টল্স্টয়ের গল্প/তীর্থযাত্রী
তীর্থযাত্রী
—১—
এফিম্ ও এলিসা দুই বৃদ্ধ কৃষক একবার তীর্থভ্রমণ করিতে মনস্থ করিল। এফিমের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল; এলিসার তত ভাল নয়।
এফিম্ খুব গম্ভীর ও সবল পুরুষ! তার জীবনে সে কখনও মদ খায় নাই, তামাক খায় নাই, এমন কি এক টিপ্ নস্য পর্য্যন্ত নেয় নাই; খারাপ কথা সে কোন দিন মুখেও আনে নাই। তার পল্লীগ্রামে তার পদমর্য্যাদা অত্যন্ত বেশী। তার প্রকাণ্ড সংসার; দুইটি ছেলে আর বিবাহিত পৌত্র— সকলেই তার সঙ্গে থাকিত। এফিম্ বৃদ্ধ হইলেও তার স্বাস্থ্য খুব ভাল, তার দেহ অত্যন্ত সবল ও সুদীর্ঘ। ষাট বৎসর পর্য্যন্ত তার চুলে পাক ধরে নাই।
এলিসার অবস্থা তত ভাল না হইলেও সে গরীব নয়। সে পূর্ব্বে সূত্রধরের কাজ করিত, শেষে বৃদ্ধ হইয়া বাড়ীতেই থাকিত। তার এক ছেলে কাজের খোঁজে বাহির হইয়াছিল, অপরটি বাড়ীতেই তার সঙ্গে থাকিত।
এলিসা খুব দয়ালু, সে সর্ব্বদাই প্রফুল্ল থাকিত। অবশ্য সে মাঝে মাঝে মদ খাইত এবং নস্যও গ্রহণ করিত; আর গানবাজনায়ও তার সখ ছিল। সে অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় ছিল বলিয়াই তার পরিবারস্থ সকল লোক এবং প্রতিবেশী সকলের সঙ্গেই সদ্ভাব ছিল। সে দেখিতে বেঁটে, তার রং কাল, ঋষির মত তার শ্মশ্রু, কেশহীন মস্তক।
দুই বৃদ্ধ বহু পূর্ব্বেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল যে, তারা একত্র জেরুজালেমে তীর্থভ্রমণে বাহির হইবে, কিন্তু এফিলের এত কাজের ভীড় ছিল যে, তার কখনও সময় হয় নাই। একটা কাজ শেষ হইয়া গেলেই সে আর একটা আরম্ভ করিত। প্রথমত তাকে তার পৌত্রের বিবাহের জোগাড় করিতে হইল, তারপর তার কনিষ্ঠ পুত্রের যুদ্ধ হইতে ফিরিয়া আসিবার প্রতীক্ষায় সে রহিল। পুত্র ফিরিয়া আসিলে সে একটা নূতন কুঁড়েঘর প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিল।
এক ছুটির দিনে দুই বৃদ্ধ কুঁড়েঘরের বাহিরে একটা কাঠের গুঁড়ির উপর বসিয়া পরস্পর গল্প করিতে লাগিল।
এলিসা বলিল—“আচ্ছা, আমাদের সেই প্রতিজ্ঞা কবে পূরণ কর্ব?”
এফিম্ মূখ বিকৃত করিয়া বলিল—“আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এবার আমার বড্ড টানাটানি। এ ঘরখানা তৈরী কর্তে আরম্ভ ক’রে মনে কর্লুম যে একশো টাকার কিছু বেশী হলেই হবে; কিন্তু এরই মধ্যে তিনশো টাকা খরচা হ’য়ে গেছে, তবুও ঘরের কাজ শেষ হয় নি। আস্ছে গ্রীষ্মকাল অবধি আমাদের দেরী করতে হবে; ভগবানের ইচ্ছে হলে তখন নিশ্চয় যাব।”
এলিসা বলিল―“আমার মনে হয় আমাদের যাওয়া বন্ধ রাখা উচিত নয়, আমাদের এখনই যাওয়া উচিত। বসন্ত কালটাই সব চাইতে ভাল সময়।”
—“হাঁ, সময় ভাল বটে, কিন্তু আমার ঘরের কি কর্ব? সেটা তৈরী না ক’রে যাব কি করে?”
—“কেন? তোমার বুঝি কারও ওপরে ভার দিয়ে যাবার জো নেই! তোমার ছেলে এ ভার খুব নিতে পারে।”
—“কি রকম? আমার বড় ছেলেকে আমি বিশ্বাস করিনে, সে কখনও কখনও খুব বেশী মদ খায়।”
—“দেখ ভাই, আমরা ম’রে গেলে আমাদের ছাড়াও কাজ চল্তে পারে। আর তোমার ছেলের এখন থেকেই এ সব বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞান হওয়া আবশ্যক।”
“সেটা খুবই ঠিক। কিন্তু যে একটা কাজ আরম্ভ করে, সে সেটাকে সম্পূর্ণ দেখ্তে চায়। সেটাকে শেষ না ক’রে সে যেতে পারে না।”
—“তা হ’লে ভাই আমাদের এত কাজ রয়েছে যে, সেগুলো সব শেষ ক’রে যাওয়া অসম্ভব। সেদিন মেয়েছেলেরা কাপড় কাচ্ছিল, ইষ্টারের জন্য বাড়ী-ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কর্ছিল। এখানে এটা, সেখানে সেটা ক’রে ক’রে তারা সব কাজ ঠিক ক’রে উঠ্তে পারে নি। তাই আমার বড়-বৌমা বল্ছিল, ‘ভগবানের নিকট আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে, এই সব ছুটির দিন আমাদের জন্য অপেক্ষা না ক’রেই চলে আসে; আমরা যতই কঠিন পরিশ্রম করি না কেন, এর জন্যে পূর্ব্বেই আমাদের প্রস্তুত হ’য়ে থাকা উচিত! আমার বৌমা কথাটা ব’লেছে ঠিক। সে খুব বুদ্ধিমতী!”
এফিম্ চিন্তা করিতে লাগিল। সে বলিল—“ঘরটা তৈরী কর্বার জন্যে কতকগুলো টাকা ব্যয় হ’য়ে গেল। শুধুহাতে ত সেখানে যাওয়া হয় না। আমাদের অন্ততঃ একশো টাকা চাই-ই। একশো টাকা ত একেবারে সোজা কথা নয়।”
এলিসা হাসিয়া বলিল—“একবার বন্ধু পথে এসো, আমার চাইতে তোমার দশগুণ টাকা বেশী আছে, তবুও তুমি কেবল, টাকার কথাই বল। বল কবে আমরা রওনা হ’ব, আমার হাতে যদিও এখন কিছু নেই, কিন্তু তখন আমার যথেষ্ট টাকা জোগাড় হবে। না হয় আধ কুড়ি মৌচাক আমার প্রতিবেশীকে বিক্রী কর্ব। সে অনেকদিন থেকেই সেগুলো কিন্তে চেয়েছে।”
—“যদি মৌচাকে মৌমাছির ঝাঁক এসে পড়ে তোমার যথেষ্ট মধু হবে। তখন তোমাকে ভাই, পস্তাতে হবে।”
—“পস্তাতে হবে না ভাই! শুধু পাপকার্য্য ভিন্ন আমি অন্য কোন কাজের জন্য আমার জীবনে দুঃখিত হই নি। আত্মার চেয়ে বেশী মূল্যবান্ জিনিষ আর কিছুই নেই।”
—“তা ঠিক বটে। তবুও বাড়ীর জিনিষগুলো এমনি তুচ্ছ করা উচিত নয়।
—“কিন্তু যদি আত্মাকে তুচ্ছ করি, সে ত আরও খারাপ। প্রতিজ্ঞা ক’রেছিলুম, চল যাই। সত্যি সত্যিই বল্ছি—চল এবারই যাই।”
—২—
এলিসা তার বন্ধুকে সম্মত করাইল। বিশেষরূপে চিন্তা করিয়া পরের দিন ভোরবেলা এফিম্ এলিসার কাছে আসিয়া বলিল—“তুমি ঠিক ব’লেছ, চল যাই। কখন কি হয় বলা যায় না ত। জীবন ও মৃত্যু ভগবানের হাতে। শক্তি থাকতেই আমাদের যাওয়া উচিত, এবারেই আমরা যাব।” এক সপ্তাহ পরে দুই বৃদ্ধ যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইল। এফিমের যথেষ্ট টাকা ছিল। সে নিজের একশত টাকা লইল ও তার স্ত্রীর হাতে দুইশত টাকা রাখিল।
এলিসাও প্রস্তুত হইল। সে দশটা মৌমাছির চাক তার প্রতিবেশীকে বিক্রী করিল। গ্রীষ্মকাল পর্য্যন্ত যত মৌমাছি তাতে আসিয়া মধু সংগ্রহ করিবে তা তার প্রতিবেশী পাইবে। চাক বিক্রী করিয়া সে সত্তর টাকা পাইল। একশতের বাকী টাকা সে বাড়ীর অন্যান্য লোকের টাকা নিয়া পূরণ করিল। তার স্ত্রীর যে কয়েকটি টাকা ছিল তা সে স্বামীকে দিল। পুত্ত্রবধূ যা জমাইতে পারিয়াছিল তাও সে দিল।
এফিম্ তার জ্যেষ্ঠ পুত্ত্রকে সকল কাজই বুঝাইয়া দিল। কখন কত ঘাস কাটিতে হইবে, জমিতে সার দিতে হইবে, এবং কি ভাবে সেই কুঁড়েঘরখানিকে সম্পূর্ণ করিতে হইবে ইত্যাদি সকল কাজের উপদেশ দিল। এদিকে এলিসা তার স্ত্রীকে শুধু বলিল, সে যেন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে মধু লইয়া কোন অন্যায় আচরণ না করে। তার প্রতিবেশী যা পাইতে পারে তাই যেন সে পায়, তাকে যেন ঠকান না হয়। সংসারের কোন কথাই সে উল্লেখ করিল না; সে শুধু বলিল—“প্রয়োজন অনুসারে কোন্টা কি কর্তে হবে তোমরাই বুঝেশুঝে কর্বে এখন।”
দুই বৃদ্ধ প্রস্তুত হইল। গ্রামের লোকেরা পথে খাইবার পিঠা ও পায়ে জড়াইবার জন্য বনাতের কাপড় ইত্যাদি সব প্রস্তুত করিয়া দিল। তারা নূতন নূতন জুতা পরিয়া রওনা হইল। তাদের পরিবারস্থ সকলেই সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের শেষপ্রান্ত পর্য্যন্ত গেল। তারপর তারা বিদায় গ্রহণ করিয়া তীর্থভ্রমণে বাহির হইল।
এলিসা অত্যন্ত হৃষ্টচিত্তে বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিল। গ্রামের বাহির হইবামাত্রই সে বাড়ীর সকল কথা ভুলিয়া গেল। এলিসা কেবল ভাবিতেছিল, সে কি করিয়া তার বন্ধুকে খুশী রাখিবে; কাকে কোন রকম কর্কশ কথা কহিবে না, কি রকমে তারা গন্তব্য স্থানে পৌঁছিবে এবং সেখান থেকে শান্তি এবং ভালবাসা লইয়া আবার বাড়ীতে আসিবে। রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে সময়ে সময়ে সে যে মনে মনে প্রার্থনা করিতেছিল, কখনও বা কোন ঋষি-চরিত্র স্মরণ করিতেছিল। রাস্তায় যখন কারও সহিত তার দেখা হইত, কিংবা রাত্রিতে বিশ্রাম করিবার জন্য কোথাও থাকিত, সে সরল সুমিষ্ট ব্যবহারে সকলকে তুষ্ট করিত, কারও সহিত বা ধর্ম্মের কথা বলিত। এইরূপে অত্যন্ত প্রফুল্লচিত্তে সে চলিতে লাগিল। সে কেবল একটা জিনিষ ত্যাগ করিতে পারিল না, সেটা নস্য। সে প্রায়ই নস্য গ্রহণ করিত। যদিও সে নস্যের কৌটা ফেলিয়া আসিয়া বড়ই অসুবিধায় পড়িয়াছিল, তথাপি রাস্তায় লোকদের কাছে সে নস্য লইত। মাঝে মাঝে এক এক টিপ্ নস্য লইত, আর একটু পিছনে পড়িত।
