জীবনের ঝরাপাতা/দশ

উইকিসংকলন থেকে

দশ

উৎসব

 বাঙালী ঘরের বার মাসে তের পার্বণ আমাদের জীবনে ছিল না। যোড়াসাঁকোর ছেলেমেয়েদের উৎসবের মধ্যে ছিল এক ১১ই মাঘ। সেটা অন্যদের দুর্গাপূজার মত। অথচ দুর্গাপূজা উৎসবের অনেক অঙ্গ-বিচ্যুত আমাদের ১১ই মাঘ। প্রথমতঃ কুমোরের হাতে গড়া কালো মাটীর ঠাকুর ঢাকঢোল বাজিয়ে ঘরে এনে পূজোর দালানে স্থাপন করা, তারপর তাতে চোখের সামনে রং লাগান, চক্ষুদান—এসবের আমোদ ছেলেদের মোটেই হত না। এইতেই ত সাকার পূজায় ও নিরাকার ব্রহ্মোপাসনায় তফাৎ হয়ে গেল দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ট্রীটস্থ ৬নং বাড়িতে ও অন্যান্য ঠাকুর বাড়িতে—এমন কি পাশাপশি ছয়ের এক—৬।১—নম্বরের বাড়িতে। এটি ছিল আমাদের প্রমাতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় বাড়ির সব পুরুষদের বৈঠকখানা বাড়ি। পরে ভাইদের সঙ্গে মাতামহ দেবেন্দ্রনাথের বিষয় বিভাগ হলে—এটি হয়ে গেল তাঁর ভ্রাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের বাড়ি। গগনেন্দ্র সমরেন্দ্র ও অবনীন্দ্রের পিতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার মা ও মাতুলদের খুড়তুত ভাই ছিলেন। তাঁদের ৬।১নংয়ের বাড়িতে সবরকম পূজা আর্চা চলতে থাকল—শুধু ৬নংয়ে বন্ধ হয়ে গেল। তাঁরা অন্যান্য শাখার ঠাকুর গোষ্ঠী জ্ঞাতিদের স্রোতে গা ঢেলে দিলেন—৬নং সে স্রোত থেকে উঠে তীরে এসে দাঁড়াল একা। শুধু ধর্মগত বিশ্বাস ও পারিবারিক আচার-ব্যবহারে মহর্ষির বাড়ি আলাদা রইল তা নয়, সামাজিক মেলামেশা, পরস্পরের ক্রিয়াকর্মে যৌতুকাদি আদান-প্রদান, যাতায়াতাদিও বন্ধ হয়ে গেল। কেবল গুণ মামার সঙ্গে বড়মামা মেজমামাদের সোদরোপম থাকায় এ

