বিষয়বস্তুতে চলুন

টল্‌স্টয়ের গল্প/আত্মসমর্পণ

উইকিসংকলন থেকে

আত্মসমর্পণ

 মিষ্টার বুলার একজন বণিক্; রিগা নগরে তার বাস। তার দুইখানি বাড়ী ও একখানা দোকান।

 বুলার দেখিতে খুব সুন্দর, চুলগুলি কোঁক্‌ড়ান। সে বড় রসিক, গান করিতে সে ভালবাসিত। যৌবনে মদ খাওয়াটা তার খুব অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল, মদ খাইয়া মাঝে মাঝে সে অত্যন্ত মাতাল হইয়া পড়িত; কিন্তু বিবাহ করিয়া মদ খাওয়া ছাড়িয়া দিয়াছিল—তবে একেবারে ছাড়িতে পারে নাই, মাঝে মাঝে একটু-আধটু খাইত।

 একবার গ্রীষ্মকালে সে মস্কো নগরে মেলায় যাওয়া স্থির করিল। যাইবার দিন সে তার স্ত্রীর নিকটে বিদায় নিতে আসিল।

 তার স্ত্রী বলিল—“আজকে তুমি যেও না, বুলার, আমি আজ বড্ড খারাপ স্বপন দেখেছি।”

 বুলার একটু হাসিয়া বলিল—“তোমার ভয় হচ্ছে যে, আমি মেলায় গেলেই মদের আড্ডায় গিয়ে মাত্‌লামি কর্‌ব।”

 তার স্ত্রী বলিল—“কিসের জন্যে আমার ভয় হচ্ছে তা আমি বল্‌তে পারিনে, তবে একটা খারাপ স্বপন দেখেছি—এই মাত্র জানি। স্বপনে দেখেছি যে, তুমি যখন মেলা থেকে ফিরে এসে টুপী খুলে ফেল্‌লে, দেখলুম তোমার চুলগুলো একেবারে সাদা হ’য়ে গেছে।”

 বুলার একটু হাসিল, বলিল—“এ ত’ লক্ষণ ভাল। মেলায় আমার সমস্ত জিনিষ বিক্রী ক’রে তোমার জন্যে আমি কতকগুলো ভাল ভাল উপহার আনতে পারি কিনা দেখ্‌ব।”

 এই বলিয়া স্ত্রীর নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া চলিয়া গেল।

 অর্দ্ধেক পথ ছাড়াইয়া গিয়াছে এমন সময়ে অপর এক বণিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হইল। তারা দুইজনে একটা হোটেলে রাত্রি কাটাইবার জন্য গেল। একত্র চা খাইয়া দুইজনেই পাশাপাশি দুইটি ঘরে শুইতে গেল।

 বিলম্বে ঘুমানো বুলারের অভ্যাস ছিল না। সে শুইয়াই ঘুমাইয়া পড়িল। ভোর হইবার পূর্ব্বেই সে বাহির হইয়া যাইবে ঠিক করিল। যথা সময়ে উঠিয়া সে গাড়োয়ানকে জাগাইয়া দিল। হোটেলের পিছনে একটা কুঁড়ে ঘরে হোটেলওয়ালা থাকিত। তার কাছে গিয়া বিল শোধ করিয়া বুলার বাহির হইল।

 প্রায় পঁচিশ মাইল পথ চলিয়া গিয়াছে। ঘোড়াগুলি বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিবার জন্য বুলার নিকটে একটা হোটেলে গেল। হোটেলের বারান্দায় বসিয়া সারেঙ বাহির করিয়া সে বাজাইতে লাগিল। হঠাৎ একটা গাড়ী আসিল। ঘোড়াগুলির ঘণ্টার বেশ ঠুন্-ঠুন্ শব্দ হইতেছিল। একজন অফিসার গাড়ী হইতে নামিলেন, সঙ্গে দুইজন সৈন্য। তিনি বুলারের কাছে আসিয়া তার নাম, ধাম, কোথা হইতে আসিয়াছে ইত্যাদি খবর জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।

 বুলার তাঁর সকল কথারই ঠিকমত উত্তর দিয়া বলিল—“আসুন, চা খাবেন কি?”

