ঝাঁশির রাণী/ইংরাজের সহিত যুদ্ধ
ইংরাজের সহিত যুদ্ধ।
ইংরাজ-সৈন্য ঝাঁশি-অভিমুখে কুচ করিয়া আসিতেছে এই সংবাদ ঝাঁশিতে আসিয়া পৌছিল, তথাপি ঝাঁশির প্রধান-বর্গ সে বিষয়ে বড় মনযোগ দিলেন না। লালাভাউ বশি, নানা-ভোপট কর প্রভৃতি,ঝাঁশি-দরবারের পুরাতন মুছুদি (ষ্টেট সমান) লক্ষ্মণ-রাওবাওে নামক ঝাঁশির নবীন দেওয়ানকে অনেক করিয়া বুঝাইলেন, কিন্তু তিনি গর্বভরে তাহাদের কথায় ধিক্কার করিলেন। শুদ্ধ তাহা নহে, রাণীঠাকুরাণীর সহিত যাহাতে তাহাদের সাক্ষাৎ না হয় তাহারও উপায় অবলম্বন করিলেন। তথাপি, নানা-ভোপটকর রাণীঠাকুরাণীর সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিয়া রাষ্ট্রীয় ব্যাপার সম্বন্ধে সমস্ত কথা নিবেদন করিয়া অবশেষে এইরূপ প্রার্থনা জানাইলেন। “আমি কঁশি-রাজ্যের সেবায় বহুকাল অতি- বাহিত করিয়াছি; অতএব, আমার প্রার্থনা এই, ইংরাজ-সরকারের নিকট যেন একজন উকীল অবশ্য-অবশ্য পাঠানো হয়। বিদ্রোহীদিগের সহিত আপনার কোন সম্বন্ধ নাই, ইংরাজের হুকুম-অনুসারেই আপনি রাজ্যের বন্দোবস্ত করিয়াছেন এবং ইংরাজের হিতোদ্দেশেই আপনি বোছার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে দমন করিয়াছেন এই সমস্ত কথা ভাল করিয়া বুঝাইবার জন্য একজন সুচতুর উকীলকে পাঠানো আবশ্যক। আপনি ইংরাজ-সরকারের নিকট পত্র প্রেরণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু সে পত্র নির্বিঘ্নে পৌঁছিলেও সমস্ত বিষয়ের স্পষ্ট বোঝাপড়া হইবে কি না, সে বিষয়ে আমার বিলক্ষণ সন্দেহ আছে।” নানার ন্যায় দুরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচারক্ষম ব্যক্তির এই কথা শুনিয়া, রাণীঠাকুরাণী, গোয়ালিয়র ও ইন্দোরের পোলিটিক্যাল এজেণ্টের নিকট ইংরাজি ভাষাভিজ্ঞ একজন সুচতুর ব্যক্তিকে দূতস্বরূপ পাঠাইবার জন্য দেওয়াজিকে হুকুম করিলেন। দেওয়ান, নবীন কর্মচারিদিগের মধ্য হইতে, অকৃতকর্ম্মা, রাষ্ট্রব্যবহারানভিজ্ঞ এক ব্যক্তিকে এই কার্যে নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন, সে ব্যক্তি এজেণ্ট সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া, অন্যস্থানে বসিয়া কতকগুলা জাল-পত্র লিখিয়া পাঠাইল এবং ঝঁশিদরবারের লোকেরাও সেই সকল পত্রের উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত রহিল। কথায় বলে, “দুমন্ত্রী রাজনাশায়;”—এ কথার যাথার্থ এইস্থলে বিলক্ষণ প্রতিপাদিত হইল।
এদিকে, ইংরাজদিগের প্রতিশোধ-তৃষ্ণা প্রবল হইয়া উঠিয়াছে, ঝাঁশির হত্যাকাণ্ডে রাণীর বিলক্ষণ যোগ ছিল এইরূপ তাহাদের দৃঢ়বিশ্বাস জন্মিয়াছে। মধ্য-হিন্দুস্থান মধ্যে ঝাঁশি-রাজ্যই বিদ্রোহীদিগের প্রধান সংকেত-স্থল ও ঝাঁশির কেল্লাই সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় ও দুর্জয়; অতএব ঝঁশি জয় করা সর্বাগ্রে কর্তব্য—এই বিবেচনা করিয়া ইংরাজ কর্তৃপক্ষয়েরা য়ুরোপ-প্রসিদ্ধ, নবাগত সেনানী সর-হিউ-রোজকে এই কার্যে নিযুক্ত করিলেন। সর-হিউ-রোজ পথিমধ্যে একে একে কতিপয় কেল্লা দখল ও তত্রস্থ বিদ্রোহীদিগকে পরাভূত করিয়া অবশেষে ২০ মার্চ তারিখে, প্রাতঃকাল ৭ টার সময় ঝাঁশিতে আসিয়া পৌছিলেন। এই সংবাদ পাইবামাত্র লক্ষ্মণরাও দেওয়ান প্রভৃতি প্রধান-মণ্ডলীর মধ্যে ভারী গণ্ডগোল বাধিয়া গেল। তাহাদিগের মধ্যে তেমন সুবিজ্ঞ ও সুচতুর লোকথাকায়, যে যাহা খুশি বলিতে লাগিল। নানা-ভোপটকর প্রভৃতি পুরাতন মন্ত্রী-মণ্ডলী, গোয়ালিয়ারের প্রবীণ সুবিজ্ঞলোকদিগের নিকট পত্র। লিখিয়া, তাহাদিগের অভিপ্রায় অবগত হইয়া, পূর্ব্ব হইতেই এ সম্বন্ধে পরামর্শ স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন। সেই পরামর্শ-অনুসারে, তাঁহারা দরবারে এইরূপ প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন যে, ইংরাজ-সৈন্যের আগমনে কোন প্রকার বাধা না দিয়া, ইংরাজ সেনাপতির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, তাহারা যে ভুল বুঝিয়াছেন, সেই