জীবনের ঝরাপাতা/বার

উইকিসংকলন থেকে

বার

স্থলে জলে

স্কুলের বন্ধু মেয়েদের মধ্যে দুচারজনের আমাদের বাড়িতে এসে মধ্যে মধ্যে থাকার কথা বলেছি। আমরা কিন্তু কোথাও গিয়ে থাকবার অনুমতি পেতুম না—একটি বাড়িতে ছাড়া—সে খুসীর পিতৃগৃহ দুর্গামোহন দাসের বাড়ি। তখন তাঁর সাহেবীপাড়ায় রডন স্ট্রীটে একটা প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ির উপরতলায় থাকতেন। স্বামী ও কন্যাগণসহ খুসীর বড়দিদি সরলা রায়—ডাক্তার পি কে রায়ের পত্নী—ঐ বাড়ির মাঝতলায় থাকেন। খুসীর মেজদিদি অবলা দাসের জগদীশ বসুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে। তিনি নিজের বাড়িতে থাকেন। খুসীদের মায়ের মৃত্যু অনেকদিন আগে হয়েছে। তখন খুসীর দুই কনিষ্ঠ ভাই সতীশ ও জ্যোতিষ—পরে এস আর দাস ও জে আর দাস বলে সুবিদিত,—খুব ছোট ছোট ছিলেন। শুনতে পেতুম তাদের পিতা দুর্গামোহন দাস মাতৃহীন বালকদের এত সযত্নে ও সস্নেহে পালন করতেন, অনেক সময় মা বেঁচে থাকলেও শিশুরা অত আদরযত্ন পায় না। একবার জ্যোতিষের অসুখের সময় ডাক্তাররা মাসাবধি তার সন্দেশ রসগোল্লা খাওয়া নিষেধ করে দেন। সেই সময় দুর্গামোহনবাবু নিজেও তা খাওয়া বন্ধ করলেন—পাছে তাঁকে খেতে দেখলে ছেলের লোভ হয়। প্রতি পদে পদে সন্তানদের সঙ্গে তাঁর সহানভূতির যোগ। তাই জন্যে সন্তানদের পিতৃভক্তিও তাঁর স্মৃতিতর্পণে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। এমন কি বৃদ্ধ পিতার সঙ্গিহীন দোসরহীন জীবনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা তাঁর সেবা, শুশ্রূষা ও একটি জীবনসঙ্গিনী লাভের প্রতি দৃষ্টি রেখে অতুলপ্রসাদ সেনের বিধবা মাতার সঙ্গে তাঁর বিবাহ সংঘটন করেন। অতুলপ্রসাদ ও তাঁর তিনটি বোনের পালনপোষণের ভার তিনিই গ্রহণ করলেন, ঠিক যেন নিজের ছেলে ও মেয়েদের মতই তারাও হল।

 আমাকে খুসী যখন তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে লাগল, দেখলুম এদের বাড়ির চালচলনে অনেকটা সাহেবিয়ানা ঢুকেছে—বিশেষতঃ মিসেস পি কে রায়ের। তাঁর তিনটি মেয়ে লরেটো কন্‌ভেণ্টে পড়তে যায়। আমাদের বাড়ির থেকেও প্রতিভাদিদি, তাঁর দুই-একটি বোন ও বিবি—এঁরা লরেটোতে পড়তেন। কিন্তু বাড়ির হাওয়ায় ইংরেজীয়ানা মাথা তুলতে পারত না। এখানে বাঙালী মেয়েদের বাড়িতেও পরস্পরের সঙ্গে সদাসর্বদা ইংরেজীতে কথোপকথন সর্বপ্রথম শুনতে পেলুম। তার বেশ একটা চটক ছিল, বাঙালী ছোট মেয়েগুলির মুখে ফুট ফুট করে ইংরেজী ভাষণ বেশ মিষ্টি লাগত। কিন্তু সে মিষ্টতা আপাতমধুর—দেশপ্রিয়তার উজানে টেনে নিয়ে যাওয়া মিষ্টতা। বড় হয়ে যখন কালের হাওয়ার ধাক্কা খেয়ে আবার দেশের দিকেই চলতে ইচ্ছা হবে, তখন অনেক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অগ্রসর হতে হবে। ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের যে সব মেয়েরা শুধু ইংরেজীতেই শিক্ষা পেয়েছেন—গোড়ার দিকে বাংলা লেখাপড়া মোটেই শেখেন নি—পরজীবনে আহরিত বাঙলার উচ্চারণে তাঁদের একটা আড় থেকে যায়—না সেটা মেমেদের স্পষ্ট বিকৃত উচ্চারণ—না বাঙালীর স্বাভাবিক বাঙলা উচ্চারণ।

