বিষয়বস্তুতে চলুন

জেলের খাতা/নিজের কথা

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় চিন্তা

নিজের কথা

প্রথম অধ্যায়

 ভগবৎ কৃপায়, এই সংসারে এই জন্মেই, প্রায় পঞ্চাশ বৎসর কাটিয়া গেল। এই অর্দ্ধশত বৎসরের প্রতি যখন ফিরিয়া চাহি, ভগবানের অত্যদ্ভুত লীলা দেখিয়া অবাক্ হইয়া যাই। এ জীবনে সুখ দুঃখ অনেক পাইয়াছি, কিন্তু এই জীবনব্যাপী চেষ্টার সফলতা নিষ্ফলতার এক কণামাত্রও আজ পরিবর্ত্তন করিতে সাধ হয় না। এ জন্মে অপরাধ অনেক করিয়াছি। লোকে যাহাকে পাপ বলে, তারও গণনা করা সম্ভবপর নহে। প্রতিদিনই শতবার আদর্শচ্যুত হইয়া পড়িয়াছি। যাহা বলা উচিত ছিল না, তাহা বলিয়াছি, যাহা করা উচিত ছিল না, তাহা করিয়াছি; জীবনের বিবিধ সম্বন্ধের যথা কর্ত্তব্য পদে পদে অবহেলা করিয়াছি। গুরুজনের প্রাপ্য গুরুজনকে দেই নাই। পিতার আদেশ অহংবশে শতবার অমান্য করিয়া তাঁহাকে অশেষ ক্লেশ দিয়াছি। তাঁর সে অতুল স্নেহের মর্য্যাদা, তাঁহার জীবদ্দশায় দিনেকের তরেও বুঝি নাই, রাখি নাই।’ বন্ধুবান্ধবদিগের উপর সতত আব্দার করিয়াছি, কত উপদ্রব করিয়াছি। কিন্তু কখনো প্রকৃতপক্ষে তাঁদের প্রণয়ের মর্য্যাদা রাখি নাই, সর্ব্বদা নিজের খেয়ালের বা প্রবৃত্তির বশবর্ত্তী হইয়া তাঁদের অনুরোধ উপরোধ সকলই পায়ে ঠেলিয়া চলিয়াছি। ইচ্ছা করিয়া যখন সংসার পাতিলাম, নূতন সম্বন্ধে আবদ্ধ হইলাম, সতীর প্রেম, পুত্রকন্যার ভক্তি ও ভালবাসা এ সকলও যখন পাইলাম, তখনও আপনাকে ছাড়িয়া ইহাদের প্রতি যে কর্ত্তব্য তাহাও ভাল করিয়া পালন করিতে পারি নাই। সংসারের কোন কর্ত্তব্যই পালন করা হয় নাই। অপরাধ লোকে যাকে বলে, আমার জীবনে তার গণনা হয় না, দোষ আমার অগণ্য। পাপ আমার অসংখ্য, কিন্তু এ সকলের জন্য, কখন প্রাণে বিন্দু পরিমাণেও প্রকৃত অনুতাপের উদ্রেক হয় নাই। অনুশোচনা মাঝে মাঝে ভোগ করিয়াছি; ক্লেশ পাইয়া, অভাব দেখিয়া, নিরাশায় পড়িয়া, সুখ বা সম্মানের হানি আশঙ্কা করিয়া, সময়ে সময়ে গভীর অনুশোচনা হইয়াছে। কিন্তু সত্য বলিতে কি, এ জীবনে এক মুহূর্ত্তের জন্যও অনুতপ্ত হই নাই। আর আজ এই প্রায় অর্দ্ধশতাব্দীর কর্ম্মাকর্ম্ম লক্ষ্য ও পরীক্ষা করিয়া, অকপটে এ কথা বলিতে পারি, যে এ জীবনের মানচিত্রে একটী ক্ষুদ্রতম, সূক্ষ্মতম রেখাও পরিবর্ত্তিত বা পরিবর্দ্ধিত হউক, ইহা কখনই ইচ্ছা করি না।

 হে ভগবন্, সত্য সত্য আজ তোমাকে জীবনের যা অকর্ম্ম করিয়াছি, আর যা সুকর্ম্ম করিয়াছি তৎসমুদায়ের জন্য ধন্যবাদ করি। যা সুখ পাইয়াছি আর যা দুঃখ ভুগিয়াছি তৎসমুদায়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি। মিলনের আনন্দ যাহা দিয়াছ, বিচ্ছেদের দাহন যাহা দিয়াছ, তৎসমুদায়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি। অনেক চাহিয়াছি, তাহা দিয়াছ, আবার অনেক চাহিয়াছি তাহা দাও নাই, তৎসমুদায়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি। আযাচিতভাবে যাহা মুখে তুলিয়া দিয়াছ, বুকে আনিয়া রাখিয়াছ, আর কাঁদিয়া কাটিয়াও যাহা তোমার নিকট হইতে পাই নাই, লুব্ধ করিয়া যাহা প্রাণের দরজা হইতে ফিরাইয়া লইয়াছ, সে সমুদায়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি উভয়ের জন্য তোমায় ধন্যবাদ করি। প্রভো! জীবনে ভুলভ্রান্তি অসংখ্য কুইয়াছে, কত অসত্যকে সত্য বলিয়া আলিঙ্গন করিয়াছি, কত সত্যকে অসত্য বলিয়া দূরে ছুড়িয়া ফেলিয়াছি, উৎসমুদায়ের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি। আমার অহঙ্কার ও বিনয়, ক্রোধ ও ক্ষমা, ভোগ ও বৈরাগ্য, অধর্ম্ম ও ধর্ম্ম, অকর্ত্তব্য ও কর্ত্তব্য, অজ্ঞান ও জ্ঞান, অভক্তি ও ভক্তি, আরম্ভ ও অনারম্ভ, বন্ধন ও মোক্ষ, মান ও অমানিতা, বিপদ ও সম্পদ, বিচ্ছেদ ও মিলন, নিরাশা ও আশা সকলের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ করি।