ভুল ঘুচাইয়া দেওয়া হউক এবং পূর্বের ন্যায় ইংরাজ-সরকারের সহিত সখ্য স্থাপন করা হউক। কিন্তু এই প্রস্তাব কাহারও মনোনীত হইল না। নথে-খার সহিত যুদ্ধ ও ঋশি প্রদেশের বন্দোবস্ত করিবার জন্য যে সমস্ত লোক সৈন্যমধ্যে রাখা হইয়াছিল, তাহারা ঝাঁশি-রাজ্যের পুরাতন ভৃত্য- ঝঁশি খাস করিবার সময় ইংরাজেরা তাহাদিগকে কর্ম্ম হইতে রহিত করে। এই কারণে, ইংরাজ-সরকারের বিরুদ্ধে তাহাদিগের দ্বেষবুদ্ধি জাগৃত ছিল। ইংরাজ-সৈন্য ঝাঁশি আক্রমণ করিবার জন্য আসিতেছে, এই সংবাদ শুনিৰামাত্র তাহারা যুদ্ধের জন্য লালায়িত হইল।
রাণীঠাকুরাণী কেল্লার মধ্যে থাকায়, প্রধান-মণ্ডলী ব্যতীত আর কাহারও তাঁহার নিকট যাইবার অনুমতি ছিল না—সুতরাং, ইংরাজ- পক্ষের প্রকৃত বৃত্তান্ত তিনি জানিতে পারিতেন না, ইংরাজেরাও তাঁহার প্রকৃতি অভিপ্রায় অবগত হইতে পারিত না। কেহ বলেন,—ইংরাজ- সৈন্যশিবির হইতে এই ভাবে পত্র আইসে, “আপনি, লক্ষ্মণরাও দেও- যানজী, লালা-ভাউ বশি প্রভৃতি আট ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া, নিঃশস্ত্র হইয়া আমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।” কিন্তু এই কথা নাকি স্বাভিমানিনী রাণীঠাকুরাণীর ভাল লাগে নাই, তাই যুদ্ধের আরম্ভ হইল। কেহ বলেন—রাণী ও তাহার সর্দার-মণ্ডলী বিদ্রোহীদিগের দলভুক্ত হইয়াছে ইংরাজদিগের বিশ্বাস হওয়ায়, ইংরাজেরা তাহাদিগকে কয়েদ করিবার মৎলব করিয়াছিলেন। এবং এই কথা রাণী জানিতে পারিয়াই “মরণ রুচে বীরের—না রুচে অপযশ কলঙ্কে” মহারাষ্ট্রীয় কবি মোরাপন্তের এই উক্তি-অনুসারে, ইংরাজের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। বলেন, ইংরাজ-সৈন্য ঝাঁশির অভিমুখে আসিতেছে, এই সংবাদ ঝুঁশিতে পৌঁছিলে এইরূপ তর্ক উপস্থিত হয় যে, উহা নথে-খার সৈন্য—উহারা মুখে রং লাগাইয়া পুনর্ব্বার ঝাশি আক্রমণ করিবার জন্য অসিয়ছে। এই বিশ্বাসে, রাণী তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিবার হুকুম দেন ' সেই সময়ে নাকি অধীনস্থ ঠাকুর-মণ্ডলী রাণীকে এইরূপ বলেন যে, ইংরাজের সহিত যুদ্ধ করিয়া উঠা যাইবে না—তাহাদের সহিত রণস্পর্ধা করিয়া কোন ইষ্ট নাই—বাণপুরের রাজাও মাথোনের যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারেন নাই ইত্যাদি। কিন্তু এই সকল কথায় কোন ফল হইল না। কেহ বলিল—রাণীঠাকুরাণী, মিত্রতা স্থাপন করিবার জন্য ইংরাজদিগের নিকট তাহার একজন সর্দারকে পাঠাইয়াছিলেন, কিন্তু তাহাতে কোন ফল না হইয়া, উল্টা সেই সর্দারের ফাশি হয় এবং এই কারণেই রাণী যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েন। আসল কথা, প্রকৃত কারণ ঠিক জানা যায় না জানিবার কোন উপায়ও নাই। এই পর্যন্ত জানা যায়, রাণী ইংরাজের সহিত সদ্ভাবে থাকিবার চেষ্টা করিয়াও যখন দেখিলেন, কোন ফল হইল,—ইংরাজেরা ঋশি আক্রমণ করিল; তখন সেই স্বাভিমানিনী তেজস্বিনী রাণী, ঋশি সংরক্ষণের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।
তাঁহার সৈন্যমধ্যে লড়াকা ও সাহসী কয়েকজন আফগান ও বুণ্ডেল-নিবাসী লোক ছিল বটে কিন্তু তাহার সমস্ত সৈন্যমধ্যে তেমন সুব্যবস্থা ছিল না। এক্ষণে রাণী স্বীয় সৈন্যমধ্যে সুশৃঙ্খলা স্থাপনে উদ্যোগী হইলেন। তিনি সমস্ত সৈন্য-মণ্ডলীর নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া অল্পকালের মধ্যেই সমস্ত যুদ্ধের আয়োজন প্রস্তুত করিলেন। তিনি স্বয়ং পরিদর্শনাদি করিয়া দুর্গবপ্রের জীর্ণসংস্কার করাইলেন, কেল্লার বুরুজের উপর তোপ বইলেন এবং তোপ চালাইবার জন্য সুদক্ষ গোলন্দাজ নিযুক্ত করিলেন। সহরস্থ বপ্র-প্রকারের রন্ধমধ্যে “কারামাইন” বন্দুক প্রবিষ্ট করাইয়া সিপাহী পাহারা বসাইলেন। কঁশির অভিজাত, বিশ্বাসী ও দক্ষ ঠাকুর-মণ্ডলী ও বুণ্ডেল-বাসী সর্দারদিগকে একত্র করিয়া তাহাদিগের উপর সৈন্যের কোন কোন অংশের নেতৃত্বভার অর্পণ করিলেন। রূপে, অল্পকালের মধ্যেই কেল্লা ও সহর সংরক্ষণের সুন্দর বন্দোবস্ত হইল!
