টল্স্টয়ের গল্প/মানুষ বাঁচে কিসে?
মানুষ বাঁচে কিসে?
—১—
সাইমন নামে এক মুচী ছিল। তার বাড়ী-ঘর, জমা-জমি কিছুই ছিল না; স্ত্রী এবং ছেলে-মেয়ে লইয়া এক কৃষকের কুঁড়েঘরে সে বাস করিত। দিন-রাত্রি খাটিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করিত; কাজেই তার অবস্থা ‘দিন আনে দিন খায়’। খুব খাটিয়াও যথেষ্ট মজুরী পাইত না, কিন্তু জিনিষ-পত্র সবই দুর্ম্মূল্য। তার এবং তার স্ত্রীব শীতকালের গায়ে দিবার জন্য মাত্র একটা পাঁটার চামড়ার জামা ছিল, তাও একেবারে শতছিন্ন। বহুদিন ধরিয়াই তার ইচ্ছা ছিল, ভেড়ার চামড়া কিনিয়া খুব ভাল করিয়া একটি নূতন জামা তৈয়ার করিবে; কিন্তু আর হইয়া উঠে নাই। সে কিছু টাকাও জমাইয়াছিল। তার স্ত্রীর বাক্সের ভিতরে তিন টাকার নোট একটি লুকানো ছিল; আর প্রায় সাড়ে পাঁচ টাকা সে গ্রাহকদের কাছে পাইত।
একদিন ভেড়ার চামড়া কিনিবার জন্য সে প্রস্তুত হইল। সার্ট গায়ে দিল, তার উপরে তার স্ত্রীর জ্যাকেটটা পরিল এবং তার উপরে সেই পাঁটার চামড়ার ছেঁড়া জামাটা চাপাইয়া দিল। তিন টাকার নোটখানি পকেটে পূরিল। সকাল সকাল কিছু খাইয়া একটা লাঠি হাতে করিয়া গ্রামে বাহির হইল। ভাবিল, ‘গ্রাহকদের কাছে যে পাঁচ টাকা পা’ব সেটা প্রথমে আদায় কর্ব; তার সঙ্গে এই তিন টাকা হ’লেই ভেড়ার চামড়া বেশ কিন্তে পার্ব।
গ্রামের ভিতরে ঢুকিয়াই সে এক কৃষকের বাড়ী গেল, কিন্তু কৃষক তখন বাড়ী ছিল না। তার স্ত্রী বলিল যে, পরের সপ্তাহে সব দেনা শোধ করা হইবে। সাইমন আর কি করিবে? সে আর এক কৃষকের বাড়ী গেল। ইহার একজোড়া বুট জুতা সাইমন মেরামত করিয়া দিয়াছিল; কিন্তু কৃষক একেবারে দিব্যি গালিয়া বলিল যে, তার হাতে কিছুই নাই, তবে তিন-চারি আনা মাত্র সে দিতে পারে। নিরুপায় হইয়া সাইমন ধারে চামড়া কিনিতে গেল; কিন্তু দোকানদার ধারে বিক্রী করিতে নারাজ হইল; বলিল—“নগদ টাকা নিয়ে এসো; তার পরে যেখানা তোমার দেখে-শুনে পছন্দ হয় নিয়ে যাবে। বাকী-টাকা আদায় করা যে কি ঝক্মারী তা আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে।”
চামড়া আর সাইমনের কেনা হইল না। সেই চাষার কাছ থেকে তিন-চারি আনা আদায় করিল। আর একজন চাষা মেরামত করিবার জন্য একজোড়া বুট দিল। সাইমন তাই লইয়া বাড়ীর দিকে আস্তে আস্তে চলিল।
সাইমনের মনটা মুস্ড়াইয়া পড়িল। তিন-চারি আনার পয়সা পথে মদ খাইয়াই উড়াইয়া দিল। শুধু হাতেই সে বাড়ীর দিকে চলিল। সকালবেলা বাহিরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তার খুব ঠাণ্ডা লাগিয়াছিল, হাত-পা কন্কন্ করিতেছে; মদ খাইয়া ঠাণ্ডাটা একটু কমিয়া গেল, শরীরটা বেশ গরম বোধ হইল, মনেও একটু স্ফুর্ত্তি জমিল! মাটিতে লাঠিটা ঠক্ঠক্ করিয়া ঠুকিতে ঠুকিতে, আর বাঁ-হাতে বুট জোড়া দোলাইয়া বিড়্ বিড়্ করিতে করিতে সে চলিল।
“ভেড়ার চামড়ার জামা গায়ে দেবো সত্যি, কিন্তু আমার বেশ গরম বোধ হচ্ছে। ফোঁটা খানেক খেয়েছি বই ত নয়; কিন্তু তা’ই আমার সমস্ত শিরার ভেতরে গিয়ে শরীরটাকে বেশ গরম ক’রে তুলেছে। যাক্ ভেড়ার চামড়ার আর দরকার নেই। কিসের আবার ভাবনা-চিন্তে? কিসের তোয়াক্কা রাখি? ভাবনা ভাবা, তোয়াক্কা রাখা একদম আমার স্বভাব নয়। দূর হোক ছাই, ভেড়ার চামড়া না হ’লেও আমার বেশ চলবে এখন। কিন্তু কথা হচ্ছে এই যে, আমার স্ত্রী চ’টে উঠ্বে নিশ্চয়; আর সত্যিই এটা ভয়ানক লজ্জার কথা যে, সমস্ত দিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও কাজের সময় কিছুই পাওয়া যাবে না। আচ্ছা বাপু, রোস একটু। আমার টাকা যদি না দাও, তোমার চামড়া আমি খসাব, দেখে নেবে, তোমায় কেউ রাখ্তে পার্বে না। এ কি রকম ব্যাভার! তিন আনা, চার আনা ক’রে দেনা শুধ্বে! ও নিয়ে আমি কি কর্ব? ওতে কি করা যায়! যা করা যায় তা আর কিছুই নয়, ছিটে-ফোঁটা মদ খাওয়া, আর কি হবে? লোকটা বল্ছে তার বড় অনটন। হ’তেও পারে, কিন্তু আমার দশাটা কি? তোমার বাড়ী আছে; গরু-বাছুর আছে, সবই আছে; আমার আছে যা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে এই। তোমার ক্ষেতে খাবার পাচ্ছ, আর আমাকে এই আক্রার বাজারে সবই কিনে খেতে হচ্ছে। এতেই কি কেবল হয়? বাড়ীতে এসে দেখি সব রুটি সাবাড়; কাজে কাজেই আবার দেড় টাকা তখনই বের ক’রে দিয়ে রুটি কিনে তবে খেতে হয়। এই ত আমার দশা; তবে আর কেন বাপু, যা পাওনা দিয়ে দাও, আর বাজে ব’কো না।”
এই ভাবে চলিতে চলিতে রাস্তার মোড়ের উপর মন্দিরটার কাছাকাছি সে আসিয়া পড়িল। সে-দিকে চাইতেই দেখিতে পাইল মন্দিরের পেছনে কি একটা সাদা সাদা। দিনের আলো তখন ম্লান হইয়া আসিতেছিল, তাই সে খুব নজর করিয়া দেখিয়াও জিনিটা কি বুঝিতে পারিল না; ভাবিল, ‘এখানে ত কখনও সাদা পাথর ছিল না। এটা কি একটা ষাঁড়? ষাঁড়ের মত ত নয়, ঠিক মানুষের মতই এর মাথাটা, কিন্তু বড্ড সাদা সাদা; আর মানুষই বা এখানে কি কর্বে?’
ক্রমশঃ আরও নিকটে গিয়া সে পরিষ্কার দেখিতে পাইল একটা মানুষ—সেটা জীবিত কি মৃত বুঝিতে পারিল না, উলঙ্গ অবস্থায় মন্দিরে ঠেস্ দিয়া বসিয়া আছে। দেখিয়া তার ভয়ানক ভয় হইল, ভাবিল, ‘ওকে কেউ খুন ক’রে টাকা-পয়সা সব কেড়ে নিয়ে এখানে ফেলে চ’লে গেছে। যাক্, এতে হাত দিলেই বিপদে পড়্ব নিশ্চয়।’
লোকটাকে যাতে আর দেখা না যায় সেইজন্য সাইমন মন্দির পেছনে রাখিয়া চলিতে লাগিল; খানিক দূর গিয়া একবার পেছনের দিকে ফিরিয়া চাহিল, দেখিল যে সেই লোকটি আর দেওয়ালে ঠেস্ দিয়া বসিয়া নাই, সে যেন তারই দিকে তাকাইয়া নড়িতেছে।
সাইমনের পূর্ব্বের চেয়েও এবার ভয় আরও বেশী হইল, ভাবিল, ‘আবার ফিরে ওর কাছে যাব, না চল্তেই থাক্ব? ওর কাছে গেলে হয়ত একটা ভয়ানক কাণ্ড হবে। কে জানে ও কে এবং কি রকমের লোক? ও কখনও ভালর জন্যে এখানে আসে নি। যদি কাছে যাই, ও লাফিয়ে প’ড়ে আমার টুঁটিটা টিপে ধর্তে পারে, তা হ’লে ত আমার আর রক্ষাই থাক্বে না। যদি তা না করে, যদি তেমন একটা সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড নাও ঘটে, হয়ত আমার ওপরে সে একটা গলগ্রহ হবে। একটা ন্যাংটা মানুষ, তাকে নিয়ে কি কর্ব? আমার সম্বলের ভেতরে ত একটা শতছিন্ন জামা, এ আমি কিছুতেই দিতে পার্ব না! ঈশ্বর ভরসা, এবার পালাতে পার্লে বেঁচে যাই।’
সাইমন ত ওখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি চলিতে লাগিল। মন্দির রহিল তার পিছনে; কিন্তু যাইতে যাইতে তার মনটা কেমন করিয়া উঠিল, তার বিবেক তাকে দংশন করিল, সে অমনি থমকিয়া দাঁড়াইল।
সে নিজে নিজে বলিতে লাগিল—“কি কর্ছ তুমি, সাইমন? লোকটা হয়ত অভাবের তাড়নায়, খেতে না পেয়ে, পর্তে না পেয়ে, মারা যাচ্ছে; আর তুমি তাকে ভয় খেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছ? তুমি এমন কি বড় মানুষ হ’য়েছ যে, তোমার আবার চোর-ডাকাতের ভয়? ছিঃ ছিঃ সাইমন; তোমায় ধিক্।”
সাইমন ফিরিয়া লোকটার কাছে আসিল।
—২—
লোকটির কাছে গিয়া সাইমন বেশ নজর করিয়া চাহিয়া দেখিল যে, সে যুবক, কাজকর্ম্ম করিবার মত শক্তি তার আছে, গায়ে কোন-স্থানে ক্ষতের চিহ্ন নাই, শীতে ও ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া মন্দিরে ঠেস্ দিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। তাকে এতই দুর্ব্বল বলিয়া মনে হইতেছিল, যেন সে চোখ তুলিয়া চাহিতেও পারিতেছিল না। সাইমন তার একেবারে কাছে গিয়া দাঁড়াইল। লোকটির যেন তখন একটু হুঁস্ হইল। সে যেন সাইমনের দিকে মাথাটি ফিরাইয়া একবার চাহিয়া দেখিল। সেই একটি চাউনিতেই সাইমন তাকে ভালবাসিল। তৎক্ষণাৎ সে তার বুট জুতা জোড়া মাটিতে ছুঁড়িয়া ফেলিল, কোমরের বেল্ট খুলিল এবং সূতার জামাটা খুলিল।
সে বলিল—“দেখ, এটা বাজে কথার সময় নয়। নাও, এই জামাটা চট ক’রে গায়ে দাও।” ইহা বলিয়াই সাইমন লোকটার হাত ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া দাঁড় করাইল। সাইমন দেখিল তার দেহখানি বেশ সুন্দর, বলিষ্ঠ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, হাতপাগুলি বেশ গোলগাল মুখখানি খুব সুশ্রী—যেন দয়ামায়া-মাখানো। নিজের জামাটা সাইমন তার কাঁধের উপর চাপাইয়া দিল, কিন্তু লোকটি গায়ে দিতে গিয়া হাতা খুঁজিয়া পাইল না। সাইমন তার হাত দু’টী টানিয়া কোটের ভিতর পরাইয়া দিয়া বেশ ঠিক্ঠাক্ করিয়া দিল। তার পরে নিজের বেল্ট তার কোমরে জড়াইয়া দিল।
নিজের অতি পুরাতন জীর্ণ টুপীটাও সে তার মাথায় পরাইয়া দিবে মনে করিয়াছিল; কিন্তু তার নিজের মাথায়ই ভয়ানক ঠাণ্ডা লাগিতে লাগিল বলিয়া সে ভাবিল, ‘আমার মাথায় টাক, ওর মাথাটি ত বেশ সুন্দর কোঁকড়ান চুলে ভরা, সুতরাং টুপী না হলেও ওর চল্তে পারে!’ এই ভাবিয়া টুপীটি সে নিজের মাথায়ই চাপাইয়া দিল। তারপর ভাবিল, ‘ওর পায়ের জন্যে বরং একটা কিছু বন্দোবস্ত কর্লে ভাল হয়, আচ্ছা দেখা যাক্।’ তারপর লোকটিকে সেখানে বসাইয়া বুট জোড়া পায়ে পরাইয়া দিতে দিতে বলিল—“ব্যস্ ভাই, একটু হেঁটে শরীরটাকে গরম ক’রে নাও; তার পরে আর সব দেখা যাবে। তুমি চল্তে পার্বে কি?”