এফিম্ও খুব জোরে চলিতে লাগিল। সেও কারও অনিষ্ট করে নাই কিংবা বাজে কথা বলে নাই; কিন্তু এলিসার মত তার মন তত হাল্কা ছিল না। তার মনে কেবল সাংসারিক ব্যাপারের কথা উঠিতেছিল। তার ছেলেকে এটা কিংবা সেটা বলা হয় নাই কি? সে ঠিক করিয়া সব কাজ করিতে পারিবে কি? রাস্তায় চলিতে চলিতে সে যদি দেখিতে পাইত যে, আলু রোপণ করা হইতেছে, কিংবা গাড়ী করিয়া জমির সার আনা হইতেছে, তখনই সে থমকাইয়া দাঁড়াইত এবং ভাবিত,—সে যে রকম করিয়া বলিয়া আসিয়াছে তার ছেলে সে রকম করিয়া এসব কাজ করিতেছে কিনা! এই রকম ভাবিতে ভাবিতে তার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হইত যে, সে ফিরিয়া গিয়া ছেলেকে এসব কাজ দেখাইয়া দেয় অথবা নিজেই সেগুলি করে।
—৩—
পাঁচ সপ্তাহ ধরিয়া দুই বৃদ্ধ ক্রমাগত চলিতেছিল। তাদের বাড়ীতে তৈরী জুতা ক্ষয় হইয়া যাওয়ায় ছোট-রুশিয়াতে (রুশিয়ার দক্ষিণ ভাগ) পৌঁছিয়া তারা নূতন জুতা কিনিল। বাড়ী ত্যাগ করিবার পরে যখন তারা ছোট-রুশিয়ায় আসিয়া পৌঁছিল, সেখানে সকল লোকই তাদের যত্ন করিয়া খাওয়াইতে লাগিল। এমন কি তারা নিজেদের ভিতরে ঝগড়াও করিত—কে ঐ আগন্তুকদিগকে স্থান দিবে। সকলেই আপনার ঘরে স্থান দিতে চাহিত—খাওয়াইতে চাহিত।
তারা আদর-যত্ন করিত, কিন্তু অতিথিদের নিকট এক পয়সাও লইত না। তা ছাড়া তাদের যাইবার সময় পথে খাইবার জন্য তাদের ব্যাগের ভিতর রুটি, এমন কি ভাল ভাল কেক পর্য্যন্ত পুরিয়া দিত।
এইরূপে বিনা খরচে তারা ছোট-রুশিয়ার প্রায় পাঁচশত মাইল পথ অতিক্রম করিল। ছোট-রুশিয়া পার হইয়া তারা আর একটা প্রদেশে আসিয়া পড়িল। এই প্রদেশের একটা জেলায় সেবারে একেবারে ফসল হয় নাই। সে দেশের কৃষকেরা তবুও তাদের থাকিবার জন্য কিছুই লইল না; কিন্তু বিনা খরচায় তাহাদিগকে খাওয়াইতে পারিল না। কখনও কখনও তারা রুটি পাইত না, অতিরিক্ত দাম দিয়া তাদের রুটি সংগ্রহ করিত হইত; শেষে এমন হইল যে, রুটি আর পাওয়া যাইত না। দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। ধনী লোকেরা নিঃস্ব হইয়া পড়িল। এক বৎসর শস্য না হওয়ায় গরীব লোকদের আর কোন সংস্থান রহিল না। বড় লোকেরা নিজেদের সব ভাল ভাল জিনিষ-পত্র বিক্রয় করিতে লাগিল। মধ্যবিত্ত লোকদের বাড়ী-ঘর সব গেল, আর গরীবেরা সর্ব্বস্ব খোয়াইয়া ভিক্ষা করিতে লাগিল। তাদের শত শত লোক অনাহারে প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল। শীতকালে তুষ, ভূষি ইত্যাদি খাইয়া তারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে লাগিল।
একদিন দুই বৃদ্ধ একটা ক্ষুদ্র গ্রামে রাত্রিযাপন করিবার জন্য রহিল; তারা অতি কষ্টে পনেরো পাউণ্ড দিয়া রুটি কিনিল। দিনের উত্তাপে পথ চলিতে অত্যন্ত কষ্ট হইবে জানিয়া ভোরেই তারা চলিতে আরম্ভ করিল। প্রায় আট মাইল পথ চলিবার পর ছোট একটা নদীর ধারে তারা বিশ্রাম করিতে বসিল; তার পর একটা পাত্রে জল লইয়া তাতে কতকটা রুটি ভিজাইয়া খাইল। খাওয়ার পরে পায়ে জড়ান বনাত খুলিয়া ফেলিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিতে লাগিল। এলিসা তার নস্যের কৌটা বাহির করিল। এফিম্ তার দিকে চাহিয়া মাথা নাড়িয়া বলিল—“এ কি রকম? তুমি এই নোংরা অভ্যেসটা কিছুতেই ত্যাগ করতে পার না?”
এলিসা হাত নাড়িয়া বলিল—“আমার চেয়ে এই অভ্যেসটার শক্তি অনেক বেশী।”
একটু পরেই তারা উঠিল, আবার চলিতে লাগিল। রৌদ্রের তেজ তখন অত্যন্ত প্রখর। এলিসাও অত্যন্ত ক্লান্ত। সে একটু বিশ্রাম করিয়া জলপান করিতে চাহিল; কিন্তু এফিম্ থামিল না। শরীরের শক্তি এলিসার চেয়ে এফিমের বেশী ছিল, কাজেই সে বেশী চলিতেও পারিত। এফিমের সঙ্গে একত্র চলা এলিসার পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া দাঁড়াইল।
এলিসা বলিল—“আমি যদি শুধু একবারটি জল খেতে পেতুম—”
এফিম্ বলিল—“আচ্ছা, তুমি জল খাও, আমার দরকার নেই।”
এলিসা থামিল; বলিল—“তুমি চলতে থাক। ঐ যে একটা কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে, আমিও ওখানে এখুনি ছুটে যাব। এক মুহূর্ত্তের ভিতরেই ফিরে এসে তোমাকে ধর্ব এখন।”
“আচ্ছা বেশ” বলিয়া এফিম বড় রাস্তা ধরিয়া চলিতে লাগিল, এলিসা সেই কুটীরের দিকে গেল।
কুটীরখানি খুব ছোট, মাটির তৈয়ারি। নীচেকার দিকটায় কালো রং, উপরের দিকে খানিকটা চূণকাম করা। বহু পূর্ব্বে প্রস্তুত সেই মাটির দেওয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। কতকাল পূর্ব্বে বিলাতী মাটির একটা পোঁচ দেওয়া হইয়াছিল। একদিকের খানিকটা চাল উড়িয়া গিয়াছে। বাড়ীটার সাম্নে একটা ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণ। তার উপর দিয়া ঘরে প্রবেশ করিতে হয়। এলিসা উঠানে গিয়া দেখিল যে, ঘরের চারিদিকে যে ধারি আছে তারই একপার্শ্বে একজন দীর্ঘ, শ্মশ্রুহীন লোক শুইয়া পড়িয়া আছে। সে নিশ্চয়ই প্রথমে ছায়ায় শুইয়াছিল, কিন্তু মধ্যাহ্নের উত্তপ্ত রৌদ্র আসিয়া তার উপর পড়িয়াছে। লোকটি ঘুমায় নাই, জাগিয়া থাকিয়াও ঘুমন্তের মতই সে পড়িয়া ছিল। এলিসা তাকে ডাকিয়া একটু জল চাহিল, কিন্তু কোনও জবাব পাইল না।
এলিসা মনে করিল, ‘এ হয়ত পীড়িত কিংবা ভাল লোক নয়।’ দরজার কাছে গিয়া শুনিতে পাইল যে, একটি শিশু কাঁদিতেছে। দরজায় একটা ছোট ঘা দিল ও কড়া ধরিয়া শব্দ করিতে লাগিল।
সে ডাকিয়া বলিল “কর্ত্তা।” কোনও জবাব পাইল না। তখন লাঠি দিয়া সে জোর ঘা দিতে দিতে বলিল—“ওহে, কে আছ?” কিছুতেই কিছু হইল না। “ওহে ভগবানের সেবক”—তবুও কোন জবাব নাই। এলিসা ফিরিয়া যাইতেছিল, এমন সময় দরজার আড়াল হইতে একটি ছোট শিশুর করুণ আর্ত্তনাদ শুনিতে পাইল। সে ভাবিল, ‘হায় হায়, নিশ্চয়ই এদের কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আচ্ছা একবার দেখে যাই।’
এলিসা সে কুটীরে প্রবেশ করিল।
—৪—
দরজা চাবিবন্ধ ছিল না। এলিসা কড়াটা ঘুরাইয়া দরজা খুলিল এবং বরাবর ভিতরে চলিয়া গেল। ভিতরে ঘরের দরজা খোলা ছিল। ঘরের বামদিকে একটা পাঁউরুটির চুল্লী, সম্মুখে দেওয়ালের দিকে পিছন করিয়া যীশুখৃষ্টের একটি মূর্ত্তি দাঁড় করানো ছিল এবং ইহার সাম্নে একটা টেবিল। টেবিলের পাশে একটা বেঞ্চি, একটি বৃদ্ধা স্ত্রীলোক তার উপরে বসিয়াছিল। তার খোলা মাথা টেবিলে ঠেকিয়া ছিল। বুড়ীর পাশে এক অস্থিচর্ম্মসার বিবর্ণ বালক। তার পেট ব্যারামে ভুগিয়া ভূগিয়া প্লীহাগ্রস্ত রোগীর মত উঁচু হইয়া উঠিয়াছিল। স্ত্রীলোকটির কাপড় ধরিয়া টানাটানি করিয়া সে কিছু খাবার চাহিতেছিল, আর অত্যন্ত কাঁদিতেছিল। এমন সময়ে এলিসা ঘরে প্রবেশ করিল।
ঘরের হাওয়া যেমন দূষিত তেমনি দুর্গন্ধ। এলিসা চারিদিকে চাহিয়া দেখিল যে, উনুনের পিছন দিকে মেজের উপর একজন স্ত্রীলোক পড়িয়া আছে। তার চোখ দুটি বুজিয়া ছিল; গলায় ঘড়্ ঘড়্ শব্দ হইতেছিল; সে পা দুইটা কখনও ছড়াইয়া দিতেছিল, কখনও গুটাইয়া বুকের কাছে আনিতেছিল এবং যন্ত্রণায় এপাশ-ওপাশ ছট্ফট্ করিতেছিল। তার শরীর হইতে দুর্গন্ধ বাহির হইতেছিল। সে একেবারে অসহায়, উঠিবার শক্তি নাই। তার কাছে থাকে কিংবা দরকারের সময় কাছে আসিয়া কিছু দেয় এমন কেহই ছিল না।
এলিসা ঘরে ঢুকিতেই বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটি মাথা তুলিয়া তাকে দেখিল এবং বলিল—“তুমি কি চাও? আমাদের কিছু নেই—তুমি কি চাও?”
যদিও স্ত্রীলোকটি সেই প্রাদেশিক ভাষায় কথা কহিতেছিল, তথাপি এলিসা তার সমস্ত কথা বুঝিতে পারিল। সে কহিল—“আমি ভগবানের একজন সেবক, একটু জল খাবার জন্যে এসেছিলুম।
—“আমাদের কেউ নেই—কেউ নেই। জল আন্বারও কিছুই নেই, কেই বা আন্বে। তুমি এখন পথ দেখ।”
এলিসা জিজ্ঞাসা করিল—“তা হ’লে তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে, এই স্ত্রীলোকটির সেবা-শুশ্রূষা কর্বে?”
