক্য বোধই আসত না—তবু যেদিন একদিন তাঁদের গান শুনলুম,

Rule Britannia! Britannia rules the waves!
Britons never shall be slaves.

—সেদিন অন্তরের গভীরতম স্তর থেকে অনুভব করলুম—আমি কত দূরে ওদের থেকে, কত পর ওদের।”

 সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক আলোচনায়, আহারে-বিহারে, আমোদ-প্রমোদে সবতাতেই লোকেন আমাদের সঙ্গী ছিলেন। একবার দিদিকে ও আমাকে ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ রচনার প্রতিযোগিতা দিলেন, “Love & Friendship."-আমি যা লিখেছিলাম, তার একটা সেণ্টেন্স আমার মনে পড়ে -"Friendship is love without its wings"- নিশ্চয়ই কোন ইংরেজ লেখকের লেখা থেকে ভাবটা পাওয়া-নয়ত এ বিষয়ে ওরিজিন্যাল গবেষণা তখন আমার মাথায় আসা সম্ভব নয়। সে সময় জর্জ ইলিয়ট প্রভৃতির বই খুব পড়তুম। যা হোক লোকে জানালে প্রতি- যোগিতায় আমার জিৎ হয়েছে এবং নির্ধারিত প্রাইজটি আমায় দিলে। দিদি রেগে গেলেন, বললেন লোকেন পক্ষপাতিতা করেছে, আগে থাকতে ঠিক করা ছিল ওর যে আমাকেই প্রাইজ দেবে-তার প্রমাণ এই যে, জিনিসটার উপর আগে থাকতেই আমার নাম লিখে রেখেছিল। জিনিসটা হচ্ছে প্রায় একশখানা ছবি সমেত একটা spectroscope, যার দুভাগে দুখানা একই রকম ছবি রাখলে focus হয়ে একখানা অতি সুস্পষ্ট বড় ছবি দেখা যায়।

 লোকেনের কৈফিয়ৎ তলব হল। সে বললে, তার জানা ছিল আমি বেশী ভাল করে লিখতে পারব। দিদির রাগ তাতে কমল না, আমি কিন্তু ওঁদের দুজনের ঝগড়া শুনে হেসে কুটিকুটি হলম। চিরকালই আমার এই স্বভাব—আমায় বা আমার সম্পর্কে কেউ রেগে কিছু বললে আমি হাসি।

 বিকেলে আমরা সবাই হেঁটে বেড়াতে বেরতুম। রাজশাহীর একটা দিকে তখন খুব জঙ্গল ছিল। একদিন জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া স্থির হল। অনেকে ভয় দেখালে-ও জঙ্গলে এখনও বাঘ থ্যকে। সাবধান করলে-সবাই একসঙ্গে কাছাকাছি থাকি যেন, আগে-পিছে না হই, জোরে জোরে শব্দ করে কথা কইতে কইতে আর হাততালি দিতে দিতে যাই যেন, আর সন্ধ্যা হবার আগেই যেন ফিরে আসি। শহুরে মেয়ে আমরা, বাঘ বেরনর ব্যাপারটা একটা কাল্পনিক কথা মাত্র, তার সত্যতায় বিশ্বাস নেই। সুতরাং তার ভয়াবহতাও আমার মনে এল না। বরঞ্চ হাততালি দিয়ে চলতে হবে শনে ভারি মজা লাগল। চিড়িয়াখানায় পিঁজরের ভিতর দেখা বন্ধ বাঘ যে জলজ্যান্ত খোলা বাঘ হয়ে আমাদের সামনে আসতে পারে, এমন অভূতপূর্ব অবস্থা হাস্যকরই ঠেকল। আমি একটা বোকা-ন্যাকার মত বললুম—“বাঘ বেরলে যদি তাকে দেখে আমার হাসি পায়।” “ওঁর সবতাতেই হাসি পায়!” দিদি বল্লেন—“আহামরি-শিশু!” লোকেন বললে—“হ্যাঁ তাই বটে! বাঘ বেরলে হাসি পাবে না আরও কিছু।”

 চিত্ত তখন একেবারে লঘু, ভয়-ভাবনার ধার ধারিনে, সবই মজার বিষয়, হাসির বিষয়! ভয়ের ভয়ঙ্করতা জানা না থাকার দরুনই নির্ভীক হয় মানুষ। কিন্তু যখন জানলুম, তখনও ভয়কে দুঃখকে চোখরাঙানিকে হাসি দিয়ে বঞ্চিত করার স্বভাব আমার রয়ে গেল; গভীর রাজনৈতিক বিপদের দিনেও মহাত্মা গান্ধী তাই একবার বলেছিলেন আমায়-"Your laughter is a national asset! Laugh away!” জীবনে কাঁদিনি তা নয়,— সে লুটোপুটি খেয়ে অন্তরের অন্তঃপুরে অনেকবার — লোকের সামনে নয়। বৌদ্ধ ত্রিপিটকে একটা গল্পে আছে, একজন বোধিসত্ত্ব বলছেন—“জনমে জনমে যত কান্না কেঁদেছি, তাতে অনেকানেক অশ্রুর সমুদ্র রচিত হয়েছে।” আমাদেরও একটা জন্মেরই কান্না জড় করলেও তাই হয়।