লোকটি উঠিয়া দাড়াইয়া অতি করুণভাবে সাইমনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল, কিন্তু একটা কথাও বলিতে পারিল না।
সাইমন জিজ্ঞাসা করিল—“কিহে, তুমি কথা কও না কেন? এত ঠাণ্ডা যে এখানে আর দাঁড়ানো যাচ্ছে না। এখুনি বাড়ী ফির্তে হবে। যদি এত কাবু হ’য়ে থাক যে চল্তে পার্ছ না, তা হ’লে আমার এই লাঠিটা নাও, এইটে ভর দিয়ে চল্বে এখন; চল!”
লোকটি বেশ স্বচ্ছন্দেই চলিতে আরম্ভ করিল; সে সাইমনের পেছনে একবারও পড়ে নাই।
পথে যাইতে যাইতে সাইমন তাকে জিজ্ঞাসা করিল—“আচ্ছা! বল দেখি তোমার বাড়ী কোথায়?”
—“এ অঞ্চলে নয়।”
—“আমারও তাই মনে হচ্ছিল। এ অঞ্চলের যত লোক—সবই আমার চেনা। কি করে এ মন্দিরের কাছে এসে পড়্লে বল ত?”
—“বল্তে পারি না”
—“তোমার ওপরে কেউ কোন অত্যাচার করেছে?”
—“না, কেউ অত্যাচার করে নি। ভগবান আমাকে শাস্তি দিয়েছেন।”
—“হ্যাঁ, তিনি ত আমাদের সকলেরই শাসন-কর্ত্তা! শাস্তি পেলেও তোমাকে কোনখানে আশ্রয় নিয়ে খাবার-দাবার চেষ্টা করতে হবে ত?”
—“কি আর কর্ব? আমার কাছে সবই সমান।”
সাইমন বিস্মিত হইল। লোকটা বদ্মায়েস বলিয়া তার মনে হইল না, তার কথাবার্ত্তাও ভদ্রলোকের মত; অথচ নিজের পরিচয় সে কিছুই দিতেছে না। সে ভাবিল—কে জানে ওর কি হয়েছে! পরে লোকটিকে বলিল—“আচ্ছা, তা হলে আমার সঙ্গে আমার বাড়ীতেই এসো, আর কিছু হোক্ বা না হোক্ খানিকক্ষণ থেকে শরীরটাকে একটু গরম-সরম করে নেবে।”
সাইমন বাড়ীর দিকে চলিল, লোকটিও সঙ্গে সঙ্গে চলিল। তখন খুব বাতাস বহিতেছিল, সাইমনের খুব শীত করিতে লাগিল; বিশেষতঃ তার মদের নেশা তখন প্রায় ছুটিয়া যাওয়ায় শীতটা সে ভাল করিয়াই টের পাইতে লাগিল। তার স্ত্রীর জামাটি গায়ে চাপিয়া ধরিয়া চলিতে চলিতে সে ভাবিতে লাগিল—‘এই ত ভেড়ার চামড়ার কথা বল! চামড়ার খোঁজেই গিয়েছিলুম ত, কিন্তু সারাদিনের পর এখন বাড়ী ফিরে যাচ্ছি, গায়ে একটা কোট পর্য্যন্ত নেই। তার উপরে একটা উলঙ্গকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে চলেছি। এতে ম্যাট্রিয়ানা খুসী হবে খুব।’
স্ত্রীর কথা মনে করিয়া সে একটু বিমর্ষ হইল, কিন্তু লোকটির দিকে আবার চাহিতেই মনে পড়িল, সে কি রকম করুণদৃষ্টিতে তার দিকে চোখ তুলিয়াছিল। অমনি তার মনের সমস্ত দুঃখ দূর হইল, মন আনন্দে নাচিয়া। উঠিল!
—৩—
সাইমনের স্ত্রী সেদিন সব কাজ খুব সকাল সকাল সারিয়া রাখিয়াছিল। কাঠ কাটিয়া, জল আনিয়া, ছেলে-মেয়েদের খাওয়াইয়া এবং নিজের খাওয়াটাও শেষ করিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিল— কখন রুটি তৈরী কর্বে―সেই দিন, না তার পর দিন? তখনও একখানা বড় রুটি অবশিষ্ট ছিল।
সে ভাবিল, ‘যদি সাইমন সহরে আজকে খেয়ে থাকে আর এখন এসে যদি খুব কম খায় তা হ’লে এ রুটিখানায় আরও একদিন চল্বে।’
রুটিখানা হাতে লইয়া বারে বারে ওজনটা বুঝিতে লাগিল ও ভাবিল, ‘আজ আর রুটি তৈরী কর্ব না। যে ময়দা রয়েছে তাতে আর একখানা রুটি হতে পাবে, কিন্তু কোনও রকমে এখানা দিয়ে শুক্রবার পর্য্যন্ত চালাতে হবে।’
ম্যাট্রিয়ানা রুটিখানা রাখিয়া দিল এবং স্বামীর সার্টটা রিপু করিবার জন্য টেবিলে গিয়া বসিল। তার স্বামী কি রকম করিয়া গরম জামার জন্য চামড়া কিনিতেছে—রিপু করিতে করিতে সে কেবল তাই ভাবিতে লাগিল।
‘আমার স্বামী নেহাৎ ভাল মানুষ—বড্ড সাদাসিদে। দোকানদার আবার তাকে না ঠকায়। একটা ছোট ছেলে পর্য্যন্ত তাকে ঠকাতে পারে; সে কিন্তু কাউকে ঠকায় না। আটটা টাকা ত আর কম নয়! ও দামে ত খুব ভাল জামা পাওয়া উচিত। পাকা চামড়া না হ’লেও বেশ দস্তুরমত গরম জামা পাওয়া যাবে। গেল বার শীতকালে গরম জামার অভাবে কি ভয়ানক কষ্টটাই পেয়েছিলুম। না যেতে পার্তুম নদীর ঘাটে’ না পার্তুম বাইরে যেতে। আমাদের যা কাপড়-জামা ছিল, তা আমার স্বামীই গায়ে দিয়ে বেরুত; আমি আর কিছু গায়ে দিতে পেতুম না। যাক্গে; আজকে অবিশ্যি খুব ভোরে সে বেরোয় নি, তবুও এখন তার ফিরে আসার সময় হ’য়েছে। দেরী দেখে ভয় হচ্ছে হয়ত মদের ভাটিতে গিয়ে ঢুকেছে।’
ম্যাট্রিয়ানা এই কথাগুলি ভাবিতেছে, ঠিক সেই সময়েই দরজায় পায়ের শব্দ শুনিতে পাইল। কে যেন ভিতরে ঢুকিল। হাতের সুচটি একটা ফোঁড় দিয়া রাখিয়া সে বাহিরে দেখিতে গেল। গিয়া দেখিল দুইজন লোক; সাইমন আর তার সঙ্গে আর একজন—তার পায়ে বুট, মাথায় টুপী নাই!
সাইমনের মুখ থেকে মদের গন্ধ বাহির হইতেছে—ম্যাট্রিয়ানা তৎক্ষণাৎ বুঝিতে পারিল। সে ভাবিল, ‘এই ত ও মদ খাচ্ছিল।’ তারপর সে যখন দেখিল যে সাইমনের গায়ে কোট নাই—কেবল তারই জ্যাকেটটি গায়ে, হাতে কোন জিনিষ নাই, চুপ করিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, তখনই তার মনটা একেবারে যেন দমিয়া যাইতে লাগিল। সে ভাবিল, ‘এই একটা একেবারে অপদার্থ লোককে সঙ্গে ক’রে নিয়ে এসেছে; এতক্ষণ একে নিয়ে ভাটিতে গিয়ে মদ খেয়ে সব টাকা উড়িয়ে দিয়েছে।’
ম্যাট্রিয়ানা চুপ করিয়া একপাশে সরিয়া গেল। তারা ভিতরে ঢুকিল। সে তাদের পিছনে পিছনে গেল। দেখিল, যুবকটি সম্পূর্ণ অপরিচিত, অত্যন্ত শীর্ণকায়, তার স্বামীর জামাটি তারই গায়ে চাপানো। কিন্তু কোটের নীচে কোন সার্ট নাই, মাথায় টুপী নাই। লোকটি ভিতরে ঢুকিয়া নড়িল-চড়িলও না, আর কোন দিকে চোখ তুলিয়া চাহিলও না।
ম্যাট্রিয়ানা তাকে দেখিয়া ভাবিল, ‘এ নিশ্চয়ই ভারি বদ্লোক, তাই ভয়ে জড়সড় হ’য়েছে।’
ভ্রু দুইটি কুঁচকাইয়া ম্যাট্রিয়ানা উনুনের পাশে গিয়া দাঁড়াইল এবং তারা কি করে দেখিবার প্রতীক্ষায় রহিল।
সাইমন টুপীটি খুলিয়া বেঞ্চির উপর বসিল, যেন কোনখানে কিছুই হয় নাই। তারপর বলিল—“এসো ম্যাট্রিয়ানা, খাবারদাবার যদি কিছু তৈরী থাকে ত আমাদের দাও।”
ম্যাট্রিয়ানা খানিকক্ষণ কি বিড়্বিড়্ করিয়া বকিল, একটুও নড়িল না, যেমন দাঁড়াইয়াছিল ঠিক তেমনই রহিল; একবার সাইমনের দিকে—একবার সেই লোকটির দিকে চাহিয়া সে মাথাটি নড়াইল।
সাইমন বুঝিল যে তার স্ত্রী রাগে গর্গর্ করিতেছে; কিন্তু সে সেটাকে উড়াইয়া দিবারই চেষ্টা করিল। সে যেন কিছুই বুঝিতে পারে নাই, এই ভাব দেখাইয়া সেই লোকটির হাত ধরিয়া বলিল— “ব’সো ভাই, ব’সো। কিছু খাওয়া যাক্।”
লোকটি বেঞ্চির উপর বসিল।
সাইমন তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল—“আমাদের জন্যে কি কিছুই রান্না কর নি? কেমন?”