   সামাজিক সম্বন্ধ একেবারে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি—মেয়েদের হয়ে গিয়েছিল। পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানের প্রতিস্থাপক বাড়ির কর্তারা হলেও, তার ধারক, চালক ও পোষক মেয়েরাই হন—গীতায় তাই বলা হয়েছে—বাড়ির মেয়েরা বিগড়লে বা বিমুখ হলে কুলাচার টেঁকে না। ও-বাড়ির কোন পূজাপার্বণে এ-বাড়ির বৌঝিরা যাওয়া বন্ধ করলেন, মহর্ষির কুলাচার স্বতন্ত্র হল, মহর্ষির ভাইদের কুলাচার পূর্ববৎই রইল। কিন্তু হিন্দু সাকারবাদীর পক্ষে নিরাকারেও ভগবদুপাসনা লঘুষ্মন্য নয়। তাই এ-বাড়ির ১১ই মাঘের উপাসনায় যোগ দিতে ও গান শুনতে ও-বাড়ির সবাই আসতেন—মেয়েরাও। পাথুরিয়াঘাটা থেকে রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, কালীকৃষ্ণ ঠাকুর প্রভৃতি বাড়ির কর্তারাই কিন্তু শুধু দুপুরবেলা একবারটি এসে মহর্ষির নিমন্ত্রণ রক্ষা করে চলে যেতেন, মেয়েরা নয়, মেয়েদের কাছে নিমন্ত্রণ পৌঁছতও না। বিজয়ার প্রণামও তাঁরা দিতে আসতেন। বাইরেই আসতেন, বাইরেই বসতেন, বাইরে থেকেই চলে যেতেন। তাঁদের আগমনবার্তা অন্দরে পৌঁছলেই বাড়ির মেয়ে বউয়েরা খড়খড়ি দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে তাঁদের দেখতে ধাবিত হতেন। ক্রমেই বেশি ছাড়াছাড়ি হতে লাগল। উত্তরপুরুষে মহর্ষির পরিবারের সঙ্গে অন্যান্য ঠাকুর পরিবারের ব্যবধান উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল, আর মহর্ষির ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে কমতে থাকল। ৬।১নং পাথুরিয়াঘাটা কয়লাহাটার সঙ্গে বৈবাহিকসূত্রে আবদ্ধ হতে লাগল। ৬নং রইল উন্নতশিরে দাঁড়িয়ে একা, নিজের বিশ্বাসে অটল, বিচারে স্বাধীন, আচারে স্বতন্ত্র। এমন দিন এল ব্যবহারগত যেসব সংস্কারে মহর্ষির পুত্রকন্যারা অগ্রণী হয়েছিলেন সমস্ত ঠাকুরগোষ্ঠীর শাখা-প্রশাখায় তা অনুপ্রবিষ্ট হল—অন্তঃপুর-প্রথা উঠে গেল, স্ত্রীশিক্ষার প্রচার হল, সঙ্গীতানুশীলন মেয়েদের জীবনের অঙ্গ হল। ভেদ রয়ে গেল শুধু, পূজা ও উপাসনাপদ্ধতিতে—এক কথায় ব্রহ্মোৎসবে বা দোল-দুর্গোৎসবে।

 আমরা তাই আর কিছু জানিনে, দেখিনি—শুধু ব্রহ্মোৎসব দেখেছি। অতবড় কথাটা আমাদের মুখ দিয়ে বেরোত না—আমাদের মুখে ও মনে ছিল শুধু একটি কথা ‘‘১১ই মাঘ”। সাধারণ ব্রাহ্ম ও নববিধানীদের কারো ছিল ১০।১৫ দিনব্যাপী, কারো একমাসব্যাপী ব্রহ্মোৎসব, আমাদের ছিল শুধু একটি দিন ১১ই মাঘ। কিন্তু আমাদের শৈশবে সেদিনের
আগমনীস্বরূপ আসত একমাস আগে থাকতে উঠানে লোহার থাম। অতি প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ও অত্যন্ত ভারি ভারি থাম, তার একটু, ধাক্কা লাগলেই মাথা ফেটে যেতে পারে। সেগুলিকে দিনকতক ধরে খানিকটা তফাৎ তফাৎ করে উঠানধারে লাইন টেনে ফেলে রাখা হত। তারপর অনেক হাত নীচু পর্যন্ত গর্ত খুড়ে বনিয়াদ মজবুত করে সেগুলি পোঁতা হত। ১০ই মাঘে এক থাম থেকে আর এক থামে গাঁদাফুলের মালা লম্বা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হত, আর তার মাঝে মাঝে থামের গায়ে শামাদান ও দেওয়ালে বেলোয়ারের ঝাড় লাগান হত। উপরের দুদিককার বারান্দায়ওবঝাড় টাঙ্গিয়ে রাখা হত। মোমবাতি কিন্তু মাত্র একদিন আগে বসান হত, বেশী আগে বসালে পাছে চুরি হয়ে যায়।

 ৯ই মাঘের দিন বিকেলবেলায় তেতালার ছাদ থেকে উঠানের উপর শামিয়ানা খাটান হলে সমস্ত বার বাড়িটা অন্ধকারে ছেয়ে যেত। কিন্তু সেই অন্ধকারই আমাদের মনে উৎসবের ভাবকে ঘনিয়ে আনত। বিজলীর প্রচলনে যেবার প্রথম উঠানে থাম আনা ও পোঁতা বন্ধ হল আমাদের আনন্দের একটা বড় অংশ কেটে ফেলে দেওয়া হল। বিজলীর দীপ-মালাতে চোখ অভ্যস্ত হতে ও মন তাকে মঞ্জুর করতে কয়েক বৎসর কাটল।