এদিকে, ইংরাজ-সেনাপতি, সর-হিউ-রোজ, ২১ মার্চ তারিখে, সমস্ত দিন ধরিয়া ঋশির কেল্লা ও সহরের স্থিতি-প্রণালী সূক্ষ্ম রূপে পর্যবেক্ষণ করিলেন এবং সুবিধার জায়গা নির্বাচন করিয়া, সেই সেই স্থানে বাছা- বাছ। তোপ ও ফৌজ স্থাপন করিলেন। বাহির হইতে যাহাতে কোন-রূপ সাহায্য না আসিতে পারে, এই উদ্দেশে সমস্ত পথঘাট রুদ্ধ করিয়া স্থানে স্থানে ঘোড়-সওয়ার ও তোপখানা (আর্টিলরি) রাখাইয়া দিলেন। আবার স্থানে স্থানে পৃথক ভাবে তোপ ও পদাতিক সৈন্য স্থাপন করিলেন। প্রত্যেক সৈন্য-বিভাগের সেনানায়কদিগের মধ্যে যাহাতে শত্রু- সম্বন্ধীয় বার্তাদির চালাচালি হইতে পারে, তজ্জন্য তাহাদিগের মধ্যে তার- যন্ত্রের যোজনা করিলেন। একটা উচ্চ ভূমির উপর স্তম্ভ উঠাইয়া, তথা হইতে দুরবীণের সাহায্যে, যাহাতে কেল্লার অভ্যন্তরস্থ সমস্ত প্রদেশ দৃষ্টি- পথে পতিত হয়, এইরূপ বেধশালার (অৰ্জরটেরি) ন্যায় একটা স্থান নিৰ্মাণ করিয়া তথায় তার-আফিশ স্থাপন করিলেন।
এই সময়ে আর একটা সুবিধা ঘটিল;—ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্টের অধীনস্থ সৈন্য চন্দেরী হইতে আসিয়া পৌছিল। ২৩ তারিখে প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের আরম্ভ হইল। ইংরাজ-সৈন্য, ঝাশির নিকটস্থ সকল ময়দান ও উচ্চভূমি অধিকার করিয়া অবস্থিতি করিতেছিল। এক্ষণে তাহার কেল্লা আক্রমণের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু বিরুদ্ধ পক্ষের তলপের ভাল বন্দোবস্ত থাকায়, তাহাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হইল। ইংরাজের ফেজি ও ঘোড়- সওয়ার অগ্রসর হইবা মাত্র, আঁশির গোলন্দাজেরা তাহাদের উপর প্রচণ্ড রূপে গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। তাহাতে ইংরাজদিগের টিকিয়া থাকা দায় হইল। যাহা হোক্ সেই দিবসের রাত্রিতেই অবসর বুঝিয়া তৃতীয় য়ুরোপীয় পণ্টনের মোহরা অগ্রসর হইল। সমস্ত রাত্রি সহরমধ্যে রণবাদ্যের ভয়ঙ্কর ধ্বনি শুনা যাইতে লাগিল; কেল্লার মধ্য হইতে মশালের আলোক মধ্যে মধ্যে প্রকাশ পাইতে লাগিল; প্রহরীরা বন্দুকের আওয়াজ করিতে লাগিল। তাহাতে বুঝা গেল, সমস্ত রাত্রি ধরিয়া, ঝাঁশির সৈন্যমধ্যে যুদ্ধের আয়োজন চলিতেছে। ইংরাজসৈন্যও সহর-প্রাকারের ৩০০ গজ দূরে তোপ পাতিয়াছিল এবং একটা দেবালয়ের মধ্যে তোপের মঞ্চ (ব্যাটারি) বাঁধিয়াছিল। প্রভাত হইবামাত্র, ঝুঁশি-কেল্লার সুচতুর ও দক্ষ গোলন্দাজেরা আপন আপন তোপে অগ্নি সংযোগ করিল এবং সহরের বস্থিত দুই তিন তাপমঞ্চ হইতে গোলা বর্ষিত হইতে আরম্ভ হইল। প্রথম প্রথম, সেই সকল গোলা ইংরাজ-সৈন্যের মাথার উপর দিয়া যাইতেছিল—তাহাতে কোন ফল হইতেছিল না। কিন্তু পরে, যখন কেল্লাস্থিত “ঘন-গর্জ” নামক তোপের বর্ষণ আরম্ভ হইল, তখন ইংরাজ- দিগের মধ্যে একেবারে হাহাকার পড়িয়া গেল। এই তোপের এই একটা আশ্চর্য গুণ ছিল যে, উহার ধূম-রাশি পূর্ব্ব হইতে দেখা যাইত না। সেই জন্য বিরুদ্ধ পক্ষ সতর্ক হইবার অবকাশ পাইত না। “ঘন-গর্জ” হইতে প্রচণ্ড গোলা-সকল ছুটিয়া সো-সে। শব্দে ইংরাজ সৈন্যের মধ্যে আসিয়া পড়িত। এই জন্য ইংরেজেরা, এই তোপের নাম দিয়াছিল— “হুইলিং ডি”।