—“না; আমাদের কেউ নেই। বাইরে আমার ছেলে যায়-যায়; আর আমাদেরও সময় ঘনিয়ে আসছে।”
নবাগত এলিসাকে দেখিয়া বালকটি কান্না বন্ধ করিয়াছিল কিন্তু বৃদ্ধা যখন কথা কহিতে আরম্ভ করিল বালকটি তার কাপড় ধরিয়া আবার কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতে লাগিল—“খাবার দাও ঠাকুরমা, খাবার।”
এলিসা বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করিতে যাইবে এমন সময় বাহিরের লোকটা, সেই বৃদ্ধারই পুত্ত্র কুটীরের ভিতর টলিতে টলিতে আসিতেছিল। তার দেহ সম্পূর্ণ শক্তিহীন, একেবারে নিস্তেজ। উঠিয়া আসিবার শক্তি তার একেবারেই ছিল না। দেওয়াল ধরিয়া ধরিয়া কোনও রকমে সে আস্তে আস্তে আসিতেছিল; কিন্তু যেমনি ভিতরে প্রবেশ করিতে চেষ্টা করিল, অমনি সে দরজার কাছে পড়িয়া গেল। সে আর উঠিয়া আসিবার চেষ্টা করিতেও পারিল না। সেখান হইতে অতি কষ্টে ভাঙ্গা গলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে ধীরে ধীরে বলিল—“আমাদের সকলকেই ব্যারাম ও দুর্ভিক্ষে ধ’রেছে। ঐ ছেলেটা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে।” বালকটিকে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া সে কাঁদিতে লাগিল।
এলিসা তার পিঠের বোঝা নামাইল; উহা বেঞ্চির উপর রাখিয়া দড়ির বাঁধন খুলিয়া ব্যাগের ভিতর হইতে একখানা রুটি বাহির করিল এবং একখণ্ড কাটিয়া সেই লোকটাকে দিল। সে নিল না, অঙ্গুলি দিয়া ছোট ছেলেটি ও উনুনের পার্শ্বে একটি মেয়ে হামাগুড়ি দিতেছিল, সেইটিকে দেখাইয়া দিল; যেন সে বলিল―“ওদের দাও।”
এলিসা ছেলেটির কাছে রুটির টুকরা ধরিল। রুটির গন্ধ পাইয়া ছেলেটি হাত বাড়াইয়া দিল এবং ছোট দুই হাতে ধরিয়া তাতে এমন ভাবে কামড় দিল যে, তার নাক পর্য্যন্ত রুটিতে ঢাকা পড়িয়া গেল। ছোট্ট মেয়েটি উনুনের পিছন হইতে ছুটিয়া আসিয়া রুটির দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। এলিসা তাকেও এক টুক্রা দিল। তারপর আর এক টুক্রা কাটিয়া বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটিকে দিল। সেও অত্যন্ত ব্যগ্রভাবে চিবাইতে আরম্ভ করিল।
স্ত্রীলোকটি বলিল—“যদি একটু জল আনা যেতে পারত—ওদের গলা একেবারে শুকিয়ে গেছে। কাল আমি কিছু জল আন্তে চেষ্টা ক’রেছিলুম—কাল না আজকে―কি জানি আমার মনে নেই—যাই হোক্, আমি প’ড়ে গেলুম, আর যেতে পার্লুম না। যদি কেউ না নিয়ে থাকে ত কলসীটা সেখানে পড়ে আছে।”
এলিসা জিজ্ঞাসা করিল—“কূয়া কোথায়?”
বৃদ্ধা তাকে বলিয়া দিল। এলিসা বাহিরে গিয়া কলসীটা পাইয়া কিছু জল আনিয়া তাদের দিল। ছেলেমেয়ে দুটি ও সেই বৃদ্ধা জল দিয়া আরও কিছু রুটি খাইল; কিন্তু সেই লোকটি খাইল না। সে বলিল—“আমি খেতে পার্ব না।”
এই সমস্ত সময় সেই যুবতীর চেতনা ছিল বলিয়া বোধ হয় নাই; সে কেবল এপাশ-ওপাশ ফিরিয়া যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিল। একটু পরেই এলিসা গ্রামের দোকানে চলিয়া গেলে এবং কিছু ময়দা, নুন ও তেল কিনিয়া আনিল। ফিরিয়া আসিয়া একখানা কুড়ালি বাড়ী হইতে খুঁজিয়া লইয়া কাঠ কাটিয়া আগুন জ্বালিল। তারপর কিছু ঝোল রাঁধিয়া সেই ক্ষুধার্ত্ত লোকদের ভোজন করাইল।
—৫—
সেই লোকটি কিছু খাইল, আর সেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটিও কিছু খাইল। বালক ও বালিকাটি এমন ভাবে খাইল যে তাদের পাতায় খাবারের চিহ্নমাত্র রহিল না—চাটিয়া চাটিয়া একেবারে পাতা পরিষ্কার করিয়া ফেলিল। খাওয়া শেষ হইলে বালক-বালিকা দুটি জড়াজড়ি করিয়া শুইল এবং ঘুমে অচেতন হইয়া পড়িল। তারপরে সেই বৃদ্ধা ও লোকটি তাদের বর্ত্তমান দুরবস্থার কাহিনী এলিসার কাছে বলিতে লাগিল। লোকটি বলিল—“আমরা পূর্ব্বে এত গরীব ছিলুম কি? কিন্তু গেলবারে যখন মাঠে একেবারে শস্য পাওয়া গেল না, আমরা যা কিছু সংগ্রহ কর্তে পার্লুম তাতে শরৎকাল কাটানই আমাদের পক্ষে নিতান্ত কষ্টকর হ’য়ে দাঁড়াল। শীতকাল যখন এলো তখন আমাদের আর কিছুই সংস্থান রইল না, আমরা তখন পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা যে কোন লোকের কাছে ভিক্ষা কর্তে লাগ্লুম। প্রথম প্রথম ওরা আমাদের দিত, কিন্তু শেষে দেওয়া বন্ধ কর্লে। অনেকে দিতে চাইত, দিয়ে সন্তুষ্ট হ’ত, দিতে পার্লে তাদের মনে খুব একটা আনন্দ হ’ত বটে, কিন্তু তাদেরও কিছু ছিল না। তাদের অবস্থাও খারাপ হ’তে লাগল, তাদের দেওয়ার আর কিছুই রইল না। কোনও দিন ভিক্ষে করি নি, আমাদেরও শেষে ভিক্ষে কর্তে লজ্জা হ’ত। কেবল ধার হ’তে লাগ্ল―টাকা, পয়সা, গম, রুটি কতই ধার কর্লুম।
“আমি কাজের খোঁজে বেরিয়ে গেলুম, কিন্তু কোথাও কাজ পেলুম না। কাজ পেলেও পাকা কাজ পাওয়া বড্ড শক্ত। সর্ব্বত্রই সকলেই নিজেদের রক্ষা কর্বার জন্য ব্যগ্র। কোনও খানে ঠিক কাজের জোগাড় করতে পার্লেও আবার অন্য চেষ্টায় থাক্তে হয়। কেবল আমাকে নিয়ে থাক্লেই ত চল্বে না, বাড়ীতে এদের সকলকেই খাওয়াতে হবে। এই বৃদ্ধা এবং মেয়েটিও শেষে অনেক দূরে দূরে ভিক্ষে কর্তে বেরুল, তারাও কিছু পেল না। রুটি অত্যন্ত মাগ্গি ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠ্ল, তবু কোনও রকমে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা ক’রে যাতে আগামী ফসলের সময় পর্য্যন্ত কাটাতে পারি, তার চেষ্টা কর্তে লাগ্লুম, কিন্তু বসন্তকালে লোকের অবস্থা এমন হ’ল যে, প্রাণ গেলেও তারা কিছু দিত না, আমরাও শত চেষ্টা ক’রেও কিছুই জোটাতে পার্লুম না। শেষে আমাদের সকলেরই ব্যারাম হ’ল। হয়ত একদিন কিছু খেতে পেলুম, আবার দু’দিন একেবারেই কিছু পেলাম না; পেটের জ্বালায় শেষে ঘাস খেতে লাগ্লুম। এই ভাবে দিন কাটিয়ে কাটিয়ে শেষে, জানিনে, ঘাস কিংবা আর কিছু খেয়ে আমার স্ত্রীর ব্যারাম হ’ল। সে আর দাঁড়াতে পার্ত না, আমারও কোন শক্তি ছিল না। আর আমাদের এ অবস্থায় সাহায্য করবে এমন লোক বা এমন কোনও জিনিষ আমাদের ছিল না।”
বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটি বলিল—“আমি একা প্রাণপণ চেষ্টা কর্তে লাগ্লুম। কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে তাকে জয় কর্তে পার্লুম না; খেতে না পেয়ে আমিও শেষে একেবারে দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে পড়্লুম। মেয়েটাও একেবারে মরার মত হয়ে পড়ায় তাকে পাড়ার লোকদের বাড়ীতে যেতে বল্তুম, কিন্তু সে যেতে পার্ত না, তার বড্ড ভয় হ’ত, ঘরের এক কোণে গিয়ে ব’সে থাক্ত। পরশু আমাদেরই এক প্রতিবেশিনী এসেছিল; কিন্তু আমরা ক্ষিদেয় ব্যারামে ছট্ফট্ কর্ছি দেখে চ’লে গেল। তার স্বামীকে দূরে চ’লে যেতে হ’য়েছে, তারও নিজের ছোট ছেলেদের খাওয়াবে এমন কিছুই নেই। আমাদের উপায়ান্তর নেই বলেই এখানে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আমরা প’ড়েছিলুম।
তাদের এই কাহিনী শুনিয়া এলিসা তার বন্ধু এফিমের সহিত সেদিন সাক্ষাৎ করিবার আশা ছাড়িয়া দিল। সমস্ত রাত্রি সে তাদের সঙ্গেই রহিল; সকালবেলা উঠিয়াই নিজের বাড়ীর মত সেখানে সংসারের কাজ আরম্ভ করিল। তারপর সে ময়দা ঠেসিতে আরম্ভ করিল। বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটি তাকে সাহায্য করিতে লাগিল। তারপর সে আগুন জ্বালিল; ঘরে কিছু ছিল না; কাজেই সে ছোট মেয়েটিকে সঙ্গে লইয়া নিতান্ত প্রয়োজনীয় কতকগুলি জিনিষ আনিবার জন্য পাড়ায় গেল। পেটের দায়ে তারা বাসন-কোসন, কাপড়-চোপড় এবং অন্যান্য সকল জিনিষই বিক্রয় করিয়াছিল। যা যা নিতান্ত দরকারী এলিসা সেইগুলি কিনিয়া আনিল, আর কতকগুলি সে নিজে তৈয়ারি করিল। একদিন একদিন করিয়া এলিসা তিনদিন রহিল। ছোট ছেলেটি হামাগুড়ি দিয়া তার কাছে আসিত। ছোট মেয়েটি তিনদিনেই বেশ সুস্থ হইয়া উঠিয়াছে; সকল কাজে ছুটিয়া গিয়া তাকে সাহায্য করিত, তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকিত, আর “বাবা” বলিয়া ডাকিত। বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটিও পূর্ব্বাপেক্ষা একটু সবল হইয়া উঠিল। কোনরকমে প্রতিবেশীদের নিকট যাইতে পারিত। লোকটাও অনেকটা সুস্থ বোধ করিল এবং বাহির হইতে পারিল। কেবল সেই লোকটির স্ত্রী উঠিতে পারিল না, কিন্তু তারও তৃতীয় দিবসে চৈতন্য হইন্স এবং খাইতে চাহিল।