 খুসী ও অবলাদিদি—লেডি বোস—বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে বাঙলা স্কুলে মানুষ। অবলাদিদি উত্তরজীবনে তাঁর কার্যে-কলাপে আচারেঅনুষ্ঠানে প্রতি পদে পদে স্বদেশ ও স্বদেশী-প্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। আর সরলাদিদির সম্বন্ধে জনশ্রুতি এই যে, বেঙ্গল পার্টিশন আন্দোলনের সময় একদিন তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজের সামনে দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন। তাঁর গাড়িতে হোয়াইটওয়ে লেডলর দোকান থেকে নেওয়া বিদেশী সওদা বোঝাই করা ছিল। স্বদেশীমত্ত একদল ছেলে তাঁর গাড়ি রুখে গাড়ির সামনে রাস্তায় শুয়ে পড়ে তাঁকে অনুরোধ করলে—“মা বিদেশী জিনিসগুলো ফেলে দিন, নয়ত আমাদের বুকের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান।’’ সেদিন ফলে কি হল ইতিহাসে তা লেখে না। কিন্তু সরলাদিদির বিদেশী ব্যবহার কোনদিন কম হতে দেখি নি। ‘গোখলে মেমোরিয়াল স্কুল’—তাঁর কীর্তি, যেমন ‘ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়’ বলতে গেলে—অবলাদিদিরই কীর্তি। এই দুই স্কুলের পরিচালনার বিভিন্ন আদর্শেই দুই বোনের মনস্তত্ত্বের ভিন্নতা সুপরিস্ফুট।

 খুসীর ভিতর কর্মবেগ ছিল না, কিন্তু আমাদের বাড়ির সংসর্গে ভাবেতে ও রুচিতে স্বদেশী হয়ে উঠেছিল। কর্মের দিক থেকেও একটি কর্মে সে আমার মায়ের সহায়তা করেছিল। পূর্বে বলেছি বৃত্তি দিয়ে শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করে অন্তঃপুরে পাঠানর লক্ষ্য সখিসমিতির ছিল। সে লক্ষ্য সিদ্ধ হওয়া সময়-সাপেক্ষ; কারণ যে সব মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া হতে লাগল, তারা নিজেদের পড়াশুনা সাঙ্গ করে উপযুক্ত হলে তবে ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াবে। ইতিমধ্যে কিন্তু দুই এক বাড়ি থেকে আবেদন আসল শিক্ষয়িত্রীর জন্যে। খুসীর তখন বিয়ে হয়েছে—বিডন স্ট্রীটে বাঙালী পাড়াতে থাকে। তখনও তার সন্তানসন্ততি হয় নি। সে মাকে বললে—“আমার হাতে অনেক সময় রয়েছে, আমি যাব পড়াতে। ছাত্রীরা যে মাইনে দেবে সেটা সখিসমিতির ফণ্ডে জমা হোক।” খুসী যতদিন যেতে পারলে ততদিনই কিন্তু সখিসমিতির এই কাজটি চলল। কারণ বৃত্তিধারিণী মেয়েরা কেউ কার্যক্ষেত্রে নামেন নি। বৃত্তিবলে শিক্ষাপ্রাপ্তা মেয়েদের ভাগ্যে বর জোটার ছোঁয়াচ লাগল। বৃত্তি গ্রহণের সময় একটা সর্তে তাদের বা তাদের অভিভাবকদের স্বাক্ষর দিতে হয়েছিল। তার মর্ম ছিল যে—এত বছর ধরে লেখাপড়া শিখে উপযুক্ত হবার পর এত বছর সখিসমিতির কাজ করতে হবে, না করলে তার জন্য সখিসমিতি যত টাকা খরচ করেছে ততটা টাকা সখিসমিতিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সর্তটা শুধু কাগজে লেখাই রয়ে গেল। না কেউ কাজ করলে, না কারো পূর্ব অভিভাবক বা স্বামী তার হয়ে টাকাটা সখিসমিতিকে ফিরিয়ে দিলে—একজন মাত্র কিয়দংশ ছাড়া। সখিসমিতির পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে মকদ্দমা আনা যেতে পারত—কিন্তু সখিসমিতি তার থেকে বিরত রইল। যারা চুক্তি ভঙ্গ করলে, তাদের পাপ তাদের শিরে বোঝাই করে রাখলে, এবং অন্তঃপুরে শিক্ষয়িত্রী পাঠানর কল্পনাটি সখিসমিতির প্রোগ্রাম থেকে একেবারে মুছে ফেলা হল। একাজ বহু বৎসর পরে হাতে নিলুম আমি—‘ভারত স্ত্রী মহামণ্ডল’ খুলে।