ম্যাট্রিয়ানার রাগ এবার ফুটিয়া বাহির হইল; সে বলিল—“হ্যা, রেঁধেছি বটে, কিন্তু তোমার জন্যে নয়। আমার মনে হচ্ছে মদ খেয়ে তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি সব একদম লোপ পেয়ে গেছে। তুমি গিয়েছিলে একটা ভেড়ার চামড়ার কোট কিন্তে, তা’ত আনই নি, তোমার গায়ে যে কোটটা ছিল তাও নেই, তা ছাড়া কোত্থেকে তুমি এই একটা ন্যাংটা হতভাগাকে নিয়ে এসেছো। তোমাদের মত মাতালের জন্য আমি রাঁধিও নি, খাবারও রাখি নি।”
—“যথেষ্ট হ’য়েছে, ম্যাট্রিয়ানা। দেখ, না বুঝে-শুঝে যা তা বক্ছ কিসের জন্যে? আগে জিজ্ঞেস কর লোকটা কি রকমের, কোত্থেকে এসেছে।”
—“আচ্ছা যাও। টাকা নিয়ে কি কর্লে আমায় বল?”
সাইমন জ্যাকেটের পকেট খুঁজিয়া তিন টাকার নোটখানি বাহির করিয়া বলিল—“এই নাও তোমার টাকা। ত্রিকোন্ক টাকা দেয় নি, শীগগিরই দেবে ব’লেছে।”
ম্যাট্রিয়ানার আরও রাগ হইল। চামড়া ত সাইমন আনেই নাই, তার উপরে সেই একমাত্র সম্বল কোটটি একটা ন্যাংটা লক্ষ্মীছাড়ার গায়ে চাপাইয়া দিয়া, তাকে আবার বাড়ীতে লইয়া আসিয়াছে।
টেবিলের উপর হইতে একটান দিয়া নোটখানা লইয়া বলিল— “তোমাদের খাবার আমি কিছুই রাখিনি। কতকগুলো ন্যাংটা মাতালকে খাওয়াতে আমরা প্রস্তুত নই।”
—“থাম, থাম ম্যাট্রিয়ানা। খুব হ’য়েছে, যথেষ্ট হ’য়েছে! আমাদের কথাটা আগে শোনই।”
—“ওঃ একটা বোকা মাতালের কাছে ত ভারি জ্ঞানের কথাই শুন্ব! তোমার মত একটা মাতালকে যে প্রথমে বিয়ে করতে বাজী হইনি, সে ঠিকই ক’রেছিলুম। মা আমায় যে কাপড়-চোপড় দিয়েছিল তা তুমিই মদ খেয়ে খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছ, তার পরে যা কিছু ছিল তাও কোট কিন্তে গিয়ে উড়িয়ে দিয়ে এলে।”
সে যে মাত্র তিন-চারি আনা খরচ করিয়াছে ইহাই সাইমন স্ত্রীকে বুঝাইতে চেষ্টা করিল। কি করিয়া সেই লোকটির সঙ্গে তার দেখা হইয়াছে, কেনই বা তাকে লইয়া আসিয়াছে ইত্যাদি বলিতে চেষ্টা করিল; কিন্তু কার কথা কে শোনে? ম্যাট্রিয়ানা তার একটি কথাও শুনিল না, কিছুই বলিতে দিল না; এক কথায় সে দশ কথা শুনাইয়া দিল। দশ বছর পূর্ব্বে কবে কি হইয়াছে তা এই উপলক্ষে টানিয়া আনিয়া বকুনি আরম্ভ করিল।
খানিকক্ষণ বকিয়া বকিয়া ম্যাট্রিয়ানা রাগের চোটে সাইমনের দিকে ছুটিয়া গিয়া তার হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল—“দাও আমার জ্যাকেট। আমার পুঁজিপাটা শুধু এইটেই। এইটি আমার কাছ থেকে নিয়ে তোমার ত গায়ে দিতেই হবে। এখুনি খুলে দে লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা, গোল্লায় যা, চুলোয় যা!”
সাইমন ব্যাপার দেখিয়া তাড়াতাড়ি জ্যাকেটটা খুলিতে গেল, কিন্তু হাতের ভিতরের দিকটা উল্টাইয়া গেল। ম্যাট্রিয়ানা হাতটা ধরিয়া টান মারিতেই সেলাইটা একদম খুলিয়া গেল। জ্যাকেটটা কাঁধে ফেলিয়া, রাগে গর্গর্ করিতে করিতে সে দরজার দিকে ছুটিয়া গেল। বাহির হইয়া যাওয়াই ছিল তার ইচ্ছা, কিন্তু কি করিবে কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া দরজাতেই থামিল।
—৪—
থামিয়া গিয়া ম্যাট্রিয়ানা বলিল—“আচ্ছা, ও যদি ভাল মানুষই হবে, তবে ন্যাংটা হ’য়ে র’য়েছে কেন? ওর গায়ে ত একটা সার্টও নেই। ভাল হ’লে তুমিই বল্তে পার্তে ও-বেটার সঙ্গে কোথায় তোমার দেখা-শুনা পরিচয় হ’ল।”
সাইমন বলিল—“তোমায় ত সেই কথাই বল্ছিলুম, শুন্লে কই? আমি যখন মন্দিরের কাছে এলুম, দেখ্লুম, লোকটির কাপড় নেই, শীতে একেবারে আড়ষ্ট হ’য়ে ব’সে আছে। বাইরে কাপড়চোপড় না নিয়ে কি আজকাল এই শীতে মানুষ থাক্তে পারে? ভগবান্ই আমাকে ওর কাছে পাঠিয়েছেন, আমি না গেলে ও নিশ্চয়ই মারা যেত। এ রকম অবস্থায় আমি কি কর্তে পারি বল? ওর কি হয়েছে, কি ঘটেছে কেমন ক’রে জান্ব? কাজেই আমি ওকে একটা জামা পরিয়ে দিলুম, আর সঙ্গে নিয়ে এলুম। না জেনেশুনেই অত রাগ ক’রো না, ম্যাট্রিয়ানা! রাগ করাটাও একটা পাপ। মনে রেখো আমাদের সকলকেই একদিন মর্তে হবে।”
এবারও ম্যাট্রিয়ানা রাগিয়া কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু লোকটির দিকে চাহিয়াই থামিয়া গেল।
লোকটি হাত দুইখানি ভাঁজিয়া হাঁটুর উপরে রাখিয়া বেঞ্চির একপাশে একেবারে নিস্পন্দ ভাবে বসিয়াছিল; মাথাটা তার বুকের উপর নুইয়া পড়িয়াছে। চোখ দুইটি বুজিয়া আছে, আর যেন যন্ত্রণায় কপাল কুঞ্চিত হইয়া গিয়াছে।
ম্যাটিয়ানা একেবারে নির্ব্বাক্!
সাইমন বলিল—“ম্যাট্রিয়ানা, তোমার কি ভগবানে ভক্তি নেই?”
সাইমনের এই কয়েকটি কথা শুনিয়া, সেই লোকটির দিকে একবার চাহিয়াই ম্যাট্রিয়ানার মন একেবারে নরম হইয়া পড়িল। দরজা থেকে সে ফিরিয়া আসিল এবং উনুনের পাশে গিয়া খাবার যোগাড় করিতে লাগিল। টেবিলের উপরে একটি পেয়ালা রাখিয়া খানিকটা সরিষার ঝোল ঢালিয়া দিয়া শেষ রুটিখানা এবং ছুরি, কাঁটাচামচ সব সাজাইয়া দিল। তারপর সে বলিল—“খাবে ত খাও না।”
সাইমন লোকটিকে টানিয়া টেবিলের কাছে আনিয়া বলিল—“এখানে ব’সো ভাই।”
সাইমন রুটিখানা কাটিয়া টুক্রা টুক্রা করিয়া ঝোলের ভিতর ফেলিল, তারপর খাইতে আরম্ভ করিল।
ম্যাট্রিয়ানা টেবিলের এক কোণে গালে হাত দিয়া বসিয়া লোকটির দিকে চাহিয়া রহিল।
দেখিতে দেখিতে তার মনটা আরও নরম হইল, লোকটার প্রতি তখন তার খুব দয়া হইল, তার জন্য মনে খুব কষ্ট হইল। লোকটির মুখ অমনি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, তার কপালটা আর কুঞ্চিত রহিল না। চোখ তুলিয়া ম্যাট্রিয়ানার দিকে চাহিয়া সে একটু হাসিল।
তাদের খাওয়া শেষ হইয়া গেলে ম্যাট্রিয়ানা সরঞ্জাম সব সরাইয়া ফেলিল এবং লোকটিকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল,
—“তোমার বাড়ী?”
—“আমার বাড়ী এ অঞ্চলে নয়।”
—“তুমি রাস্তায় এসে পড়্লে কি ক’রে?”
—“বল্তে পারিনে।
—“কেউ তোমার ওপর অত্যাচার করেছে?”
—“ভগবান্ আমায় শাস্তি দিয়েছেন।”
—“তুমি কি সেখানেও ন্যাংটো পড়েছিলে?”