এলিসা ভাবিল—‘বেশ, পথের মাঝে আমার এত সময় নষ্ট হবে তা আমি কখনও ভাবি নি। আমি এখন যাব।’
—৬—
তিনদিন শেষ হইয়া গেল, তবুও এলিসা সেখানে রহিল। ওখানে গ্রীষ্মকালে একটা উৎসব হয়। লোকে উপবাস করে এবং উপবাসভঙ্গের দিন সকলেই উৎসব করিয়া থাকে। এলিসার সেখানে থাকিবার চতুর্থ দিনই সেই উপবাস ভঙ্গের দিন। সে ভাবিল, ‘এদের সঙ্গে আজকের দিনটা থেকে এই উৎসবটা কর্ব—উপোস ভাঙ্ব। কিছু জিনিষ-পত্তর কিন্ব এবং এদের সঙ্গেমিলে মিশে আজকের উপোসের পরে খাওয়া-দাওয়ার আনন্দে যোগ দেবো; কাল সন্ধ্যার সময় আবার যাত্রা কর্ব।’
এলিসা সেই মতলবেই গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করিয়া উৎসবের উপযোগী ময়দা, দুধ প্রভৃতি কিনিয়া আনিল। বৃদ্ধা রান্না করিতে লাগিল, এলিসাও তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করিল। পরের দিন ব্রত পারণের জন্য রুটি সেঁকিয়া রাখা হইল। সেদিন এলিসা স্থানীয় গির্জ্জায় গিয়া প্রাণ খুলিয়া উপাসনা করিল। সেই দিনই সেই রুগ্ণা স্ত্রী উঠিয়া বসিল, তার ব্যারাম একটু ভাল হইল। এমন কি সে অল্প অল্প চলিতে পারিল। তার স্বামী দাড়ি কামাইয়া একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হইল এবং বৃদ্ধ স্ত্রীলোকটি তার জামা কাচিয়া পরিষ্কার করিয়া দিলে সেই জামা পরিল। সেই গ্রামের একজন ধনী কৃষকের কাছে তার চাষের জমি ও ঘাসের মাঠ বন্ধক ছিল। আগামী শস্যের সময় পর্য্যন্ত যাতে সে ঐ জমি চষিতে ও ময়দানের ঘাস নিতে পারে, তার জন্য সে গিয়া ধনী কৃষকের কৃপা ভিক্ষা চাহিল; কিন্তু হতাশচিত্তে সে সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসিল এবং কাঁদিতে লাগিল। ধনী দরিদ্রের বেদনা বুঝে না, সে কোন দয়াই প্রকাশ করিল না, শুধু বলিল—“টাকা নিয়ে এসো।”
এলিসা আবার ভয়ানক চিন্তায় পড়িল। সে ভাবিতে লাগিল, ‘এখন ওরা কি রকম ক’রে বাঁচবে? অনেকে ঘাস কাট্বে, বিক্রী কর্বে, তাদের ঘাসের জমি আছে, কিন্তু এদের ত কিছুই নেই। এরা ঘাসই বা পাবে কোথা? ঘাসের জমি সবই বন্ধক রয়েছে। গম পেকে উঠবে, সকলেই তা কেটে এনে তাতে বাঁচ্তে পারবে, কিন্তু এদের ত কিছুই নেই। এদের নয় বিঘা জমিই ত সেই ধনী চাষাটার কাছে বাঁধা প’ড়েছে। আমিও যেই এখান থেকে চলে যাব, এদের আবার পূর্ব্বেকার মত—যে অবস্থায় আমি এসে দেখ্তে পেয়ে ছিলুম—সেই অবস্থাই হবে।’
এলিসার মনে যাওয়া আর না-যাওয়া লইয়াই একটা ঘোর সমস্যা—একটা দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইল। অনেক আলোচনা ও সমালোচনার পর স্থির করিল যে, সেদিন রাত্রে তাদের ছাড়িয়া যাইবে না; তার পরের দিন পর্য্যন্ত অপেক্ষা করিবে। বাহিরের প্রাঙ্গণে সে ঘুমাইতে গেল। শয়নের পূর্ব্বে বার বার ভগবানের নাম স্মরণ করিল; কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসিল না। সমস্ত রাত্রি শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল, কি করিবে; কিছুই স্থির করিতে পারিল না। সে যাইবার জন্য খুব ব্যাকুল হইয়াছিল, তার যথেষ্ট সময় ও অর্থ ব্যয়িত হইয়াছে; কিন্তু সেই লোকগুলির জন্য তার অত্যন্ত দুঃখও হইতে লাগিল।
সে নিজেকে নিজে বলিতে লাগিল—“এর আর শেষ নেই। প্রথম ওদের জন্যে একটু জল আন্লুম আর এক এক টুক্রা রুটি দিলুম; কিন্তু এই সামান্য একটু থেকে আমি কতদূর চ’লে এসেছি। ঐ একটু কাজ ক’রে যাব মনে কর্লুম, কিন্তু কোত্থেকে কোথায় এসে কি রকম ভাবে জড়িয়ে পড়্লুম। এখন আবার শস্যের জমি, ঘাসের মাঠ প্রভৃতি উদ্ধার করবার সমস্যাই হচ্ছে প্রধান। যদি টাকা দিয়ে জমি ছাড়িয়ে দিই তা’ হ’লে আবার একটা গরুও কিনতে হয়; আর গম কেটে কেটে গাড়ী বোঝাই ক’রে নেবার জন্যে একটা ঘোড়ারও দরকার।”
এলিসা একটা ভাবনার কুণ্ডলীর মধ্যে আবদ্ধ হইল। যাত্রা করিয়া আসিয়াছে তীর্থ করিতে, কিন্তু সেই গন্তব্য স্থানে আর যাওয়া হইল না।
এলিসা উঠিল। তার কোটটা ভাঁজ করিয়া বালিসের মত করিয়া মাথায় দিয়াছিল, সেটা তুলিয়া পকেট হইতে নস্যের কৌটা বাহির করিল এবং মাথাটা সাফ্ হইবে মনে করিয়া এক টীপ্ নস্য গ্রহণ করিল।
কিন্তু মাথা সাফ্ হইল না। তার মনে তখন একটার পর একটা চিন্তা প্রবেশ করিতে লাগিল। সে ক্রমাগত ভাবিতে লাগিল—কিছুই স্থির করিতে পারিল না; একবার যাওয়া উচিত মনে করে, কিন্তু ঐ লোকদের প্রতি দয়া তাকে সে সঙ্কল্প হইতে বিরত করে; কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া অবশেষে জামাটা ভাঁজ করিয়া মাথায় দিয়া আবার শয়ন করিল। অনেকক্ষণ এইভাবে শুইয়া থাকিয়া ঊষাগমের পূর্ব্বে মোরগ ডাকিয়া উঠিলে তার একটু ঘুম আসিল। তখন হঠাৎ মনে হইল যেন কে তাকে জাগাইয়া দিল। সে যেন দেখিল যাওয়ার জন্য সে পোষাক পরিয়াছে, আর কাঁধে সেই বোঝা, হাতে সেই লাঠি, দরজা এমন ভাৱে খোলা আছে য়েন সে অতি কষ্টে তার ভিতর দিয়া গলিয়া যাইতে পারে। সে যাইতে উদ্যত; কিন্তু তার পিঠের বোঝাটা দরজায় আটকাইয়া গেল। সে ছাড়াইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু তার পায়ে জড়ান চওড়া পট্টি আবার কিসে আটকাইয়া গেল, সে যাইতে পারিল না। সে বোঝাটা সজোরে টানিল, দেখিল যে, দরজায় সেটা আটকায় নাই, ছোট মেয়েটি উহা ধরিয়া টানিয়াছে, আর চীৎকার করিয়া বলিতেছে—“খাবার দাও, বাবা, খাবার।”
এলিসা পায়ের দিকে চাহিয়া দেখিল ক্ষুদ্র বালকটি তার পায়ের পট্টি ধরিয়া রহিয়াছে, গৃহস্বামী ও বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি জানালা দিয়া তার পানে তাকাইয়া আছে।
এলিসা উঠিয়া বসিল, এবং স্পষ্ট করিয়া নিজেকেই বলিল―“কালকে আমি এদের ক্ষেত ছাড়িয়ে আন্ব এবং একটা ঘোড়া ও কিনে দেবো। খন্দের সময় অবধি চল্তে পারে এই পরিমাণ ময়দা আর ছেলেমেয়েগুলোর জন্যে একটা গরু কিন্তে হচ্ছে। যদি এগুলো না করি তা হ’লে সমুদ্রের ওপারে যাকে দেখ্তে যাচ্ছি তাকে হারিয়ে ফেল্ব। এখনও প্রভু আমার অন্তরে র’য়েছেন বটে, কিন্তু আমাতে তিনি আর থাক্বেন না।”
তারপর এলিসা গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইল। প্রত্যূষে শয্যা ত্যাগ করিয়া সে তাদের মহাজনের বাড়ীতে গিয়া শস্যক্ষেত্র ও ঘাসের জমি টাকা দিয়া ছাড়াইয়া লইল এবং ফিরিবার সময় একখানি কাস্তে কিনিয়া আনিল। তারপরে লোকটিকে ঘাস কাটিতে পাঠাইয়া নিজে গ্রামের ভিতর চলিয়া গেল। যাইতে যাইতে শুনিল যে, বিক্রয়ের জন্য একটি ঘোড়া ও একখানা গাড়ী আছে। বিক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া গাড়ী ঘোড়া দুই-ই কিনিয়া ফেলিল। তারপর এক বস্তা ময়দা কিনিয়া গাড়ীতে তুলিয়া একটা গরু কিনিবার মতলবে বাহির হইল। যাইতে যাইতে দুইজন স্ত্রীলোকের কথাবার্ত্তা তার কানে গেল। তারা সেই প্রাদেশিক ভাষায় বলিলেও সে তাদের কথা বেশ বুঝিতে পারিল।
তাদের একজন বলিল—“বোধ হয় তারা প্রথমে তাকে চিনতে পারে নি, একজন সাধারণ লোক ব’লেই মনে ক’রেছিল। একটু জল খাবার জন্যেই সে বাড়ীতে এসেছিল বটে, তারপর সে র’য়ে গেল। এখন তাদের জন্যে কত সব জিনিষ কিনেছে তা’ একবার ভেবে দেখ দেখি। তারা বল্লে যে, সে তাদের জন্যে গাড়ী ঘোড়াও আজকে সকালে কিনেছে। এ রকম লোক জগতে বেশী নেই। একে একবার গিয়ে দেখে আসা উচিত।”
এলিসা সব শুনিল, বুঝিতে পারিল যে, তাকে প্রশংসা করা হইতেছে। সে আর গরু কিনিতে না গিয়া ঘোড়াকে সাজ পরাইয়া গাড়ী হাঁকাইয়া, সোজা সেই কুটীরের দিকে চলিয়া আসিল। সে বাড়ী পৌঁছিলে বাড়ীর সকল লোক গাড়ী-ঘোড়া দেখিয়া বিস্মিত হইল। তারা মনে ভাবিল, ঘোড়াটা হয়ত তাদের জন্যই আনা হইয়াছে, কিন্তু কিছুই জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। তারপর সেই লোকটি আসিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া বলিল—“তুমি কোত্থেকে একটা ঘোড়া আনলে বল ত?”