 এ-বাড়ির ১১ই মাঘের উৎসব এবং ও-বাড়ির পুজোয় একটা কিন্তু বড়রকম পার্থক্য ছিল ছেলেমেয়েদের পক্ষে-নতুন কাপড় পরা না পরায়। ১১ই মাঘে আমাদের নতুন কাপড় পরার কোন রেওয়াজ ছিল না, ভাল সাজগোজ করা হত এই পর্যন্ত। একমাস আগে থাকতে ঘরে ঘরে ‘পূজোর বাজার’ করে করে বাড়ির প্রত্যেক লোকটির হাতে নতুন কাপড় জামা উপহার দেওয়ার জনা সমগ্র বাঙালী জাতি যে নিযুক্ত থাকে, কলকাতার রাজপথে সেই সময় বড়মানুষদের ঘর থেকে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যে পূজোর তত্ত্ব বাহিত হয়—আমাদের বাড়িতে সে সবের কিছুই ছিল না। তাই প্রিপ্যারেটরি ক্লাসে উঠলে যখন একদিন আমাদের রচনার বিষয় দেওয়া হল, “A comparison between Xmas & Durgapuja”—আমার মাথায় বিশেষ কোন কথাই জুটল না। যে বিষয়ে জানি না কিছু, সে বিষয়ে লিখব কি? শিক্ষয়িত্রী আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ইঙ্গিত দিলেন—"Xmasএ বাড়ির লোকের সঙ্গে মিলনের জন্যে ইংরেজরা যেমন উন্মুখ থাকেন পূজোর ছুটিতে বাঙালীরাও তেমনি। Xmasএ খ্রীস্টানেরা পরস্পরকে যেমন উপহার দেন—পূজোর সময় হিন্দুরাও তেমনি।” এই মোটা রকমের কতকগুলি সাদৃশ্যের ইঙ্গিত পেয়ে একটা কিছু ধরতে ছুঁতে পেলুম—নয়ত ও বিষয়ে মাথা আমার একেবারে ফাঁক ছিল। যা লিখলুম এবার তাতে একটা রচনা খাড়া হয়ে উঠল বটে কিন্তু লেখাটা নিজের অভিজ্ঞতাপ্রসূত হল না, নিজের হৃদয়রসে জড়ান হল না।