 সাহেব পাড়ায় একটি বাঙালী পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে খুসীর বিশেষ বন্ধুতা ছিল—তাঁরা জস্টিস চন্দ্রমাধব ঘোষের পত্নী, মেয়ে ও বৌ। তাঁর ছোট মেয়ে জগদীশ রায়ের স্ত্রী নলিনীর সঙ্গে খুসীর ‘জ্যোৎস্না’ পাতান ছিল। একবার খুসীদের বাড়ি যখন গেছি সে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে। এ বিষয়ে মায়ের অনুমতি নেওয়া হয় নি, তাঁকে না জানিয়ে কারো বাড়ি বেড়াতে যেতে খুব দ্বিধা আসতে লাগল মনে। খুসী বললে—“তোমার ভয় নেই, আমি গিয়ে তোমার মাকে বলব, কিছু বলবেন না তিনি।”

 গেলুম সেখানে। গিয়ে যে অপূর্ব আনন্দ পেলুম তা আর বলবার নয়। চন্দ্রমাধব ঘোষের বড় মেয়ে—‘দিদিমণি’ সকলেরই দিদিমণি, তিনি টাকীর জমিদারনী, অল্প বয়সে বিধবা, নিঃসন্তান। বৈধব্যের পর পিতৃগৃহে মেম গবর্নেসের কাছে ইংরেজীতে সুশিক্ষিতা, বাঙলা ত ভালরকম জানেনই। আমাদের বাড়ির ধরনধারণ, শিক্ষাদীক্ষা, সাহিত্য ও সঙ্গীত—সব কিছুর প্রতি তাঁদের বিপুল শ্রদ্ধা। সেই বাড়ির একজন মেয়েকে—স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যাকে—নিয়ে আসাতে খুসীর প্রতি ভারি কৃতজ্ঞ হলেন, যেন আকাশের চাঁদ হাতে এনে দিয়েছে। আমার সঙ্গে তাঁদের স্নেহবন্ধন এত সুদৃঢ় হল—আমাকে এত চাইতে লাগলেন—খুসী যেন পিছনে পড়ে গেল। সত্যি তা নয়। তাঁদের হৃদয়ে খুসীর আসন তেমনি অটল রইল, শুধু আর একজনের জন্যে আরো একখানা আসন পাতা হল।

 তারপরে আমার গান গাওয়ার পালা আরম্ভ হল—সেই যেমন অন্যান্য বাড়িতে হত; গায়িকার পক্ষে একটা তফাৎ এই যে, অন্যান্য বাড়িতে পুরুষ শ্রোতা ও সমজদার—এ বাড়িতে রসগ্রাহিণী মেয়েরা শুধু—যাঁদের সঙ্গে আমার রুচিতে রুচিতে হৃদয়ে হৃদয়ে মিল হয়ে গেল। নলিনীর ছেলেমেয়েরা দিদিমণিরই ছেলেমেয়ে যেন। তার দুটি ছেলে রবি, ছবি ও দুটি মেয়ে বীণা, বিভা। ছবির ভাল নাম অশোক—যিনি এখন স্যার এ কে রয়। তাকে দিদিমণি পোষ্য নিয়েছেন, লোকে দিদিমণিকেই তাঁর মা বলে জানে—বাড়িসুদ্ধ ছোটদের সবারই তিনি ‘মামণি’।

 বীণা স্কুলে যাবার যোগ্য হলে তাকে লরেটোতে পাঠান হল। সুন্দর মেয়েটির সুন্দর ঢলঢলে হাবভাব—সেজন্যে প্রাপ্য প্রশংসা প্রকৃতিদেবীর—আর সুন্দর তার পরিচ্ছদ—সেজন্যে প্রাপ্য প্রশংসা দিদিমণিদের সুরুচির। ছেলেবেলা থেকে লরেটোতে গিয়েও, ফিরিঙ্গি মেয়েদের সঙ্গে মেশামিশি করেও, বাড়িতেও ফিরিঙ্গি গবর্নেসদের দ্বারা পরিবৃত হলেও বীণার ভিতর এতটুকু ফিরিঙ্গিয়ানা প্রবেশ করতে পারলে না, দিদিমণিদের সুচারু অভিভাবকতায়।