সে যাহা হউক, ২৪ তারিখে, ইংরাজ-সৈন্য, চারিটা তোপমঞ্চ প্রস্তুত করিয়া, দক্ষিণ দিকের কেল্লার উপর গোলা বর্ষণের উদ্যোগ করিল। ২৫ তারিখে তোপের রঞ্জুকে আগুন লাগাইল। কতকগুলি তোপ হইতে “কুলুপী:গোলা” (Shell) একসঙ্গে বর্ষিত হইয়া সহরের মধ্যে আসিয়া পড়িতে লাগিল এবং সহর-বপ্রের উপর লক্ষ্য করিয়া, “পৌণ্ডস”-তোপ হইতে গোলাবর্ষণ হইতে লাগিল। ইহাতে করিয়া, ঝুঁশির তোপ-খানার (আর্টিলারি) কতকগুলি গোলন্দাজ নিহত হওয়ায় ঝাঁশির তোপ বন্ধ হইয়া। গেল এবং ব-প্রকারও কতকটা ভগ্ন হইল। ইংরাজদিগের কুলুপী-গোল। সহরের মধ্যে আসিয়া পড়ায়, সহরবাসী লোকদিগের মধ্যে মহা আতঙ্ক উপস্থিত হইল। এই ভয়ঙ্কর গোলা, রাস্তা কিম্বা ঘরের উপর পড়িবামা ফাটিয়া চারিদিকে প্রক্ষিপ্ত হওয়ায়, অনেক লোেক জখম ও নিহত হইল। সহরের দোকান-হাট বন্ধ হইয়া গেল—অনেক ঘরে আগুন লাগায়, তাহার প্রজ্বলিত শিখায় গগনমণ্ডল আরক্তিম হইয়া উঠিল। এই দারুণ কাণ্ড প্রত্যক্ষ করিয়া রাণীঠাকুরাণী অত্যন্ত ব্যথিত। হইলেন, কিন্তু ইহাতে হতবুদ্ধি না হইয়া, যাহাতে লোকের কষ্ট নিবারণ হয়, তাহার সমুচিত ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। যে সকল প্রজার গৃহদাহ হইয়াছিল, সেই অনাথ লোকদিগের জন্য অন্নদানের ব্যবস্থা করিলেন—দক্ষিণী ব্রাহ্মণদিগের জন্য গণপতির মন্দিরে অন্নসত্র খুলিলেন, এবং অপর সাধারণের জন্য সদাব্রতের উদ্যোগ করিয়া কাঙ্গাল গরিবদিগকে ছোলা-ভাজা বিতরণ করিতে লাগিলেন। রাণীঠাকুরাণীর নিকট হইতে সৈন্যগণ উত্তেজনা ও উৎসাহবাক্য প্রাপ্ত হইয়া, ইংরাজের ভীষণ কুলুপী- গোলাতে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া, বন্দুক হইতে এক সঙ্গে অজস্র গুলি বর্ষণ করিতে লাগিল। এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই বিস্তর লোক জখম ও নিহত হয়। চতুর্থ দিবসে, অর্থাৎ ২৫ মার্চ তারিখে, ইংরাজের কেল্লার দক্ষিণ- ভাগ হল্লা করিয়া আক্রমণ করিল; উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল; অবশেষে, দ্বিপ্রহরের সময়, কেল্লার দক্ষিণ বুরুজের তোপ বন্ধ হইয়া গেল। ইহাতে কেল্লার লোকেরা অত্যন্ত হতাশ হইয়া পড়িল। সেই সময়ে, পশ্চিমস্থ বুরুজের গোলন্দাজ, পে-মঞ্চ হইতে তোপ উঠাইয়া লইয়া দূর্বীণের দ্বারা উত্তম লক্ষ্য সন্ধান করিয়া, কেল্লার দক্ষিণ বুরুজে আবার তোপ মঞ্চ বসাইল। এবং তথা হইতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিয়া, ইংরাজের গোলন্দাজদিগকে নিহত করিয়া, তাহাদিগের তোপ বন্ধ করিয়া দিল। ইহাতে রাণীঠাকুরাণী পরিতুষ্ট হইয়া এক-তোড়া টাকা গোলন্দাজকে বকশিস করিলেন। এই গোলন্দাজের নাম গুলাম-গোষখান।
যদিও ঝুঁশির সৈন্য, ইংরাজ সৈন্যের ন্যায় রণবিদ্যায় সুশিক্ষিত ও সুব্যবস্থিত ছিল না, তথাপি তাহারা এই যুদ্ধে যেরূপ পরাক্রম প্রদর্শন করিয়াছিল, তাহাতে ইংরাজ-সেনানী বিস্ময়োচ্ছাস প্রকাশ না করিয়া থাকিতে পারেন নাই। ডাক্তার লো-সাহেব, তাহার “মধ্য হিন্দুস্থান” নামক গ্রন্থে ঝাঁশি যুদ্ধের যে সবিস্তার বর্ণনা দিয়াছেন, তাহাতে দেখা যায়, ঝুঁশির সৈন্য ৩১ মার্চ পর্যন্ত, রণশিক্ষিত ইংরাজ-সৈন্যের সহিত, সমান ও সমকক্ষভাবে, যুদ্ধ করিয়াছিল। একজন দেশীয় ভদ্রলোক, যিনি সেই যুদ্ধের সময়, ঝশিতে উপস্থিত ছিলেন, তিনিও যেরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, ডাক্তার সাহেবের বর্ণনার সহিত তাহার বিলক্ষণ ঐক্য দেখা যায়। দেশীয় ভদ্রলোকটি এইরূপ বলেন:
“রাত্রিকালে সহর ও কেল্লার উপর গোলা আসিয়া পড়িতে লাগিল। সেই গোলাগুলা দেখিতে ভয়ঙ্কর! (মটার) “গহবর-নলী” তোপ-নিঃসৃত গোলাগুলা ৫০/৬০ সের ওজনের হইলেও, তোপ হইতে যখন সবেগে ছুটিয়া আসিত, তখন যেন ক্রীড়া-কঙুকের ন্যায় ক্ষুদ্র ও খদিরের ন্যায় লাল দেখাইত। দিবসের প্রখর সূর্যালোকে গোলাগুলা স্পষ্ট দেখা যাইত না; কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে তাহারা যেন কতুকের ন্যায় ইতস্ততঃ ছুটিতেছে, এইরূপ মনে হইত। প্রত্যেক লোকের মনে হইত, বুঝি এই গোলা আমার উপর আসিয়াই পড়িবে। কিন্তু প্রায়ই সেই সব গোলা সাত আট শো পদ তফাতে আসিয়া পড়িত। এই প্রকার, দিবারাত্রি যুদ্ধ হইয়া সমস্ত সহর একেবারে ত্রস্ত হইয়া উঠিল। পঞ্চম ও ষষ্ঠ দিব- সেও এইরূপ যুদ্ধ হইল। দেড় প্রহর পর্যন্ত, রাণীঠাকুরাণীর জয় হইয়া, ইংরাজের সৈন্যনাশ হইতে লাগিল এবং তাহাদিগের তোপও কিয়ৎ- কালের জন্য বন্ধ হইল। কিছু পরে, ইংরাজের আবার জয় হইতে লাগিল এবং বিরুদ্ধ পক্ষের তোপ বন্ধ হইয়া গেল; বিশেষতঃ সূর্যাস্তকালে কেল্লার দক্ষিণদিকের তোপ-চালক গোলন্দাজেরা আর তিষ্ঠিয়া থাকিতে পারিল না। ইংরাজের গোলাবর্ষণে, দক্ষিণদিকের তোপ-মঞ্চ ভাঙ্গিয়া যাওয়ায়, রাত্রিকালে সুদক্ষ রাজমিস্ত্রি মজুর আনানো হইল। তাহার অতীব কৌশল-সহকারে, কম্বলে গাত্র আচ্ছাদন করিয়া ধীরে ধীরে বুরুজের উপর উঠিল, এবং নিম্নভূমি হইতে, লোকের স্কন্ধে লোক উঠাইয়া, ইষ্টক প্রভৃতি উপকরণ, বুরুজের উপর আনিয়া তুলিল, এবং শুইয়া- শুইয়া তোপ-মঞ্চ বাঁধিতে লাগিল।
এইরূপে ইংরাজের অলক্ষিতে, তোপ-মঞ্চ প্রস্তুত করিয়া ঝাশির সৈন্য আবার তোপ চালাইতে আরম্ভ করিল। সেই সময় ইংরাজদিগের একটু শৈথিল্য হওয়ায়, তাহাদের অনেক লোক মারা পড়িল এবং দুইটি তোপ বন্ধ হইয়া গেল। অষ্টম দিবসের প্রভাতে, ইংরাজ-ফৌজ “শঙ্কর” কেল্লার উপর আবার গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। ইংরাজদিগের নিকট দুর্গ অবরোধের উপযোগী অতি মূল্যবান দুরবীণ ছিল। ••• সেই দুরবীণের সাহায্যে কেল্লার অভ্যন্তরস্থ জলের চৌবাচ্চার উপর লক্ষ্য করিয়া তাহারা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। জলের ভারীরা জল তুলিতে তাহদের মধ্যে ৫৭ জন নিহত হওয়ায়, বাঁক্ ফেলিয়া তাহারা পলায়ন করিল। ইহাতে, জলের অভাব হওয়ায়, স্নানাদির অত্যন্ত ব্যাঘাত ঘটিল। এই সময়ে, কেল্লার গোলন্দাজেরা ইংরাজ-গোলন্দাজের উপর গোলাবর্ষণ করিয়া তাহাদিগের তোপ বন্ধ করিয়াছিল। এখন আবার, চৌবাচ্চা হইতে জল তুলিবার সুবিধা হওয়ায়, স্নান ভোজনাদির সুব্যবস্থা হইল। আহারাদির কিছুকাল পরে, হঠাৎ একটা ভয়ঙ্কর শব্দ হইয়া যত্র-তত্র ধূম ও ধূলায় ভরিয়া গেল তাহাতে, দশদিক আচ্ছন্ন হইয়া আর কিছুই দেখা যায় না, এইরূপ হইল। না জানি কি হইয়াছে, এই ভয়ে সকলেরই হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। পরে, অনুসন্ধানে জানা গেল, রাজ- বাটীর সম্মুখস্থ ময়দানের বারুদ-কারখানায়, ৩০ জন পুরুষ ও আট জন স্ত্রীলোক মারা গিয়াছে এবং ৪০|৫০ জন জখম হইয়াছে। তেঁতুল গাছের ময়দানে, বারুদ কারখানার কাজ আরম্ভ হইয়াছিল। দুই মণ বারুদ প্রস্তুত হইবামা, বুরুজের নীচের তল-ঘরে লইয়া রাখা হইতেছিল। সেই কারখানায় ইংরাজের গোলা পড়িবামাত্র, বারুদে আগুন লাগে এবং তাহার সূক্ষ্মণ। সকল ধূলির মধ্যে প্রসারিত হইয়া জ্বলিয়া উঠিয়া, তদোদগত ধূম চারিদিকে পরিব্যাপ্ত হয়। অষ্টম দিবসে তুমুল যুদ্ধ আবার আরম্ভ হইল। কামান ও বন্দুকের মুহুর্মুহু ধ্বনি, শিঙ্গা, কর্ণে, ও ঝুগেলের বাদ্য যেখানে সেখানে শুনা যাইতে লাগিল। পেঁয়াতে, ধূলাতে ও নানাপ্রকার শব্দে চারিদিক আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ইংরাজ সৈন্যের গোলাবর্ষণে ঝাঁশির অনেক সৈন্য বিনষ্ট হইল। রাত্রিতেও সহরের উপর গোলা আসিয়া পড়িতে লাগিল—তাহাতেও অনেক লোক মারা গেল, অনেকে প্রাণভয়ে গৃহ মধ্যস্থিত উৎকট স্থানে গিয়া লুকাইয়া রহিল। বপ্রস্থ গোলন্দাজ ও শিপাহী বিস্তর নিহত হইল। এই দিন রাণীঠাকুরাণীর অত্যন্ত শ্রম হইয়াছিল। চারিদিকে নজর রাখিয়া, যেখানে কিছু অভাব হইতেছিল, অমনি তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা পূরণ করিয়া দিবার হুকুম দিতেছিলেন। তাহাতে, সৈন্যগণ উৎসাহিত হইয়া প্রবল ইংরাজ-সৈন্যের বিরুদ্ধে সমানভাবে লড়িতেছিল। ইংরাজদিগেরও পরাক্রম প্রকাশে ত্রুটি হয় নাই। কিন্তু ঝশি-সৈন্যের অপ্রতিম দৃঢ় নিশ্চয়-নিবন্ধন, ইংরাজের। ৩১ তারিখ পর্যন্ত কেল্লার মধ্যে প্রবেশলাভ করিতে পারেন নাই।”
এই ৩১ তারিখের রাত্রিতে রাণীঠাকুরাণী একটা আশ্চর্য্য স্বপ্ন দেখেন। যেন একটা সুবেশিনী মধ্যমবয়স্কা নারী, গৌরবর্ণ, সরল নাসিকা, প্রশস্ত-ললাট, বিশাল-কৃষ্ণ-নেত্র, অতীব রূপবতী, সর্ব্বাঙ্গে মুক্তার অলঙ্কার, পরিধানে চওড়া পাড়ের লাল শাড়ি, অঙ্গে রেসমী পাড়ের চোলি, মাল-কোচা দেওয়া, কোমর-বাঁধা,—এইরূপ বেশে কেল্লার বুরুজের উপর দণ্ডায়মান হইয়া, অতীব উগ্র ভাবভঙ্গীসহকারে রক্তবর্ণ গোল। লুফিয়া ধরিতেছেন এবং গোলা ধরিতে ধরিতে হাতে কালিমা পড়ায়, রাণীঠাকুরাণীকে তাহা দেখাইয়া যেন এইরূপ বলিলেন, আমি বলিয়াই এইরূপ গোল লুফিয়া ধরিতে পারিতেছি!
যাহা হউক, উভয় পক্ষের মধ্যে এইরূপ ঘনঘোর যুদ্ধ চলিতেছে, এমন সময়ে আর একটা গুরুতর ঘটনা উপস্থিত হইল। ঝাশির রাণীকে সাহায্য করিবার জন্য, নানাসাহেবের আদেশানুসারে, তাঁহার সেনাপতি তাত্যা-টোপে, কাল্পী হইতে বিশ সহস্র সৈন্য সঙ্গে লইয়া কুচ করিতে করিতে ঝুঁশির নিকট আসিয়া পৌছিলেন। ঋশির নিকটস্থ উচ্চ ভূমির উপর, ইংরাজদিগের টেলিগ্রাফ-আফিস স্থাপিত ছিল। আফিসের অধ্যক্ষ দূরবীণ-সহযোগে উত্তরদিক হইতে এক বিপুল সৈন্য আসিতেছে দেখিয়া, ভয়সূচক নিশান খাড়া করিল। তরা, শত্রুর আগমনবার্তা জানিতে পারিয়া ইংরাজ সেনাপতি চিন্তিত হইলেন। কেননা বিরুদ্ধ পক্ষের তুলনায়, ইংরাজ-সৈন্য কম থাকায়, ঝশির অবরোধের জন্য, তাহারা স্থানে স্থানে পথ-ঘাট বন্ধ করিয়া অবস্থিতি করিতেছিল। সেই সকল স্থান হইতে তাহাদিগকে সরাইয়া আনিলে, কেল্লার লোকেরা পথ মুক্ত পাইয়া, হল্লা করিয়া ইংরাজদিগকে আক্রমণ করিবে—এইরূপ ইংরাজ সেনাপতির আশঙ্কা হইল।
এদিকে, বেটোয়া নদীতীরস্থ সমভূমি ময়দানে, তাত্যা-টোপের প্রবল সৈন্য, মহা উৎসাহে, আড্ডা গাড়িয়া অবস্থিতি করিতেছিল। তন্মধ্যে, গোয়ালিয়ার কণ্টিঞ্জেণ্ট ফৌজের যে বিদ্রোহীদল, কানপুরে, সেনাপতি উ্যামের সৈন্যকে পরাভূত করে, তাহারাও সেই সঙ্গে ছিল। তাহারা বিজয়ানন্দে বিস্ফরিত হইয়া মনে করিতেছিল, পেশোয়ার সৈন্যের নিকট ইংরাজ-সৈন্যের কিসের যোগ্যতা! যাহা হউক, এই সাহায্য যথাসময়ে আসিয়া পড়ায়, ঝশি-রক্ষণের বল অনেক পরিমাণে বৃদ্ধি হইল এবং ইংরাজদিগের বিজয়পথ কণ্টকাকীর্ণ হইয়া উঠিল।
এদিকে, স-হিউ-রোজ তাত্যা-টোপের আগমন-বার্তা অবগত হইবা- মাত্র, কোন প্রকার গোলযোগ না করিয়া, অতি শান্তভাবে, ৩১ তারিখের রাত্রে, প্রথম ব্রিগেডের সৈন্যদল হইতে কতকগুলা হাতি আনাইয়া, ২৪ পৌণ্ডের দুই তোপ, বোচ্ছার রাস্তার উপর স্থাপন করিলেন, এবং সেখান হইতে সহরে যাইবার রাস্তা একেবারে বন্ধ করিয়া ফেলিলেন।