এলিসা বলিল—“কেন? আমি কিনে আন্লুম। এটা খুব সস্তায় বিকিয়ে যাচ্ছিল। ঘোড়াটার রাত্তিরে খাবার জন্যে তুমি কিছু ঘাস কেটে এনে ডাবায় দাও, আর এই বস্তাটা নিয়ে যাও।”
লোকটি ঘোড়াটার পিঠে বস্তাটা দিয়া গোলাবাড়ীতে লইয়া গেল। কিছু ঘাস কাটিয়া ডাবায় রাখিল। এমনি ভাবে দিনের কাজ শেষ হইয়া গেলে সকলে ঘুমাইয়া পড়িল। এলিসাও আর কোন কথা না বলিয়া বাহিরে গেল এবং রাস্তার ধারে শুইয়া পড়িল।
সেদিন সে ব্যাগ লইয়া শুইতে গিয়াছিল। রাত্রি শেষ হইয়া গিয়াছে। সকলেই ঘুমে অচেতন। এমন সময় এলিসা জাগিয়া উঠিয়া তার জিনিষ-পত্রাদি ব্যাগে পুরিল এবং জামা-জুতা পরিয়া এফিমের উদ্দেশে বাহির হইল।
—৭—
ঊষার সোণালী আভা জগতে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। এলিসা তিন মাইলেরও অধিক পথ চলিয়া আসিয়াছে। একটা গাছের ছায়ায় বসিয়া ব্যাগ খুলিয়া টাকা গণিতে আরম্ভ করিল, দেখিল যে মাত্র কুড়ি টাকা অবশিষ্ট আছে।
সে ভাবিল, ‘এই ক’টাকা নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে যাবার চেষ্টা বৃথা। পথে যদি ভিক্ষে ক’রে যেতে হয় তা হ’লে সেটা একেবারে না যাওয়ার চাইতে খারাপ হবে। আর এফিম্ আমাকে ছাড়াও জেরুজালেমে পৌঁছিবে এবং সেখানকার মন্দিরে আমার নামে একটা আলোও জ্বেলে দেবে। এখন আমার সম্বন্ধে কথা হচ্ছে এই যে, জীবনে আমার ব্রত পূর্ণ করতে পারব না। দয়াল প্রভুর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, প্রতিজ্ঞা রক্ষা হ’ল না—এই আমার ভয়; কিন্তু তিনি এতই দয়ালু যে, সকল পাপীকেই তিনি ক্ষমা করেন।”
এলিসা উঠিল, ব্যাগ বন্ধ করিয়া কাঁধে তুলিল এবং বাড়ীর দিকে ফিরিয়া চলিল। সেই গ্রামের ভিতর দিয়াই ফিরিবার পথ, কিন্তু পাছে কেহ তাকে চিনিতে পারে এই ভয়ে সে-পথে না গিয়া—অনেক দূর ঘুরিয়া আবার পুরাতন রাস্তা ধরিয়া দ্রুত চলিতে লাগিল। বাড়ী হইতে আসিবার সময় সারাটা পথ তার কাছে অত্যন্ত কঠিন বলিয়া মনে হইয়াছিল; কিন্তু ফিরিবার সময়ে ভগবানের কৃপায় সে সেই বন্ধুর পথে এমনই ভাবে চলিতে লাগিল যে, একটু ক্লান্তিও বোধ করিল না। এত সুদীর্ঘ পথ পায়ে চলিয়া যাওয়া তার কাছে ছেলে-খেলার মত খুব সহজ বলিয়াই বোধ হইল; লাঠি ঘুরাইতে ঘুরাইতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল পথ সে রোজ চলিতে লাগিল।
ক্রমে এলিসা বাড়ী পৌঁছিল। মাঠ থেকে তখন শস্য কাটিয়া আনা হইয়াছে। বাড়ীর সকল লোকই তাকে দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইল এবং কি কি ঘটিয়াছে জানিতে সকলেই ব্যস্ত হইল। কেন এবং কি করিয়া সে পেছনে পড়িয়া রহিল, জেরুজালেমে না পৌঁছিয়াই সে ফিরিয়া আসিল কেন—এ সম্বন্ধে সে কাকেও কিছু বলিল না।
সে শুধু বলিল—“ভগবানের ইচ্ছে ছিল না যে, আমি সেখানে পৌঁছুই। পথে আমার সমস্ত টাকা হারিয়ে যাওয়ায় আমি আমার বন্ধুর পেছনে পড়্লুম। আমায় তোমরা ক্ষমা কর, ভগবানের দোহাই আমাকে ক্ষমা কর, এর বেশী কিছু জান্তে চেও না।”
এলিসার কাছে বাকী যে টাকা ছিল, তা সে তার স্ত্রীকে দিল। তারপর সংসারের সব সংবাদ একে একে জিজ্ঞাসা করিল। সকল কাজই সুশৃঙ্খলার সহিত সম্পন্ন করা হইয়াছে, কোন কাজেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয় নাই; সংসারের সকলেই মিলিয়া মিশিয়া শান্তিতে দিন যাপন করিতেছিল।
এফিমের বাড়ীর লোকেরাও তার ফিরিয়া আসিবার কথা সেই দিনই শুনিতে পাইল এবং এফিমের সংবাদ জানিবার জন্য ছুটিয়া আসিল। এলিসা তাহাদিগকে একই জবাব দিল,—এফিম্ খুব জোরে চল্তে পারে। ক্রমশ একটু একটু ক’রে আমি পেছিয়ে পড়্লুম। তাকে আবার ধর্ব মনে কর্লুম; কিন্তু নানান বিঘ্ন ঘট্তে লাগল। আমার টাকা হারিয়ে গেল, আর বেশী দূরে যাওয়ার সম্বল আমার রইল না; কাজেই ফির্তে হ’ল।”
ইহা শুনিয়া সকলেই আশ্চর্য্যান্বিত হইল যে, এলিসার মত বুদ্ধিমান্ লোক এমনি বোকার মত কাজ করিল। বাড়ী হইতে বাহির হইল অথচ সেখানে গেল না, পথে সব টাকা হারাইয়া ফেলিল—এ কি রকম! তবে সে আদৌ যাত্রাই বা করিয়াছিল কেন? যাই হউক, লোকের বিস্ময় আর কয়দিন থাকে? প্রথম প্রথম দুই-একদিন ইহা লইয়া কথা হইল বটে, কিন্তু সকলেই শেষে ইহা ভুলিয়া গেল। এলিসাও ইহা ভুলিয়া গিয়া বাড়ীর কাজে মনোযোগ দিল।
ছেলেকে লইয়া সে শীতকালের জন্য জ্বালানি কাঠ কাটিয়া রাখিল। বাড়ী হইতে যাওয়ার সময় যে সকল মৌচাক তার প্রতিবেশীর নিকট বন্ধক রাখিয়া গিয়াছিল, তাতে বসন্তকালে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি আসিয়াছে এবং অনেক মধু জমা হইয়াছে। কোন্ কোন্টা বাঁধা দিয়াছিল, তার স্ত্রী প্রথমে তাকে বলিল না, কিন্তু এলিসার সবই মনে ছিল; সে দশটার পরিবর্ত্তে সতেরোটা মৌচাক তার প্রতিবেশীকে দিল। শীতকালে প্রয়োজনীয় সমস্ত দ্রব্য জোগাড় করিয়া সে তার ছেলেকে একটা কাজের খোঁজে পাঠাইল; নিজে বাড়ীতে থাকিয়া গাছের ছালের জুতার উপরে নানা পাত দিয়া মুড়িয়া বিক্রী করিয়া বেশ দু’পয়সা আয় করিতে লাগিল। বাড়ীর ও মাঠের সব কাজও করিতে লাগিল। দিনরাত সে কেবল কাজেই ব্যস্ত থাকিত।
—৮—
যেদিন এলিসা সেই কুটীরের দরিদ্র এবং পীড়িত লোকদের কাছে আসিয়া আর যাইতে পারিল না—সেখানেই রহিয়া গেল, সেই সমস্ত দিনটা মাঠের মাঝে এফিম্ তার প্রতীক্ষায় বসিয়া রহিল। সে কিছুদূরে গিয়াই বসিয়াছিল। প্রতীক্ষায় রহিয়া রহিয়া ক্লান্তি বোধ করিল, একটু ঘুমাইল, আবার উঠিয়া বসিয়া পথের দিকে চাহিয়া রহিল; কিন্তু এলিসা আর ফিরিয়া আসিল না। চাহিয়া চাহিয়া তার এত কষ্ট হইতেছিল যে, সে আর চাহিতে পারিতেছে না, তবুও বন্ধুর ফিরিয়া আসিবার আশায় ব্যাকুল প্রতীক্ষায় রহিল। এদিকে পশ্চিম আকাশে দিনমণি হেলিয়া পড়িলেন, কিন্তু এলিসাকে আর দেখা গেল না।
এফিম্ ভাবিল, ‘সম্ভবত সে আমাকে ফেলে এগিয়ে গেছে, কিংবা আমি যখন ঘুমিয়ে প’ড়েছিলুম সে হয়ত গাড়ী পেয়ে আমাকেই ধর্বার জন্যে তাতেই চ’লে গেছে, কিন্তু আমাকে দেখ্তে পায়নি। না দেখেই বা যাবে কী ক’রে? রাস্তার পাশেই ত ছিলুম, এ ত বেশ দেখ্তে পাওয়া যেত। এখন কি করি? ফিরে যাব কি? সে যদি এগিয়ে গিয়ে থাকে, আর আমি যদি ফিরে যাই তা হ’লে তার সঙ্গে দেখা হবে না। সে ত আরও খারাপ হবে। তার চাইতে বরং এগিয়ে চ’লে যাই। আজকে রাত্তিরে থাক্বার জায়গায় আমাদের নিশ্চয়ই দেখা হবে।’
এফিম্ চলিতে লাগিল; একটা গ্রামে থাকিবার জায়গায় আসিয়া—একটা পাহারাওয়ালাকে এলিসার সম্বন্ধে খানিকটা বর্ণনা করিয়া বলিয়া রাখিল যে, সে যদি আসে তবে তাকে যেন সেখানে লইয়া যাওয়া হয়। কিন্তু সে রাত্রে এলিসা আর আসিল না। এফিম্ আবার চলিতে লাগিল। মাথায়-টাক একজন বৃদ্ধকে যাইতে দেখিয়াছে কিনা,—এ কথা সে রাস্তায় সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে গেল। কিন্তু কেহই তাকে দেখে নাই শুনিয়া এফিম্ আশ্চর্য্যান্বিত হইল। সে মনে মনে ভাবিতে ভাবিতে চলিল—‘ওডেসায় কিংবা জাহাজে আমাদের নিশ্চয়ই দেখা হবে।’ এলিসার বিষয় লইয়া সে আর বেশী মাথা ঘামাইল না।
পথে আর একজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হইল। তার পোষাক পুরোহিতের মত। এই যাত্রী আর একবার জেরুজালেমে গিয়াছিল। তারা দুইজনেই একরাত্রি এক জায়গায় রহিল; তারপর আবার একত্র চলিতে লাগিল।
তারা নির্ব্বিঘ্নে ওডেসায় পৌঁছিল। সেখানে জাহাজের জন্য তিনদিন তাহাদিগকে অপেক্ষা করিতে হইল। অন্যান্য যাত্রীদিগেরও সেই একই অবস্থা। এফিম্ এলিসার সম্বন্ধে আরও অনেককেই জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু কেহই তাকে দেখে নাই।
পাঁচ টাকা দিয়া এফিম্ জাহাজে যাইবার পাস-পোর্ট পাইল, চল্লিশ টাকা দিয়া জেরুজালেমের একখানা রিটার্ন টিকিট কিনিল এবং জাহাজে খাইবার জন্য কিছু রুটি এবং মাছ কিনিয়া লইল।
এফিমের সহযাত্রীটি বলিতে লাগিল, ইচ্ছা করিলে সে কি করিয়া টিকিট না কিনিয়াও জাহাজে উঠিতে পারিত; কিন্তু এফিম্ তার কোন কথাতেই কর্ণপাত করিল না। শেষে সেই যাত্রীটি বলিল―“না, টিকিট কেন্বার জন্যেই আমি প্রস্তুত হ’য়ে এসেছিলুম, টিকিটের দাম দেবো বই কি।”
জাহাজে মাল বোঝাই হইল, যাত্রীরা সকলে জাহাজে উঠিল। এফিম্ও তার সঙ্গীকে লইয়া জাহাজে উঠিল। নোঙ্গর তোলা হইলে জাহাজ ছাড়িয়া দেওয়া হইল।