—“হ্যাঁ, ন্যাংটো ত ছিলুমই, শীতে জ’মে যাচ্ছিলুম। আমাকে দেখে সাইমনের খুব দয়া হ’ল। নিজের কোটটি খুলে সে আমায় পরিয়ে সঙ্গে ক’রে এখানে নিয়ে এসেছে। তুমিও আমায় বেশ খাওয়ালে, যত্ন কর্লে, যথেষ্ট দয়া দেখালে। ভগবান্ তোমাকে এর পুরস্কার দেবেন।”
ম্যাট্রিয়ানা উঠিল, তার স্বামীর যে সার্টটা সেলাই করিতেছিল জানালা থেকে সেইটা আনিয়া লোকটিকে দিল। তারপর একটা পা-জামাও আনিয়া দিয়া তাকে বলিল—“দেখ্তে পাচ্ছি তোমার একটা সার্টও নেই, এইটেই প’রে নাও, তারপর হয় মাচার ওপরে, না হয় উনুনের ওপরে শোও গে।”
লোকটি কোটটি খুলিয়া সার্টটা গায়ে দিল এবং মাচার ওপরে গিয়া শুইল।
ম্যাট্রিয়ানা কোটটি লইয়া, বাতিটা নিবাইয়া দিয়া, তার স্বামী যেখানে শুইয়াছিল সেখানে গিয়া শুইল।
কোটের কাপড়টা টানিয়া গায়ে জড়াইয়া ম্যাট্রিয়ানা শুইল, কিন্তু ঘুমাইতে পারিল না; লোকটির কথা সে আর ভুলিতে পারিল না।
যখন তার মনে হইল যে শেষ রুটিখানা সে খাইয়াছে—তার পরের দিনের জন্য আর খাবার কিছুই নাই এবং সার্টটা ও পাজামাটাও তাকে সে দিয়াছে, তখন তার মনে ভারি কষ্ট হইল। কিন্তু লোকটি তার দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়াছিল—এই কথা মনে পড়িবামাত্রই তার প্রাণ আনন্দে নাচিয়া উঠিল।
অনেকক্ষণ ধরিয়া ম্যাট্রিয়ানার ঘুম হইল না। দেখিল যে সাইমনও জাগিয়া আছে। কোটের কাপড়টা টানিয়া তার গায়েও খানিকটা দিয়া সে ডাকিল—“সাইমন!”
—“কি?”
—“তোমরা ত শেষ রুটিখানা পর্য্যন্ত খেয়েছ, কালকে খাবার কিছুই নেই, জানিনে কি কর্ব। এখন আমাদের পাড়ার সেই মার্থার কাছে যদি ধার পাই তবেই ত।”
—“দেখ যদি বেঁচে থাকি খাবার কিছু-না-কিছু ঠিক মিল্বেই।”
ম্যাট্রিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তারপর বলিল—“ওকে বেশ ভাল লোক ব’লেই মনে হয়, কিন্তু নিজের পরিচয় দিচ্ছে না কেন?”
—“তা না দেবার যথেষ্ট কারণ আছে বোধ হয়।”
—“সাইমন!”
—“কি?”
—“দেখ আমরাই কেবল দিচ্ছি, কিন্তু কৈ আমাদের কেউ কিছু দেয় না ত?”
কি বলিবে সাইমন কিছুই স্থির করিতে পারিল না। সে কেবল বলিল—“চুপ কর, ঘুমোও।”
সাইমন পাশ ফিরিয়া শুইল।
—৫—
ভোরে সাইমন উঠিল। ছেলে-মেয়েরা তখনও উঠে নাই। তার স্ত্রী প্রতিবেশীর কাছে রুটি ধার করিতে গেল। সেই লোকটি সার্টি আর পা-জামা পরিয়া উপরের দিকে চাহিয়া একলা বেঞ্চির একপাশে বসিয়াছিল। পূর্ব্বদিনের চেয়ে তার মুখটা একটু বেশী উজ্জ্বল দেখাইতেছিল।
সাইমন তাকে বলিল—“দেখ ভাই, এই পেটটা চায় খাবার, আর শরীরটা চায় কাপড়। থাক্তে হ’লেই কাজ কর্তে হয়। তুমি কি কাজ জান?”
—“আমি কোন কাজই জানিনে।”
সাইমন বিস্মিত হইল, বলিল—“মানুষ যদি শিখ্তে চায় তা হ’লে যে কোনও কাজ শিখতে পারে।”
—“মানুষ খাটে, আমিও খাট্ব।”
—“তোমার নামটি কি?”
—“মাইকেল।”
—“আচ্ছা। মাইকেল, তুমি নিজের পরিচয় দিতে চাও আর নাই চাও সেটা তোমার ইচ্ছে। সে তুমি যেমন বোঝ কর; কিন্তু তোমাকে খেটে খেতে হবে। আমার কথামত যদি কাজ কর, আমার এখানেই থাক্তে পাবে, খেতে পাবে।”
—“ভগবান্ তোমার মঙ্গল করুন। আমি কাজ শিখ্ব। কি কর্তে হবে আমায় দেখিয়ে দাও।”
সাইমন খানিকটা সূতা লইয়া পায়ের বুড়ো আঙুলে জড়াইয়া পাকাইতে আরম্ভ করিল, বলিল—“দেখ্লে এ খুব সোজা।”
মাইকেল সাইমনের কাজটি খুব ভাল করিয়া দেখিয়া কৌশলটি শিখিয়া ফেলিল এবং খানিকটা সূতা পায়ের বুড়ো আঙুলে জড়াইয়া পাকাইল।
তারপর সূতোয় কি করিয়া মোম লাগাইতে হয় সাইমন তাকে দেখাইল। মাইকেল তাও শিখিল। তারপর কি রকম করিয়া চামড়া মুড়িয়া দিতে হয়, সেলাই করিতে হয় দেখাইল, মাইকেল ইহাও চট করিয়া শিখিয়া ফেলিল।
সাইমন তাকে যা একবার দেখাইয়া দিত তাই সে শিখিয়া ফেলিত। তিন দিন পরে সে এমনি ভাবে কাজ করিতে লাগিল যেন সে চিরকালই মুচীর কাজ করিয়া আসিয়াছে। সে আর বিশ্রাম চাহিত না, কেবলই কাজ করিত। খাওয়া-দাওয়া তার খুবই কম ছিল। কাজ শেষ হইয়া গেলেই উর্দ্ধমুখ হইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত। রাস্তায় বড় একটা বাহির হইত না। দরকার না হইলে কথাও কহিত না; হাসি-ঠাট্টাও ছিল না। যে রাত্রিতে ম্যাট্রিয়ান তাকে প্রথম খাবার দিয়াছিল, কেবল তখনই সে একবার হাসিয়াছিল, তা ছাড়া আর কখনও তাকে হাসিতে তার দেখো নাই।
—৬—
এক দিন দুই দিন করিয়া, এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ করিয়া ঠিক একটি বৎসর আসিল। সাইমনের সঙ্গে মাইকেল কাজ-কর্ম্ম করিয়া সেইখানেই রহিয়া গেল। চারিদিকে তার খুব সুখ্যাতি হইল। সকল লোকেই বলিত, “সাইমনের কারিকর মাইকেলের মত পরিষ্কার মজবুত বুট জুতো আর কেউ তৈরী কর্তে পারে না।” জেলার সকল জায়গা থেকে লোক আসিয়া সাইমনকে দিয়া বুট তৈয়ারী করাইয়া লইয়া যাইত। কাজে কাজেই সাইমনের অবস্থা খুব সচ্ছল হইয়া উঠিল।
এক দিন শীতকালে সাইমন এবং মাইকেল বসিয়া কাজ করিতেছিল, এমন সময়ে বরফের উপর দিয়া যে গাড়ী চলে—সেই রকম একটা গাড়ী ঘণ্টা বাজাইতে বাজাইতে তাদের দিকে আসিল। জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিল যে, তাদের দরজার সাম্নেই গাড়ীটা থামিল। একজন ভাল পোষাক পরা চাকর কোচবাক্স হইতে লাফাইয়া পড়িয়া গাড়ীর দরজা খুলিয়া দিল। একজন সুসজ্জিত ভদ্রলোক গাড়ী থেকে নামিয়া বরাবর সাইমনের ঘরের দিকে চলিলেন। ম্যাট্রিয়ানা উঠিয়া গিয়া তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া দিল। ভদ্রলোকটি হেঁট হইয়া ঘরে ঢুকিলেন; যখন সোজা হইয়া দাড়াইলেন তাঁর মাথাটা প্রায় ছাদে ঠেকিল; আর তিনি ঘরের ঠিক একটা দিক্ জুড়িয়া দাঁড়াইলেন।
সাইমন দাঁড়াইয়া তাঁকে সেলাম ঠুকিল এবং খুব আশ্চর্য্য হইয়া ভদ্রলোকটির দিকে তাকাইয়া রহিল। সে এপর্য্যন্ত তার মত লোক আর দেখে নাই। সে নিজে অত্যন্ত রোগা, মাইকেলও তথৈবচ, আর ম্যাট্রিয়ানা এত রোগা যে, তার হাড়গোড় সব বাহির হইয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এই ভদ্রলোকটিকে দেখিয়া মনে হইল যেন তিনি এই পৃথিবীর লোক নন, মুখখানা লাল টক্টকে যণ্ডামার্ক চেহারা, ষাঁড়ের মত কাঁধ, আর সমস্তটি শরীর যেন লোহা দিয়া গড়া।
ভদ্রলোকটি ফোঁস্ ফোঁস্ করিয়া খানিকটা বাতাস মুখ দিয়া ছাড়িয়া বেঞ্চির উপর বসিলেন এবং বলিলেন—“তোমাদের ভেতরে মনিব কে?”
একটু সাম্নে আসিয়া সাইমন বলিল—“আমি হুজুর।”
ভদ্রলোকটি চীৎকার করিয়া তাঁর চাকরকে ডাকিয়া বলিলেন,—“হাঁরে ভেদ্কা, চামড়াটা নিয়ে আয়।”
চাকরটা ছুটিয়া গিয়া পুঁটুলী লইয়া আসিল।
ভদ্রলোকটি পুঁটুলীটি টেবিলের উপর রাখিয়া বলিলেন—“এইটে খোল্।”
চাকরটা পুঁটুলীটি খুলিল।
চামড়াখানা দেখাইয়া দিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন—“এই মুচী, চামড়াখানা দেখেছিস্?”
—“হ্যাঁ হুজুর।”
—“এটা কি রকম চামড়া জানিস্?”
সাইমন হাত দিয়া নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া বলিল—“এটা বেশ চামড়া।”
—“বেশ ত নিশ্চয়ই; তুই এ রকম চামড়া কখনও দেখিস্ নি। এটা জার্ম্মেনী থেকে এসেছে। এর দাম কুড়ি টাকা, বুঝেছিস্।”
সাইমন একটু ভয় খাইয়া বলিল—“আমি এ চামড়া কোথায় দেখ্ব হুজুব?”
“তা ত বটেই! এই চামড়া দিয়ে আমার জন্যে একজোড়া ভাল বুট তৈরী করতে পার্বি?”
—“পার্ব, হুজুর।”
ভদ্রলোকটি অত্যন্ত রুক্ষভাবে বলিলেন—“পার ত কেবল মুখে, সত্যিই কি পার্বে? মনে রেখো কার জন্যে জুতো তৈরী কর্বে, আর এ চামড়াটা কি রকম! আমাকে এমন বুট তৈরী ক’রে দিতে হবে যেন সেটা ঠিক একটি বছর টেঁকে, অথচ না ছেঁড়ে, বেঢপ্ না হয়, বুঝলে? যদি পার চামড়া নাও, কাট। যদি না পার, সাফ ব’লে দাও। তোমায় সাবধান ক’রে দিচ্ছি—যদি এক বছরের ভেতরে সেলাই খুলে যায় বা বেঢপ্ হয়, তোমায় জেলে দেওয়াব। আর যদি না ছোঁড়ে, ঢপ্টি বেশ ঠিক থাকে, একটা বছর বেশ ক’রে পর্তে পারি, তোমায় দশ টাকা মজুরী দেবো।”
সাইমনের ভারি ভয় হইল। কি বলিবে কিছুই স্থির করিতে পারিল না। মাইকেলের দিকে একবার চাহিয়া, কনুই দিয়া তাকে ঠেলা মারিয়া ইসারায় জিজ্ঞাসা করিল—‘কাজটা নেব কি?’