 কিন্তু সেই অফিসার তাকে ক্রমাগত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল—“কাল রাত্তিরে তুমি কোথায় ছিলে? তুমি একলা ছিলে কি? না তোমার সঙ্গে অন্য কোন সওদাগর ছিল? আজকে ভোরে কি তুমি সেই সওদাগরকে দেখেছ? ভোর হবার পূর্ব্বেই তুমি হোটেল থেকে চ’লে এলে কেন?”

 এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় বুলার বিস্মিত হইল। সে যা যা জানিত সব বলিয়া জিজ্ঞাসা করিল—“আপনি আমায় এইভাবে জেরা করছেন কেন, আমি কি চোর না ডাকাত? আমি যাচ্ছি নিজের কাজে, আমাকে এসব কথা জিজ্ঞেস কর্‌বার দরকার কি?”

 অফিসার তাঁর সৈন্যদের ডাকিয়া কাছে আনিয়া বলিলেন—“আমি এই জেলার সর্ব্ব প্রধান পুলিস কর্ম্মচারী; যে সওদাগরের সঙ্গে তুমি কাল রাত্তিরে ছিলে, আজকে দেখা গেল তাকে খুন করা হ’য়েছে—এই জন্যই তোমাকে এ সব জেরা কর্‌ছি। তোমার জিনিষ-পত্তর সব খানাতল্লাস কর্‌ব।”

 তখন তারা সকলে ঘরের ভিতর গেল। সেই কোতোয়াল ও সৈন্য দুইজন বুলারের সব জিনিষ-পত্র খুলিয়া দেখিতে লাগিল। হঠাৎ মিষ্টার বুলারের ব্যাগ হইতে একখানি ছোরা বাহির করিয়া কোতোয়াল চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন—“ছোরা কার?”

 বুলার রক্তমাখা সেই ছুরি দেখিয়া চমকিয়া উঠিল, ভারি ভয় পাইল

 —“এ ছুরিতে রক্ত লেগেছে কি ক’রে?”

 বুলার জবাব দিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু একটা কথাও বলিতে পারিল না। তার সকল কথাই বাধিয়া গেল, অতি কষ্টে বলিল—“আমি—আমি জানিনে—আমার নয়।”

 কোতোয়াল বলিলেন—“আজ সকালে দেখা গেল যে, সেই সওদাগর বিছানায় প’ড়ে র’য়েছে, তার গলা কাটা। এই কাজ কর্‌তে পারে এমন লোক কেবল তুমি; ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, ঘরে আর কোনও লোক ছিল না, তোমার ব্যাগে আবার রক্তমাখা ছুরিও রয়েছে, তা’ ছাড়া তোমার মুখচোখ ভাব-ভঙ্গীতেও এটা বেশ ফুটে বেরুচ্ছে। তুমি কি ক’রে খুন কর্‌লে, আর কত টাকা তুমি চুরি ক’রেছ, বল।”

 বুলার শপথ করিয়া বলিল—“আমি খুন করিনি; আমরা একসঙ্গে চা খেয়েছিলুম, তারপর আর তাকে দেখি নি। আমার সঙ্গে মোট আট হাজার টাকা ছিল, সে টাকা আমার নিজেরই। ছুরি আমার নয়।”

 কিন্তু বুলারের গলার আওয়াজটা অপরাধীর মত ধরা-ধরা হইয়া উঠিল, মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল, সে ভয়ে ঠক্‌ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

 কোতোয়াল বুলারকে বাঁধিয়া গাড়ীতে তুলিবার জন্য সৈন্যদের হুকুম করিলেন। সৈন্যেরা তার হাত-পা বাঁধিয়া গাড়ীর ওপরে ফেলিল। বুলারের মনে অনেক কথা উঠিতে লাগিল, সে কাঁদিয়া ফেলিল। তার জিনিষ-পত্র, টাকা-কড়ি সকলই পুলিস অফিসার কাড়িয়া লইয়াছিলেন। কাছের একটা সহরে তাকে নিয়া আটক করিয়া রাখা হইল। রিগাতে তার চরিত্র সম্বন্ধে অনেক খোঁজ-খবর লওয়া হইল। সহরের সকল লোকেই বলিল যে, বুলার পূর্ব্বে মদ খাইত বটে, কিন্তু সে লোক ভাল ছিল।