  আমার বোধ হয় নতুন কাপড় পরাটা দুর্গাপূজার আনুষঙ্গিক ছিল বলেই দাদামশায় ১১ই মাঘের ব্রহ্মোপাসনায় সে জিনিসটা একেবারে স্থানই দেননি। কিংবা হয়ত ১১ই মাঘের উৎসব একটি বীজের ক্রমোদ্ভব-তাঁর বাড়িতে রামমোহন রায়ের প্রবর্তিত প্রথম ব্রহ্মোপাসনার সাম্বৎসরিক অনুষ্ঠানের অনুবত্তিমাত্র, মূলত পারিবারিক কোন ব্যাপার নয়, সুতরাং এতে পারিবারিক কোন বিশেষ বিধানের স্থান নেই, এই জন্যে সেদিন পরিবারে সকলের নতুন কাপড় পরার অবশ্যকর্তব্যতা বিবেচিত হয়নি বলতে পারিনে। ফলে ঐ দিনে নতুন কাপড় পরার সংস্কার আমাদের রক্তেমজ্জায় বসে যায়নি। বিজয়ায় পরস্পর-মিলন এবং সম্পর্ক-অনুযায়িক প্রণাম বা আলিঙ্গনাদি ব্যাপারও এ পরিবারের সংস্কারভুক্ত হয়নি। সেটা পরিবারের কারো কারো মধ্যে প্রচলিত হল আশু চৌধুরী ও তার ভ্রাতাদের সঙ্গে বিবাহসূত্রে জড়িত হয়ে তাঁদের পরিবারের অনুকরণে। কিন্তু আমাদেরও একটি পারিবারিক উৎসবের দিন ছিল যেদিন পরস্পরকে আলিঙ্গন প্রণামাদি করা হত। সে নববর্ষে, ১লা বৈশাখে। নতুন কাপড় পরার কতকটা রেওয়াজও সেইদিনটিতে ছিল। এক হিসেবে এইটিই আমাদের যথার্থ পারিবারিক মিলনের দিন। সেদিন অতি ভোরে ব্রাহ্ম মূহূর্তে দেউড়িতে ঘণ্টা বেজে উঠত। ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে উঠে, বাড়িসুদ্ধ পুরুষেরা সকলে প্রস্তুত হয়ে নবশুভ্রবস্ত্র পরিধান করে, উঠানে উপাসনা-সভায় সমবেত হতেন, আর মেয়েরা খড়খড়িতে। উপাসনাদি হয়ে গেলে বয়সের তারতম্য অনুসারে প্রণাম আলিঙ্গনাদি শেষ করে মেয়েমহলেও-সরবৎ পান করান হত বাইরে—তার বাড়ির লোকদের সেদিন সকলের একত্র ভোজন হত মধ্যাহ্নে। এক হিসেবে নববর্ষের মিলনোৎসবটি বেশি অন্তরঙ্গভাবে পারিবারিক হলেও ১১ই মাঘের উৎসবটিই উৎসব বলে আমাদের মনে প্রতিভাত হত। যাই হোক গুণে গেঁথে এই দুটি সামাজিক উৎসব ছিল আমাদের। বাকি যা ছিল— পৌষ-সংক্রান্তিতে পিঠে গড়া—সেটা একটা বিরাট অনুষ্ঠান বটে— এতবড় পরিবারের অনুকল—কিন্তু বাইরের সঙ্গে সংযোগের অভাবে ততটা উৎসবের মত নয়—ঘরোয়া আনন্দ, ননদ-ভাজ মেয়ে বৌরা মিলে গড়া ও বামুনেরা ভেজে দিলে এ-ঘর ও-ঘরে বণ্টন করা।

 ১১ই মাঘের উৎসব ছিল উপাসনা ও সঙ্গীত-প্রধান উৎসব। সেকালের ১১ই মাঘের বেদীতে উপবিষ্ট হতেন তিনজন আচার্য-তার মধ্যে কখনো কখনো দ্বিজেন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথও একজন আচার্য হতেনতাঁদের সমবেত কণ্ঠে বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণের বেদমন্ত্রধনিতে কর্ণ [তৃপ্ত হ'ত। ভক্ত দর্শকে। অর্ধেক উঠান ভরে যেত। বাকী অর্ধেক আগন্তুক আসত সঙ্গীতের মোহে। এমন বেদধবনিও বাঙলায় কেউ কোথাও শোনেনি ইতিপূর্বে, আর এমন গুরুগম্ভীর অথচ সুমধুর সঙ্গীত-রসে প্লাবিত হয়নি বাঙলার অঙ্গন। নদীয়ার কীর্তন এক জিনিস—এ আর এক জিনিস। বৈষ্ণব ভক্তদের কীর্তন ভাবেতে মজে দশাপ্রাপ্ত হয়ে ধুলায় অবলুণ্ঠন প্রধান, আর ১১ই মাঘের সঙ্গীত ভাবেতে উড্ডীন হয়ে মর্ত হতে স্বর্গে আরোহণ প্রধান। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ভ্রাতাদেরসহ ১১ই মাঘের সঙ্গীতের আসরে নামলেন তখন ব্রহ্মের উপাসনায় হৃদয়ের কোণে কোণে যেখানে যত নদী খাল বিল শুকনো ছিল সব ভরে উঠল। আর “মনে কর শেষের সেদিন কি ভয়ঙ্কর” নয়, শুধু, “তুমি অগম্য অপার” ইত্যাদি বর্ণনামূলক নির্গূণ ব্রহ্মের স্তুতি নয়। এখন হল সমস্ত বাহ্য বা অন্তর-প্রকৃতিতে প্রতিভাত সগুণ ঈশ্বরের আবাহন। বৈষ্ণবদের লক্ষী বিষ্ণ, বা শাক্তদের শিব কালীর স্থলে খ্রীস্টানদের Personal God-এর অবতারণা—