 রসায়নশাস্ত্রে বলে এমন এক একটা ধাতু আছে যা সবেতে dissolve হয়ে যায়—মিশ খায়। আমার ভিতর বোধহয় সেই রকম কোন একটা পদার্থ ছিল যাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির লোকের সঙ্গেও মিশ খেয়ে যেতুম। খুসীর বড়দিদি মিসেস পি কে রায় আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়—আর আমার জাতীয় আদর্শ ও তাঁর আদর্শে মিল ছিল না—তবু তিনি আমাকে টানতে লাগলেন। তাঁর কতকগুলি গুণে আমি মোহিত হলুম। খুব আমুদে মজলিসী, হাসিখুশিতে ভরা, লোককে যত্ন করতে আপনার করে নিতে অদ্বিতীয়। তাঁর অন্তরে একটা seriousness—একটা গভীরতা ছিল, যা সচরাচর দেখা যায় না। বড় রকম কিছু-না-কিছু একটা করবার ইচ্ছা ভিতরে ভিতরে তাঁকে সর্বদা অনুপ্রেরিত করত। যদিও বাঙলা বেশী পড়েন নি—কিন্তু ইংরেজী ভারি সাহিত্যে Emerson প্রভৃতির রচনায় বিশেষ অনুরক্ত। তাঁদের লেখা নিয়ে, আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে আলোচনা করতে বসে যেতেন। সবচেয়ে ভাল লাগত আমার তাঁর একাধারে ইংরেজীয়ানা ও দিশীয়ানা। যখন বালিগঞ্জে ছিলেন, তখন রবিবার দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্যে তাঁর বাড়িতে প্রায়ই লোকসমাগম হত ও বিকেলে টেনিস খেলা হত, অনেক বাইরের লোক আসতেন। রাঁধুনে নেই হয়ত, অসুখ করেছে। ঘর্মাক্তদেহে সারাদিন নিজে রেঁধেবেড়ে—বাঙাল দেশের নানা সুস্বাদু ব্যঞ্জন ও বিকেলে চায়ের জন্য নানারকম খাবার—গা হাত ধুয়ে কাপড় ছেড়ে ফিটফাট হয়ে টেনিস কোর্টে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে দুচার হাত টেনিস খেলতেন, অতিথিদের আপ্যায়িত করতেন, পীড়াপীড়ি করে এটা ওটা সেটা খাওয়াতেন। রোগীর সেবায়ও একান্ত তৎপর দেখেছি তাঁকে। বিদেশীরা তাঁর গৃহে স্বগৃহের মত আরাম ও যত্ন পেত। একজন নরুইজিয়ান থীস্ট অর্থাৎ ব্রাহ্ম একবার কলকাতায় আসেন। গরীব, অর্থসম্বল বিশেষ নেই। আমাকে বলে তাকে আমায় ফ্রেঞ্চ পড়াবার জন্যে রাখালেন। কিছুদিন পরে কঠিন কলেরা হল তার। সেই সময় সরলা রায় তাকে যেভাবে নার্স করলেন—না দেখলে অনুমান করা যায় না। বেচারাকে কিন্তু বাঁচাতে পারলেন না। মৈসোর থেকে রামস্বামী আয়েঙ্গার এসে তাঁরই বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। অতুলপ্রসাদ সেনের বোনের সঙ্গে তার বিবাহবন্ধন তিনিই বেঁধে দেন। গোখলে আর এক বিদেশী তাঁর আতিথ্য-নিগড়ে ধরা পড়লেন। শেষাশেষি কলকাতায় এলেই সরলা রায়ের গৃহই গোখলের আবাসস্থান হত। গোখলের সঙ্গে তাঁর সম্প্রীতির চরম নিদর্শন “গোখলে মেমোরিয়াল স্কুল"।