 ক্রমে ক্রমে বিচারের দিন আসিল। সওদাগরের খুন ও দশ হাজার টাকা চুরির অপরাধে সে অপরাধী সাব্যস্ত হইল।

 তার স্ত্রী একেবারে হতাশ হইয়া পড়িল। প্রথমে সে এ কথা বিশ্বাস করিতেই পারিল না। তার ছেলেমেয়েগুলি সবই ছোট ছোট, একটি আবার তখনও তার কোলে। যাই হো’ক্ ছেলেমেয়েগুলিকে সঙ্গে লইয়া, বুলার যে সহরে জেলে আটক ছিল, সে সেখানে গেল। স্বামীর সঙ্গে দেখা করিবার হুকুম সে প্রথমে পাইল না; কিন্তু শেষে অনেক কাকুতি-মিনতির পরে, দেখা করিবার হুকুম পাইল। সে যখন বুলারকে কয়েদীর পোষাক-পরা চোর ও ডাকাতদের সঙ্গে আটক অবস্থায় দেখিল, তখন অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল; অনেকক্ষণ অজ্ঞান হইয়াই রহিল। তারপরে যখন তার জ্ঞান হইল, সে ছেলেমেয়োদর কোলের কাছে টানিয়া আনিয়া স্বামীর কাছে গিয়া বসিল। বুলারের কি করিয়া এই দশা ঘটিল তাই সে প্রথমে জিজ্ঞাসা করিল। বুলার সকল কথা খুলিয়া বলিল। তার স্ত্রী বলিল—“আমরা এখন কি কর্‌ব?”

 বুলার বলিল—“যাতে একজন নির্দ্দোষ লোক মারা না যায় তার জন্যে আমরা জারের কাছে আর্জ্জি পেশ কর্‌ব?”

 তার স্ত্রী বলিল—“আমি জারের কাছে দরখাস্ত ক’রেছিলুম, কিন্তু না-মঞ্জুর হ’য়েছে।”

 বুলার আর কোনও কথা বলিল না, হতাশ হইয়া মাটির দিকে চাহিয়া রহিল।

 তার স্ত্রী বলিল—“আমি যে স্বপন দেখেছিলুম, তোমার সব চুল একেবারে সাদা হ’য়ে গেছে, সেটা একেবারে মিথ্যে হ’ল না, কেমন? তোমার মনে আছে ত? তোমার সেদিন আসা একেবারেই উচিত হয়নি।” তারপর বুলারের চুলে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল—“আচ্ছা আমায় সত্যি কথা বল দেখি, তুমি কি খুন কর নি?”

 “তুমিও আমায় সন্দেহ কর্‌ছ?” বলিয়া বুলার দুই হাত দিয়া নিজের মুখ ঢাকিয়া কাঁদিতে লাগিল। এমন সময় পাহারাওয়ালা আসিয়া বলিল যে, তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের চলিয়া যাইতে হইবে। বুলার স্ত্রী, পুত্ত্র ও কন্যার নিকট বিদায় লইল।

 বুলার স্ত্রীর কথাগুলি সব মনে করিতে লাগিল। যখন তার মনে পড়িল যে, তার স্ত্রী পর্য্যন্ত তাকে সন্দেহ করে, তখন সে ভাবিল, ‘এক ভগবান্‌ই জানতে পারেন এই সত্যিকার ব্যাপার কি! কেবল তাঁরই দয়া আশা কর্‌তে পারি।’

 বুলার আর দরখাস্ত করিল না। মুক্তির সকল পার্থিব চেষ্টা ও সকল আশা ছাড়িয়া দিয়া দিনরাত সে ভগবানের নিকট প্রাণের কান্না জানাইতে লাগিল।