“বিশ্ববীণা-রবে বিশ্বজন মোহিছে
স্থলে জলে, নতলে বনে উপবনে,
নদী নদে, গিরি গুহা পারাবারে।”
 * * * *
“আজ আনন্দ প্রেমচন্দ্রে নেহারো
হৃদি-গগন-মাঝে!
করি জীবন সফল।”
 * * * *
হল— “তোমার কথা হেথা কেহত বলে না
করে মিছে কোলাহল,
সুধা-সাগরের তীরেতে বসিয়া
পান করে শুধ, হলাহল!”
 * * * *

হল— ‘অনেক দিয়েছ নাথ!
আমার বাসনা তবু, পূরিল না।
দীন দশা ঘুচিল না, অশ্রুবারি মছিল না
গভীর প্রাণের তৃষা মিটিল না মিটিল না॥
দিয়েছ জীবন মন, প্রাণপ্রিয় পরিজন
সুধাস্নিগ্ধ সমীরণ, নীলকান্ত অম্বর
শ্যাম শোভা ধরণী॥
এত যদি দিলে সখা,
আরো দিতে হবে হে,
 তোমারে না পেলে আমি
ফিরিব না, ফিরিব না!”

Personal God-এর অনুভূতি নিরাকারত্বে হয় না। যিনি চক্ষুষঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং তাঁকে চক্ষুকর্নবান চরণহস্তবান বলে কল্পনায় না আনলে অন্তরে তাঁকে অঙ্গন করে না দেখলে তাঁকে পাওয়াই হয় না। তাই রামমোহন যুগের পরবর্তী ব্রহ্মোৎসবের রবীন্দ্রের ব্রহ্ম বা ঈশ্বর ‘অপাণিপাদ' নন, তিনি ‘সর্বতো অক্ষি’ ‘সর্বত্র শিরোমুখ। তাই তাঁর পরিচালিত ১১ই মাঘে পর পর গাওয়া হয়েছে -

“বড় আশা করে এসেছি গো
কাছে ডেকে লও।
ফিরায়ো না জননি।
আর আমি যে কিছু চাহিনে,
চরণতলে বসে থাকিব,
আর আমি যে কিছু চাহিনে,
‘জননী' বলে শুধু ডাকিব। “
 * * * *
“আজি শুভ দিনে পিতার ভবনে
অমত সদনে চল যাই।”
 * * * *
"সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে
শোন শোন পিতা।”

“হেরি তব বিমল মুখভাতি
 দূর হল গহন দুখরাতি।”
 * * * *
“এস হে গৃহদেবতা এ ভবন।
 পুণ্য প্রভাবে কর পবিত্র!”
 * * * *
“তব প্রেম-আঁখি সতত জাগে
 জেনেও জানি না।”
 * * * *

হল— “এ কি অন্ধকার এ ভারতভূমি
বুঝি পিতা তারে ছেড়ে গেছ তুমি
প্রতি পদে পদে ডুবে রসাতলে
কে তারে উদ্ধার করিবে।”