তাত্যা-টোপে একজন সুচতুর বীরপুরুষ ছিলেন। বিদ্রোহসময়কার বিলাতী “ডেলিনিউস” পত্রে, তাহার এইরূপ বর্ণনা প্রকাশিত হয়
“তাত্যা মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ—উচ্চ বংশের নহে। তাহাতে দস্যুবৃত্তির লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাহার চাতুবুদ্ধি বিলক্ষণ আছে, কিন্তু বিদ্যাবুদ্ধি কিছুমাত্র নাই। তিনি লেখা-পড়া জানেন না কিন্তু সিপাহীগিরি কাজে খুব মজবুৎ। ইহার জন্য তাহার উপর, তাহার অনুচরবর্গের অচলা নিষ্ঠা। তাঁহার দেহের গঠন সুদৃঢ় হৃষ্ট-পুষ্ট ও সতেজ। নৈতিক প্রভাব অপেক্ষা বাহুবলের প্রতাপে তিনি অন্যের মনে উৎসাহ ও বল সঞ্চার করেন। ইংরাজেরা যে সমর-বিদ্যায় কুশল, ইহা তিনি বিলক্ষণ অবগত আছেন। এই জন্য, সমরক্ষেত্রে ইংরাজদিগের সহিত সম্মুখযুদ্ধ না করিয়া, তাহাদিগকে অনুধাবন করিয়া ক্লান্ত করিতে তাহার ভাল লাগে। তাঁহার বয়ঃক্রম ৪০ বৎসর। তিনি অত্যন্ত দুর্দান্ত বেগশালী তেজীয়ান ও সাহসী। তাঁহার শৌর্যযুক্ত সতেজ সুন্দর মুখশ্রী। তাঁহার দৃষ্টি চপল ও উগ্র। -যুগল ধনুকাকার, কপাল উচ্চ ও সরল, নাসিকা গরুড় পক্ষীর ন্যায়, মুখ ছোট, ঠোট চাপা, দাত ধধপে সাদা, গোঁফ কালো ও দেহ-বর্ণ ঘনশ্যামল। কেতাদুরস্ত অপেক্ষা দেহরক্ষণোপযোগী কাপড় পরিতে তিনি ভাল বাসেন। তিনি সর্বদা পা-পর্যন্ত লম্বা একটা জোব্বা পরেন ও কাধের উপর একটা কাশ্মিরী শাল ফেলিয়া রাখেন। তাহার সহিত বারো মাস, প্রায় ২৫/৩০জন লোক প্রহরী থাকে। ইহাদের সাহায্যে, যুদ্ধের মধ্যে তিনি আপনাকে কোন প্রকারে উদ্ধার করেন। “নানা সাহেবের প্রতিনিধি” এই উপাধিটা তিনি গ্রহণ করিয়াছেন।”
শ্রীমন্ত বাজীরাও সাহেব পেশোয়াকে যে পেশন দেওয়া হইত, সেই পেনশনের টাকা তাহার মৃত্যুর পর, ইংরাজেরা বন্ধ করিয়া দেওয়া, তাহার উত্তরাধিকারী, প্রসিদ্ধ নানা সাহেব সিপাহীবিদ্রোহে যোগ দেন; এবং তাহার তরফে তাঁহার স্বামিনিষ্ঠ সেবক তাত্যা-টোপে ইংরাজদিগকে আক্রমণ করিয়া, স্বীয় প্রভুর আধিপত্য স্থাপনে সচেষ্ট হয়েন। এই ত্যাটোপের পরাক্রমে, বিদ্রোহীদল প্রবল হইয়া কিছুকালের জন্য যেন অজেয় হইয়া উঠিয়াছিল। কেবল তাত্যার ষড়যন্ত্রবলেই, সিন্ধিয়া-সরকারের কণ্টিণ্টে-ফৌজ বিদ্রোহীদলভুক্ত হয় এবং তাহারই যুদ্ধকৌশলে কানপুরের নিকটস্থ যুদ্ধক্ষেত্রে জেনেরাল উইচ্যামের অধীনস্থ ইংরাজ- সৈন্য পরাভূত হয়। “এম্পায়ার ইন্ ইণ্ডিয়া” এই গ্রন্থের লেখক বলেন—“যদি আরও কিছু সাহস প্রকাশ করিতেন এবং কেবল অভাব- পক্ষের রণকৌশল না দেখাইয়া, কতকগুলি ভাবপক্ষের রণকীর্ত্তি দেখাইতে পারিতেন, তাহা হইলে তিনি শীঘ্রই “হিন্দু গ্যারিবডি” নামে খ্যাত। হইতেন সন্দেহ নাই”।
যাহা হউক, তাত্যা-টোপে; কাল্পী হইতে বিপুল সৈন্য-সমভিব্যাহারে। ঝাঁশির সাহায্যে আসিয়াছেন দেখিয়া, কেল্লার লোকেরা আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল; তাহার স্বগত সম্ভাষণার্থ তাহারা মুহুর্মুহু তোপের সেলামি দিতে লাগিল এবং তাহার জয়ঘোষণায় রণবাদ্য আরম্ভ করিয়া দিল। সেই বাদ্যরবে গগনমণ্ডল বিকম্পিত হইল এবং সকলের হৃদয় আশা ও উৎসাহে পূর্ণ হইল। এই উৎসাহের দৃশ্য, রাণীঠাকুরাণী ও তাঁহার সর্দার-মণ্ডলী কেল্লার ব হইতে দেখিতে লাগিলেন এবং রাণীঠাকুরাণী বপ্রের উপর ঘুরিয়া ফিরিয়া সৈন্যদিগকে উত্তেজিত করিতে লাগিলেন। সমস্ত রাত্রি, কেল্লার বপ্রের উপর এবং ইংরাজের ছাউনীমধ্যে মশাল জ্বলিতেছিল—এবং তাহারই আলোকে যুদ্ধ চলিতেছিল।