 এদিকে বিচার শেষ হইল। বুলারের প্রতি প্রথমে বেত মারিবার হুকুম হইল। তার সমস্ত শরীর ক্ষত-বিক্ষত হইয়া গেল। যখন শুকাইয়া আসিল তখন কতকগুলি কয়েদীর সহিত তাকে সাইবেরিয়ায় নির্ব্বাসিত করা হইল।

 নিদারুণ কষ্টে তার জীবনের ছাব্বিশ বৎসর সাইবেরিয়ায় কাটিল। তার সমস্ত চুল বরফের মত সাদা হইয়া গিয়াছে, সাদা দাড়ি পেট পর্য্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। স্ফূর্ত্তি তার আর ছিল না। দেহ নুইয়া পড়িয়াছিল, সে খুব আস্তে আস্তে চলিত; কথাবার্ত্তা প্রায়ই বলিত না, কখনও প্রাণ খুলিয়া হাসিত না, একমনে কেবল ভগবানকেই ব্যাকুলপ্রাণে ডাকিত।

 জেলখানায় বুলার জুতা তৈয়ার করিয়া কিছু কিছু রোজগার করিত; সেই সামান্য আয়ের টাকা কয়টি জমাইয়া একখানি ‘মহাপুরুষ-চরিত’ কিনিল। জেলখানায় দিনের আলোতে প্রায়ই সে সেই বইখানি পড়িত; আর ফি রবিবার জেলখানার গীর্জ্জায় যাইত। সে এই বইয়ের অনেক জায়গা পাঠ করিত, আর পাদ্রীদের সঙ্গে গান করিত। তার গলার আওয়াজ তখন ও বেশ মিষ্ট ছিল।

 শান্ত-শিষ্ট ব্যবহারের জন্য জেলখানার কর্ত্তারা বুলারকে খুব ভালবাসিত। কয়েদীরাও তাকে খাতির করিত; কখন তাকে “ঠাকুরদাদা” কখনও বা “সাধু” বলিয়া ডাকিত। কর্ত্তাদের নিকট কোনও কিছু জানাইতে হইলে বুলারের মারফতেই তারা জানাইত। নিজেদের ভিতরে কোন বিষয় লইয়া ঝগড়া হইলে তা মিটাইবার জন্য তারা বুলারের কাছেই আসিত।

 এই ছাব্বিশ বৎসর বুলার বাড়ীর কোন খবরই পায় নাই বা তার স্ত্রী, পুত্ত্র, কন্যারা তখনও প্রাণে বাঁচিয়া ছিল কিনা, সে কিছুই জানিত না।

 একদিন একদল নূতন কয়েদী সেখানে আসিল। সন্ধ্যার সময় পুরাণো কয়েদীরা নূতন কয়েদীদের ঘিরিয়া দাঁড়াইল; কে কোথা হইতে আসিয়াছে, কেনই বা নির্ব্বাসিত হইয়াছে—এই সব কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। বুলারও নূতন কয়েদীদের একপাশে বসিয়াছিল এবং তাদের কথাবার্ত্তা মন দিয়া শুনিতেছিল। নূতন কয়েদীদিগের মধ্যে একজনের বয়স ষাইট বৎসর। সে খুব লম্বা ও শক্ত-সমর্থ। তার দাড়ি ছাঁটা। কিসের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছিল সে তাই সকলকে বলিতেছিল―