আর কত তুলব? আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসঙ্গীত পুস্তকের প্রথম ভাগ থেকে দশম একাদশ ভাগ পর্যন্ত যত দূর ছাপান হয়েছে সগুণ সাকার ঈশ্বর ভাবের সব রকম সঙ্গীত স্তরে স্তরে সঞ্চিত আছে। ভাবের ও ভাষার পার্থক্য দেখলে চিনতে পারা যাবে রামমোহন রায়ের সময়কার নিরাকার ব্রহ্ম কেমন করে ভাবের ঘরে একদম সাকার হয়ে নেমে ব্রহ্মবাদীর আকার- নিরাকার অভেদ জ্ঞানের ভিত্তিই পুনঃস্থাপিত করলেন। অথচ ভাবের ছবির চৌকাঠ পেরিয়ে গেলেই—মাটি-খড়ে, ধাতু-প্রস্তরে, বর্ণে-চিত্রে ভাবের উপলক্ষ্য ভগবানকে পূর্ণ লক্ষ্য করে মূর্ত করে আঁকড়ে ধরলেই রবীন্দ্র- নাথ উত্ত্যক্ত বিচলিত হয়ে উঠতেন। তাঁর আজন্ম ‘নিরাকার' পূজার সংস্কারে ঘা লাগত। আশু, চৌধুরী ও তাঁর ভাইদের সঙ্গে যোড়াসাঁকোর, বৈবাহিক সংযোগ স্থাপনের কিছু পরে তাঁর ভগ্নী ডাক্তার উমাদাস বাঁড়ুয্যের পত্নীর সঙ্গে আমরা অনেকে ছুটী যাপনে বেনারসে যাই। প্রমথ চৌধুরীর তখন ইন্দিরার সঙ্গে সদ্য বিবাহ হয়েছে। তাঁরাও ছিলেন। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রকাণ্ড বাড়ি হরধাম-এ আমরা সবাই ছিলুম। বৌবাজারের বসু মল্লিক পরিবারের হেম মল্লিকও সেবার সপরিবারে বেনারস গিয়েছিলেন। এক রাত্রি আমাদের বিশ্বেশ্বর মন্দিরের প্রসিদ্ধ আরতি দেখানোর জন্যে তিনি বন্দোবস্ত করলেন। আমরা সবাই মন্দিরের সামনে বস্লুম। পাণ্ডারা আমাদের চারিদিক ঘিরে রক্ষে করতে লাগল—যাতে ভিড় ভেঙ্গে আমাদের উপর না পড়ে। সে কি আরতি! আর  ভক্তের কি ভিড় ও জয়োল্লাস! বিশ্বেশ্বরের সে আরতি দেখে চিত্ত পুলকিত নমিত না হয়ে যায় না। এতদিন শুধু গুরু নানকের পদভাঙা রবীন্দ্রের ব্রহ্মসঙ্গীত বলে গাইতুম—

“তাঁর আরতি করে চন্দ্র তপন
দেব মানব বন্দে চরণ
আসীন সেই বিশ্ব শরণ
তাঁর জগৎ মন্দিরে।”

আজ সেই গানের ভাবেরই সত্যবৎ অনুভূতি লাভ হল। আরতি শেষে শত সহস্র বৎসর ধরে অগণ্য ভক্তের ভক্তিভাব-ভরিত সেই গগনতলে বিশ্বেশ্বরের মন্দির-দ্বারে আজকের সহস্র সহস্র ভক্তদের ভক্তি-তরঙ্গে ভক্তি মিলিয়ে আমরাও উদ্দেশে প্রণত হলুম।

 এই কথাটা কলকাতায় ফিরে গেলে রবিমামার কানে যখন পৌছল তিনি আমাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট হয়ে বললেন—“তোরা এই রকম করে পৌত্তলিকতার প্রশ্রয় দিলি? মিথ্যাচার করলি?”

  হায়! ৬নং যোড়াসাঁকোর বাঁধা অবিশ্বাসের পথ থেকে সরে অনেক ছেলেমেয়ে বউই যে যুক্তির অবলম্বনেই পুরোন বিশ্বাসের valley-তে চলে এসেছেন সে বিষয়ে ক্রমেই যত পরিচয় পেতে থাকলেন ততই রবিমামা ক্ষুন্ন হতে থাকলেন।