 এ সব অনেক পরের ঘটনা। আমার পঠদ্দশাতেই খুসীর সঙ্গে তাদের বাড়ি আনাগোনায় তার বড় দিদির সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হল। দুর্গামোহন দাস ও চন্দ্রমাধব ঘোষ এই দুই পরিবারের সঙ্গে আমার সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে আমার মায়ের অনুমোদন ত রইলই, তিনি নিজেও সংযুক্ত হলেন। সরলাদিদি সখি-সমিতির একজন উৎসাহী মেম্বর হলেন। দিদিমণিরাও হলেন।

 একবার পূজার ছুটিতে ডাক্তার পি কে রায় ও মিসেস রায় মাদ্রাজ হয়ে মহীশূরে যাত্রার সংকল্প করলেন—রামস্বামী আয়েঙ্গার এ বিষয়ে তাঁদের উৎসাহদাতা। সরলাদিদি আমায় বললেন—‘‘যাবে সরলা আমাদের সঙ্গে? চল না।” আমি বললুম —“মা-রা কি যেতে দেবেন।” তিনি বললেন —“আমি বলে মত করিয়ে নেব।” সেকালে জলপথে ছাড়া মাদ্রাজ যাওয়া যেত না। আমি কখনো সমুদ্র দেখিনি, জলযাত্রাও করিনি। এ ভয়ানক সুযোগ—ওঁদের মত অভিভাবকের সঙ্গে যাওয়া। মা-বাবামহাশয় অনুমতি দিলেন। এই প্রথম বড় স্টীমারে চড়লুম আমি। এর আগে গঙ্গায় নতুনমামার ‘সরোজিনী’ বোটে মেজমামীদের সঙ্গে জলের উপর বাস কখনো কখনো করেছি। স্থির ধরণীর বক্ষে স্থল-বাস ছেড়ে, কূলে বাঁধা তরণীর বক্ষে জলবাসের স্বাদ পেয়েছি। নিঝুম রাত্রে কোন স্টীমার বা বড় নৌকার ধাক্কায় যখন আমাদের বোট হঠাৎ দোলায়িত হয়ে উঠে তখন ঘুম ভেঙে অন্যান্য নৌকা থেকে মাঝিরা নানারকম কলরব করে, তাদের কণ্ঠধ্বনি-মুখরিত আকাশের স্পর্শ পেয়ে মনে আসে বাড়িতে শুয়ে নেই, এক অভিনব পারিপার্শ্বিকে রয়েছি। ভোর হলে কুয়াসায় ছাওয়া গঙ্গার স্বচ্ছতা নিরোধ হয়ে যায়, কুয়াসা সরে সূর্যোদয়ের অনেক পরে সূর্য দৃশ্যমান হলেও সে সূর্যের সঙ্গে বাড়ির চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা বৈধ হয়, আর বোটের জানলার ধারে বসে জলের তলায় চলায়মান জলজীবদের গতিবিধি দেখতে মজা লাগে—আমাদের নিত্যপরিচিত নিত্যঅভ্যস্ত স্থলজগৎ নয়, আর এক সম্পূর্ণ বিভিন্ন জগতে যে এসেছি তা হৃদয়ঙ্গম হয়। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান স্টীম ন্যাভিগেশন কোম্পানির সমুদ্রগামী এক বৃহৎ জাহাজে মাদ্রাজ অভিমুখে যাত্রা করলুম। যেন হঠাৎ বিলেতের একখণ্ডে পদার্পণ করেছি। এখানে একেবারে ইংরেজী জীবনযাত্রা প্রণালী। ভোরের বেলায় ক্যাবিনের ভিতর স্টুয়ার্ডেস চা ও বিস্কুট দিয়ে যায়। তারপর উঠে স্টীমারের সরকারী স্নানাগারে লম্বা টবে স্নান করে সারাদিনের মত বেশভূষা করে নিয়ে ৯টার সময় ভোজনাগারে যাওয়া। সেখানে প্রত্যেকের আলাদা স্থান নির্দিষ্ট আছে। আমাদের তিনজনের একটা টেবিল। ইংরেজী রকম প্রাতরাশের পর ডেকের উপর গিয়ে স্ব স্ব আরামকেদারায় বসে বা অর্ধশয়ান হয়ে বই পড়া, দৃশ্য দেখা, মধ্যে মধ্যে উঠে ডেকে পায়চারি করা, সহযাত্রীদের কারো সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলে তাদের সঙ্গে গল্প করা—এই কাজ। কলকাতার জানাশুনা ইংরেজ ও আর্মানী দুই একজন ব্যারিস্টারও এই জাহাজে মাদ্রাজ বেড়াতে যাচ্ছিলেন। এই করতে করতে ১টা হয়ে যায়—তখন মধ্যাহ্নভোজনের জন্যে ভোজনাগারে পুনঃপ্রবেশ। এটা একটা গুরুভোজ, প্রাতভোজনের মত লঘু নয়। এর পর স্ব স্ব ক্যাবিনে গিয়ে বিশ্রাম এবং ঘণ্টা তিনচার পরে কেকাদি-সমন্বিত বৈকালিক চা-পান হয় ক্যাবিনেই বা স্টীমারের ড্রইংরুমে। তারপর ডেকের উপর গিয়ে পাদচারণ বা কোন ব্যায়াম কিংবা ক্রীড়ার দ্বারা সান্ধ্যভোজনের জন্যে ক্ষুধা সঞ্চার। ডিনার খেতে ভোজনাগারে আসার সময় ডিনার সাজ পরে আসা চাই—নয়ত অভদ্র দেখাবে। মেয়েরা সেই সময় নিশ্চয়ই রেশমের পোশাক পরবেন—সূতির নয়। এই হল কায়দা। সেই কায়দা অনুসরণ করে যে যত চলবে, সে তত সভ্য বলে গণ্য হবে—নয়ত অসভ্য আখ্যা পাবে। চতুর্থ দিনে মাদ্রাজ পৌঁছন গেল। এর মধ্যে দেড় দিন মাত্র আমি খাড়া ছিলুম ও স্টীমারের জীবনপদ্ধতি অনুসরণ করেছিলুম। তারপরেই সমুদ্রব্যাধির কবলে পড়লুম। ক্যাবিনেই আমার দিনরাত্রি কাটতে লাগল—কোন কিছু খাওয়ার রুচি আর রইল না—খাদ্যবস্তু দেখলেই গা-বমি করে উঠত। স্টুয়ার্ডেস অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে আমাকে একটু কিছু খাওয়াত। এই খাওয়ার প্রাচুর্যের জন্যেই অনেক সাহেব-মেম সমুদ্রযাত্রায় যেতে চায়। যাতায়াতের কয়লা খরচের চেয়ে খাবার যোগানতেই স্টীমার কোম্পানীর বেশি খরচ হয়। তাই খাবারের দামটা ভাড়ার অন্তর্গত। খাও আর না খাও—খাবারের দামটা ভাড়া থেকে কাটান যায় না।