 “বন্ধুগণ একটা ঘোড়া বাঁধা ছিল। আমি সেটায় চেপে বাড়ী এসেছিলুম। একটু শীগ্‌গির শীগ্‌গির বাড়ী আস্‌বার জন্যেই আমি অবশ্য ঘোড়াটা নিয়েছিলুম। বাড়ী এসে আবার সেটাকে ছেড়ে দিলুম। তা’ছাড়া ঘোড়াটার সহিস আমার বন্ধু। আমি এ সব বল্লুম, কিন্তু তারা বল্লে, ‘না, তুমি ঘোড়া চুরি ক’রেছ।’ কিন্তু কি ক’রে কিংবা কোথায় চুরি ক’রেছি তারা বল্‌তে পার্‌লে না। আমি সেই অপরাধে বন্দী হ’য়ে নির্ব্বাসিত হ’য়েছি। আমি একবার বাস্তবিকই অপরাধ করেছিলুম, তখন কিন্তু আমাকে তারা ধর্‌তে পারে নি। আইন-অনুসারে বহু পূর্ব্বেই এখানে আসা উচিত ছিল। এবার আমাকে বিনা অপরাধে এখানে পাঠানো হ’য়েছে।—ওঃ! আমি তোমাদের মিছে কথা বল্লুম! পূর্ব্বে একবার সাইবেরিয়ায় এসেছিলুম বটে, কিন্তু বেশী দিন থাকি নি।”

 একজন জিজ্ঞাসা করিল—“তুমি কোত্থেকে এসেছ?”

 —“রিগা থেকে। আমার পরিবারের সবাই সেখানে থাকে। আমার নাম হাওয়ার্ড।”

 বুলার মাথা তুলিয়া বলিল—“হাওয়ার্ড, বণিক্ বুলারের পরিবারের কোন খবর জান কি? তারা কি এখনও বেঁচে আছে?’

 —“তারা? হ্যাঁ তাদের জানি। বুলারেরা খুব বড়লোক; যদিও বুলার এখনও সাইবেরিয়ায়। সে আমাদেরই মত একজন কয়েদী বোধ হয়! আচ্ছা, ঠাকুরদা, তুমি কি ক’রে এখানে এলে?”

 বুলার তার দুঃখের কাহিনী বলিতে ইচ্ছা করিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল—“আমার পাপের জন্যে আমি এই ছাব্বিশ বৎসর এই জেলখানাতেই বাস করছি!”

 হাওয়ার্ড বলিল—“কি পাপ!”

 বুলার বলিল—“সে সব কথায় আর কাজ কি? আমি অবশ্যই জেলখানার যোগ্য কোনও কাজ ক’রে থাক্‌ব, তা না হ’লে আমার এ অবস্থা হবে কেন?”

 তারপর বলিতে ইচ্ছা হইল না; কিন্তু কি করিয়া অন্য কোনও লোক একজন সওদাগরকে খুন করিয়া বুলারের ব্যাগের ভিতরে রক্তমাখা ছুরিখানা রাখিয়াছিল এবং ফলে তাকে অন্যায়রূপে শাস্তি দিয়া দেশের বাহির করিয়া সাইবেরিয়ায় পাঠানো হইয়াছিল—ইত্যাদি বুলারের সঙ্গীরা হাওয়ার্ডকে বলিল।

 হাওয়ার্ড ইহা শুনিয়া বুলারের মুখের দিকে চাহিয়া হাঁটু চাপড়াইয়া বলিয়া উঠিল—“ওঃ আশ্চয্যি। বাস্তবিকই আশ্চয্যি! তোমার কত বয়স হ’য়েছে ঠাকুরদা?”

 আর আর সকলে হাওয়ার্ড কে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, সে এত আশ্চর্য্য হইল কেন এবং সে বুলারকে কোথায় দেখিয়াছে? হাওয়ার্ড কোন জবাব দিল না সে শুধু বলিল—“এ ভারি আশ্চয্যি যে এখানে আমাদের দেখা হবে।”

 এই কথায় বুলার অবাক্ হইয়া গেল। কে বণিক্‌কে খুন করিয়াছে, হয়ত এই লোকটা তা জানিত; কাজে কাজেই সে বলিল—“সম্ভবতঃ তুমি সেই ব্যাপারের কথা শুনেছ! কিংবা হ’তে পারে যে তুমি আমায় পূর্ব্বে দেখেছ।”

 —“না শুনে পারব কি ক’রে? এই জগৎটাই লোকের কথায় ভরা। তবে বহুদিন পূর্ব্বে শুনেছি, আর কি শুনেছি আমার ঠিক মনে নেই।”

 বুলার বলিল—“সেই বণিক্‌কে কে খুন ক’রেছিল সম্ভবত তুমি শুনেছিলে।”

 হাওয়ার্ড হাসিয়া বলিল—“যার ব্যাগে ছুরি পাওয়া গেছে সে-ই খুন ক’রেছে। যদি অন্য কেউ ছুরি লুকিয়ে ব্যাগের ভেতর রেখে থাকে তা হ’লেও—লোকে কথায় বলে, ‘যে ধরা না পড়ে সে চোর নয়’। ব্যাগের উপরেই মাথা রেখে তুমি শুয়েছিলে, কি ক’রে অন্য লোক তার ভেতরে ছুরি রাখ্‌বে? ছুরি রাখ্‌তে গেলেই যে তুমি জেগে উঠ্‌বে!”

 বুলার এই কথাগুলি শুনিয়া স্থির করিল যে, এই লোকটাই নিশ্চয় বণিক্‌কে খুন করিয়াছিল। সে উঠিয়া চলিয়া গেল। মনে একটা ভয়ানক অশান্তি বোধ করিতে লাগিল।

 স্ত্রীর নিকট হইতে বিদায় লইবার সময় তার মুখখানি যে রকম হইয়াছিল, সেই মুখখানি যেন সে দেখিতে লাগিল,—তার সাম্‌নে ফুটিয়া উঠিল; সে যেন তার কথা শুনিতেছিল, তার হাসি দেখিতেছিল। সেই সময়ে তার সেই ছেলেমেয়েরা যেমন ছোট ছিল, ঠিক তেমনই যেন সে তাহাদিগকে দেখিতে লাগিল—একটি পোষাক-পরা, আর একটি তার মায়ের কোলে। তার নিজের সদা প্রফুল্ল ফুটন্ত যৌবন মনে পড়িল। হোটেলের বারান্দায় বসিয়া সারেঙ বাজাইতেছিল, সেখানে সে বন্দী হইল। তাকে যেখানে চাবুক মারা হইয়াছিল, সেই স্থান—ঘাতক,—চতুর্দ্দিক্‌স্থ দণ্ডায়মান লোকজন—সকলই তার চোখের সাম্‌নে ভাসিয়া উঠিল। আর একে একে তার মনে পড়িল সেই শিকল, কয়েদীর দল, ছাব্বিশ বৎসর ধরিয়া কয়েদ থাকার কষ্ট, তার অকালবার্দ্ধক্য—ক্রমশঃ চিন্তা করিতে করিতে তার এমন অশান্তি হইল যে, তার আত্মহত্যা করিবার ইচ্ছা হইল।

 বুলার ভাবিল, ‘এ সবই ত সেই শয়তানের কাজ।’ হাওয়ার্ডের উপর তার এতই রাগ হইল যে, তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে ইচ্ছা হইল, তাতে নিজের প্রাণ যাক্ আর থাক্।

 সমস্ত রাত্রি সে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিল; তবুও শান্তি পাইল না। পরদিন দিনের বেলা হাওয়ার্ডের কাছে সে একবারও গেল না, তার দিকে একবার ফিরিয়াও চাহিল না।

 পনর দিন কাটিয়া গেল। রাত্রে তার ঘুম হয় না। চিন্তা করিয়া করিয়া সে এতই মুস্‌ড়িয়া পড়িয়াছিল যে, সে কি করিবে ঠিক করিতে পারিল না।

 একদিন বুলার কয়েদখানার ভিতর রাত্রিতে পায়চারী করিতেছিল। হঠাৎ দেখিতে পাইল যে, একটা তাকের নীচে থেকে মাটি ঝরিয়া পড়িতেছে। সেখানে জেলখানার কয়েদীরা এক একজন এক ঘণ্টা তাকের উপর ঘুমায়। বুলার একটু থামিল। হঠাৎ হাওয়ার্ড তাকের নীচে থেকে গুড়ি মারিয়া বাহিরে আসিল এবং ভয়ে ভয়ে বুলারের দিকে চাহিল। তার দিকে বুলার আর চাহিবে না মনে করিয়াছিল, কিন্তু হাওয়ার্ড হঠাৎ আসিয়া তার হাত ধরিয়া ফেলিল এবং বলিল যে, পাঁচিলের নীচে সে একটা গর্ত্ত খুঁড়িয়াছে। রোজ যখন কয়েদীদিগকে বাহিরে লইয়া যাওয়া হইত সে তার জুতার ভিতরে মাটি পূরিয়া লইয়া রাস্তায় ফেলিয়া আসিত।