 ছেলেবেলায় ১১ই মাঘের সঙ্গীতে আমরা যে অংশ গ্রহণ করতুম, সে বড়দের দ্বারা চালিত নিয়ত্রিত হয়ে যতটুকু করবার ততটুকু মাত্র; দিন পনের আগে থেকে গান-অভ্যাসের আসরে বসে গান শেখা ও সে রাত্রে গান গাওয়া এবং গানের সঙ্গে সঙ্গে বাজান। কিন্তু কয়েক বছর পরে নিয়ন্ত্রণের ভার কিছু কিছু, আমরাও নিলুম। আমাদের সঙ্গীতপ্রেম সেদিনটাকে কিছুটা নিজের নিজত্ব না দিয়ে পারলে না। আমরা চারজনে -সুরেন, বিবি, দাদা ও আমি প্রত্যেকে একটা না একটা কিছু যন্ত্র বাজা—কেউ কেউ দুটো তিনটেও বাজাতে পারতুম-হার্মোনিয়ম বাজানটা ত আমাদের গণ্যর মধ্যেই ছিল না। আমরা আপনা-আপনির মধ্যেই ইংরেজী গতের কনসার্ট প্রায়ই করতুম। ১১ই মাঘের সঙ্গীত প্রোগ্রামে প্রতি গানের আরম্ভে সেই গানের রাগ বা রাগিণীর খানিকটা আলাপ মিলিতযন্ত্রে খানিকক্ষণ ধরে করে তারপর গানটি ধরতে লাগলাম। আমাদের এই দলে প্রতিভা দিদির কোন কোন বোনও থাকতেন। সে সময়ে এবিষয়ে এত উৎসাহ ছিল আমাদের মনে পড়ে—একবার সকালের উপাসনায় যোড়াসাঁকোয় এসে, খেয়েদেয়ে আবার আমরা বিৰ্জিতলায়— তখন মেজমামীরা সেখানে থাকতেন—ফিরে গেলম, সেখানে সন্ধ্যের কনসার্টের জন্যে খানিকক্ষণ নিরিবিলি প্র্যাকটিস করে জিনিসটা সর্বাঙ্গ- শোভন করতে পারব বলে। আবার সন্ধ্যের পবেই যন্ত্রপাতি ঘাড়ে করে আমরা এসে স্ব স্ব স্থান গ্রহণ করলুম। গানের পূর্বে ইংরেজী ধাঁচের এই রকম খানিকটা উপক্রমণিকার দস্তুর এখন Radio এবং Gramo- phone Record গানে ঢুকেছে। সে সময় বাঙলা গানে এটা সম্পূর্ণ নতুন ছিল।

 একেই যোড়াসাঁকোর ছেলেমেয়েরা উৎসব-আনন্দে পরিক্ষীণ ছিল, ১১ই মাঘ ছাড়া কোন বড় উৎসব তাদের ছিল না—তার উপর লাহোর থেকে একবার ফিরে দেখি সেটিও তাদের প্রায় চলে গেছে। শান্তি- নিকেতনে রবিমামার আশ্রম জমে উঠবার পর থেকে তিনি বাড়ির ছেলে- মেয়েদের ত্যাজ্য করে তাঁর আশ্রমের ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিতে লাগলেন। ১১ই মাঘের উৎসবের জন্যে গান ও বাজনার প্র্যাকটিসে বাড়ির ছেলে- মেয়েদের আর যোগ রইল না। বোলপুর আশ্রমের ছেলেমেয়েরাই একে- বারে সেখান থেকে তৈরি হয়ে এসে গাইতে বসে যায়। আগেকার সঙ্গীতের অংশবহনে প্রতিভা দিদির যে বোনেরাও যুক্ত ছিলেন তাঁদের কাছে অনুযোগ শুনলুম—আমরা এ বাড়ির মেয়েরা কোথায় যাই? আমাদের আর পালপার্বণ নেই, ঐ একটি ১১ই মাঘ। হিন্দু বাড়িতে দুর্গাপূজার উৎসবে বাড়ির সব ছেলেমেয়েদের কি আহ্লাদ। লোকজনের আনাগোনা, আদর-অভ্যর্থনা, খাওয়া-দাওয়া, নতুন কাপড় পরে ঘরে ঘরে বেড়ান—তাদের কত রকমে্র; আনন্দ। আমাদের ১১ই মাঘে পারিবারিক খাওয়া-দাওয়াও কবে থেকে উঠে গেছে, বাকী ছিল ঐ গানবাজনায় যোগটুকু। রবিকাকা তা থেকেও আমাদের বঞ্চিত করে দিলেন। সারা বছরের এই একটিমাত্র পারিবারিক উৎসব আমাদের-তাও রইল না। আমরা কি সাধারণ সমাজের দলে ঢুকব এখন, না নববিধানের? আমরা যদি হিন্দু সমাজের বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তাতেও গঞ্জনা দেন। আমাদের ভাগ্যে তাঁর ঠাট্টা বিদ্রুপ অবজ্ঞা ঔদাসীন্য—পরের বাড়ির মেয়েদের ভাগ্যে ১১ই মাঘের উৎসব।