সমস্ত দিন জাহাজখানি নিরাপদে চলিতে লাগিল, কিন্তু সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময়ে ঝড় উঠিয়া বৃষ্টি আরম্ভ হইল এবং জাহাজ দুলিতে লাগিল; ক্রমে ভিতরে জল প্রবেশ করিতে লাগিল। আরোহীদের ভয় হইল, স্ত্রীলোকেরা চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল। যারা একটু দুর্ব্বল ছিল, তারা জাহাজের ভিতরে নিজেদের বাঁচাইবার জন্য এদিকে সেদিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিল। এফিমেরও খুব ভয় হইল, কিন্তু সে কোনও কথা বলিল না বা তার ভয় প্রকাশ করিল না। ডেকের ওপর আসিয়া সে প্রথমে যে স্থানে বসিয়াছিল, সেইখানেই স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। সেখানে আরও কতকগুলি বৃদ্ধ লোক ছিল, তারা নিজেদের মালপত্র ধরিয়া সেই রাত্রি ও পরের দিন সমস্ত সময় চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তৃতীয় দিন বাতাসের বেগ কমিয়া গেল, সমুদ্র শান্ত হইল। জাহাজ কনষ্টান্টিনোপলে আসিয়া পৌঁছিল।
বহু যাত্রী তীরে উঠিয়া সেণ্টসোফিয়ার গির্জ্জা দেখিতে গেল। এফিম্ জাহাজেই রহিল এবং কিছু সাদা রুটি কিনিল। ২৪ ঘণ্টা তারা সেখানেই রহিল। তারপরে আবার জাহাজ ছাড়িয়া দেওয়া হইল। কয়েক দিন পরে তারা স্মার্ণায় আসিল, পরে আলেক্জান্দ্রিয়ায় এবং শেষে তারা নিরাপদে জাফায় আসিয়া উপস্থিত হইল; এখানে সকল যাত্রীকে নামিতে হইল। এখান হইতে জেরুজালেম প্রায় চল্লিশ মাইলেরও বেশী দূরে। এই দীর্ঘ পথ যাত্রীদিগকে চলিয়া যাইতে হইত। নামিবার সময় তাহাদিগের আবার বিশেষ ভয়ের কারণ হইল। জাহাজের ডেক থেকে নৌকায় চড়িয়া তাহাদের তীরে উঠিতে হইল। সমুদ্রের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঢেউয়ের আঘাতে নৌকাগুলি এত দুলিতে লাগিল যে, সহজেই তারা জলে পড়িয়া যাইতে পারিত। নৌকায় নামাইয়া দেওয়ার সময় দুইজন জলে পড়িয়া গেল। যা হোক শেষে তারা নিরাপদে তীরে উঠিল।
যাত্রীরা সকলে চলিতে আরম্ভ করিল এবং তৃতীয় দিনে বেলা দুইপ্রহরে জেরুজালেমে পৌঁছিল। তারা সহরের বাহিরে একটা রুশদেশীয় হোটেলে রহিল। সেখানে তাদের পাসপোর্ট সব লওয়া হইল। শেষে মধ্যাহ্ন-ভোজনের পর এফিম্ তার পূর্ব্বের সেই সহযাত্রীর সহিত জেরুজালেমের স্থানসকল দেখিতে লাগিল। তখনও যাত্রীদের মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করিবার অনুমতি দেওয়া হয় নাই। তারা সকলেই প্রধান ধর্ম্মযাজকের বাসস্থানে গেল। সকলে মিলিত হইলে স্ত্রীলোক ও পুরুষগণ পৃথক্ পৃথক্ হইয়া খালি পায়ে গোল হইয়া বসিল। তাদের পা মুছাইয়া দিবার জন্য তোয়ালে হাতে করিয়া একজন সন্ন্যাসী আসিল। সেখানকার সকলেরই পা সে ধুইয়া মুছাইয়া দিয়া চুম্বন করিল। এফিমেরও পা ধুইয়া মুছাইয়া সে চুম্বন করিল।
তখন সন্ধ্যার ছায়া মাটিতে নামিয়া আসিয়াছে। উপাসনার সময় হইয়াছে। এফিম্ দাঁড়াইয়া প্রার্থনা করিল। মন্দিরে মন্দিরে বাতি বসাইল। গির্জ্জায় উপাসনায় যাহাতে তার মাতাপিতার নাম উল্লেখ করা হয়, সেই জন্য সে তার নাম লেখা ছোট বই বিতরণ করিল। ধর্ম্মাধ্যক্ষের আশ্রমে তাদের সকলকে খাদ্য ও পানীয় দেওয়া হইল। সেদিন সেই পর্য্যন্ত।
পরদিন এফিমের সহযাত্রী তাকে সকল স্থানই বেশ করিয়া দেখাইল, এবং কোন্ জায়গায় কত দর্শনী দিতে হইবে তাও তাকে বলিয়া দিল। দুই প্রহরে হোটেলে ফিরিয়া আসিয়া তারা বিশ্রাম করিবার উদ্যোগ করিতেছিল, এমন সময় সেই যাত্রীটি কাপড়-চোপড় খুঁজিয়া চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল— “আমার টাকা চুরি হ’য়েছে, আমার মোট তিরিশ টাকা ছিল, দু’খানা দশটাকার নোট ছিল আর সব টাকার ভাঙ্গানি ছিল।” সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া, খুব দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল; কিন্তু দুঃখ করায় কিছুই হইবে না জানিয়া এবং আর কোনও উপায় ছিল না বলিয়া সে শুইয়া পড়িল।
—৯—
এফিম্ শয়ন করিল; কিন্তু শুইয়াই ঘুমাইয়া পড়িল না। সেই যাত্রীটির টাকা চুরি সম্বন্ধে নানা চিন্তা তার মনে উঠিতে লাগিল। সে ভাবিল, ‘এর টাকা কেউ চুরি করে নি; আমার মনে হয় না যে এর টাকা ছিল। সে কোনওখানে কাকেও টাকা দেয় নি। যে সকল জায়গায় টাকা দেওয়া দরকার সে কেবল আমাকেই দিতে হয়েছে, উপরন্তু একটা টাকা সে আমার কাছ থেকে ধার ক’রেছে।’
এইরূপ চিন্তা করিতে করিতেই এফিম্ নিজেকে মনে মনে তিরস্কার করিতে লাগিল—“একটা মানুষকে বিচার কর্বার আমার কি অধিকার আছে? এরূপ চিন্তা করা পাপ। যাক্ আমি আর এ সম্বন্ধে ভাব্ব না।”
কিন্তু অন্যায় বিষয়ে চিন্তা করিতে করিতে তার আবার সেই যাত্রীর কথা মনে পড়িল। সে ভাবিল, ‘টাকার প্রতি তার কেমন নজর! তার টাকা চুরি হবে এ যে অসম্ভব ব’লে মনে হচ্ছে।―তার কিছুই ছিল না; এ সবই ওর তৈরী-করা কথা।’
সন্ধ্যা হয়-হয় সময়ে তারা উঠিল এবং যে গির্জ্জায় যীশুখৃষ্টের কবর আছে সেই গির্জ্জায় রাত্রির উপাসনার জন্য গেল। সেই যাত্রীটি এফিমের পাশে পাশেই থাকিয়া তার সঙ্গে সকল জায়গায় গেল। তারা গির্জ্জায় আসিল, সেখানে বহু যাত্রী জড় হইয়াছিল—নানা জাতির ও নানা দেশের যাত্রী। তাদের মধ্যে কতক রুশদেশ হইতে আসিয়াছে, আর কতক আরমেনীয়ান, গ্রীক্, সীরিয়ান, তুর্কী প্রভৃতি। যাত্রীদের ভীড়ের ভিতরে ঢুকিয়া এফিম্ও গির্জ্জার ফটকে প্রবেশ করিল। যেখানে ক্রশ হইতে যীশুখৃষ্টকে নামাইয়া তেল মাখানো হইয়াছিল, সেখানে একজন সন্ন্যাসী পাদ্রী তাহাদিগকে লইয়া গেল। সেখানে নয়টা পীলসুজের উপরে আলো জ্বলিতেছিল। সন্ন্যাসী সে সকল দেখাইল এবং সকল ঘটনাই বুঝাইয়া দিল। এফিম্ সেখানে একটি আলো দিল। তারপরে যেখানে ক্রশ দাঁড় করানো ছিল, এফিম্কে সেখানে লইয়া গেল; এফিম্ সেই ক্রশের সম্মুখে দাঁড়াইয়া প্রার্থনা করিল। তারপরে যেখানে যীশুখৃষ্টের হাত-পা ক্রুশে বিদ্ধ করা হয়, এডামের কবর, যেখানে খৃষ্টের রক্ত ফোঁটা ফোঁটা করিয়া এডামের হাড়ের উপর পড়িয়াছিল, যে পাথরের উপরে কাঁটার মুকুট পরিয়া খৃষ্ট বসিয়াছিলেন, তারপর যে যে থামের সঙ্গে বাঁধিয়া যীশুকে চাবুক মারা হইয়াছিল, সে সকলই একে একে সেই সন্ন্যাসী এফিম্কে দেখাইল। তিনি এফিম্কে আরও অনেক দৃশ্য দেখাইতে যাইতেছিলেন, এমন সময় সেই ভীড়ের মধ্যে একটা ভয়ানক গোলমাল আরম্ভ হইল। এ পর্য্যন্ত যীশুর সমাধি স্থানে যাত্রীরা যাইতে পারে নাই; এখন তাহাদিগকে সেখানে যাইতে দেওয়া হইল। ল্যাটিন ভাষায় প্রার্থনা শেষ হইলে রুশিয়ার ভাষায় প্রার্থনা আরম্ভ হইল। সেই ভীড়ের সঙ্গে এফিম্ও সমাধিস্থানে চলিল।
সেই যাত্রীটির সঙ্গ ত্যাগ করিতে এফিম্ চেষ্টা করিল। তার উপর এফিমের একটা ভয়ানক সন্দেহ মনে জাগিতেছিল, কিন্তু সে কিছুতেই সঙ্গ ছাড়িল না। তারা দুজনেই সেই প্রার্থনার জায়গায় গেল। তারা সম্মুখে যাইতে চেষ্টা করিল; কিন্তু একটু বিলম্ব হওয়ায় যাইতে পারিল না।
সেখানে এমন ভীড় যে, সামনে কিংরা পিছনের দিকে একটু নড়াচড়া অসম্ভব। এফিম্ সম্মুখের দিকে চাহিয়া প্রার্থনা করিতে লাগিল, আর মাঝে মাঝে তার টাকা আছে কিনা হাত দিয়া দেখিতে লাগিল। তার তখন দুইদিকে মন—একবার প্রার্থনার দিকে, আর একবার টাকার দিকে।
—১০—
গির্জ্জার ভিতরে মহাত্মা যীশুখৃষ্টের সমাধির কাছে দাঁড়াইয়া যাজকদল প্রার্থনা করিতেছিলেন; এফিম্ একদৃষ্টে সেইদিকে তাকাইয়া রহিল। সেখানে ছত্রিশটি আলো জ্বলিতেছিল। বহু লোক দাঁড়াইয়াছিল; সকলের মন ভক্তিতে নুইয়া পড়িয়াছে, মুখ উজ্জ্বল। এফিম্ হঠাৎ চমকিত ও বিস্মিত হইল; প্রজ্বলিত পবিত্র আলোক-মালার ঠিক নীচে, সকলের সামনে সাদা জামা পরিয়া একজন বৃদ্ধকে এফিম্ দেখিতে পাইল, তার টাক পড়া চক্চকে মাথাটা ঠিক এলিসার মত।
এফিম্ ভাবিল, ‘এ ঠিক এলিসার মত, কিন্তু এলিসা হতেই পারে না। সে আমার আগে যেতে পারে নি। আমরা যে জাহাজে এসেছি তার এক সপ্তাহ পূর্ব্বে আর একখানা জাহাজ এসেছে। আগে এলেও সে সেই জাহাজ ধরতে পারে নি; আর আমাদের জাহাজে ত আসেই নি; আমি ত জাহাজের সকল যাত্রীকেই দেখেছি।’
এফিম্ এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে দেখিল সেই বৃদ্ধ প্রার্থনা আরম্ভ করিল। সে তিনবার নুইল, প্রথম ভগবানকে প্রণাম করিল; তারপর দক্ষিণে ও বামে যাত্রীদিগের প্রতি ফিরিয়া এক একবার প্রণাম করিল। সে যখন ডানদিকে ফিরিল এফিম্ তাকে চিনিতে পারিল। সেই কাল কাল দাড়ি গালের উপর কিছু কিছু পড়িয়াছে, ঠিক সেই ভ্রূ, সেই চক্ষু, সেই নাসিকা, মুখের হাবভাব ঠিক সেই। হ্যাঁ, এলিসাই বটে!