মাইকেল মাথা নাড়িয়া জানাইল—‘হাঁ, নাও।’
তার কথামতই সাইমন কাজটি নিতে রাজী হইল।
চাকরকে ডাকিয়া ভদ্রলোকটি তাঁর বাঁ-পাখানি বাড়াইয়া দিয়া জুতা খুলিতে বলিলেন।
তারপর সাইমনকে বলিলেন—“মাপ নাও।”
পাছে ভদ্রলোকের মোজা ময়লা হইয়া যায়, তাই সাইমন হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া হাত দুইখানি পরিষ্কার করিয়া সতের ইঞ্চি লম্বা একখানা মাপের কাগজ লইয়া বসিল। তারপর মাপ নিতে আরম্ভ করিল। পায়ের পাতা, পাতার ঘের ইত্যাদি মাপিল; কিন্তু পায়ের ডিমটা মাপিতে গিয়া দেখিল কাগজে কুলায় না। পায়ের ডিমটা ঠিক কড়িকাঠের মত মোটা।
—“দেখ্বে যেন পায়ে খুব কসা না হয়?”
সাইমন আর একখানি কাগজ জুড়িল।
ঘরের মধ্যে যারা ছিল তাদের দিকে একবার চাহিয়া ভদ্রলোকটি মোজার মধ্যেই পায়ের আঙ্গুলিগুলি একবার ফাঁক করিয়া মেলিলেন। মাইকেলকে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও কে হে?”
—“ও আমারই কারিকর। ওই বুট্ সেলাই কর্বে।”
ভদ্রলোকটি বলিলেন—“সাবধান, মনে রেখো যেন একটি বছর বেশ টেঁকে।”
সাইমন মাইকেলের মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু দেখিল সে ভদ্রলোকটির মুখের পানে তাকাইয়া নাই। সে তাকাইয়া ছিল তাঁর পেছনে কোণের দিকে,―যেন সেখানে কাহাকেও দেখিতেছিল। খানিকক্ষণ চাহিয়া চাহিয়া মাইকেল হঠাৎ হাসিল এবং তার মুখখানি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
ভদ্রলোকটি গর্জ্জন করিয়া উঠিলেন—“দাঁতগুলো বের ক’রে কি দেখ্ছিস্ রে উল্লুক? দেখ্না এদিকে; বুট যেন ঠিক সময়ে তৈরী পাই?”
মাইকেল বলিল—“ঠিক সময়েই তৈরী হবে!”
“মনে রেখো যেন”―বলিয়া ভদ্রলোকটি বুট্ পরিয়া কোটটা গায়ে চড়াইতে চড়াইতে দরজার কাছে গেলেন; কিন্তু দরজায় নুইতে ভুলিয়া গেলেন। তাঁর মাথাটা ঠুকিয়া গেল।
গালাগালি দিতে দিতে তিনি মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন; তারপর গাড়ীতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন।
সাইমন হাঁফ ছাড়িয়া বলিল―“সাবাস্ পুরুষ, সরদলটা উল্টে গিয়েছিল আর কি, বাপ! ওর কিন্তু একটুও লাগ্ল না। মুগুর মার্লেও ওর কিছু হবে না।”
ম্যাট্রিয়ানা বলিল—“হবে না কেন? যেমন খায়-দায় তেমনি জোয়ান হবে ত? যম ওস্বয়ং ওর মত পাহাড় ছুঁতে ভয় খান!”
—৭—
সাইমন মাইকেলকে বলিল—“আচ্ছা, কাজ ত হাতে নেওয়া গেল; কিন্তু দেখো যেন এ নিয়ে আবার একটা ফ্যাসাদে না পড়ি। একে ত চামড়াটা খুব ভাল আর খুব দামী, তার ওপর ভদ্রলোকটির মেজাজটাও ভারি গরম। ভুল-টুল যেন আবার না হয়। যাক্, এসো দেখি, তোমার চোখ খুব সই, আর তোমার হাতও খুব পাকা, মাপটা একবার ভাল ক’রে দেখে নাও দেখি; বেশ সই ক’রে চামড়াটা কেটো। আমি না হয় ওপরের সেলাইটা কর্ব এখন।”
সাইমনের কথামত মাইকেল চামড়াটা টেবিলের উপর রাখিল এবং দুই ভাঁজ করিয়া একখানা ছুরি দিয়া কাটিতে লাগিল।
ম্যাট্রিয়ানা আসিয়া তার কাটা বেশ নজর করিয়া দেখিতে লাগিল। কাটিবার ধরণ দেখিয়া সে আশ্চর্য্য হইল। সে চিরকাল বুট তৈয়ার করা দেখিয়া আসিয়াছে; কিন্তু এ কাটা ত সে রকম নয়। বুটের মত করিয়া না কাটিয়া মাইকেল চামড়াখানা ঠিক গোল করিয়া কাটিল।
কিছু বলিতে তার ইচ্ছা হইল; কিন্তু ভাবিল, ‘ভদ্রলোকদের বুট কি রকম ক’রে তৈরী কর্তে হয় তা ত আর দেখিনি, তাই হয়ত বুঝ্তে পারছিনে। মাইকেল আমার চাইতে ভাল জানে নিশ্চয়ই; সুতরাং আমি কোন কথাই কইব না।’
চামড়া কাটিয়া মাইকেল একগাছা সূতা লইয়া বুটের মত দুই পাশ ধরিয়া সেলাই না করিয়া নরম চটী জুতার মত এক পাশ ধরিয়া সেলাই করিতে লাগিল।
মাট্রিয়ানা আবার আশ্চর্য্য হইল; কিন্তু পূর্ব্বেরই মত এবারেও সে চুপ করিয়াই রহিল। দুপুরবেলা পর্য্যন্ত মাইকেল একমনে সেলাই করিতে লাগিল। সাইমনও কাজ করিতেছিল। খাইবার জন্য সে উঠিল; মাইকেলের দিকে চাহিয়া দেখিল যে, ভদ্রলোকটির সেই দামী চামড়া দিয়া সে এক জোড়া চটী জুতা তৈয়ার করিয়া বসিয়াছে।
“অ্যাঁ, কি সর্ব্বনাশ!” বলিয়া সাইমন একেবারে আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল; ভাবিল, ‘এ কি রকম? মাইকেল ত আমার সঙ্গে এক বছর ধ’রে কাজ ক’রে এসেছে, কিন্তু একদিনও ত একটা কাজ ও ভুল করে নি! আর আজ একি সর্ব্বনাশ কর্লে! ভদ্রলোক ফর্মাস দিয়ে গেলেন খুব সরু চামড়ার বেড় ক’রে দিয়ে মাথা উঁচু বুট্ তৈরী করতে আর মাইকেল একটা সোল্ দিয়ে নরম চটী জুতো তৈরী ক’রে চামড়াখানা একেবারে নষ্ট ক’রে ফেল্লে! তাঁকে কি বল্ব? এ রকম চামড়া ত কিন্তে পাওয়া যাবে না! কি উপায়?’
সে মাইকেলকে বলিল—“তুমি কি কর্লে ভাই! অ্যাঁ? তুমি যে আমার সর্ব্বনাশ ক’রেছ! জান ত ভদ্রলোক ফরমাস্ দিয়ে গেলেন বুট্ জুতোর, আর তুমি এ কি কর্লে? দেখ ত কি ক’রেছ?”
মাইকেলের ওপরে গালাগালি আরম্ভ করিতে না-করিতেই দরজার লোহার কড়াটা বাজিয়া উঠিল; কে যেন দরজায় আঘাত করিল। জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া তারা দেখিল একজন লোক ঘোড়ায় চাপিয়া আসিয়া ঘোড়াটা বাঁধিতেছে। তারা দরজা খুলিয়া দিল। সেই ভদ্রলোকটির সঙ্গে যে চাকরটি আসিয়াছিল সে-ই ভিতরে ঢুকিল।
সে বলিল—“নমস্কার!”
সাইমন বলিল,—“নমস্কার। কি চাই?”
—“সেই বুটের দরুণ মাঠাক্রুণ পাঠিয়ে দিলেন।”
—“কি রকম?”
—“আমার মনিবের আর তাতে দরকার নেই। তিনি মারা গেছেন!”
—“সে কি?”