 এ বড় ভীষণ মর্মব্যথার অনুযোগ। বাস্তবিকই কর্তা দাদামশায় থাকতে থাকতেই ব্যয়সঙ্কোচের উদ্দেশ্যে ১১ই মাঘের উৎসবের কায়া মলিন ও ক্ষীণ হতে আরম্ভ হয়েছিল। তাঁর দেহাবসানের পর থেকে ওটি শীর্ণ-বিশীর্ণ হতে হতে এখন ত একরকম গতাসুই হতে চলেছে। যোড়াসাঁকোর উঠানখানা যতদিন রয়েছে, ততদিন বোধহয় কর্তা দাদা- মশায়ের উইল অনুসারে নমো নমো করেও ১৯ই মাঘ চালাতে হবে। সে উঠান কিন্তু এখন রাজপথ। সেজমামার ছোট ছেলে ঋতুদাদার অংশ একজন মারোয়াড়ীর কাছে বিক্রীত। তাদের উঠান দিয়ে যাতায়াতের অধিকার আছে। ১১ই মাঘের উপাসনা ও গান যখন চলছে ঠিক সেই সময় সেই অংশের ছাদ ও খড়খড়ি বেয়ে মাড়োয়ার গিন্নীর উনুন জ্বালানর ধোঁয়া ও ফোড়নের গন্ধ উঠানে চলে আসে। আর নীচেরতলায় উঠানের গায়ে সংলগ্ন বাড়ির ভিতরমুখো সব অন্ধকেরে ঘরগুলি খোট্টা ও দেশ-বিদেশী ভাড়াটাতে ভরা। তাদের আগমন ও নিষ্ক্রমণের কোন সময় নির্ধারিত নেই। ১১ই মাঘ ব্রহ্মোপাসনা সভার ভিতর দিয়ে যার যার যখন খুশী সভা ভেদ করে গতায়াত করতে পারে ও করবে। এই দুর্যোগের দিন বোলপুরের ছেলেমেয়েরাও আর গাইতে আসে না বোলপুরেই ধুমধাম করে ১১ই মাঘ হয়, এখানে কলকাতার বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীত-প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের জড় করে গানের যোগান হয়। যে সকল উৎসব অনুষ্ঠান যোড়াসাঁকোতে ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পরিবারগত, তাঁর মৃত্যুর পর থেকে ক্রমশ হয়ে গেল তাঁর কীর্তিমান কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতিষ্ঠানগত। যেমন ঐ বাড়ির ইমারৎখানা [ভিটাতে] মহর্ষির সম্পর্কিত যে কোন লোকের অধিকার নেই, তেমনি তাঁর প্রচলিত উৎসবাদিতেও আর তাঁর রক্তের বলেই কারো রক্তগত অধিকার নেই।

 পদ্মা যেমন কত প্রাচীন কীর্তি ও কীর্তিমান বংশের অবলোপ করে সরে গেছে আর এক প্রান্তে, মহর্ষি ও তাঁর বংশের যোড়াসাঁকোস্থ কীর্তি- কলাপ তেমনি পাশ কাটিয়ে গেছে চলে শান্তিনিকেতনে—যার ছাতিমতলার বুনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছে অভ্রভেদী রবীন্দ্র তাজমহল। যোড়াসাঁকো এখন কুজনের কানের দ্বারা রক্ষণীয় ধংসাবশেষ।