 চতুর্থ দিনে মাদ্রাজের উপকূল দেখা গেল। বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছিল জাহাজ। এবার জাহাজ থেকে তীরে পৌঁছতে ‘কাটামারন’ নামে এক জাতীয় দিশী নৌকার আশ্রয় নিতে হবে। জাহাজ থেকে কাছি ধরে খালাসিদের সাহায্যে কোনরকমে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাইতে বাহিত হয়ে তীরে উঠতে হবে। তাতে ঝাঁপান, ঝাঁপিয়ে পায়ের ব্যালান্স রেখে দাঁড়ান বা বসা—এসবই মারাত্মক ব্যাপার। এ ‘কাটামারন’ কিন্তু মারণ উচাটনের দ্বারা কোন যাত্রীর কোনদিন অপঘাত মৃত্যু ঘটায়নি। মাদ্রাজের বন্দরে আর কোন উপায়ে সেকালে যাওয়া অসম্ভব ছিল—উপকূলের সমীপস্থ জল ভীষণ দুরন্ত—তার বশীকরণ এই কাটামারনের দ্বারাই নির্বিঘ্নে হত। আমাদের অভ্যর্থনা করতে কূলে দাঁড়িয়েছিলেন বাঙালী বন্ধু—রজনী রায় মহাশয়—মাদ্রাজের তদানীন্তন একাউণ্টাণ্ট জেনারেল। তিনি দাস পরিবারের বিশেষ বন্ধু—তাঁর স্ত্রী বিধুমখী দেবী সুশীলাদিদির সম্পর্কে আমার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁদের ওখানে আট-দশদিন কাটল আমাদের। রজনীবাবু তাঁর মাদ্রাজী বন্ধুদের পালা করে প্রতিদিন নিমন্ত্রণ করতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার জন্যে। এঁরা কিন্তু সবাই প্রায় শিক্ষিত খ্রীস্টান বা ব্রাহ্মসমাজী। তাঁদের হিন্দু উচ্চশ্রেণীর কোন মাদ্রাজী বন্ধু দেখলুম না। মাদ্রাজের হিন্দুরা তখন অত্যন্ত গোঁড়া।