তার বন্ধুকে আবার দেখিতে পাইয়া এফিম্ অত্যন্ত আনন্দিত হইল। সে বিস্মিত হইল,—এলিসা কি করিয়া তার পূর্ব্বে সেইখানে আসিল।
সে ভাবিল, ‘এলিসা বেশ করেছে; সে কি রকম এগিয়ে এসেছে। হয়ত তার সঙ্গে অন্য কোন লোকের সাক্ষাৎ হ’য়ে থাকবে, সে ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। যাহোক বেরিয়ে এলে এলিসাকে ধরব এখন। ওকে পেলেই আমি এই যাত্রীটির সঙ্গ ছাড়তে পারি; এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এলিসার সঙ্গেই থাকব, কি ক’রে অত সাম্নে ওখানে যাওয়া যায়, সম্ভবতঃ সে আমাকে দেখিয়েও দিতে পারবে।’
এফিম্ চাহিয়া রহিল, যেন সে এলিসাকে সেই ভীড়ের ভিতরে না হারাইয়া ফেলে। উপাসনা শেষ হইল। সম্মিলিত লোকদের মধ্যে একটা ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি আরম্ভ হইল। সকলেই গিয়া প্রভুর সমাধি চুম্বন করিতে লাগিল। ধাক্কা লাগিয়া এফিম্ পড়িয়া গেল। তার আবার ভয় হইল পাছে কেহ টাকা চুরি করে। টাকার থলিটি হাত দিয়া চাপিয়া ধরিয়া ঠেলাঠেলি করিয়া কোন রকমে সে বাহির হইয়া আসিবার জন্য ব্যস্ত হইল। বাহিরে আসিয়া সে এদিকে সেদিকে, আবার গির্জ্জার ভিতরে অনেকক্ষণ ধরিয়া খোঁজ করিল। গির্জ্জার ঘরগুলিতে বহুলোক,—কেহ আহার করিতেছে, কেহ বা সুরা পান করিতেছে, কতকগুলি ঘুমে অচেতন হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, আবার কেহ বা পাঠে নিরত। এলিসাকে কোনওখানে সে খুঁজিয়া পাইল না; বন্ধুকে না দেখিতে পাইয়া ভাঙ্গা-মনে আবার হোটেলে ফিরিয়া গেল। সেই রাত্রে সেই যাত্রীটি ফিরিয়া আসিল না। এফিমের টাকাটি সে পরিশোধ করিয়া গেল না। সেই রাত্রি এফিম্ একলা রহিল।
পরের দিন সে আবার গির্জ্জায় গেল। তার সঙ্গে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। ইহার সঙ্গে তার জাহাজে আলাপ হইয়াছিল। সে সেদিনও সামনে যাইতে চেষ্টা করিল, কিন্তু ভীড়ের জন্য যাইতে পারিল না, পিছনে পড়িয়া রহিল। কাজেই একটা থামের পাশে দাঁড়াইয়া সে প্রার্থনা করিতে লাগিল। সকলের সাম্নে, আলোগুলির নীচে, প্রভুর সমাধিস্থানে অত্যন্ত নিকটে সে এলিসাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিল। বেদীর উপরে ধর্ম্মযাজকের মত তার দুই বাহু বিস্তৃত, তার চুলহীন মস্তক অত্যন্ত উজ্জ্বল।
এফিম্ ভাবিল, ‘আচ্ছা, এবারে আর এলিসাকে হারাব না, এবারে তাকে ঠিক ধর্ব।’
ভীড়ের ভিতরে ঠেলাঠেলি করিয়া সে সামনের দিকে অগ্রসর হইল, কিন্তু সেখানে পৌঁছিয়া আর এলিসাকে দেখিতে পাইল না। এলিসা চলিয়া গিয়াছে।
তৃতীয় দিনও আবার গির্জ্জার অভ্যন্তরে চাহিয়া দেখিল যে, সেই পবিত্রতম স্থানে সকলের সামনে বাহু বিস্তার করিয়া এলিসা দাঁড়াইয়া। সে ঊর্দ্ধনেত্রে যেন কিছু দেখিতেছিল। তার কেশহীন মস্তকে একটা দীপ্তি।
এফিম্ ভাবিল, ‘আচ্ছা, এবারে আর ফস্কে যেতে পাচ্ছে না। আমি দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক্ব এখন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখা হবেই হবে।’
এফিম্ বাহির হইয়া গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। দেখিতে দেখিতে বেলা বাড়িতে লাগিল। দু’ প্রহর হইয়া গেল। একে একে সকলেই বাহির হইয়া গেল; কিন্তু এলিসা আর আসিল না।
এফিম্ ছয় সপ্তাহ জেরুজালেমে রহিল এবং সকল পবিত্র স্থান দেখিল; বেথলহাম, বেথানীতে গেল, জর্দন নদী দর্শন করিল। নিজের সমাধির জন্য একটা নূতন জামা কিনিয়া, সে গির্জ্জায় গিয়া ছাপ মারিয়া আনিল; জর্দন নদী হইতে এক বোতল পবিত্র জল ও খানিকটা পবিত্র মাটি লইল। গির্জ্জায় যে বাতি পোড়ান হয় তারও কতকগুলি সে কিনিল। আট জায়গায় সে তার নাম লিখিয়া রাখিল।
কেবল বাড়ী যাওয়ার খরচ ভিন্ন তার সব টাকাই খরচ হইয়া গেল। সে বাড়ী যাত্রা করিল, জাফা পর্য্যন্ত চলিয়া গিয়া জাহাজে উঠিল, সেখান হইতে ওডেসায় গিয়া নামিল এবং সেখান হইতে বাড়ীর দিকে চলিতে লাগিল।
—১১—
যে পথে আসিয়াছিল সেই পথ ধরিয়াই এফিম্ চলিতে লাগিল। যতই সে বাড়ীর কাছাকাছি যাইতে লাগিল, ততই বাড়ীর কাজ-কর্ম্ম কি রকম চলিতেছে এই চিন্তা প্রধান হইল। সে ভাবিল একটা বাড়ী প্রস্তুত করিতে একটা লোকের জীবনব্যাপী সময়ের দরকার; কিন্তু সেটাকে নষ্ট করিতে বেশী সময় লাগে না! সেই কুঁড়েঘরখানি ভাল করিয়া তৈয়ারি হইয়াছে কিনা, গরু-বাছুর প্রভৃতি শীতকালে কি ভাবে ছিল, বাড়ীর লোকেরা বসন্তকালটা কি রকম কাটাইয়াছিল, তাকে ছাড়া তার ছেলে সংসারের সকল কাজের কি রকম বন্দোবস্ত করিয়াছিল—এই সব ভাবিতে ভাবিতে সে চলিতে লাগিল।
যেখানে এলিসার সঙ্গে সে পৃথক্ হইয়া পড়িয়াছিল তার অনেকটা নিকটে আসিল। সেখানকার লোকদের দেখিয়া এফিম্ বিশ্বাস করিতে পারিল না যে, তারা সেই গত বৎসরের লোক। তারা তখন দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে একেবারে ধ্বংস হইতে বসিয়াছিল। অনাহারে শতশত লোক মরিতেছিল। কিন্তু এবারে একেবারে বিপরীত। ভগবানের অনুগ্রহে তারা এবার সুখস্বচ্ছন্দে বাস করিতেছে। জমিতে প্রচুর ফসল হইয়াছে; তাদের দুর্দ্দশা ঘুচিয়া গিয়াছে, দুর্ভিক্ষের কথা তারা ভুলিয়া গিয়াছে। সকলেই তখন শান্তি উপভোগ করিতেছে, সুস্থ ও সবল হইয়া উঠিয়াছে।
একদিন সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় যেখান হইতে এলিসা তার পিছনে পড়িয়াছিল, ঠিক সেইখানে আসিয়া এফিম্ উপস্থিত হইল। সে যেমনি গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করিতে যাইতেছিল অমনি একটা ছোট মেয়ে একটা কুটীর হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল—“বাবা, বাবা, আমাদের বাড়ী এসো।”
এফিম্ মনে করিল যে, সে থামিবে না, বরাবর চলিয়া যাইবে; কিন্তু ছোট মেয়েটি তাকে ছাড়িল না, তার কোট ধরিয়া হাসিতে হাসিতে কুটীরের দিকে তাকে টানিতে লাগিল। কুটীরের ভিতরে একজন স্ত্রীলোক, তার কোলে একটি ছোট ছেলে। সেও বাহিরে আসিয়া বলিল—“ভেতরে এসো ঠাকুরদা, আজকে রাত্তিরে এখানে খাওয়া দাওয়া সেরে আমাদের সঙ্গেই থাক।”
এফিম্ ভিতরে প্রবেশ করিল।
সে মনে করিল, ‘এখানে এলিসার খোঁজ খবর নিতে পারব। আমার মনে হচ্ছে ঠিক এই বাড়ীতেই সে জল খেতে এসেছিল।’
সেই স্ত্রীলোকটি আসিয়া ব্যাগটা তার হাত হইতে লইয়া গেল, তার মুখ ধুইবার জন্য জল দিল, তারপর তাকে টেবিলের কাছে বসাইয়া দুধ, ছানার পিঠা এবং সুপ প্রভৃতি টেবিলে সাজাইয়া খাইতে বলিল। এফিম্ তাকে ধন্যবাদ দিল এবং তীর্থযাত্রীর প্রতি এত দয়া প্রকাশ করিবার জন্য তার যথেষ্ট প্রশংসা করিল। স্ত্রীলোকটি মাথা নীচু করিল।
স্ত্রীলোকটি বলিল—“তীর্থযাত্রীর প্রতি আদর যত্ন দেখাইবার আমাদের যথেষ্ট কারণ র’য়েছে। একজন তীর্থযাত্রী আমাদের দেখিয়েছেন জীবনটি কি। তিনিই ত আমাদের জীবন দান ক’রেছেন। আমরা ভগবান্কে ভুলে গিয়েছিলুম, এবং ভগবান্ আমাদের এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যে, আমরা প্রায় মর মর হ’য়ে প’ড়েছিলুম। গেল বছর গ্রীষ্মকালে আমরা এমন অবস্থায় পড়্লুম যে, আমাদের সকলেরই ব্যারাম হ’ল। আর তার পরে আমাদের খাবারও একেবারেই ছিল না। আমরা ম’রে যেতুম, কিন্তু আমাদের রক্ষা করবার জন্য ঈশ্বর একজন বুড়ো মানুষকে পাঠিয়েছিলেন, ঠিক আপনারই মত বুড়ো। তিনি একদিন একটু জল খাবার জন্যে এসেছিলেন; এসে আমাদের অবস্থা দেখ্লেন, আমাদের প্রতি তাঁর খুব দয়া হ’ল, তিনি আমাদের সঙ্গেই র’য়ে গেলেন। তিনিই আমাদের আহার ও পানীয় দিলেন, আর সেবাশুশ্রূষায় চল্বার শক্তি এনে দিলেন। আমাদের সমস্ত জমি টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনলেন, এবং একটা গাড়ী ও ঘোড়া কিনে আমাদের দিয়ে গেলেন।”