—“তোমাদের এখান থেকে বেরিয়ে তিনি বাড়ী অবধিও যেতে পারেন নি, গাড়ীতেই মারা গেছেন। যখন বাড়ী পৌঁছলুম চাকরেরা তাঁকে নামাতে এলো, তিনি একটা বস্তার মত গড়িয়ে পড়ে গেলেন। গাড়ীতেই ম’রে র’য়েছিলেন; এতই শক্ত হ’য়েছিলেন যে, তাঁকে নামানোই দায় হ’য়েছিল; কাজেই বুট জুতোর আর কোনই দরকার নেই। মাঠাক্রুণ আমাকে ব’লে পাঠালেন, ‘বল গে সেই মুচীকে, যে ভদ্রলোক বুট্ জুতোর জন্যে ফর্মাস দিয়ে চামড়া দিয়ে এসেছিলেন তাঁর আর জুতোর দরকার নেই; তিনি মারা গেছেন; তাঁর শবের জন্য যেন খুব শীগ্গির শীগ্গির একজোড়া নরম চটী জুতো তৈরী করে দেয়। যতক্ষণ না তৈরী হয় ততক্ষণ সেখানে থাকবে, ব’সে থেকে একেবারে তৈরী করিয়ে নিয়ে আসবে।’ সেই জন্যেই আমি তোমার এখানে ছুটে এসেছি।”
বাকী চামড়াটুকু মাইকেল ভাল করিয়া মুড়িল। সে যে চটী জোড়া তৈয়ারী করিয়াছিল, তার দুই পাটী দুই হাতে লইয়া ঠুকিল, কাপড় দিয়া মুছিল। তারপর চামড়ার মোড়কটা এবং চটী জোড়া চাকরের হাতে দিল।
চাকরটি জুতা হাতে লইয়া বলিল—“নমস্কার, তবে আসি।’
—৮—
মাইকেল একে একে ছয় বৎসর সাইমনের সঙ্গে কাটাইল, কিন্তু এতদিনেও তার কোন পরিবর্ত্তন হয় নাই; পূর্ব্বেও যেমন ছিল তখনও তেমনি। কোনখানেই সে যাইত না, বিশেষ দরকার না হইলে কথা কহিত না, হাসিত না। ছয়টি বৎসরের মধ্যে সে মাত্র দুইটিবার হাসিয়াছে—একবার যখন ম্যাট্রিয়ানা তাকে রাত্রিতে খাবার দিয়াছিল, আর একবার সেই ভদ্রলোকটি যখন ঘরে আসিয়া বসিয়া জুতার ফরমাস দিয়াছিলেন। সাইমন এখন তার ওপরে ভারি খুসী; পাছে সে অন্য কোনও জায়গায় চলিয়া যায় এই ছিল তার ভয়।
একদিন তারা সকলেই বাড়ীতে ছিল। ম্যাট্রিয়ানা উনুনের ওপরে লোহার ভাঁড়গুলি গরম করিতেছিল, ছেলে-মেয়েগুলি বেঞ্চির ধারে ধারে দৌড়াদৌড়ি করিতেছিল, আর মাঝে মাঝে জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতেছিল। একটা জানালায় বসিয়া সাইমন সেলাই করিতেছিল, আর একটা জানালায় বসিয়া মাইকেল এক জোড়া জুতায় গোড়ালি লাগাইতেছিল।
একটি ছেলে দৌড়াইয়া আসিয়াই মাইকেলের ঘাড়ের উপর ভর দিয়া জানালা দিয়া রাস্তা দেখিতে লাগিল। সে বলিল—“দেখেছ মাইকেল খুড়ো, ঐ ছোট্ট ছোট্ট মেয়ে নিয়ে একজন মেয়েমানুষ আমাদের এই দিকেই আছে বোধ হয়। একটি মেয়ে আবার খোঁড়া।”
ছেলেটি বলিবামাত্রই মাইকেল হাতের কাজ ফেলিয়া মুখ ফিরাইয়া জানালা দিয়া দেখিতে লাগিল।
সাইমন একটু আশ্চর্য্য হইল। মাইকেল কখনও রাস্তার দিকে চাহিয়া থাকিত না, কিন্তু এখন সে জানালার ওপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া কি যেন একমনে দেখিতেছিল। সাইমনও চাহিয়া দেখিল। দেখিল যে সত্যসত্যই খুব ভাল কাপড়-চোপড়-পরা একজন স্ত্রীলোক দুইটি মেয়েকে সঙ্গে করিয়া তার ঘরের দিকেই আসিতেছে। মেয়ে দুইটি দেখিতে ঠিক একই রকম, কেবল একজনের বাঁ-পাখানি ভাঙ্গা বলিয়া সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া চলিতেছে।
স্ত্রীলোকটি ভিতরে যাইবার পথে তিনটি খিল পাইলেন; খিল খুলিয়া দরজা খুলিলেন এবং ভিতরে ঢুকিলেন। মেয়ে দুটিও ঢুকিল।
—“নমস্কার।”
সাইমন বলিল—“আসুন, বসুন দয়া ক’রে। আপনার কি চাই?”
স্ত্রীলোকটি টেবিলের পাশে গিয়া বসিলেন। ঘরের ভিতরে সব অপরিচিত লোকদের দেখিয়া মেয়ে দুইটি ভয়ে জড়সড় হইয়া তাঁর হাঁটু চাপিয়া বসিল।
তিনি বলিলেন—“এই মেয়ে দু’টির জন্য খুব ভাল দু’জোড়া জুতো তৈরী ক’রে দিতে হবে।”
—“তা খুব হবে এখন। এদের পায়ের মত এত ছোট জুতো কোন দিন তৈরী করি নি, না কর্লেও কর্তে আমরা পার্ব, তা যে রকমই ফর্মাস দিন না কেন? আমার কারিকরটি খুব পাকা।”
সাইমন মাইকেলের মুখের দিকে একবার তাকাইল, দেখিল সে কাজ ফেলিয়া রাখিয়া মেয়ে দুইটির দিকে চাহিয়া আছে। সাইমন একটু বিস্মিত হইল। মাইকেল এ রকম কখনও করে না। মেয়ে দুইটি খুবই সুন্দর বটে, বেশ সুস্থ শরীর, গাল দুইটি যেন ঠিক গোলাপ ফুলের মত, চোখ দুইটি বেশ কালো, ঝক্ঝকে তক্তকে কাপড়-চোপড়-পরা, হাতে সুন্দর সুন্দর রুমাল। মেয়ে দুইটি দেখিবার মত মেয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু মাইকেল তাদের দিকে ওরকম ভাবে কেন তাকাইয়া রহিয়াছে, সাইমন একদম বুঝিতেই পারিল না। তার চাউনি দেখিয়া বোধ হইতেছিল, যেন সে পূর্ব্বেও তাহাদিগকে চিনিত।
সাইমন একেবারে হতবুদ্ধি হইয়া গেল; হেঁট হইয়া স্ত্রীলোকটির সঙ্গে দর-দস্তুর করিতে লাগিল। দাম ঠিক করিয়া সাইমন মেয়েদের পায়ের মাপ নিতে বসিল। স্ত্রীলোকটি খোঁড়া মেয়েটিকে তুলিয়া নিজের কোলে বসাইয়া বলিলেন—“এই মেয়েটির দুটো মাপ নাও। খোঁড়া পায়ের জন্যে এক পাটী কর। আর দু’জনের পা-ই সমান। ওরা যমজ।”
সাইমন মাপ নিল। খোঁড়া মেয়েটিকে দেখিয়া বলিল—“মেয়েটি খোঁড়া হ’ল কি ক’রে? আহা কি সুন্দর মেয়ে! ও কি জন্মাবধিই খোঁড়া?”
—“না, ওর মা মুচ্ড়ে দিয়েছেন।”
এমন সময় ম্যাট্রিয়ানা আসিয়া যোগ দিল। এই স্ত্রীলোকটিই বা কে, আর মেয়ে দুইটিই বা কারা কিছুই বুঝিতে না পারিয়া সে আশ্চর্য্য হইয়া গেল। তাই সে জিজ্ঞাসা করিল—“মেয়ে দুটি তা’ হ’লে আপনার নয়?”
—“না, মা, আমি এদের মাও নই, বা এদের কোন আত্মীয়ও নই। ওরা ছিল আমার একেবারেই অপরিচিত; কিন্তু আমিই ওদের মানুষ ক’রেছি।”
—“কি আশ্চর্য্য, এরা তোমার মেয়ে নয় অথচ তুমি এদের এত ভালবাস!”
—“ভাল না বেসে পারব কেমন ক’রে? আমি নিজের মাই খাইয়ে ওদের বাঁচিয়েছি। আমার নিজের একটি ছেলে ছিল, কিন্তু তাকে যমের মুখে তুলে দিয়েছি। ওদের আমি যত ভালবাসি তাকেও আমি তত ভালবাসি নি।”
—“তবে এ মেয়ে দু’টি কার?”
—৯—
স্ত্রীলোকটি তাদের সব বলিতে লাগিলেন—“প্রায় ছ’বছর পূর্ব্বে এক হপ্তার ভেতর এদের বাপ-মা দু’জনেই মারা গেছেন, মঙ্গলবার হ’ল এদের বাপের কবর, আর শুক্রবারে মায়ের কবর। বাপ মরার তিন দিন পরেই মেয়ে দু’টির জন্ম হ’ল; আর এদের জন্ম হওয়ার পর এক দিনও এদের মা বেঁচে রইলেন না। আমার স্বামী আর আমি তখন এদের গ্রামে চাষ-বাস করতুম; আমরা ছিলুম তাদের পাড়াপড়শী, একেবারে পাশা-পাশি বাড়ী। এদের বাপ ছিল কাঠুরে, বনে বনে কাঠ কেটে বেড়াত, তার কেউ ছিল না। একদিন বনের ভিতর সে একটা গাছ কাট্ছিল; সেই গাছটা তারই ওপরে হঠাৎ পড়্ল—এমনি ভাবে পড়্ল যে তার বুক ভেঙে গেল, নাড়ীভুঁড়িগুলো সব পেট ফেটে বেরিয়ে গেল। তাকে বাড়ীতে আন্তে না আনতেই সে মারা গেল। ঠিক সেই হপ্তাতেই এই মেয়ে দুটো জন্মাল। আহা, তার কেউ ছিল না। বাড়ীতে এ অবস্থায় তার খোঁজ-খবর কে আর নেবে? মেয়ে দুটো প্রসব হ’তে হ’তেই সে বেচারা মারা গেল।
“পরের দিন ভোর বেলাতে আমি তাকে দেখ্তে যাই; যেই ঘরে ঢুক্লুম, দেখ্লুম বেচারা ম’রে শক্ত আর ঠাণ্ডা হ’য়ে পড়ে আছে। মরণকালে যন্ত্রণায় ছট্ফট ক’রে এসে এই মেয়েটার ওপর প’ড়েছিল, তাতেই ওর পা-টা জখম্ হ’য়েছে। গ্রামের লোকজন ছিল খুবই ভাল। তারা এলো। শবদেহটা ভাল ক’রে ধুইয়ে ঠিক ক’রে শুইয়ে, শব ব’য়ে নেবার জন্যে একটা সিন্ধুক তৈরী ক’রে তাকে কবর দিলে। মেয়ে দুটো একেবারে নিরাশ্রয় হ’য়ে পড়্ল। তাদের কি হ’বে? সেখানে যে কয়েকজন স্ত্রীলোক ছিল তার ভেতরে কেবল আমার কোলেই একটি শিশু ছিল। আমার সেই আট মাসের শিশুটিকেই আমি মানুষ কর্ছিলুম। কিছুদিনের জন্য আমিই এদের ভার নিলুম। তারপর কৃষকেরা মিলে তাদের কি উপায় করবে তাই কেবল ভাবতে লাগ্ল, কিছু স্থির কর্তে না পেরে শেষে আমায় বল্লে—‘মেরী, এখন মেয়ে দু’টি তোমারই কাছে থাক্, তুমিই ওদের মানুষ কর, তার পরে কি ব্যবস্থা করা যেতে পারে দেখ্ব।’ আমিই ওদের ভার নিলুম। প্রথম প্রথম বুকের দুধ দিয়ে ভাল মেয়েটিকে পাল্তে লাগ্লুম। মনে কর্লুম খোঁড়া মেয়েটা বাঁচ্বে না, তাই ওকে আর বিশেষ খাওয়াতুম না। পরে ভেবে দেখ্লুম এই অনাথা নিরাপরাধ শিশুটিই বা কষ্ট পায় কেন? ওকে দেখে আমার বড্ড দুঃখ হ’ত, ওকে বেশ ক’রে খাওয়াতে লাগ্লুম। আমার নিজের ছেলে—আর এই দুই জন—এই তিনটিকেই বুকের দুধ খাওয়াতুম।
“তখন আমার বয়সও ছিল অল্প, শরীরেও খুব জোর ছিল, খুব ভাল ভাল খাবার খেতুম, তাই পার্তুম; আর ভগবানের দয়ায় আমার বুকে মাঝে মাঝে দুধও উপ্চে পড়্ত। কখনো কখনো দু’টিতে একসঙ্গেই দুধ খেত, আর একটি তখন প’ড়ে থাক্ত। একটির খুব খাওয়া হ’লে সেটিকে নামিয়ে দিয়ে তৃতীয়টিকে খাওয়াতে আরম্ভ কর্তুম। ভগবানের ইচ্ছায় এরা রক্ষা পেল, বড় হ’য়ে উঠল; কিন্তু আমার ছেলেটি দু’বছর না হ’তেই শেষ হ’ল। আমাদের অবস্থা খুব ভাল হ’ল বটে, কিন্তু আমার আর ছেলেমেয়ে কিছুই হ’ল না। ধানের কলের ব্যাপারীর কাজেই আমার স্বামী এখন র’য়েছেন। মাইনেটাও পাওয়া যাচ্ছে ভাল; আমাদের অবস্থাও আজকাল বেশ সচ্ছল। আমার নিজের ত ছেলেমেয়ে কিছু নেইই, আর যদি এই মেয়ে দুটো না থাকত, তা হ’লে কি রকম ফাঁকা ফাঁকা ঠেক্ত। বল দেখি এদের আমি না ভালবেসে পারি কি ক’রে? এরাই আমার জীবনের আনন্দ।”
বলিতে বলিতে তাঁর গাল বাহিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল পড়িতে লাগিল। খোঁড়া মেয়েটিকে এক হাত দিয়া কোলের কাছে টানিয়া আনিয়া চাপিয়া ধরিয়া আর এক হাত দিয়া তিনি চোখের জল মুছিলেন।
ম্যাট্রিয়ানা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিল—“লোকে কথায় বলে—সেটা কিন্তু খুবই সত্যি যে, ‘বাপ-মা না থাক্লেও মানুষ বাঁচতে পারে, কিন্তু ভগবান্ না থাক্লে মানুষ বাঁচতে পারে না।”
তারা এইরূপে কথাবার্ত্তা বলিতেছিল, ঠিক সেই সময়েই গ্রীষ্মকালের বিদ্যুৎ চম্কানোর মত মাইকেল যে কোণে বসিয়া ছিল, সেখান থেকে একটা আলোয় হঠাৎ ঘরখানি আলোকিত হইয়া উঠিল। তার দিকে তারা সকলেই চাহিয়া দেখিল, সে জোড় হাত করিয়া বসিয়া আছে, আর ওপরের দিকে চাহিয়া অল্প অল্প হাসিতেছে।
—১০—
স্ত্রীলোকটি মেয়ে দুইটিকে লইয়া চলিয়া গেলেন। মাইকেল বেঞ্চি ছাড়িয়া উঠিল, হাতের কাজ ফেলিয়া রাখিল, কোমরে কাপড়ের ওপরে জড়ানো গামছাটা খুলিয়া ফেলিল। তারপর সাইমন এবং তার স্ত্রীর সামনে নত হইয়া বলিল-“তোমাদের কাছে বিদায় নিচ্ছি। ভগবান্ আমায় ক্ষমা ক’রেছেন, তোমাদের কাছেও যদি কোনও অপরাধ ক’রে থাকি তার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছি।”
অমনি তারা দেখিল যে মাইকেলের মুখ থেকে একটা জ্যোতি বাহির হইতেছে। সাইমন উঠিয়া মাইকেলের কাছে খুব নত হইয়া বলিল―“মাইকেল, আমি দেখ্ছি তুমি ত সামান্য লোক নও। তোমায় আমি রাখ্তেও পাচ্ছিনে, কিছু জিজ্ঞেস কর্তেও পাচ্ছিনে। আচ্ছা, তুমি আমায় এই কথাগুলি বল তো—
“তোমাকে দেখ্তে পেয়ে যখন বাড়ীতে নিয়ে এলুম তুমি অত বিষণ্ণ ছিলে কেন? আর আমার স্ত্রী যখন তোমায় খাবার দিলে তুমি একটু হাস্লেই বা কেন, তোমার মুখখানাই বা অত উজ্জ্বল হ’য়ে উঠ্ল কেন? তারপর সেই ভদ্রলোকটি যখন বুট্ তৈরীর ফর্মাস দিতে এলেন, তুমি আবার হাস্লে, তোমার মুখখানা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠ্ল কেন? তা’ ছাড়া এই স্ত্রীলোকটি যখন ছোট মেয়ে দু’টি নিয়ে এলো তুমি ফের হাস্লে, মুখখানা ঠিক দিনের আলোর মত উজ্জ্বল হ’ল, কেন বলত দেখি? বল মাইকেল, তোমার মুখখানি ওরকম উজ্জ্বলই বা হয় কেন, আর তুমি ঐ তিনবার হাস্লেই বা কিসের জন্যে?”
ইকেল বলিল—“ভগবান্ আমায় শাস্তি দিয়েছেন বলেই আমার মুখ থেকে জ্যোতি বেরুচ্ছে; কিন্তু তিনি আমায় ক্ষমা ক’রেছেন। তিনি আমায় তিনটি মহাসত্য শিখ্তে পাঠিয়েছিলেন, আমি তা শিখেছি, তাই তিনবার হেসেছিলুম। তোমার স্ত্রী আমার ওপরে যখন খুব দয়া দেখালে তখন শিখেছিলুম একটা সত্য, তাই তখন প্রথমবার হেসেছিলুম। দ্বিতীয় সত্যটি শিখেছিলুম যখন সেই ধনী ভদ্রলোকটি বুটের ফরমাস দিতে এসেছিলেন, তাই তখন দ্বিতীয় বার হেসেছিলুম। আর তৃতীয় সত্য শিখ্লুম যখন এই মেয়ে দুটোকে দেখ্লুম, এই হ’ল আমার শেষ সত্য, তাই তৃতীয়বার হাস্লুম।”
সাইমন বলিল—“যাতে আমিও শিখ্তে পারি সেই জন্যেই বল তো মাইকেল, ভগবান্ তোমায় শাস্তি দিয়েছিলেন কিসের জন্যে! আর তিনটি সত্য কি কি?”
মাইকেল বলিল—“ভগবান্ শাস্তি দিয়েছিলেন তাঁর আদেশ অগ্রাহ্য ক’রেছিলুম ব’লে। আমি ছিলুম স্বর্গে তাঁর দেবদূত, আমি তাঁকে অমান্য ক’রেছিলুম। তিনি আমাকে একটি স্ত্রীলোকের আত্মা আনতে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু উড়ে এসে দেখলুম যে, একটি স্ত্রীলোক দু’টি যমজ সন্তান প্রসব ক’রে একলা পড়ে আছে। শিশু দু’টি মার কাছে প’ড়ে ছিল বটে, কিন্তু তার এমন শক্তি ছিল না যে, তাদের টেনে কোলে তুলে নেয়! সে আমায় দেখে বুঝ্তে পারলে যে তারই আত্মা নেবার জন্যে ভগবান্ আমায় পাঠিয়েছেন, তাই সে খুব কেঁদে বল্লে—‘দেবদূত, গাছ ভেঙ্গে প’ড়ে আমার স্বামী মারা গেছে, তাকে এইমাত্র কবর দেওয়া হ’য়েছে! আমার বোন নেই, ভাই নেই, বাপ নেই, মা নেই, জগতে আমার বল্তে কেউ নেই, এই অনাথা শিশু দু’টির কি হবে? এদের কে যত্ন নেবে? কে এদের মানুষ কর্বে? আমার আত্মা নিও না। মরবার আগে ওদের একটু বড় ক’রে তুলতে দাও। ওরা মানুষ হোক, তারপর আত্মাটি নিও। বাপ বা মা না থাক্লে সে সন্তান বাঁচে না।’ আমি তার কথা শুন্লুম।
“একটি শিশুকে তার বুকের ওপরে, আর একটিকে কোলে তুলে দিয়ে স্বর্গে উড়ে গেলুম। গিয়ে ভগবান্কে বল্লুম—আমি সে নারীর আত্মাটি আন্তে পার্লুম না, তার দু’টি যমজ মেয়ে হ’য়েছে, তার স্বামী গাছ চাপা প’ড়ে মারা গেছে, তার আত্মা যাতে না নেওয়া হয় তাই সে খুব কাকুতি-মিনতি ক’রে প্রার্থনা কর্ছে। সে বলে―‘মরবার আগে আমাকে ওদের মানুষ কর্তে দাও, বড় করে তুল্তে দাও, মা না থাক্লে যে সন্তান বাঁচে না।’ কাজেই তার আত্মা আমি আন্তে পারলুম না।
“ভগবান্ বললেন ‘যাও, মায়ের আত্মা নিয়ে এসো, আর তিনটি সত্য শিখে এসো—‘মানুষের ভিতর কি আছে, মানুষকে কি দেওয়া হয় না, এবং ‘মানুষ বাঁচে কিসে।’ তোমার এই তিনটি সত্য শেখা হ’য়ে গেলে তবে স্বর্গে ফিরে এসো।
“কাজে কাজেই আমি আবার উড়ে পৃথিবীতে এলুম এবং সেই নারীর আত্মাটি নিলুম। শিশু দু’টি মায়ের বুক থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল, তার দেহখানি গড়িয়ে একটি শিশুর উপরে গিয়ে পড়ল, তাতেই তার পা-টা মুচ্ড়ে গেল। ভগবানের কাছে তার আত্মাটি নিয়ে যা’ব বলে সেই গ্রামের ওপরে উঠ্লুম, কিন্তু ঝড়ের ঝাপ্টা খেয়ে আমার ডানা দুটো খ’সে পড়ে গেল; তার আত্মা নিজেই ভগবানের কাছে উঠে গেল, আর আমি সেই পথের পাশে মাটিতে পড়ে গেলুম।
—১১—
সাইমন এবং ম্যাট্রিয়ানা এবারে স্পষ্ট বুঝিতে পারিল তাদের সঙ্গে এই কয়েক বৎসর যে বাস করিয়াছে, তারা যাকে খাইতে ও পরিতে দিয়াছে সে কে। তারা একটু তটস্থও হইল, আনন্দও পাইল। তারা কাঁদিয়া ফেলিল।
দেবদূত বলিলেন—“একলা আমি উলঙ্গ অবস্থায় মাঠের মাঝখানে প’ড়েছিলুম। নবদেহ ধারণ করবার পূর্ব্বে মানুষের অভাব, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, শীত, গ্রীষ্ম আমি কিছুই জান্তুম না। আমি ক্ষুধার্ত্ত হয়েছিলুম, শীতে জমে যাচ্ছিলুম, কি কর্ব কিছুই ভেবে ঠিক কর্তে পারছিলুম না, এমন সময় মাঠের কাছেই দেখতে পেলুম ভগবানের একটি মন্দির। সেখানে গেলুম, মনে কর্লুম আশ্রয় পাব; কিন্তু তালা বন্ধ ছিল ব’লে ভেতরে ঢুক্তে পার্লুম না। কাজেই অন্ততঃ ঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মন্দিরটার পেছনে গিয়ে বস্লুম। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমার যেমন পেয়েছিল ক্ষিদে, তেমনি শীতে আবার হাড় পর্য্যন্ত কন্কন্ করছিল, খুব যন্ত্রণাও বোধ কর্ছিলুম। এমন সময়ে হঠাৎ একটা লোক আস্ছে শুন্তে পেলুম। তার হাতে ছিল একজোড়া বুট্, আর সে নিজে নিজেই কত কি বক্ছিল। নরদেহ ধারণ করার পর সেই প্রথম আমি মানুষের মুখ দেখ্লুম। তার মুখখানা খুব ভয়ঙ্কর ব’লে ঠেক্ল, আমি মুখ ফিরিয়ে নিলুম।