 কোন্ প্রাণে, ঠাকুর, আবার বলিব যে এ জীবন এমন হইলে ভাল হইত? ভাল কাকে বলে, আর মন্দ কাকে বলে, আমি কি তা জানি, না যাহা সময় সময় ভাল মন্দ বলিয়া মনে হয়, তাহাই আমি স্ব চেষ্টায় লাভ বা বর্জ্জন করিতে পারি? যদি তা পারিতাম, যদি তা বুঝিতাম, সে ভার যদি আমার উপরে তুমি রাখিতে, তবে তোমার ঈশ্বরত্ব, তোমার বিধাতৃত্ব, তোমার নিয়ম্ভূত্ব কোথায় থাকিত, প্রভো! তবে কে তোমাকে “লা সরিক্” বলিতে পারিত? তাহা হইলে এ সংসার যে ভাগের সংসার হইয়া পড়িত। তাহাকে বহু কর্ত্তা, বহু প্রভু, বহু বিধাতা আসিয়া দখল করিতে চেষ্টা করিতেন। আর যদি কেহ বলে যে জীবনের দুঃখের মোহের পাপের কর্ত্তা আমি, আর সুখের, জ্ঞানের, পুণ্যের কর্ত্তা তুমি; তোমার সঙ্গেও, ক্ষমা কর, তেমন ভাগের ব্যবসায়ে আমি রাজি নই। লাভ টুকুন তুমি সব নিবে, আর লোক্‌‌সান যত সব আমার হাতে দিবে, এ তো মানুষের হিসাবেও ন্যায়পর হয় না, ন্যায়বান ঈশ্বর, তোমার বিধানে কি এ ব্যবস্থা কখন সম্ভব হইতে পারে? যদি পাপ আমার হয় তবে পুণ্যও আমারই। মন্দের ভাগী যদি আমি হই, তবে ভালরও পুরা ভাগ দিতে হবে। আর তাই যদি হয়, তবে আমি কেবল কর্ম্মাধীন হইয়া পড়িলাম, তোমর সঙ্গে ত আর কোন সম্পর্ক রহিল না। এ যে নাস্তিক্য। এ যে দক্ষিণায়ন বৌদ্ধমত। কর্ম্মই কর্ম্মের প্রবর্ত্তক, পুরুষকারই কর্ম্মের কর্ত্তা;—এখানে এতদতিরিক্ত কর্ম্মাধিপের স্থান কোথায়? আর তাই যদি হয়, তবে কর্ম্ম যেমন পুরুষাধীন পুরুষও তেমনি কর্ম্মাধীন হইয়া পড়েন। কর্ম্ম পুরুষকে বাঁধিতে চাহে, পুরুষ কর্ম্মকে রোধিতে চাহেন; —ইহাই তো, তাহা হইলে, সংসারের মর্ম্ম হয়। আর জীবন যদি এই নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামেরই নামান্তর হয়, তবে সংগ্রামের জয়-পরাজয়ে দুঃখ, বেদনা ও অনুশোচনার অবসর থাকে বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনুতাপের অবসর কোথায়? আর পুরুষ যখন একদিন না একদিন আপন কর্ম্মকে অভিভূত করিয়া, কর্ম্মচক্রের বহির্ভূতে, নির্বাণ লাভ করিবেই করিবে, তখন দুদিনের শক্তি পরীক্ষায় কর্ম্ম বা প্রবৃত্তি যদি তাহার উপরে জয়লাভই করে, তাতেই বা কি আসে যায়? আর এও তো সত্য যে পুরুষের ধর্ম্ম ও নিয়তি যেমন মুক্তি ও নির্ব্বাণ, কর্মেরও তো ধর্ম্ম এবং নিয়তি সেইরূপ ক্ষয় ও বিলোপ। কর্ম্ম আপনি আপনাকে ক্ষয় করে। তাহা না করিলে পুরুষ কখন মুক্তিলাভ করিতে পারিত না; আর করিলেও, সে মুক্তি সার্ব্বজনীন হইত না, কেহ বা আকস্মিক ঘটনায় কখন কর্ম্মবন্ধন ছেদন করিতে পারিত, অনেকে অনন্তকালই তাহাতে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়া থাকিত। সংসারবন্ধন মোচন তবে শুদ্ধ আকস্মিক ঘটনার অধীন হইত, পুরুষেরও অধীন নহে, ঈশ্বর যদি থাকেন, তাঁহারও অধীন নহে। কিন্তু সংসারকে তো কখনও এমন নিরীশ্বর বলিয়া ভাবি নাই। আর যে ভাবেই দেখি না কেন, এ দীর্ঘজীবনে যাহা ঘটিয়াছে, যাহা হারাইয়াছি, যাহা পাইয়াছি, তার এক কণাও আমি পরিবর্তন করিতে পারিতাম না; পারিলেও, ঠাকুর, পশ্চাৎ দিকে চাহিয়া এখন নিঃসংকোচে বলি,—এক কণাও তার পরিবর্ত্তিত করিতাম না। এই কারণেই জীবনের সুখ দুঃখ, আশা নিরাশা, পাপ পুণ্য, ভাল মন্দ, সকলের জন্য তোমাকে সরল হৃদয়ে ধন্যবাদ করি।