১ এপ্রিল তারিখে, প্রাতঃকালে রীতিমত যুদ্ধ আরম্ভ হইল। পূর্ব্ব। দিবসে, সহিউ-রোজ, ঝশির অবরোধের জন্য যত লোক আবশ্যক, তাহা স্থানে স্থানে রাখিয়া, অবশিষ্ট সৈন্য অতীব দক্ষতা সহকারে, শত্রু- দিগকে বিন্দুমাত্র জানিতে না দিয়া, ভিন্ন ভিন্ন দিকে প্রেরণ করিয়াছিলেন। এদিকে, তাত্যা-টোপে ইংরাজের সৈন্য নিতান্ত অল্প বিবেচনা করিয়া নিশ্চিন্তভাবে অবস্থিতি করিতেছিলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হইবামাত্র, তিনি ঝুঁশির অবরোধ ভঙ্গ করিবার জন্য, একদল সৈন্য রণস্থলে প্রেরণ করিলেন; তাহারা ইংরাজদিগের আয়ত্ত্ব-সীমার মধ্যে আসিবামাত্র, স-হিউ- রোজ, শত্রুর দক্ষিণদিক্ আক্রমণ করিবার জন্য, কতকদল অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যকে নিয়োজিত করিলেন এবং তাহার অব্যবহিত তত্ত্বাবধান। ও নেতৃত্বাধীনে তাহার গোলন্দাজ সৈন্য গোলাবর্ষণ করিতে লাগিল। ইহাতে, শত্রুদল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া চারিদিকে পলায়ন করিল এবং তাহাদিগের মধ্যে বিস্তর লোক মৃত্যুমুখে পতিত হইল। ইতিমধ্যে, ত্যাটোপের পক্ষ হইতেও তোপের মার সুরু হইল, তাহাতে ইংরাজ-অশ্বারোহী সৈন্য অনেক নিহত হইল। সেই সময়ে, তাত্যা-টোপের অধীনস্থ আফগান-সিপাহীরা উচ্চ উচ্চ ভূমির উপর উঠিবার চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু, কাপ্তেন লীড় তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়া ধরাশায়ী করিলেন। এইক্ষণে, ইংরাজ পক্ষ হইতে গোলাবর্ষণ, ঘোড়সওয়ারের অনুধাবন ও পদাতিকদিগের আক্রমণ একেবারে এক সঙ্গে আরম্ভ হওয়ায়, পেশোয়ার সৈন্য নিরুপায় হইয়া পড়িল। এই পরাজিত সৈন্যদলের পশ্চাতে, এক ক্রোশ অন্তরে, তাতা-টোপের অধীনস্থ মুখ্য সৈন্যদল, বেটোয়া নদীর তীরে, জঙ্গল-প্রদেশমধ্যে অবস্থিত ছিল। অগ্রগামী সৈন্যদল পলাইয়া আসিতেছে দেখিয়া, তাহারা একেবারে হতাশ হইয়া পড়িল। এদিকে স-হিউরোজ, তোপের সরঞ্জাম সঙ্গে লইয়া, পদাতিকদিগের পৃষ্ঠানুসরণ করিলেন। ত্যার সৈন্য, জঙ্গলে আগুন লাগাইয়া দিয়া, যাহাতে ইংরাজের আর অগ্রসর হইতে না পারে, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিল। তথাপি সমস্ত বাধা অতিক্রম করিয়া ইংরাজ-সৈন্য বেটোয়া নদী পর্য্যন্ত অগ্রসর হইল। তাত্যাটোপের গোলন্দাজেরা তাহাদের উপর গোলা বর্ষণ করিতে লাগিল, কিন্তু তাহারা উচ্চভূমির উপর থাকায়, তাহাদিগের কোন ক্ষতি হইল না। পক্ষান্তরে, ইংরাজেরা যে গোলাবর্ষণ করিতেছিল, তাহাতে বিরুদ্ধ পক্ষের গোলন্দাজেরা নিহত হইতে লাগিল। তাহার পর, ইংরাজ অশ্বারোহী-সৈন্য সজোরে হল্লা করিয়া আক্রমণ করায়, তাহারা বড় বড় ২৪। ৩৬ পৌণ্ডের তোপ রণভূমির উপর ফেলিয়া পলায়ন করিল। এই সকল কামান অত্যন্ত ভারী বলিয়া, নদীতীরের বালুকার মধ্যে বসিয়া গিয়াছিল; সুতরাং গোলা, বারুদ প্রভৃতি উপকরণের সহিত এই সকল তোপ অনায়াসে ইংরাজদিগের হস্তগত হইল। শুধু তাহা নহে, ১৬ মাইল পর্যন্ত পলাতক শত্রুদিগকে অনুধাবন করিয়া তাহাদের সমস্ত যুদ্ধসামগ্রী ইংরাজেরা আপনার করিয়া লইল। এই বিজয়লাভে ইংরাজ- সৈন্যমধ্যে মহা উল্লাস পড়িয়া গেল এবং বিরুদ্ধ পক্ষের মধ্যে, সেই পরিমাণে, দুঃখ, ভীতি ও নৈরাশ্য এই তাপত্রয় আসিয়া উপস্থিত হইল। সংসারের গতিই এইরূপ!
“নীচৈৰ্গচ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রনেমিক্রমেণ।”
অথবা এ কথাও বলা যাইতে পারে;
“ক্রিয়সিদ্ধি সত্ত্বে ভবতি মহতাং নােপকরণে।”