“সে নিজে নিজে বল্ছিল—শীতকালে কি রকম ক’রে গা ঢাক্বে, স্ত্রী-পুত্ত্রদের কি ক’রে খাওয়াবে, তাই সে কেবল ভাব্ছিল। আমি ভাব্লুম, ‘আমি এই ঠাণ্ডায় আর ক্ষিদেয় মর মর হয়েছি, আর এই লোকটা কি ক’রে নিজে শীত কাটাবে, স্ত্রী কি গায়ে দেবে, তারা কি খাবে কেবল এই ভাব্ছে, ও আমাকে সাহায্য কর্তে পার্বে না।'
“সে আমায় দেখে কট্মটিয়ে তাকালে, তার মুখখানা আরও ভয়ঙ্কর হ’য়ে উঠ্ল, আমার পাশ কাটিয়ে সে চ’লে গেল। আমি নিরাশ হলুম। কিন্তু হঠাৎ সে ফিরে আসছে শুনতে পেলুম। আমি তার মুখের পানে তাকালুম; কিন্তু সে যে পূর্ব্বের লোক তা চিনতে পারলুম না। পূর্ব্বে তার মুখে দেখেছিলুম মরণের ছায়া, এখন সে জীবনময়। তার ভেতরে আমি ভগবানের সত্তা অনুভব কর্লুম। সে আমার কাছে এলো, আমার শরীর তার নিজের জামা দিয়ে ঢাক্লে এবং আমাকে সঙ্গে ক’রে তার বাড়ীতে নিয়ে গেল।
“আমি ভেতরে ঢুক্লুম। একজন স্ত্রীলোক আমাদের সাম্নে এসে কথা কইতে লাগ্ল। লোকটার প্রথমে যে ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখেছিলুম, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি দেখ্লুম এই স্ত্রীলোকের। তার মুখে যেন মরণের ছায়া একেবাবে জাজ্বল্যমান দেখলুম। তার চারদিকে মৃত্যুর এমন একটা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে প’ড়েছিল যে, আমি নিঃশ্বাস টান্তে পার্লুম না, আমার যেন দম আট্কে এলো। তার ইচ্ছা হ’য়েছিল যে, আমাকে সেই ভীষণ ঠাণ্ডায় বাইরে বার ক’রে দেয়; কিন্তু আমি জানতুম যে, আমাকে বার ক’রে দিলেই মারা যা’ব।
“হঠাৎ ভগবানের নামে তার স্বামী তাকে বললে, আর সেই মুহূর্ত্তেই তার ভাবান্তর হ’ল। তারপর সে যখন আমায় খাবার দিয়ে আমার দিকে তাকালে আমিও তার দিকে চেয়ে দেখলুম যে, তার মুখে সেই মৃত্যুর কালোছায়া আর নাই সে তখন জীবনময়। তার ভিতরেও আমি ভগবানের অস্তিত্ব অনুভব কর্লুম।
“ভগবান্ কোন্ সত্যটি আমায় শিখ্তে পাঠিয়েছেন তখন আমার মনে পড়্ল—‘মানুষের ভিতরে কি আছে।’ আমি বুঝ্তে পার্লুম, মানুষের হৃদয়ে আছে ভালবাসা। ভগবান্ আমায় যা দেবেন ব’লেছিলেন তা দিতে আরম্ভ করেছেন ব’লে আমার মনটা খুব খুসী হ’ল। সেই আমি প্রথমবার হাসলুম। তখনও আমার শেখা বাকী ছিল। তখনও আমি জানতুম না ‘মানুষকে কি দেওয়া হয় না’ ‘আর মানুষ বাঁচে কিসে’?
“তোমার সঙ্গে থেকে প্রায় এক বছর কাটিয়েছি, তারপর এক ভদ্রলোক এলেন বুটের ফর্মাস দিতে। তার এমনি বুট হওয়া চাই যে, পুরো একটি বছর টিঁক্বে, সেলাই খুল্বে না, গড়ন নষ্ট হবে না আমি তার দিকে চাইলুম, দেখ্লুম তার পেছনে আমারই সহচর দাঁড়িয়ে, সে মরণের দেবদূত; তাকে আমি ছাড়া আর কেউ দেখ্তে পায় নি। আমি তাকে চিন্তুম, তাই এটা বেশ বুঝেছিলুম যে, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই ধনীর আত্মাটি সে গ্রহণ কর্বে। কাজেই মনে মনে ভাব্লুম, ‘লোকটি জোগাড় কর্ছে এক বছরের, কিন্তু জানে না যে সন্ধ্যার পূর্ব্বেই সে মর্বে।’ তখন আমার মনে পড়্ল ভগবানের দ্বিতীয় বাক্য ‘মানুষকে কি দেওয়া হয় না।’
“মানুষের ভিতরে কি আছে পূর্ব্বেই শিখেছিলুম, আর এখন শিখ্লুম ‘মানুষকে কি দেওয়া হয় না’। মানুষকে আপন প্রয়োজন পর্য্যন্ত জান্তে দেওয়া হয় না—এইটিই শিখলুম ব’লে দ্বিতীয়বার হাস্লুম। আমার সহচরটিকে দেখে ভারী খুসী হ’য়েছিলুম, আর ভগবান্ আমাকে দ্বিতীয় সত্যটি শিখ্তে দিলেন ব’লে আমার খুব আনন্দ হ’য়েছিল।
“কিন্তু তখনও আমার সব শেখা হয় নি। ‘মানুষ বাঁচে কিসে’, তা শিখ্তে পারি নি। শেষ রহস্যটি ভগবান্ কবে আমার কাছে প্রকাশ করবেন আমি সে প্রতীক্ষায় রইলুম। ছ’ বছর পরে স্ত্রীলোকটির সঙ্গে যমজ মেয়ে দুটো এলো। দেখেই তাদের চিন্তে পার্লুম, কি ক’রে তারা বাঁচ্ল তা শুন্লুম। তাদের কাহিনী শুনে ভাবলুম—‘আহা! এদের মা কত মিনতি ক’রে এই মেয়ে দুটোর জন্যে আমায় ব’লেছিল ‘বাপ-মা না থাক্লে সন্তান যে বাঁচে না!’ আমি তার কথা বিশ্বাস ক’রেছিলুম। কিন্তু বাপ-মা না থাক্লেও সন্তান বাঁচ্তে পারে দেখ্ছি। এক অজানা অচেনা স্ত্রীলোক লালন-পালন ক’রে এদের মানুষ ক’রে তুলেছে। স্ত্রীলোক যখন সেই পরের মেয়ে দু’টিকে আপনার সন্তানের মত ভালবেসে, তাদের কোলে টেনে নিয়ে চেপে ধরে যখন কেঁদে ফেললে, তারই মাঝে তখন আমি ভগবানের জীবন্ত ছবি দেখ্তে পেলুম। তখন বুঝতে পারলুম ‘মানুষ বাঁচে কিসে’। শেষ রহস্যটি ভগবান্ আমার কাছে প্রকাশ কর্লেন; তখনই জান্লুম তিনি আমায় ক্ষমা ক’রেছেন, “তাই তৃতীয়বার হাস্লুম।”
—১২—
তখনই দেবদূতের দেহখানি নগ্ন হইল, আর এমনি আলোকিত হইল যে, তাঁর দিকে আর চাহিতে পারা গেল না। তাঁর গলার স্বর ক্রমশঃ চড়িয়া যাইতে লাগিল, মনে হইল যেন স্বর স্বর্গ হইতে নামিয়া আসিতেছিল। দেবদূত বলিয়া যাইতে লাগিলেন—
“আমি শিখ্লুম মানুষ তার নিজের চেষ্টায় বাঁচে না, ভালবাসা আছে ব’লেই সে বাঁচে। ভালবাসাই জীবন।
“মা জান্ত না তার সন্তানদের বেঁচে থাক্তে হ’লে কিসের প্রয়োজন, কিংবা সেই ধনীটিও জান্ত না তার নিজের কি প্রয়োজন। কেহই জানে না—বোঝে না যে, তার জীবনের সন্ধ্যায় আঁধার যখন ঘনিয়ে আসবে, তখন আরাম কর্বার জন্যে বুটেরই দরকার, না তার শবদেহের জন্যে চটী জুতারই প্রয়োজন।
“মানুষের দেহ ধারণ ক’রে যে আমি বেঁচেছিলুম, সে আমার নিজের চেষ্টায় নয়; একজন পথিকের প্রাণে ভালবাসা ছিল, সে আর তার স্ত্রী আমাকে দয়া দেখিয়েছিল, ভালবেসেছিল ব’লেই আমি বেঁচেছিলুম। ঐ যে বাপ-মরা মা-মরা মেয়ে দুটো বেঁচেছিল, তা তাদের মায়ের চেষ্টায় নয়, এক অজানা স্ত্রীলোকের ভালবাসা ও করুণাই ওদের রক্ষা ক’রেছিল। আর এই জগতের সব লোকই যে বেঁচে আছে, তা তাদের নিজের মঙ্গলচিন্তা কিম্বা মঙ্গল-চেষ্টার ফলে নয়—মানুষের অন্তরে একের প্রতি অন্যের ভালবাসা আছে ব’লেই তারা বেঁচে থাকে।
“আগে জান্তুম ভগবান্ মানুষকে জীবন দিয়েছেন, আর জীবনটাকে চালাবার জন্য দিয়েছেন আকাঙ্ক্ষা। এখন বুঝ্তে পার্লুম, তিনি তার চাইতেও অনেক বেশী দিয়েছেন।
“ভগবানের ইচ্ছা নয় যে, একজন মানুষ আর একজনকে ছেড়ে পৃথক্ পৃথক্ হ’য়ে বাস করে; তাই তারা প্রত্যেকে নিজের জন্যে কিসের প্রয়োজন বোধ করে, তা তিনি প্রকাশ করেন না। তাঁর ইচ্ছা তারা একত্র বাস করে, তাই সকলের জন্যে যার প্রয়োজন সেইটিই তিনি প্রত্যেকের কাছে প্রকাশ করেন।
“এবার আমি বুঝ্তে পেরেছি যে, যদিও মানুষে মনে করে যে নিজের চেষ্টার বলেই সে বেঁচে থাকে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে বেঁচে থাকে অন্তরে ভালবাসা আছে ব’লেই—স্নেহ, প্রীতি, মমতা আছে ব’লেই।”
দেবদূত তখন ভগবানের স্তবগান করিতে লাগিলেন। তাঁর গানের স্বরে কুটীরখানি বারে বারে কাঁপিয়া উঠিতে লাগিল। একটু পরেই ছাদ খুলিয়া গেল, আর একটা অগ্নিস্তম্ভ মাটি থেকে উঠিয়া আকাশে গিয়া ঠেকিল। সাইমন, তার স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েগুলি মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। দেবদূতের কাঁধে আবার ডানা বাহির হইল, তিনি শূন্যে উঠিয়া গেলেন।
সাইমনের সংজ্ঞা হইলে উঠিয়া দেখিল যে কুটীরখানি পূর্ব্বেরই মত দাঁড়াইয়া আছে, ভিতরে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া আর কেহ নাই।