এমন সময় সেই বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটা কুটীরে প্রবেশ করিলা এবং যুবতী স্ত্রীলোকটির কথায় বাধা দিয়া নিজে বলিতে লাগিল—“জানিনে তিনি ভাল মানুষ কি ঈশ্বরের দূত। তিনি আমাদের সকলকেই ভালবাসতেন, সকলেরই উপরে তাঁর কৃপাদৃষ্টি ছিল। তাঁর নামটি পর্য্যন্ত আমাদের না ব’লে চলে গেলেন, জানিনে কার নাম ক’রে প্রার্থনা কর্ব। আমাদের সেই অবস্থা যেন এখনও আমার চোখের সামনে ভাস্ছে, সবই যেন পরিষ্কার দেখ্তে পাচ্ছি। এখানে আমি মৃত্যুর অপেক্ষায় পড়েছিলুম, এমন সময় টাকপড়া এক বুড়ো ঘরে ঢুক্লেন, তাঁকে দেখ্তে বিশেষ কিছু নয়, তিনি এসে একটু জল চাইলেন। আমি পাপী, তাই মনে কর্লুম—‘এখানে কি কর্তে এসেছে।’ কিন্তু ভেবে দেখুন দেখি, তিনি আমাদের জন্য কি কর্লেন। যেই তিনি আমাদের দেখ্লেন, তিনি তাঁর ব্যাগটা এইখানেই রেখে খুল্লেন।”
ছোট্ট মেয়েটি সেই সময় তাদের কথায় যোগ দিল। সে বলিল—“না ঠাকুরমা, ব্যাগটা সে প্রথমে ঘরের মাঝখানটার এখানে রেখেছিল; তারপর সে সেটাকে বেঞ্চির উপর তুল্লে।”
তারপর সে যা যা বলিয়াছিল ও তাদের জন্য করিয়াছিল, কোথায় সে বসিত, কোথায় সে শুইত, তাদের প্রত্যেককে সে কি কি কথা বলিয়াছিল—সেইগুলি মনে করিয়া তারা তা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিল।
রাত্রে সেই কৃষক ঘোড়ায় চড়িয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিল। সেও কি রকম ভাবে তাদের সঙ্গে থাকিত তা বলিতে লাগিল—“যদি তিনি না আস্তেন, তা’ হ’লে আমাদের পাপে আমরা মারা যেতুম। ঈশ্বর ও মানুষের ওপরে রাগ ক’রে হতাশ হ’য়ে আমরা মারা যাচ্ছিলুম। তিনি এসে আমাদের তুল্লেন, চল্বার শক্তি দিলেন। তাঁর দ্বারা আমরা ভগবান্কে চিন্তে পার্লুম, বিশ্বাস কর্তে শিখ্লুম যে, মানুষের ভিতরে দেবত্ব আছে। ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। আমরা পশুর মত বাস কর্ছিলুম, তিনি আমাদের পশুত্ব দূর ক’রে মানুষ ক’রে তুল্লেন।”
এফিমের খাবার দেওয়া হইল। আহারের পরে তারা শয়ন করিবার স্থান দেখাইয়া দিল।
এফিম্ শুইল বটে, কিন্তু ঘুম হইল না। সে এলিসার কথা ভুলিতে পারিল না। শুইয়া কেবল তার কথাই ভাবিতে লাগিল। সকলের সামনে জেরুজালেমে এলিসাকে সে যে তিনবার দেখিয়াছিল, সে তাই মনে করিতে লাগিল। এফিম্ ভাবিল, ‘সে-ই আগে গিয়েছিল। আমার তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য ভগবান্ পূর্ণ করুন, আর না-ই করুন, কিন্তু নিশ্চয় তিনি ওর উদ্দেশ্য পূর্ণ ক’রেছেন ওর প্রার্থনা তিনি শুনেছেন।’
পরদিন সকালবেলা এফিম্ তাদের কাছে বিদায় গ্রহণ করিল। তারাও তার পুঁটুলির ভিতরে পিঠা পূরিয়া দিয়া কাজে বাহির হইল। এফিম্ আবার চলিতে লাগিল।
—১২—
এফিম্ এক বৎসর পূর্ব্বে বাড়ী হইতে যাত্রা করিয়াছিল। তখন ছিল বসন্তকাল। আবার বসন্তকাল ফিরিয়া আসিল। একদিন সন্ধ্যার সময়ে সে বাড়ী পৌঁছিল। তার পুত্র তখন বাড়ীতে ছিল না, সে কোথায় গিয়াছিল। সে খুব বেশী মদ খাইয়া বাড়ীতে আসিল। এফিম্ তাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। প্রত্যেক কথার উত্তরে এবং আর আর ব্যাপার হইতে বুঝিতে পারা গেল যে, এফিমের অনুপস্থিতিকালে তার ছেলে বিগ্ড়াইয়া গিয়াছে; সমস্ত টাকা অপব্যয় করিয়াছে এবং সকল কাজেই উদাস ভাব দেখাইয়াছে। সে পুত্রকে তিরস্কার করিতে লাগিল, পুত্রও খুব কড়া কড়া জবাব দিল।
পুত্র বলিল—“কেন তুমি বাড়ীতে থেকে নিজে সব কাজ কর্লে না? তুমি নিজেই সব টাকা নিয়ে চলে গেলে আর এখন আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছ?”
এফিমের অত্যন্ত রাগ হইল এবং পুত্রকে প্রহার করিল। পরদিন সকালবেলা সে গ্রামের মোড়লের কাছে ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ করিবার জন্য গেল। যখন সে এলিসার বাড়ীর পাশ দিয়া যাইতেছিল, তার বন্ধু এলিসার পত্নী ঘরের বারান্দা হইতেই তাকে আদরের সহিত ডাকিল। সে বলিল—“আপনি কেমন আছেন? জেরুজালেমে নিরাপদে যেতে পেরেছিলেন ত?”
এফিম্ থামিল। সে বলিল—“হ্যাঁ, ভগবানের কৃপায় সেখানে যেতে পেরেছিলুম। তোমার স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছিলুম, শুন্তে পেলুম সে নির্ব্বিঘ্নে বাড়ী এসে পৌঁছেছে।”
বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি কথা কহিতে বড় ভালবাসিত। সে বলিল—“হ্যাঁ, সে ফিরে এসেছে। বহুদিন পূর্ব্বেই সে কিন্তু এসেছে। মেরীর স্বর্গারোহণের দিন (৫ই আগষ্ট—ক্যাথলিক খৃষ্টানদের মতে এই দিন কুমারী মেরী সশরীরে স্বর্গারোহণ করেন—ইহাকে Assumption day বলা হয়) একটু পরেই সে ফিরে এসেছিল। ঈশ্বর যে তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাতে আমরা সকলেই সুখী। তাকে ছাড়া জীবনটা যেন কেমন নীরস বোধ হচ্ছিল। তার কাছে বেশী কাজ আর আশা কর্তে পারিনে। আর কাজ কর্বার বয়সও তার চ’লে গেছে, তবুও সে-ই সংসারের কর্ত্তা। সে যখন বাড়ী থাকে তখন সকলেরই যেন আনন্দ। আমাদের ছেলের সেদিন কি রকম আনন্দ হ’য়েছিল! সে বলে, ‘বাবা যখন বাড়ী থাকে না, বাড়ী থেকে দূরে চলে যায়, তখন সব ফাঁকা ফাঁকা মনে হয়, যেন সূর্য্যের মুখ না দেখে অন্ধকারে র’য়েছি।’ তাকে ছাড়া বড্ড নীরস বোধ হচ্ছিল—বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। আমরা তাকে বড্ড ভালবাসি আর তার খুব যত্নও করি।”
“সে এখন বাড়ী আছে কি?”
—“হ্যাঁ, বাড়ীতেই আছে। সে এখন মৌমাছি নিয়ে আছে।” এবারে মৌচাকে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি এসে পড়েছে; আর এত মধু জ’মেছে যে, সে তার জীবনে আর কখনও দেখেছে ব’লে বোধ হয় না। সে আরও বলে, ‘আমাদের পাপের জন্যেই ভগবান আমাদের পুরস্কার দিচ্ছেন না!’ আসুন না, আপনাকে আবার দেখ্তে পেলে সে অত্যন্ত সুখী হবে।’
এফিম্ কাছে গেল। এলিসার গায়ে একটা সাদা জামা। জেরুজালেমের মন্দিরের ভিতরে যীশুখৃষ্টের সমাধির পার্শ্বদেশে তাকে এফিম্ যেভাবে দেখিতে পাইয়াছিল, আবার এখানেও তাকে ঠিক সেইরূপ দেখিতে পাইল। বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইয়া, চক্ষু দুটি ঊর্দ্ধে নিবদ্ধ, বাহু বিস্তৃত, উজ্জ্বল মস্তকে ঠিক তেমনি প্রজ্বলিত দীপশিখার ন্যায় বৃক্ষের পত্রান্তরাল হইতে প্রভাতসূর্য্যের কিরণ পতিত হইয়া চক্চক্ করিতেছিল, আর সোণালী রঙ্গের মৌমাছিগুলি জ্যোতিমণ্ডলের মত তার মাধাটি ঘিরিয়া উড়িতেছিল, ঠিক তেমনি প্রফুল্ল, প্রশান্ত মুখখানা!—এফিম্ থামিল।
তার বন্ধুপত্নী স্বামীকে ডাকিয়া বলিল―‘ওগো শুন্ছ?—এই যে তোমার বন্ধু এসেছে।”
এলিসা চারিদিকে হাসিমুখে চাহিল, তারপর দাড়ি হইতে মৌমাছি ছাড়াইতে ছাড়াইতে এফিমের দিকে আসিয়া বলিল―“নমস্কার বন্ধু, নমস্কার। তুমি সেখানে নির্ব্বিঘ্নে যেতে পেরেছিলে কি?”
—“হ্যাঁ, আমার শরীরটা সেখানে গিয়েছিল বটে। আমি তোমার জন্য জর্দন নদী থেকে খানিকটা পবিত্র জল নিয়ে এসেছি। এর জন্য তোমাকে আমার বাড়ীতে যেতে হবে। জানিনে আমার চেষ্টা ও উদ্যমে ভগবান্ সন্তুষ্ট হ’য়েছেন কিনা।”
এলিসা বলিল—“বেশ, ভগবান্কে ধন্যবাদ দাও। যীশু তোমার মঙ্গল করবেন।”
এফিম্ খানিকক্ষণ মৌন হইয়া রহিল। তারপর বলিল—“আমার পা দেহটাকে চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমার আত্মা সেখানে গেছে কি না জানিনে—আর একজনের সত্যিই সেখানে গেছে—”
এলিসা তার কথায় বাধা দিয়া কহিল—“সে ভগবানের কাজ ভাই—সে ভগবানের কাজ।”
এফিম্ বলিল—“ফিরে আস্বার সময়, তুমি আমার পিছনে প’ড়ে যে বাড়ীতে ছিলে সেখানে গিয়েছিলুম।”
এলিসার ভয় হইল এবং তাড়াতাড়ি বলিল—“ভগবানের কাজ ভাই, ভগবানের কাজ; এসো, তুমি ঘরের ভেতরে এসো। তোমাকে খানিকটা মধু দেবো’খন।” এলিসা সেই-কথাবার্ত্তা চাপা দিবার জন্য সাংসারিক কথা আরম্ভ করিল।
এফিম্ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল। সেই কুটীরের লোকদের কাছে কি শুনিয়াছে কিংবা কি ভাবে জেরুজালেমে তাঁকে দেখিয়াছে তা সে এলিসার কাছে আর প্রকাশ করিল না।
সে বুঝিল যে, তীর্থভ্রমণ করিলেই ভগবানের পূজা হয় না। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ করা ও তাঁকে সন্তুষ্ট করিবার শ্রেষ্ঠ পন্থা—আজীবন পরের জন্য স্বার্থের বলিদান।