 বুলারের হাত ধরিয়া হাওয়ার্ড বলিল—“চুপ ক’রে থেকো বুড়ো, তুমিও বেরিয়ে যেতে পার্‌বে। তুমি যদি একথা প্রকাশ কর, তা’ হ’লে চাবুক খেয়ে আমার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে আর যদি তাই হয়, তবে তোমাকে আমি আগে খুন কর্‌ব, তার পরে না হয় আমি মরব।”

 তার দিকে চাহিয়া বুলার রাগে থর্‌থর্ করিয়া কাঁপিতে লাগিল। টানিয়া হাত ছাড়াইয়া লইয়া সে বলিল—“আমার পালাবার ইচ্ছে নেই, আর আমাকে খুন করবারও তোমার দরকার নেই; তুমি ত আমায় অনেক আগে থেকেই খুন ক’রে রেখেছ। তোমার কথা প্রকাশ করতে পারি, নাও পারি―সে ভগবান্ আমাকে যে রকম চালাবেন।”

 পরের দিন যখন সকল কয়েদীকে বাহিরে লইয়া যাওয়া হইল, পাহারার সেপাইরা দেখিতে পাইল খানিকটা মাটি খোঁড়া হইয়াছে। জেলখানাটা খুঁজিয়া সুড়ঙ্গ বাহির করা হইল।

 গবর্ণর স্বয়ং আসিয়া কয়েদীর মধ্যে কে গর্ত্ত খুঁড়িয়াছে, বাহির করিবার জন্য সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন। কেহই কিছু বলিতে পারিল না, কারণ কেহই কিছু জানিত না। যারা জানিত, তারাও কিছু বলিতে পারিল না, কারণ বলিলে হাওয়ার্ডকে যে শাস্তি দেওয়া হইবে তাতে তার বাঁচা কঠিন। গবর্ণর জানিতেন যে বুলার অন্যায় করিবার লোক নয়; শেষে তার দিকে ফিরিয়া বলিলেন—“তুমি সত্যবাদী, বুড়ো মানুষ, তুমি ভগবান্‌কে সাক্ষী ক’রে বল ত, কে এই গর্ত্ত খুঁড়েছিল?”

 হাওয়ার্ড চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, যেন সে ইহার কিছুই জানে না। বুলারের দিকে না চাহিয়া সে শাসনকর্ত্তার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বুলারের ঠোঁট হাত কাঁপিয়া উঠিল, কিছুক্ষণ সে কথা কহিতে পারিল না। সে ভাবিল, ‘যে আমার জীবন নষ্ট করেছে তার অপরাধ আমি গোপন কর্‌ব কেন? আমি যে যন্ত্রণা ভোগ ক’রেছি ও করছি তার জন্যে ওর শাস্তি হোক। কিন্তু আমি যদি ওর কথা প্রকাশ ক’রে দিই তা হ’লে ও চাবুক খেয়ে খেয়ে মারা যাবে সম্ভব। এটাও হ’তে পারে যে, আমি ওকে ভুল সন্দেহ ক’রেছি। আর তা’তে আমারই বা কি ফল হবে?’

 শাসনকর্ত্তা আবার বলিলেন—“বুড়ো, সত্যি কথা বলো, কে মাটি খুঁড়েছিল?”