 রজনীবাবুদের হাতায় একজন সাধারণ মাদ্রাজীর গান শুনতে পেয়েছিলুম একদিন। আমার আর কাজকর্ম নেই—তাকে বাড়ির বারান্দায় ডাকিয়ে তার দুই একটা গান শিখে নিলুম, একটা হচ্ছে—

“বারুং নালুঙ্গুড়া কৈধঁন্নি লে
বাসুদেব কি বরপুত্র!
রত্নসিংহাসন তল রাজয়ি রূপরিন্না
রি—রি—রি—রি—রি!”

 কথা আমাদের পক্ষে উৎকট—কিন্তু সুর চমৎকার। একদিন ডিনার পার্টিতে সমাগত মিস্টার রায়ের মাদ্রাজী অতিথিদের তাঁদের দেশের গানই আমার মুখে শুনিয়ে দিলুম। তাঁরা অবাক হলেন, নিজেরা খ্রীস্টান, তাই ইংরেজী গান ছাড়া নিজের দেশের গান তাঁরা গান না। আমার ‘রি—রি—রি—রি’র আবৃত্তিতে বিশেষ আমোদ পেলেন, বললেন মাদ্রাজী সঙ্গীতের চেহারাটি একেবারে ঠিকঠাক ধরে ফেলেছি। যেমন ইতিপূর্বে বাঙাল মাঝিদের গানে “মনমাঝি সামাল সামাল ডুবল তরী ভবনদীর তুফান ভারি—ই—ই মনমাঝি"তে ‘ই’র টান ধরায় তাদের গানের চেহারা ফুটেছিল। এই আমার দক্ষিণী গান সঞ্চয়ের সূত্রপাত। রজনীবাবুর কন্যারাও গান করতেন—বিশেষত বড়মেয়েটি—সুকুমারী সুগায়িকা, কিন্তু আমার মত বাতিকগ্রস্ত ত নয়। নাহলে কয়েক বৎসর মাদ্রাজে থাকতে কত মাদ্রাজী সর পুঁজি করে বাঙলাদেশে আনতে পারতেন। তা করেননি তাঁরা—বাঙালীসুলভ অন্য জাতির প্রতি ঘৃণাবশত তাদের সঙ্গীতে কোন চমৎকারিতা পান না, যা পান শুধু, একটা হাসিকৌতুকের অবসর।

 মাদ্রাজ থেকে আমরা মহীশুরে গেলুম। সেখানে ডাক্তার রামস্বামী আয়েঙ্গারের মাতুল দরবার বক্সী। তিনিই আমাদের অভ্যর্থনার সব আয়োজন করেছেন। আমরা সেখানে রাজ-অতিথি। মহীশূরে পদার্পণ করে দেখলুম একেবারে সঙ্গীতের রাজ্যে প্রবেশ করেছি। সারাদিনরাত্রি বায়ুতরঙ্গে সঙ্গীত ভেসে আসছে। উত্তর ভারতের সঙ্গীতের মত নয়, দক্ষিণের একটি নিজস্ব অপূর্বতাসম্পন্ন। ‘মহারাণী গার্লস স্কুল’ দেখতে গেলুম। সেখানে দেওয়ানের পৌত্রীর তরঙ্গায়িত কণ্ঠে ত্যাগরাজ নামে প্রসিদ্ধ তেলেগু কবির রচিত অনেকগুলি ওদেশী ক্লাসিকাল গান শুনে মুগ্ধ হলুম এবং মেয়েটিকে বাড়িতে আনিয়ে তার কাছ থেকে সেগুলি আদায় করলুম। দেশে ফিরে রবিমামাকে উপঢৌকন দিলুম। তিনি তাদের ভেঙে ভেঙে ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করলেন—বাঙলার সুররাজ্য বিস্তৃত হল। ইতিপূর্বে গুজরাট থেকে তাঁদের নিজে সংগীত গুজরাটি ভজনের কথা ও সুর এবং শিখগুরুদের পঞ্জাবী গীতের ভাব ভাষা ও সুর নিয়ে মাতুলেরা আগেই বাঙলা সঙ্গীতের ভাণ্ডারে প্রাচুর্য এনেছিলেন। নারীনাং মাতুলক্রমঃ। আমি তাঁদেরই গতানুগতিক হয়েছিলুম।