 বুলার হাওয়ার্ডের দিকে চাহিয়া বলিল—“আমি বল্‌তে পার্‌ব না হুজুর। ভগবান্ ইচ্ছা করেন না যে আমি বলি। আমাকে যা খুসী কর্‌তে পারেন। আমি ত আপনার হাতে প’ড়েছি।”

 গবর্ণর যতই চেষ্টা করিলেন, বুলার কিছুতেই আর বলিল না। কাজে কাজেই এই কথা এখানেই বন্ধ হইল।

 সে রাত্রে বুলার যখন বিছানায় বসিয়া ঝিমাইতেছিল, কোন একজন লোক তখন চুপি চুপি ঘরে আসিয়া তার বিছানায় বসিল। অন্ধকারেও বুলার চিনিতে পারিল যে, সে হাওয়ার্ড।

 বুলার বলিল—“তুমি আমার কাছে আর কি চাও? তুমি এখানে এসেছ কেন?”

 হাওয়ার্ড চুপ করিয়া রহিল। বুলার উঠিয়া বসিল এবং বলিল—“তুমি কি চাও? দূর হও এখান থেকে, নইলে আমি পাহারাওয়ালাকে ডাক্‌ব।”

 হাওয়ার্ড নুইয়া বুলারের কানে কানে বলিল—“বুলার, আমায় ক্ষমা কর।”

 বুলার বলিল—“কেন?”

 “আমিই সেই বণিক্‌কে খুন ক’রে ছুরিখানা তোমার জিনিষপত্তরের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলুম। তোমাকেও খুন করতে আমার ইচ্ছে হ’য়েছিল, কিন্তু বাইরে একটা গোলমাল শুনে তোমার ব্যাগের মধ্যে ছুরিখানা পুরে জান্‌লা গ’লে পালিয়ে গেলুম।”

 বুলার খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল—কি বলিবে কিছুই স্থির করিতে পারিল না। হাওয়ার্ড বিছানা হইতে নামিয়া গিয়া মাটিতে হাঁটু গাড়িয়া বলিল—“বুলার, আমায় ক্ষমা কর। ভগবানের দোহাই আমায় ক্ষমা কর। আমি স্বীকার কর্‌ব যে, আমি সেই বণিক্‌কে খুন করেছি। তুমি মুক্তিলাভ ক’রে বাড়ী যেতে পার্‌বে।”

 বুলার বলিল—“তোমার পক্ষে বলা খুব সোজা; কিন্তু তোমারই জন্যে এ ছাব্বিশ বছর কষ্ট পেয়েছি। আমি এখন কোথায় যাব? আমার স্ত্রী মারা গেছে, ছেলেমেয়েরা আমাকে ভুলে গেছে। আমার এখন আর যাবার জায়গা নেই।”

 হাওয়ার্ড উঠিল না, মেজের উপর মাথা কুটিয়া চীৎকার করিয়া বলিল—“বুলার, আমায় ক্ষমা কর। জল্লাদ যখন আমায় বেত মার্‌ছিল, তখনও আমার এত কষ্ট হয় নি—তোমাকে এখানে দেখে যত কষ্ট হচ্ছে। তবুও তুমি আমার উপর এত দয়া ক’রেছ, তবুও তুমি আমার কথা প্রকাশ কর নি। আমি হতভাগা, যীশুখৃষ্টের নাম ক’রে বল্‌ছি, আমায় ক্ষমা কর।” এই বলিয়া হাওয়ার্ড কাঁদিতে লাগিল।

 একথা শুনিতে শুনিতে বুলারেরও গাল বাহিয়া চোখের জল ঝরিতে লাগিল। সে বলিল— “ভগবান্ তোমাকে ক্ষমা করবেন; হয়ত আমি তোমার চেয়ে অনেক গুণে ছোট।”

 এই কথায় বুলারের মনটা যেন একটু হাল্‌কা হইল, তার বাড়ী ফিরিবার ঝোঁক কমিয়া গেল। সেই কয়েদখানা ছাড়িয়া যাইতে তার ইচ্ছা হইল না। সে শুধু অন্তিম সময়ের অপেক্ষায় বসিয়া রহিল।

 বুলারের অনিচ্ছাসত্ত্বেও হাওয়ার্ড নিজের অপরাধ স্বীকার করিল; কিন্তু যখন বুলারের খালাসের হুকুম আসিল তখন দেখা গেল যে, সে মরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে।